নার্সিং হোমের স্বল্পতা এথনিক গোষ্ঠির প্রবীণ অভিবাসীদের জন্য ‘বিপর্যয়’ ডেকে এনেছে
মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে ভর্তি হওয়ার পর বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে বিষন্নতার হার ২৫.১%। অন্যদিকে এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে এই হার মাত্র ৩.৩৫%!
খুরশিদ আলম : যশ সুরেশের বয়বৃদ্ধা মা ইন্দ্রানী নিজ বাড়িতে চালের নুডুল দিয়ে তৈরি খাবার খেতেন। এটি তার জন্মভূমি শ্রীলঙ্কার একটি প্রচলিত খাবার। এছাড়াও তার খাবারের টেবিলে সাজানো থাকতো ইদলি ও দোসার মত দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের প্রধান পদসমূহ।
কিন্তু স্মৃতিভ্রংশের লক্ষণ ধরা পরার পর ২০১৫ সালে স্কারবরোর একটি লং-টার্ম কেয়ার হোমে ভর্তি করা হলে তার সব সুখশান্তি লোপ পেয়ে যায়। ওইসব খাবারের পরিবর্তে ইন্দ্রানীকে দেয়া হতে থাকে সেদ্ধ আলু ও পাস্তার মত খাবার।
তিনি সেগুলো ছুঁয়েও দেখেন না। তখন থেকেই তিনি খাওয়া-দাওয়া প্রায় পুরোপুরি ছেড়ে দেন। যার ফলে ওজন হারান ৪০ পাউন্ড। এছাড়া তিনি কথাবার্তায় শুধুই নিজের মাতৃভাষা তামিল ব্যবহার করতে শুরু করেন।
সুরেশ বলেন, কেয়ার হোমের নার্সরা যদিও খুবই “চমৎকার”, কিন্তু তারা ইন্দ্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। তাকে সাহায্য করার মত কোনও উপায় তাদের কাছে নেই। “তিনি একটি খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।”
সম্প্রতি টরন্টো স্টার পত্রিকায় স্থানীয় একটি লং টার্ম কেয়ার হোমের এরকম একটি চিত্র তুলে ধরা হয় যা ভাবিয়ে তুলে অনেককেই, বিশেষ করে এথনিক গোষ্ঠির প্রবীন অভিবাসীদেরকে।
অলিভিয়া বাউডেন এর তৈরী করা টরন্টো স্টার এর ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় – বিশেষজ্ঞদের মতে, বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদেরকে তাদের সাংস্কৃতিক চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলে তা তাদের ভালো থাকা, না থাকার ওপর বিপুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘকালীন কেয়ার হোমগুলোর জন্য মহামারি-উত্তর যে কোন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে তাতে কেবল নিরাপত্তা, কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো বা ভৌত সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত না করে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের যেন মানুষ হিসাবেই গণ্য করা হয় সেটিও নিশ্চিত করার আহবান জানান। এর মধ্যে ওই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির সত্যিকারের পরিচয়, তার ভাষা, তার সংস্কৃতির সবকিছুই যেন বিবেচনায় নেওয়া হয়।
কোভিড-১৯ অন্টারিওর দীর্ঘকালীন কেয়ার হোমগুলোর জন্য ছিলো ধ্বংসাত্মক। এগুলোতে সেবাযত্নের ঘাটতির বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে এবং ৩,৭০৬ জন নিবাসী ও ১১ জন স্টাফের মৃত্যু ঘটেছে। আর করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকার প্রেক্ষিতে নিবাসীদের পরিবারগুলো এবং এ বিষয়ে সক্রিয়তাবাদীরা এগুলোর ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা পাল্টানোর দাবি তোলেন। টরন্টোর মত ক্রমবর্ধমান হারে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকা একটি শহরের জন্য এই সংস্কারের মধ্যে বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আবহযুক্ত সেবাদানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা দরকার।
