কানাডায় যেখানে জাতিগত বৈচিত্র্য বেশি সেখানে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুহারও বেশি

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কানাডার যেসব মহল্লায় জাতিগত বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি সেগুলোতে কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যুহারও অনেক বেশি। সেখানে মৃত্যুহার শ্বেতাঙ্গপ্রধান মহল্লাগুলোর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। সম্প্রতি প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার নতুন তথ্যে একথা জানা গেছে।

ইয়ার ইন রিভিউ শিরোনামের ওই রিপোর্ট বিভিন্ন জাতিগত পটভূমির কানাডীয়দের ওপর বর্তমান মহামারির অসম প্রতিক্রিয়া উন্মোচন করেছে। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন জন পল টাস্কের।

উপাত্তে সেই বিষয়টিই নিশ্চিত হয়েছে, যে কথাটি কিছু কানাডীয় কয়েক মাস ধরে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলে আসছিলেন যে, এই মহামারিতে অন্য যে কোনও গোষ্ঠীর মানুষের চেয়ে নির্দিষ্ট করে কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের মারা যাবার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি।

যেসব এলাকায় সরকারিভাবে “দৃশ্যমান সংখ্যালঘু” হিসাবে চিহ্নিত অশ্বেতাঙ্গ ও আদিবাসী জনগণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বা তারও বেশি সেখানে মৃত্যু হার গড়ে প্রতি একলাখ মানুষের মধ্যে ৩৫। অন্যদিকে যেখানে জনসংখ্যার এক শতাংশেরও কম অশ্বেতাঙ্গ সেখানে মৃত্যু হার এক লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ১৬।

মন্ট্রিলের একটি ক্লিনিকে কোভিড-১৯ এর টেস্ট করানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে মাস্ক পরা লোকজন। (গ্রাহাম হিউজেস/কানাডিয়ান প্রেস)

এটি ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ের পরিসংখ্যান। 

প্রধানত শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকা অর্থাৎ যেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা এক থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে সেখানকার নারীদের চেয়ে যেসব এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ জাতিগত সংখ্যালঘু সেখানে নারীদের মৃত্যু হার প্রায় তিনগুণ। 

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ও কুইবেকে জাতিগত বৈপরীত্ব নিশ্চিতভাবেই বিস্ময়কর। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় দেশের বেশিরভাগ এলাকার চেয়ে মৃত্যু হার অনেক কম। কিন্তু যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস সেখানে মৃত্যু হার প্রধানত শ্বেতাঙ্গদের এলাকার চেয়ে ১০ গুণ বেশি।  মিশ্রবর্ণের মানুষের এলাকায় মৃত্যু হার প্রতি লাখে ৫.৬ জন এবং শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় মৃত্যু হার প্রতি লাখে ০.৫ জন।

কুইবেকে শুধু শ্বেতাঙ্গদের আবাসনের চেয়ে জাতিগত বৈচিত্র্যময় আবাসনে কোভিড-১৯ জনিত মৃত্যুর পরিমাণ অনেক বেশি (যথাক্রমে লাখে ১২৩ জনের বিপরীতে ৩৫.১জন)। মন্ট্রিলে কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান এলাকায় মৃত্যু হার ছিল প্রতি লাখে ১৪৯.৩। সেই তুলনায় যে সব এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গদের হার স্বল্প সেখানে মৃত্যুর হার ছিল প্রতি লাখে মাত্র ৮৮.১ জন।

পরিসংখ্যানে জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে একটি উদ্বেগজনক উপাত্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে: সেটি হলো, মহামারিতে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষ্ণাঙ্গ কানাডীয়রাই আবার সেই সামাজিক গোষ্ঠী যারা কোভিড-১৯ টিকা নেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে অনিচ্ছুক।

টিকা নিতে দ্বিধাগ্রস্ততার হার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে সর্বোচ্চ

