অভিবাসী তরুণরা কানাডার সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে

এশীয় অভিবাসীদের সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সম্ভাবনাও অনেক বেশি

খুরশিদ আলম : কানাডায় অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুণরা সাফল্যের প্রতিযোগিতায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সমবয়সী কানাডিয়ানদেরকে। এমনকি বয়সে বড় কানাডিয়ানদেরকেও হার মানাচ্ছে তারা সাফল্যের দৌড়ে! দ্বিতীয় প্রজন্মের এই তরুণ অভিবাসীদের মধ্যে আছে বাংলাদেশী কানাডিয়ানরাও।

কানাডায় যারা প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী, তাদের মধ্যে অনেকেরই মনে ক্ষোভ ও হতাশা রয়েছে এই ভেবে যে, কানাডায় এসে তাঁরা কিছুই করতে পারেননি। ডক্তারগণ ডাক্তারী পেশায় নেই, ইঞ্জিনিয়ারগণ ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় নেই, কৃষিবিজ্ঞানীগণ কৃষি পেশায় নেই। এরকম আরো বহু পেশাজীবী অভিবাসীগণ তাদের নিজ নিজ পেশায় নেই। হাতে গোনা দুই চারজন ছাড়া বাকী সবাইকে পেশা বদল করে নিন্ম আয়ের কাজে যোগ দিতে হয়েছে। ফলে তাঁদের অনেকেই রয়েছেন তীব্র মানসিক চাপ ও যন্ত্রনার মধ্যে। সেই সাথে শারীরিক চাপও রয়েছে। যারা এই শারীরিক ও মানসিক চাপকে সামাল দিতে পারছেন না তারা বুড়িয়ে যাচ্ছেন দ্রুত। শরীর ও মনে বাসা বাধছে নানান রোগ।

তবে এত হতাশার মাঝেও আশার আলো দেখাচ্ছে অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা। চলতি সালের ২৩ মার্চ প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার এক গবেষণা তথ্য এই আশাব্যঞ্জক চিত্রটি তুলে ধরেছে। ঐ গবেষণা তথ্যে বলা হয়, ২০১৮ সালের অভিবাসন সম্পর্কিত আনুপূর্বিক ডেটাবেসের সর্বশেষ উপাত্ত থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, সময়ের পরিক্রমায় অভিবাসী শিশুরা কানাডার সমাজ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। যদিও স্থানীয় নিবাসী শিশুদের (১৫.৪%) চেয়ে অভিবাসী শিশুদের (৩২.২%) দ্বিগুণেরও বেশি সংখ্যককে স্বল্প-আয়ের পরিবারে বেড়ে উঠতে হয়েছে। কানাডার শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা অর্জনের সুযোগ এবং সরকারি ভাষাগুলোতে বর্ধিত সাচ্ছন্দ্য অর্জনের মত উপাদানগুলো অভিবাসী শিশুদেরকে প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছে তাদের কানাডায় জন্মানো সহকর্মীদের অনুরূপ বেতন পাবার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।

কানাডায় অভিবাসী পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুণরা সাফল্যের প্রতিযোগিতায় ছাড়িয়ে যাচ্ছে তাদের সমবয়সী কানাডিয়ানদেরকে। নোভা স্কোশিয়ার হ্যালিফেক্সে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের একটি অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় প্রজন্মের একদল কিশোর কিশোরী। আগামীতে এরাও কানাডার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ছবি : গোলাম কিবরিয়া

অভিবাসী শিশুদের বিষয়ে স্ট্যাটিসটিকস কানাডার গবেষণা থেকে আরো যে সকল তথ্য জানা যায় তা হলো:

শিশু বয়সে যেসব অভিবাসী কানাডায় এসেছে তাদের মাধ্যমিক-উত্তর শিক্ষা অর্জনের সম্ভাবনা দেশের সার্বিক জনসমষ্টির চেয়ে বেশি