টরন্টো স্টারের ঐ প্রতিবেদনে টরন্টো ও আশপাশ এলাকায় অবস্থিত সরকারী ও বেসরকারী লংটার্ম কেয়ার হোমগুলোতে বিভিন্ন এথনিক গ্রুপের বিশেষ করে এশিয় বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়। এবং একইসাথে এথনিক গ্রুপের প্রবীন সদস্যদের জন্য আলাদা সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় পরিমন্ডলের লংটার্ম কেয়ার হোমের প্রয়োজনীয়তার উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
উল্লেখ্য যে, কয়েক বছর আগে এ সংক্রান্ত একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন অন্টারিওর সাবেক মিনিস্টার অব সিনিয়র এ্যাফেয়ার্স দীপিকা ডামেরলা। বৈঠকে অংশগ্রহনের জন্য প্রবাসী কণ্ঠকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমন্ত্রণ পত্রের সাথে দীপিকার একটি কোটেশনও যোগ করা হয়েছে যেখানে বলা হয়, “মানুষ যখন বৃদ্ধ হয় তখন সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া ও নিস্ক্রিয়তা একটি বড় ইস্যু হয়ে দাড়াতে পারে। এই সময়টাতে তারা যদি সক্রিয় থাকতে পারেন, একজন আরেকজনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারেন, নিজ কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন তবে সত্যিকার অর্থেই তাড়া এ থেকে উপকৃত হতে পারেন। বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমির বয়স্ক ব্যক্তিগণ সর্বদাই নিজেদের রীতি-নীতি, দেশাচার, ভাষা, খাদ্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উপভোগ করেন বেশী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্টারিওর ডেমোগ্রাফিক (জনসংখ্যা বিষয়ক) পরিস্থিতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে সে বিষয়টি চিন্তায় রেখে আমাদেরকে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে যাতে করে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য আরো উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তোলা যায়।”
উল্লেখ্য যে, অন্টারিওসহ কানাডায় সিনিয়র সিটিজেনদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিপূর্বে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বর্তমানে কানাডায় ৬ মিলিয়নের বেশী সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। এই তথ্য স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার। সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক ব্যক্তিদের এই সংখ্যা বৃদ্ধি বর্তমানে কানাডার জন্য অর্থনীতির পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও হয়ে দাড়িয়েছে।
কানাডায় এই সিনিয়র সিটিজেন বা বয়স্ক ব্যক্তিদের মাঝে কিছু বাংলাদেশীও রয়েছেন যারা অনেক আগে এ দেশে এসেছেন বা যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের ছেলে-মেয়েদের দ্বারা স্পন্সর হয়ে এসেছেন। আর যারা গত ১৫/২০ বছর আগে এই দেশে এসেছেন তারাও আগামী ১০, ১৫ বা ২০ বছরের মধ্যে সিনিয়র সিটিজেনের খাতায় নাম লিখাবেন। তাদের সংখ্যাটি তখন নেহায়েৎ কম হবে না।
সুতরাং কানাডায় বাঙ্গালীদের মধ্যে যারা ইতিমধ্যেই সিনিয়র সিটিজেনের পর্যায়ে চলে গেছেন বা আগামী এক বা দুই দশকের মধ্যে যারা সিনিয়র সিটিজেন হয়ে যাবেন তাদের নিয়ে চিন্তা করার সময় ইতিমধ্যেই চলে এসেছে।
টরন্টোর গবেষণা ও অলাভজনক নীতিগত সংস্থা ওয়েলেসলি ইন্সটিটিউটের গবেষক সেঅং-গি উম টরন্টো স্টারকে বলেন, “আমার ধারণা, আমাদের দীর্ঘকালীন প্রযত্ন পুনর্গঠনে সংস্কৃতির বিষয়টিই মূল আলোচ্যসূচি ও মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা দরকার। তথ্যপ্রমাণ নিশ্চিত করছে যে, মানুষের স্বাস্থ্য ও সার্বিক কল্যাণে সংস্কৃতি ও ভাষাগত সংশ্লিষ্টতাসম্পন্ন সেবাদানের জোরালো ইতিবাচক ভূমিকা আছে। এটি এমন কোনও বিষয় নয় যেটি থাকলে ভালো। বরং এটি থাকা জরুরী।”
