অশ্বেতাঙ্গ কানাডীয়দের অনলাইনে ঘৃণার শিকার হবার আশঙ্কা তিন গুণ বেশি
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ২০১৭ সালে নূর ফাদেল যখন ১৮ বছরের তরুণী তখন ভ্যাঙ্কুভারের স্কাই ট্রেনে এক ব্যক্তি তার মুখে আঘাত করে। লোকটি এই বলে চিৎকার করছিলো যে, সে নূরকে এবং সব মুসলমানকে খুন করে ফেলবে।
নূর ফাদেল ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে তার পেজে প্রকাশ করেন।
সে পোস্ট ভাইরাল হয়, তাতে ঘৃণাপ্রসূত ও হুমকিমূলক মন্তব্যের জোয়ার বয়ে যায়। সেসব মন্তব্যের কিছু ছিলো যৌনবাদী, কিছু ইসলামভীতিজনিত; আবার কিছু মন্তব্যে তাকে নিজের দেশে ফিরে যেতে হুকুম করা হয়।
এক ভিডিওতে তিনি বলেন, “সত্যি বলছি, ওইসব মন্তব্যের বিরূপ প্রভাব আমার ওপর এমনকি ঘটনার তিন বছর পরও থেকে গিয়েছিলো, এটা সব সময়ই আমাকে তাড়া করে ফিরেছে।”
এই ভিডিওটি #ব্লকহেট নামের একটি প্রচারণার অংশ। কানাডার ওয়াইডব্লিউসিএ (YWCA Canada) এবং কানাডার রেস রিলেশন্স ফাউন্ডেশন (CRRF) সম্প্রতি এই প্রচারণা শুরু করে। অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানোর বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরা এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহবান জানানোর লক্ষ্যে এই প্রচারণা শুরু করা হয়। খবর সিবিসি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন সাবরিনা জোনাস।
এই প্রচারণা এমন দিনে শুরু করা হয় যে দিনটি ছিলো ঘটনাক্রমে বর্ণবৈষম্য নির্মূল সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক দিবস।
সিআরআরএফ-এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হাশিম সিবিসি নিউজকে বলেন, “অনলাইনে ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী আচরণের প্রতিক্রিয়া হয় অত্যন্ত গভীর।”
হাশিম বলেন, “এই প্রচারণার লক্ষ্য হলো, ঘৃণাজনিত আক্রমণের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা যেন আলোচনার কেন্দ্রে থাকে সেটি নিশ্চিত করা।”
অশ্বেতাঙ্গ কানাডীয়দের লক্ষ্যবস্তু হবার আশঙ্কা তিন গুণ বেশি, সমীক্ষার তথ্য
সম্প্রতি পরিচালিত সিআরআরএফ-এর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, অশ্বেতাঙ্গ কানাডীয়দের অনলাইনে ঘৃণার শিকার হবার সম্ভাবনা তিনগুণ বেশি।
হাশিম বলেন, বর্ণবাদীরা অনলাইনে হামলার মাধ্যমে অশ্বেতাঙ্গ লোকেদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে। অশ্বেতাঙ্গ মেয়েদের বিরুদ্ধে হামলা চালানো হয় সবচেয়ে বেশি। সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, অপেক্ষাকৃত তরুণ কানাডীয় যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে তারা এধরণের ঘৃণাপ্রসূত মন্তব্য ও বিষয়ের মুখোমুখি হয় অনেক অনেক বেশি।
সমীক্ষায় দেখা যায়, অনলাইনে বর্ণবাদ, যৌনতা, সহিংসতার উস্কানি বা সমকামিতা সংক্রান্ত মন্তব্যের মুখোমুখি হয়েছেন বা জেনেছেন এমন ঘটনা ব্যাপকবিস্তৃত। মোট কানাডীয় জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই অনলাইনে বর্ণবাদী বিষয়ের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন বা এ ধরণের বিষয়বস্তু দেখেছেন।
কানাডার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নারী সংগঠন ওয়াইডব্লিউসিএ, কানাডার মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মায়া রায় বলেন, অশ্বেতাঙ্গ জনগণের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানটি অপেক্ষাকৃত বেশি হতে পারে।
তিনি বলেন, “একজন কৃষ্ণাঙ্গ বা আদিবাসী মানুষের পক্ষে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের শিকার হলেও পুলিশে রিপোর্ট করা একেবারেই নিরাপদ নয়, যখন তাদেরকে বর্ণবাদী মানসিকতা থেকেই দেখা হয়।”
তিনি বলেন, “আমরা জানি, অনেক কানাডীয়ই অভিযোগ করা বা সোচ্চার হবার পথ বেছে নেয়াটা পছন্দ করেন না।”