ট্যাক্স পরিশোধের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ২০ বছর বয়সী অভিবাসীদের মধ্যে ৭০ শতাংশই মাধ্যমিক-উত্তর শিক্ষায় ভর্তি হয়। এরা ১৫ বছর বয়সে কানাডায় এসেছিলো।

ওই বছর ২০ বছর বয়সী সার্বিক জনগোষ্ঠীর উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ভর্তির হার ছিলো ৫৬%।

শিশু বয়সে কানাডায় আসা অভিবাসীদের মোটামুটি আয় তাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক জনগোষ্ঠীর আয়ের অনুরূপ পর্যায়েই বৃদ্ধি পায়। ২০১৮ সালে সার্বিক জনগোষ্ঠীর একজন ২৫ বছর বয়সী কানাডীয়র মোটামুটি আয়ের পরিমাণ ছিলো ২৯,৭১০ ডলার (বার্ষিক)। সেই তুলনায় শিশুবয়সে কানাডায় আসা একজন একই বয়সের অভিবাসীর আয় ছিলো বছরে ৩০,৩০০ ডলার। ৩০ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে একজন কানাডীয়র আয় যেখানে ছিলো ৪১,৮১০ ডলার সেখানে ৩০ বছর বয়সী একজন অভিবাসী যে শৈশবে কানাডায় এসেছে তার আয় ছিলো ৪৭,৪০০ ডলার। দেখা যাচ্ছে, শৈশবে কানাডায় আসা একজন ৩০ বছর বয়সী অভিবাসীর মোটামুটি আয়ের সঙ্গে সার্বিক জনগোষ্ঠীর একজন নাগরিকের আয়ের পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ১৩.৪%।

অর্থনৈতিক অভিবাসী পরিবারের সঙ্গে শৈশবে কানাডায় আসা শিশুরা কানাডার সমগ্র জনগণের শিশুদের চেয়ে অধিক সংখ্যায় উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ভর্তি হয়

অভিবাসী শিশুদের প্রাপ্তবয়সে অর্জিত আর্থ-সামাজিক অর্জনকে প্রভাবিত করে অনেকগুলি কারণ, যার মধ্যে রয়েছে কানাডায় তাদের আগমনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবেশও। অর্থনৈতিক অভিবাসীদের (দক্ষ ও পেশাজীবী) যাদেরকে কানাডার অর্থনীতিতে অবদান রাখার সম্ভাব্যতা বিবেচনায় নির্বাচন করা হয়, তাদের মোটামুটি আয় শরাণার্থীদের চেয়ে বেশি। শরণার্থীরা কানাডায় আসেন নিপীড়ন বা যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য অথবা ইতিমধ্যে কানাডায় বসবাসরত তাদের স্বজনের স্পন্সরশিপ নিয়ে।

অর্থনৈতিক অভিবাসীদের পোষ্য হিসাবে কানাডায় আসা অভিবাসী শিশুদের অর্থনৈতিক অভিবাসী শ্রেণিতে মূল আবেদনকারীর (বাবা অথবা মায়ের) অপেক্ষাকৃত উচ্চতর আয়ের সুবিধা পাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অর্থনৈতিক অভিবাসী পরিবারের সঙ্গে কানাডায় আসা শিশুদের মধ্যে যাদের বয়স ২০১৮ সালে ২০ বছর হয়েছে তাদের ৭৫% উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ভর্তি হয়। একই বছরে একই বয়সের শিশুদের মধ্যে স্পন্সর পেয়ে আসা পরিবারের শিশুদের ৬০%, শরণার্থীদের ৫১% এবং সার্বিক কানাডীয় জনগোষ্ঠীর ৫৬% শিশু উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ভর্তি হয়।

অর্থনৈতিক অভিবাসী শ্রেণির পরিবারের সঙ্গে ১৫ বছর বয়সের আগে কানাডায় আসা একজন অভিবাসী ৩০ বছর বয়সে অন্য যে কোনও শ্রেণিতে এদেশে আসা অভিবাসীর চেয়ে উচ্চ হারে বেতন পান

উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ভর্তির হার নিম্ন হলে তাদের আগেভাগে শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। বয়স ২৩ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত স্পন্সর পেয়ে আসা পরিবার, শরণার্থী এবং সার্বিক কানাডীয় জনগোষ্ঠীর শিশুদের আয় অর্থনৈতিক অভিবাসী পরিবারের সন্তানের চেয়ে বেশি থাকে। এই বয়সে স্পন্সর পেয়ে আসা পরিবারের অভিবাসীদের মোটামুটি আয়ের পরিমাণ থাকে ১৯,২০০ ডলার, আর শৈশবে আসা শরণার্থী পরিবারের একজন অভিবাসীর আয় থাকে ১৯,০০০ ডলার। যেখানে সার্বিক কানাডীয় জনগোষ্ঠীর সন্তান আয় করেন ২১,৩০০ ডলার এবং অর্থনৈতিক অভিবাসী পরিবারের সন্তান আয় করেন ১৮,৯০০ ডলার।

কিন্তু ২৪ বছর বয়স হতে হতে যখন অনেকেই তাদের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করে তখন শৈশবে আসা অর্থনৈতিক অভিবাসী পরিবারের সন্তানের আয় তার অন্য সব শ্রেণিতে আসা এবং সার্বিক কানাডীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিপক্ষের আয়কে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আয় অন্য সব শ্রেণির সন্তানদের আয়কে অব্যাহতভাবে ছাড়িয়ে যেতে থাকে মাত্রাতিরিক্ত হারে।

২০১৮ সালে ৩০ বছর বয়সে পৌঁছা অর্থনৈতিক অভিবাসী পরিবারের সঙ্গে শৈশবে কানাডায় আসা একজন অভিবাসীর আয় ছিলো ৫২,৪০০ ডলার। সেই তুলনায় একই বয়সের একজন শরণার্থী পরিবারের শৈশবে আসা সন্তানের আয় ছিলো ৪১,৬০০ ডলার, স্পন্সরে আসা পরিবারের সন্তানের আয় ছিলো ৪০,১০০ ডলার এবং সার্বিক কানাডীয় জনগোষ্ঠীর সন্তানের আয় ছিলো ৪১,৮১০ ডলার।

শৈশবে কানাডায় আসা অভিবাসী মেয়েদের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ভর্তির হার ছেলেদের চেয়ে  বেশি

২০১৮ সালে বয়স ২০ বছর হয়েছে এমন যেসব অভিবাসী মেয়ে শৈশবে কানাডায় এসেছে তাদের মধ্যে ৭৪% উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ভর্তি হয়। সেই তুলনায় শৈশবে কানাডায় আসা ছেলেদের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় ভর্তির হার ছিলো অপেক্ষাকৃত কম (৬৫%)। ওই ৭৪% এর মধ্যে যারা শৈশবে কানাডায় এসেছে সেই সব অভিবাসী মেয়ের উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হার আবার একই বয়সের সার্বিক নারী জনগোষ্ঠীর (৬২%) মেয়ে এবং সার্বিক পুরুষ জনগোষ্ঠীর (৫০%) চেয়ে অধিকতর।

বেতনের দিক থেকে ৩০ বছর বয়সে একজন শৈশবে আসা অভিবাসী মেয়ে আয় করে ৪৩,৩০০ ডলার যা শৈশবে আসা একজন ২৫ বছর বয়সী অভিবাসী মেয়ের আয়ের (২৯,২০০ ডলার) চেয়ে ৪৮% বেশি। কিন্তু তাদের আয় একই বয়সের এবং একইবাবে শৈশবে আসা অভিবাসী ছেলে (৫১,৯০০ ডলার) এবং সার্বিক পুরুষ জনগোষ্ঠীর আয়ের (৪৮,৮৫০ ডলার) তুলনায় কম। আয়ের ক্ষেত্রে এই লৈঙ্গিক বৈষম্য আগের বিভিন্ন সমীক্ষাতেও উঠে এসেছে যে, একই স্তরের শিক্ষা অর্জনকারী পুরুষের তুলনায় নারীর আয় কম।