টরন্টো স্টার জানায়, এ বিষয়ে চাহিদাও আছে। টরন্টোর কোনও সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় হোমে সিট পেতে হলে অপেক্ষা করতে হয় গড়ে প্রায় ১৬ মাস। সে তুলনায় সাধারণ সরকারি লংটার্ম কেয়ার হোমে সিট পেতে সাধারণত অপেক্ষায় থাকতে হয় গড়ে মাত্র আট মাস। এটি হলো সর্বশেষ পাওয়া ২০১৭ সালের তথ্য।
আর নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক গ্রুপের মানুষের জন্য সেবাদানকারী হোমে সিট খুঁজতে গেলে অপেক্ষার সময়টা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। নগরীর যে পাঁচটি হোমে সিট পেতে দীর্ঘতম সময় অপেক্ষা করতে হয় সেগুলি হলো চীনা-কানাডীয়দের জন্য নির্দিষ্ট। এগুলোতে সিট পেতে হলে অপেক্ষা করতে হতে পারে মোটামুটি দুই থেকে চার বছর।
ওয়েলেসলি ইন্সটিটিউটের গত শরতে প্রকাশিত এক রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রদেশের দীর্ঘকালীন কেয়ার হোমের মধ্যে যে ২০টিতে সিট পাবার জন্য সবচেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় তার মধ্যে ১২টিই হলো জাতিগত বা ধর্মীয়ভাবে পরিচালিত হোম।
উল্লেখ্য যে, অন্টারিওতে এথনিকবান্ধব বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা একেবারে নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই সরকারী বৃদ্ধাশ্রমের পাশাপাশি কিছু কিছু এথনিক বৃদ্ধাশ্রমও গড়ে উঠেছে অন্টারিওতে। যেমন মূলধারার সরকারী বৃদ্ধাশ্রমের পাশাপাশি চীনারা তৈরী করেছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বৃদ্ধাশ্রম, ইটালিয়ানরাও তৈরী করেছে। তৈরী করেছে আরো কিছু এথনিক সম্প্রাদয় তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বৃদ্ধাশ্রম। এই সব বৃদ্ধাশ্রমে সরকারী বৃদ্ধাশ্রমের মতই সব ব্যবস্থা থাকে। যেমন, প্রত্যেকের জন্য নিজ নিজ ঘর, চব্বিশ ঘন্টা নার্স সেবা, বিনোদনের ব্যবস্থা। আর সবচেয়ে বড় যে সুবিধা এই সব এথনিক বৃদ্ধাশ্রমের তা হলো, এখানে বৃদ্ধদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য অনেক ভাল থাকে মেইনস্ট্রিমের বৃদ্ধাশ্রমের তুলনায়। গবেষণায় দেখা গেছে এই এথনিক বৃদ্ধাশ্রমে যারা থাকেন তারা নিজেদেরকে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন মনে করেন না, শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন, বিষন্নতা বা মনমরা ভাব তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এবং সর্বপোরি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হারও কম এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মধ্যে। কানাডার ওয়েলেসলি ইনস্টিটিউট ইতিপূর্বে এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
মূলত: অন্টারিতে বৃদ্ধদের জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরীর বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধাশ্রমগুলো বিভিন্ন এথনিক ব্যাকগ্রাউনেডর লোকদের জন্য ষোলআনা বৃদ্ধবান্ধব নয়। বৃদ্ধাশ্রম যদি বৃদ্ধবান্ধব না হয় তবে বৃদ্ধদের সমস্যা বরং আরো জটিল আকার ধারণ করে। বৃদ্ধাশ্রমগুলো বৃদ্ধবান্ধব না হওয়ার প্রধান কারণ হলো
ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যবধান।
কানাডায় যারা প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্ট, তাদের অধিকাংশেরই রয়েছে ভাষার সমস্যা। ইংরেজীতে তারা যোগাযোগটা ষোলআনা করে উঠতে পারে না। যোগযোগটা সঠিক ভাবে না হয়ে উঠলে সেবাটাও সঠিক ভাবে পাওয়া যায় না। কারণ যিনি সেবা দিবেন তাকে বুঝতে হবে সেবাগ্রহণকারী কি চাচ্ছেন। আর সেবা যিনি নিবেন তাকেও সঠিকভাবে বুঝাতে হবে সেবাপ্রদানকারীকে যে তিনি কি চাচ্ছেন। ভাষা ছাড়াও রয়েছে সাংস্কৃতিক সমস্যা। সেবা গ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারী যদি দুই সাংস্কৃতিক পটভূমির হন তবে সেক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়।