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যখন কোভিড-১৯-এর টিকার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে খুব সামান্যই জানা ছিলো সে সময় সংগ্রহীত এক উপাত্তে দেখা যায়, ৭৭ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ স্ট্যাটক্যানের সমীক্ষায় অংশ নিয়ে বলেছেন যে, “তাদের টিকা নেয়ার সম্ভাবনা খুব একটা নেই।” এই হার শ্বেতাঙ্গ, চীনা ও দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে যারা একই রকম জবাব দিয়েছেন তাদের চেয়ে ২০ পয়েন্ট বেশি।

হাইস্কুল বা তার চেয়ে কম শিক্ষা লাভকারীদের মধ্যেও টিকার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ততার হার বেশি। তাদের ৬৪ শতাংশই স্ট্যাটক্যানকে বলেছে, টিকা আসার পর তারা সেটি গ্রহণ করবেন এমন সম্ভাবনা কম। এই হারটি আনুষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে যারা দ্বিধাগ্রস্ত তাদের চেয়ে দ্বিগুণ।

স্ট্যাটক্যান-এর রিপোর্টে বলা হয়, জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যেও বেকারত্বের হার এবং অর্থনৈতিক ভোগান্তি বেশি। কারণ তাদের বেশিরভাগই স্বল্প-মজুরির কাজে নিয়োজিত এবং এসব কাজ দূর থেকে করার সুযোগ নেই।

২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংশই চাকরি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। বিপরীতে শ্বেতাঙ্গ কানাডীয়দের মধ্যে চাকরি হারিয়েছে নয় শতাংশ মানুষ। স্ট্যাটক্যানের সমীক্ষায় দেখা যায়, গত মাসজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গ, আরব, দক্ষিণ এশীয়, লাতিন আমেরিকান এবং ফিলিপিনো বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের এমনটা বলার সম্ভাবনা অনেক অনেক বেশি ছিলো যে, তাদের পক্ষে মৌলিক আর্থিক চাহিদা পূরণ করা ছিলো “কঠিনতর” অথবা “অত্যন্ত কঠিন”।

মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কারণে পুলিশ ডাকার ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়

জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা নতুন আরও কিছু তথ্যউপাত্ত প্রকাশ করেছে যা এই মহামারি এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পদক্ষেপের কারণে পরিবার ও স্বজনকে দূরে রাখার পরিণামে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সৃষ্ট প্রভাবের মাত্রা তুলে ধরে।

স্ট্যাটক্যান দেখতে পেয়েছে, মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন যখন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে সেই সময় মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কারণে পুলিশ ডাকার হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

মহামারির প্রথম আট মাসে এ ধরণের পরিষেবার জন্য পুলিশে কল করার পরিমাণ ছিল ২০১৯ সালের তুলনায় আট শতাংশ বেশি। ওয়েলনেস চেক বা সুস্থ্যতা পরীক্ষার জন্য কল (১৩ শতাংশ বেশি) এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কারণে, যেমন কোনও ব্যক্তির আবেগগত সঙ্কটে (১২ শতাংশ বেশি) কল করার পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। আর ঘরে গোলমালের ঘটনার কারণে পুলিশে রিপোর্ট করার পরিমাণও (আট শতাংশ বেশি) বৃদ্ধি পায়।

২০২০ সালের মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। দোকানপাটে ক্রেতাবেশে চুরির ঘটনা কমে যায় ৪৭ শতাংশ, ডাকাতির জন্য বলপূর্বক কারো বাড়িতে ঢুকে পড়ার মত অপরাধ কমে ২৭ শতাংশ এবং যৌন হামলার ঘটনা গত বছরের চেয়ে ২০ শতাংশ হ্রাস পায়। এর সবই ছিল সামাজিক দূরত্ব রক্ষার পদক্ষেপের প্রতিফলন যখন দোকানপাট বন্ধ এবং মানুষ নিজ ঘরে অবস্থান করে।

সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যায়, শরতে স্কুল খুলে দেয়া এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করার পর কানাডীয়দের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। তবে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কিছু এলাকায় লকডাউন বলবৎ করা হলে পরিস্থিতির আবারও কিছুটা অবনতি ঘটে।