ডিজিটাল মাধ্যমে ঘৃণা আসলে বাস্তব জীবনে বিদ্রমান ঘৃণার সম্প্রসারণ: ওয়াইডব্লিউসিএ
রায়ের বিবেচনায় অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানোর এধরণের ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। তিনি বলেন, মহামারির শুরুর দিকে ওয়াইডব্লিউসিএ কানাডা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বিপুল আক্রমণের শিকার হয়।
তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক যে, সেখান থেকেই ঘটনাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পারছি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও ডিজিটাল মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো আসলে বাস্তব জীবনে বিদ্যমান ঘৃণারই সম্প্রসারণ।”
চীনা কানাডীয় ন্যাশনাল কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক জাস্টিন কং বলেন, এশীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণা কানাডায় নতুন কিছু নয়। তবে মহামারি এটিকে তীব্রতা দিয়েছে। মিজ. রায় এই মহামারিকে এশীয়বিরোধী বর্ণবাদের “রীতিমত ঝড়” বলে বর্ণনা করেন।
কং বলেন, “বর্ণবাদীদের ধারণা থেকে মনে হয়, যেন চীনা ও এশীয় লোকজনই কোভিড-১৯ মহামারির জন্য দায়ী। এটি ঠিক নয় এবং এ ধরণের বিশ্বাস লালন করাই বর্ণবাদ।
তিনি বলেন, “এখানে, কানাডায় এশীয়বিরোধী বর্ণবাদ আমাদের জন্য একটি বিরাট সমস্যা। রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের পর্যায়, ব্যক্তিগত পর্যায় এবং সামাজিক পর্যায়ে থেকে এই সমস্যার সুরাহা করা জরুরি।
কেন্দ্রীয় সরকার, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রবিধি প্রণয়নের আহবান
#ব্লকহেট প্রচারণার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সামাজিক মিডিয়া প্লাটফরমগুলিকে তাদের পরিবেশিত বিষয়বস্তুর জন্য দায়ী করা উচিৎ, কারণ তাদের বিবেচনায় এই সামাজিক মিডিয়াই হলো ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম।
রায় এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলিকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের কাঠামো এবং যে দেশে সেবাদানের মাধ্যমে তারা লাভবান হচ্ছে সেই দেশের আইন অনুসরণ করতে হবে।
তার ভাষায়, “আমার মনে হয়, এক্ষেত্রে যা গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে মুখ্য হলো প্রবিধি এবং আইন মেনে চলার বিষয়টি।
হাশিম বলেন, অনলাইনে ঘৃণার প্রচারণা বন্ধের প্রক্রিয়ার এটি হলো একটি পদক্ষেপ।
তিনি বলেন, ঘৃণা বন্ধে সহায়তার দায়িত্ব অনিবার্যভাবে প্রত্যেকের- প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের।
গত জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার বলেছে, তারা বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও “অনলাইনের ক্ষতির” বিষয়ে কিছু আইন এবছর চালু করার পরিকল্পনা করছে।
হেরিটেজ বিষয়ক মন্ত্রী (Heritage Minister) স্টিভেন গিলবল্ট বলেন, তিনি একটি নতুন সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের লক্ষ্যে একটি আইন পেশ করবেন। নতুন ওই সংস্থাকে সামাজিক গণমাধ্যমের ওপর নজরদারি এবং যারা তাদের প্লাটফরমে ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্য বা এধরণের কোন বিষয় থাকার অনুমোদন দেবে তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা করার ক্ষমতা দেওয়া হবে।
হাশিম বলেন, “অনলাইনে কথা বলার সুবিধা সুরক্ষিত রাখার পরিবেশ নিশ্চিত হলে তা কেবল যে চরম ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্যের প্রচারণা সঙ্কুচিত করবে তা-ই নয়, বরং এটি সত্যিকারের বৈশ্বিক সহিংসতা অনুসৃত না হওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করবে।”
তিনি বলেন, “খাঁটি মানুষেরা এসব কর্মকাণ্ডে মর্মাহত। খাঁটি মানুষদের ওপর এর মন্দ প্রভাব পড়ছে। চলমান আলোচনায় তাদের বক্তব্যও শোনার দরকার আছে।”