এ কারণে বৃদ্ধা মায়ের জন্য সুরেশের প্রথম পছন্দ ছিলো দক্ষিণ-এশীয়-কানাডীয়দের জন্য নির্দিষ্ট হোম। কিন্তু তেমন কোনও হোমে সিট পাওয়া যায়নি। কারণ, গ্রেটার টরন্টো এলাকায় দক্ষিণ-এশীয়-কানাডীয়দের জন্য হোম আছে গুটিকয়েক মাত্র।
সুরেশ টরন্টো স্টারকে বলেন, “যেখানে তারা যোগাযোগ করতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না এবং সংশ্লিষ্ট লোকেরা তাদের সাংস্কৃতিক স্পর্শকাতরতা বুঝতে পারবে না এমন অপরিচিত পরিবেশে বয়োজ্যেষ্ঠদের পাঠানো মানে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার সামিল।”
কিন্তু সুরেশের পক্ষে ইন্দ্রানীকে ঘরে ফিরিয়ে নেয়াও সম্ভব ছিলো না। তার স্মৃতি এতটাই লোপ পেয়েছিলো যাতে আশঙ্কা ছিলো বাড়ির দরজা দিয়ে তিনি বেরিয়ে যেতে পারেন এবং বেপাত্তা হয়ে যেতে পারেন। যদিও ইন্দ্রানি খর্বাকৃতির এবং ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের অধিকারী, কিন্তু তিনি প্রায়শ প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়তেন।
ইন্দ্রানী তার স্বামীর সঙ্গে ১৯৮৪ সালে কানাডায় আসেন। সে সময় সুরেশের বয়স ১৭ বছর। এছাড়াও তাদের আরও তিনটি সন্তান ছিলো।
কানাডায় কয়েক দশক ধরে বসবাসকারী সুরেশ বলেন, এটি খুবই দুঃখের যে, মায়ের শেষ দিনগুলি এমন এক লং-টার্ম কেয়ার হোমে কাটাতে হয়েছিল যেখানে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার মা ২০১৯ সারে মারা যান।
সুরেশের ভাষায়, “এটি একটি বিপর্যয়… আর সেজন্যেই সংস্কৃতি-ভিত্তিক কেয়ার হোম জরুরী।”
উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে নার্সিং হোম আইনের পরিবর্তে চালু করা অন্টারিওর লং-টার্ম কেয়ার হোম সম্পর্কিত আইনে বলা হয়েছে, হোমের প্রত্যেক নিবাসীর অধিকার থাকবে সেবা লাভের পরিকল্পনা করার। সে পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে পারে চিকিৎসা, নার্সিং, ব্যক্তিগত সহায়তা, খাবার, বিনোদন, সামাজিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চাহিদা।
তাছাড়া প্রদেশের প্রতিটি লাইসেন্স পাওয়া হোম নতুন কোনও বয়োজ্যেষ্ঠ নিবাসীকে ভর্তির সময় জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে তার অগ্রাধিকারের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিটি অঞ্চলের স্থানীয় স্বাস্থ্য সংহতি নেটওয়ার্ক থেকে আসা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়কারীদেরকে অবশ্যই এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। লং-টার্ম কেয়ার সম্পর্কিত মন্ত্রণালয় এক ই-মেল বিবৃতিতে স্টারকে এসব তথ্য জানায়।
মন্ত্রণালয় আরো জানায়, অন্টারিওতে লং-টার্ম কেয়ারের জন্য অপেক্ষায় আছেন প্রায় ৩৯ হাজার মানুষ। আর প্রদেশটি ৩০ হাজার বেড সৃষ্টির বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেইসঙ্গে কেয়ার হোমগুলোর পরিষেবায় “সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সেবার” যেন প্রতিফলন ঘটে সেটি নিশ্চিত করতে “অতিরিক্ত বিবেচনা” করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে অবশ্য নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে, সাংস্কৃতিক সেবাদানের জন্য কতগুলি বেড আছে। বরং প্রদেশিক সরকার বিচিত্র চাহিদা পূরণের মত সেবা দানের বিষয়টি এলএইচআইএন-এর উপর ছেড়ে দিয়েছে।
