কোভিড-১৯ মহামারি সাম্প্রতিক অভিবাসীদের কানাডা ছেড়ে যাওয়া ত্বরান্বিত করেছে
অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার না হলে অনেকেই হয়তো আর ফিরবেন না
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ৭ মার্চ, ২০২১ : কোভিড-১৯ মহামারিতে অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে আসা কিছু অভিবাসী দ্রুত কানাডা ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে গেছে। কারণ নিজ দেশে তাদের অনেক বেশি সামাজিক ও পারিবারিক যোগাযোগ রয়েছে।
কানাডায় পাঁচ বছরের কম সময় ধরে অবস্থান করছিলেন এমন পারমানেন্ট রেসিডেন্টের সংখ্যা ২০২০ সালে চার শতাংশ কমে ১০ লাখ ১৯ হাজারে দাঁড়ায়, যেটি এক বছর আগে ছিলো ১০ লাখ ৬০ হাজার। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার শ্রম শক্তি সম্পর্কিত সমীক্ষার এক বিশ্লেষণে এই তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষায় অভিবাসনের অবস্থানের ভিত্তিতে ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী শ্রমিকদের সংখ্যা হিসাব করা হয়।
এর আগের দশ বছর ধরে এই সংখ্যা বছরে তিন শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়। খবর দি কানাডিয়ান প্রেস এর। রিপোর্ট করেছেন মান আলহামিদী।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পাঁচ থেকে ১০ বছর ধরে কানাডায় বসবাসকারী পারমানেন্ট রেসিডেন্টেদের সংখ্যাও ২০১৯ সালের ১১ লাখ ৭০ হাজার থেকে কমে ২০২০ সালে ১১ লাখ ৪৬ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
ক্যালগেরি ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক পলিসির গবেষক রবার্ট ফ্যালকনার বলেন, “মন্দা পরিস্থিতির সময়ে অভিবাসীদের স্বদেশে ফিরে যাওয়া তেমন অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়।”
“চাকরি হারালে তারা নিজ দেশে ফিরে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে পারে যেখানে তাদেরকে বাড়িভাড়া দিতে হবে না। তারা হয়তো কিছু সামাজিক সংযোগ খুঁজে পাবে এবং নিজের দেশে নতুন করে কাজ শুরু করতে পারবে।”
তিনি বলেন, ২০০৮ ও ২০০৯ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট ও পরবর্তী মন্দা পরিস্থিতির সময়ও নতুন অভিবাসীদের সংখ্যা তিন শতাংশ কমে গিয়েছিলো।
তিনি বলেন, অর্থনীতি যদি দ্রুত পুনরুদ্ধার করা না যায় তাহলে গত এক বছরে যারা ফিরে গেছে তাদের অনেকেই হয়তো আর না-ও ফিরতে পারে।
“তারা যত দীর্ঘদিন নিজ দেশে নিজের বাড়িতে অবস্থান করবে ততই তাদের কানাডায় ফিরে আসার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।”
গত আগস্টে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মহামারির শুরুর কয়েক মাসে কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের চেয়ে নবাগত অভিবাসীদের চাকরি হারানোর হার ছিলো অনেক বেশি। এর প্রধান কারণ ছিলো এই যে, তারা কর্মস্থলে কম সময় ধরে কর্মরত ছিলো এবং সার্বিকভাবে স্বল্প বেতনের কাজে অভিবাসীদের সংখ্যাই ছিলো সর্বাধিক। পরিষেবা খাতের চাকরিতেও ছিলো একই অবস্থা।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার বিশ্লেষক জুলিয়েন বেরার্ড-চাগনন বলেন, তাদের সংস্থা দেশত্যাগকারী অভিবাসীদের সংখ্যার মাসওয়ারি হিসাব রাখে না তবে এর বিশ্লেষকদেরএকটি গ্রুপ কোভিড-১৯ মহামারির সময় এই বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি পরিপত্র নিয়ে কাজ করছেন।
মহামারির কারণে অভিবাসনের সংখ্যাও ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে লেবার দলীয় সরকার গত অক্টোবরে ঘোষণা করেন যে, কানাডা আগামী তিন বছরে নতুন করে ১২ লাখ ব্যক্তিকে পারমানেন্ট রেসিডেন্টের মর্যাদা দিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে চলতি বছর দেয়া হবে চার লাখ এক হাজার ব্যক্তিকে।
অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী মার্কো মেনডিসোর মুখপাত্র আলেক্সান্ডার কোহেন জানান, সরকার অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী যে, আগামী তিন বছরে তারা অভিবাসনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হবেন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “২০২০ সালের জানুয়ারিতে যখন মহামারি ছিলো না তখনকার চেয়ে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে আমরা আরও বেশি সংখ্যক নতুন পারমানেন্ট রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়েছি। এরই মধ্যে আমরা নির্ধারিত লক্ষ্যের চেয়ে এগিয়ে আছি এবং আমাদের পূর্বাভাসের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি মানুষকে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি দিয়েছি।”
ফ্যালকনার বলেন, সরকার কানাডার টেম্পোরারি রেসিডেন্টদেরকে পারমানেন্ট রেসিডেন্টের মর্যাদা দেয়ার ওপর জোর দিচ্ছে। তিনি বলেন, “এখানে যারা বসবাস করছে তাদের জন্য এটাই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। কিন্তু এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে এটি একটি কথার কথা মাত্র, এর অর্থ হলো, আমাদের জনসংখ্যা আসলে বাড়ছে না।”
তিনি বলেন, এই কৌশল প্রয়োজনীয় কিন্তু চলতি বছর সরকারের উচ্চাভিলাষী অভিবাসন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এটি যথেষ্ট সহায়ক হবে না। “টেম্পোরারি রেসিডেন্টদের প্রত্যেকেই কানাডার পারমানেন্ট রেসিডেন্ট বা নাগরিক হতে চায় ব্যাপারটি এমন নয়। তাদের অনেকে শুধু এদেশে কাজ করতে ও শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় এবং তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারলেই রীতিমত খুশি।”
তিনি বলেন, অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা রয়েছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা ও প্রযুক্তি খাতের চাকরিতে, কারণ যথেষ্ট পরিমাণ অভিবাসী না পেলে এই দুটি খাতের ক্ষতি হবে অন্য সব খাতের চেয়ে বেশি।
অভিবাসন বিভাগের নাগরিকত্ব ও বহুসংস্কৃতিবাদ বিষয়ক সাবেক পরিচালক এন্ড্রু গ্রিফিথ বলেন, অর্থনৈতিক অধোগতির সময়ে আসা অভিবাসীদেরকে যারা অর্থনীতির সুসময়ে আসেন তাদের চেয়ে অন্ততপক্ষে স্বল্প মেয়াদে হলেও আর্থিক দিক থেকে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়।
তিনি বলেন, অর্থনীতি যখন দুর্বল এবং আতিথেয়তা, খুচরা বাজার ও পর্যটন শিল্পের মত খাতগুলো যখন বিপর্যস্ত তখন অভিবাসনের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা বজায় রাখার মধ্যে এক ধরণের দায়িত্বহীনতার ব্যাপার থেকে যায়।
গ্রিফিথ বলেন, অভিবাসীদের কানাডা ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা এদেশের অভিবাসন নীতির ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
তিনি বলেন, সরকারের উচিৎ এরই মধ্যে এদেশে বসবাসরত অভিবাসীদের ব্যাপারে বেশি মনোযোগ দেওয়া। কারণ আমরা অতিথেয়তা, ভ্রমণ ও পরিষেবার মত বিভিন্ন খাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি যা প্রধানত নারী, অশ্বেতাঙ্গ ও সম্প্রতি আসা অভিবাসীদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
“আমরা সম্ভবত একটি সার্বিক কাঠামোগত রূপান্তরের মধ্যে রয়েছি যার ফলে কিছু কাজ বিলুপ্ত হয়ে যাবে অথবা কিছু কাজ নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাবে এবং এর পর আমাদের ভাবতে হবে এই প্রক্রিয়া থেকে উত্তরণের চেষ্টায় নিয়োজিত জনগণের জন্য কী ধরণের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বা অন্য ধরণের কর্মসূচি দরকার।”
ফ্যালকনার বলেন, সরকার লাইসেন্স প্রদান এবং পেশাদারি উন্নয়নের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে পারে কারণ কানাডায় অনেক নবাগত এসব সমস্যায় পড়েন।
“একজন ব্যক্তি নিজের দেশে যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এখানে এসে তাকে সেই একই পেশায় কাজ করার সুযোগ দেয়ার বিষয়টি আমরা ভয়ানক কঠিন করে ফেলেছি। অভিবাসীরা এদেশে আসেন এমন স্বপ্ন ও আশা নিয়ে যে তারা কাজের সুযোগ পাবেন এবং নিজ দেশের চেয়ে অনেক ভালো জীবিকা উপার্জনে সক্ষম হবেন, কিন্তু তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, আসলে তাদেরকে বেতনহীন অথবা স্বল্পবেতনের কাজে যোগ দিতে হচ্ছে।”