বাস্তবতা হলো, দেশের কোনও বিশেষ অঞ্চলে নয় বরং সারা দেশেই বয়স্ক জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্র বাড়ছে।
বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময় ধরে কানাডার অভিবাসন নীতি ছিলো বহুলাংশে ইউরোপের শ্বেতাঙ্গদের আকৃষ্ট করতেই নিবেদিত এবং অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক। ১৯৭৬ সালে নতুন অভিবাসন আইনে বৈষম্যহীনতার নীতি গ্রহণ করা হয় এবং নবাগতদের এক নতুন জোয়ার আসে এদেশে।
এর অর্থ হলো, বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি সংখ্যক অশ্বেতাঙ্গ মানুষ রয়েছেন। টরন্টোতে ২০০৬-২০১৬ সালের মধ্যে জাতিগত বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৯৪ শতাংশ। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে একই সময়ে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ বেড়েছে ২৭ শতাংশ। আদম শুমারির তথ্য পরীক্ষা করে ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ওয়েলেসলি ইন্সটিটিউটের এক রিপোর্টে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়।
একই প্রতিষ্ঠানের ২০১৭ সালের এক রিপোর্টেও দেখা যায়, টরন্টোর বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দাদের প্রায় অর্ধেক মানুষই এমন একটি মাতৃভাষায় কথা বলেন যেটি ইংরেজি বা ফরাসী নয়।
মাউন্ট সিনাই অ্যান্ড দ্য ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্ক হাসপাতালের বার্ধক্যবিদ্যার পরিচালক ডা. সমীর সিনহা বলেন, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের রোগীরা অনেক সময় তাদের শৈশব বা মাতৃভাষার পুরনো স্মৃতির জগতে ফিরে যান। ওইসব বিষয়ে ব্যস্ত থাকতে তাদেরকে সহায়তা দিতে পারলে তাদের চাঙ্গা রাখা সম্ভব।
এসব বিষয় সম্মানজনক ও নিরাপদ উপায়ে সামলে নেওয়া না হলে আরও বেশি মানসিক আঘাত সৃষ্টি করা হবে।
অন্টারিওর লং-টার্ম কেয়ার হোম অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে নার্সিং হোমের ৬৪ শতাংশ নিবাসীর মধ্যেই স্মৃতিভ্রষ্টতা এবং ৯০ শতাংশের মধ্যে কোনও না কোনও আকারে জ্ঞানের অধোগতির আলামত দেখা যায়।
সেঅং-গি উম তার গবেষণার ভিত্তিতে টরন্টো স্টারকে জানান, অভিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রায়শই তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের যতটা সম্ভব সেবা দেয়ার চেষ্টা করেÑ কারণ তারা প্রতিবেশিদের এবং নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মসূচি আছে এমন সামাজিক সংঘ-সমিতির সহায়তা পায়।
তিনি বলেন, “কিন্তু যখন তাদেরকে লং-টার্ম কেয়ার হোমে পাঠানো হয় যেখানে ভাষা বোঝার মত সুযোগ খুবই সামান্য, তখন সেটি মানসম্মত সেবা পাবার ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা হয়ে দেখা দেয়।”
উম বলেন, কোভিড-১৯এর কারণে দীর্ঘমেয়াদী সেবার ব্যাপারে সরকারের বর্তমান অঙ্গীকার যথেষ্ট উঁচু যেহেতু সাংস্কৃতিক সেবা কার্যক্রমকে নীতি পরিবর্তনের একটি অংশ বিবেচনা করতে হবে। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, সাংস্কৃতিক চাহিদা বিবেচনায় নেয়ার আইনগতভাবে বাধ্যবাধকতা থাকলেও তার অর্থ এই নয় যে, প্রত্যেক নিবাসীর জন্য বাস্তবিকই সেটা নিশ্চিত করা হয়।
টরন্টো এলাকায় সংস্কৃতিক-ভিত্তিক সেবাদানের জন্য নির্দিষ্ট হোমের সংখ্যাও বিরল। টরন্টোর সেন্ট্রাল ইন্টিগ্রেশন নেটওয়ার্ক (ঞঈখওঘ) যে ৩৬টি হোমকে তহবিল যোগায় তার মধ্যে ১১টিতে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পদ রয়েছে। এসব হোমে সাংস্কৃতিক পদে লোক আছে গ্রিক, ইউক্রেনীয়, পোলিশ, চীনা ও কোরিয়ান কানাডীয়দের পাশাপাশি শুধু ইহুদি ও ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসীদের জন্য। টরন্টো সেন্ট্রাল পুরো নগরীর হোমগুলোর নিয়ন্ত্রণ করে না।
নেটওয়ার্কের এক বিবৃতিতে জানান হয়, অন্য নয়টি হোমের আলাদা ইউনিট আছে যেখানে সাংস্কৃতিক পদ রয়েছে।
ঞঈখওঘ -এর হোমগুলোর একটি রুমে যেখানে দুজন করে নিবাসী থাকতে পারেন, একটি বেড পেতে অপেক্ষা করতে হয় গড়ে তিন বছরের বেশি। এটি হলো গত জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের হিসাব। আর একজনের জন্য একটি রুমের বরাদ্দ পেতে অপেক্ষা করতে হয় আড়াই বছরের বেশি সময়।
মেলোডি লো নামের একজন টরন্টো স্টারকে বলেন, স্কারবরোর ই হং সেন্টারে একটি বেড খালি হবার আগ পর্যন্ত তিনি, তার বাবা এবং দুই বোন মিলে সার্বক্ষণিকভাবে তার মায়ের সেবা করেছেন।
ই হং লং-টার্ম কেয়ার হোমস চালু হয় ১৯৯৪ সালে। টরন্টো এলাকার এসব হোমে চীনা, জাপানী ও দক্ষিণ এশীয় কানাডীয়দের সংস্কৃতি-ভিত্তিক সেবা দেওয়া হয়। আর এগুলোতে রয়েছে ৮০৫টি বেড।
লো’র মা এলসি ১৯৭৪ সালে হং কং থেকে কানাডায় আসেন এবং স্বামীর সঙ্গে স্কারবরোতে বসবাস করতে থাকেন। তারা তাদের মেয়েদের লালনপালন করে বড় করেন। কিন্তু ২০০৪ সালে ব্রেন টিউমার অপসারণের জন্য অপারেশন করার পর এলসি বেশ ক’বার বড় ধরণের স্ট্রোকের শিকার হন। ওই সময় মাত্র ৫৩ বছর বয়সী এলসি সামান্যই কথা বলতে পারতেন এবং জীবনের অবশিষ্ট সময়ের জন্য তার সেবার প্রয়োজন ছিলো। তিনি বলেন, “আমি ও আমার মা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। তিনি সব সময়ই পরিবারকে সবার আগে গুরুত্ব দিতেন, এমন কি যখন তিনি অসুস্থ তখনও। তাই আমরাও তাকে ছেড়ে থাকতে চাইনি।”
লো বলেন, অন্য সব লং-টার্ম কেয়ার হোম ঘুরে এসে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আমাদের পরিবার মাকে ওইসব হোমে রাখতে পারে না। চীনা কানাডীয় হিসাবে তারা চাননি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলবিহীন জায়গায় যেখানে অনভ্যস্ত খাবার খেতে হবে এবং যেখানে ক্যান্টনী ভাষা বলার মত কেউ নেই সেরকম জায়গায় তিনি থাকুন। লো বলেন, স্ট্রোকের কারণে তার মধ্যে এমন শৈথিল্য দেখা দেয় যে তিনি ইংরেজি বলার মত সক্ষমতায় ছিলেন না।
২০০৮ সালে ই হং হোমে একটি রুম খালি হলে তারা হাফ ছেড়ে বাঁচেন। তার মা সারা জীবন যেসব খাবারের পদ রান্না করেছেন সেই কংগি, নুডুলস, তাজা মাছ ও লাল শীমের স্যুপ সেখানে সুলভ ছিলো। লো বলেন, “তার জীবনের শেষ কিছু বছরই কেবল অবশিষ্ট আছে এটা জেনে আমরা চাইনি তাকে তার আগের জীবনযাত্রা পাল্টাতে এবং নতুন জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হোক।”
লো বলেন, তার পরিবার ভাগ্যবান যে ২০১৫ সালে মৃত্যুর আগে এলসি ই হং হোমে বহু বছর বেঁচে ছিলেন। অনেক পরিবার এখনও অপেক্ষমান তালিকায় রয়ে গেছে।
ই হং হোমের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জোসেফ ওয়াং টরন্টো স্টারকে বলেন, “আমি যখন শুরু করেছি তখন অপেক্ষমান তালিকায় ছিলো মাত্র ৩০০ জন। আর এখন আছে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার মানুষ।” তিনি বলেন, অপেক্ষার তালিকায় গড়ে ছয় থেকে ১০ বছরও থাকতে হয়।
ই হং এখন অন্টারিওর কাছ থেকে আরও অর্থ পাচ্ছে যাতে তারা আরও তিনটি নার্সিং হোমে অতিরিক্ত ৮০০ বেড খুলতে পারে। এসব হোমেও দক্ষিণ এশীয় ও ভিয়েতনামী-কানাডীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের সেবা দেওয়া হবে। কিন্তু, ওয়াং বলেন, এসব হোম প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার প্রায় ৩৩০ মিলিয়ন ডলার। আর নতুন ভবন তৈরির জন্যে ই হংকে ৯০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এটুকুই যথেষ্ট নয়, প্রথম নতুন ভবন নির্মাণে ৭ থেকে ১০ বছর লেগে যাবে।
ওয়াং বলেন, যে কারণে তিনি ১৯৮০-র দশকে ই হং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটি হলো, একজন ডাক্তার হিসাবে তিনি লং-টার্ম হোমে যেতেন। তিনি লক্ষ্য করেন, চীনা-কানাডীয় নিবাসীরা তার চেহারা দেখেই তাকে কাছে ডাকতো, ম্যান্ডারিন ভাষায় তার কাছে সাহায্য চাইতো। কেউ কেউ আত্মহত্যা করার জন্য তার সাহায্য চাইতো।
তিনি বলেন, “এর মূল কারণ হলো সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত দিক থেকে যথাযথ সেবার অভাব। তারা কোনও প্রয়োজনের কথাই বুঝিয়ে বলতে পারতো না। ফলে মানসিক ও আধ্যাত্মিকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তো।”
তিনি বলেন, সুরেশের ক্ষেত্রে যেমন, যদি তামিল-ভাষী বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য কোনও হোম থাকতো তাহলে সুরেশ তার মাকে সেই হোমেই পাঠাতো।
তিনি বলেন, “আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এই চাহিদা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বাড়বে। একজন বয়োজ্যেষ্ঠকে কোনওভাবেই এমন কোনও জায়গায় রেখে আসা যায় না যেখানে তিনি পুরোপুরি হারিয়ে যান। এই প্রভাবটি যতদূর সম্ভব ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।”
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে ভর্তি হওয়ার পর বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে বিষন্নতার হার ২৫.১%। অন্যদিকে এথনিক বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের মধ্যে এই বিষন্নতার হার মাত্র ৩.৩৫%! গ্রেটার টরন্টোর ই হং নামের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এরকম চিত্রই দেখা গেছে। ই হং এর চারটি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে জিটিএ’তে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ এই সকল বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে যারা থাকেন তারা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যেই থাকেন। তাদের চারপাশে সবাই তাদের নিজেদের সংস্কৃতিরই লোক। তারা স্টাফদের সঙ্গেও নিজের ভাষায় কথা বলতে পারেন। ফলে যোগাযোগটা হয় ষোলআনা। কোথাও কোন ফাক থাকে না। এখানকার অধিবাসীদের অভিমত হলো, “আমরা এখানে একটি পরিবারের মতই বাস করি”। কিন্তু মূলধারার বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে এথনিক বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাগণ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
ভাষাবান্ধব ও সংস্কৃতিবান্ধব বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধরা কেমন থাকেন তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে টরন্টোর গ্লোব এন্ড মেইল পত্রিকা থেকে। উদাহরণটি হলো, চীনাদের একটি বৃদ্ধাশ্রম ‘ই হং’ এর এক বৃদ্ধ বাসিন্দার নাম সু টিন হো। তার বয়স ৮৭। বছর দুই আগে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। দিন দশেক থাকতে হয়েছিল তাকে সেখানে। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে তাকে ই হং বৃদ্ধাশ্রমে স্থানান্তর করা হয়। তার স্বামীও ছিলেন ঐ বৃদ্ধাশ্রমে আগে থেকেই। এখানে আসার পর তিনি ফিরে পেলেন তার নিজ ভূবন। চারপাশেই তিনি খুঁজে পেলেন তার নিজ ভাষার লোকজন, নিজ সংস্কৃতির লোকজন। এখানে তিনি এতটাই আনন্দ উপভোগ করতে শুরু করেন যে একপর্যায়ে তিনি বলেই ফেলেন, “আমি আমার বাড়িতে আমার সন্তানদের সঙ্গে বাস করতে চাই না। একঘেয়েমী জীবন সেখানে। বরং এই বৃদ্ধাশ্রমে আমি অনেক ভাল আছি।”