তার পরও শৈশবে আসা একজন ৩০ বছর বয়সী অভিবাসী নারীর মোটামুটি আয় সার্বিক নারী জনগোষ্ঠীর আয়ের (৩৫,২৮০ ডলার) চেয়ে বেশি। সার্বিক নারী জনগোষ্ঠীর একজন নারী সবার চেয়ে কম আয় করেন।

উল্লেখ্য যে, স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা ইতিপূর্বেও অভিবাসী শিশুদের অগ্রগতি নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত করেছিল। ২০০৬ ও ২০১৬ সালের আদমশুমারির সমন্বিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত এক সমীক্ষায় একদল অভিবাসী শিশুর শিক্ষা ও শ্রমবাজারে তাদের অর্জন পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে যাদের বয়স ২০০৬ সালে ছিলো ১৩ থেকে ১৭ বছর। ঐ সমীক্ষায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা অভিবাসী বাবা-মার সন্তানদের অর্জনের তুলনা করা হয়েছে কানাডায় জন্মানো বাবা-মা’র সন্তানদের অর্জনের সঙ্গে।

২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ঐ রিপোর্টের সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় –

Ñ   অভিবাসী শিশুদের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সমাপ্ত করার সম্ভাবনা তাদের তৃতীয় বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি। উদাহরণ স্বরূপ, ২০০৬ সালে ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়স ছিলো এমন অভিবাসী শিশুদের ৪৩% শতাংশই ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করে। যেখানে তাদের তৃতীয় বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিপক্ষের শিশুদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জন করে ২৯% শতাংশ।

Ñ    এশীয় অভিবাসীদের সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সম্ভাবনা অনেক বেশি। উদাহরণ স্বরূপ, পূর্ব এশিয়া থেকে আসা অভিবাসী শিশুদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি অর্জনের সম্ভাবনা ২০১৬ সালে ছিলো তাদের তৃতীয় বা তারও পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিপক্ষের শিশুদের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি।

Ñ    সাধারণভাবে স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তানরাও স্বল্পশিক্ষিত থেকে যায়। অবশ্য বাবা-মায়ের শিক্ষার স্তর অভিবাসী শিশুদের শিক্ষার স্তরের বিষয়ে যতটা না প্রভাব রাখে তার চেয়ে বেশি প্রভাব রাখে কানাডায় জন্মানো বাবা-মায়ের সন্তানদের ওপর।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ঐ রিপোর্টের ভূমিকায় বলা হয়, শরণার্থীদের স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে মানবিক ঐতিহ্যের বাইরে কানাডার অভিবাসন নীতির আরেকটি লক্ষ্য হলো সারাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি

অর্জন। তার ওপর আন্তর্জাতিক অভিবাসনের লক্ষ্য থাকে যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব পূরণ করা যায়।

এসব লক্ষ্য সামনে রেখে অভিবাসনের জন্য আবেদনকারীদের বাছাই করার সময় তাদের শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ধরে নেয়া হয় যে, চাকরি খুঁজে নিতে সক্ষম হলে অভিবাসীদের জন্য সমাজে একীভূত হতে অপেক্ষাকৃত কম ভোগান্তি হবে এবং তারা যদি কোনও স্বীকৃত উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করে তাহলে তাদের জন্য ভালো চাকরি খুঁজে পাওয়া কম কষ্টের হবে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানডার ভূমিকায় আরো বলা হয়, কানাডায় অভিবাসনের জন্য বাছাইয়ের মানদণ্ড হিসাবে শিক্ষার ভূমিকাকে পরিসংখ্যান সমর্থন করে।  যেমন, ২০১১ ও ২০১৬ সালের মধ্যে কানাডায় আসা ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী অভিবাসীদের মধ্যে ৫৭% শতাংশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক বা ডিপ্লোমা বা তারও উচ্চস্তরের সার্টিফিকেট রয়েছে (অর্থনৈতিক অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৭১% শতাংশ)। সেই তুলনায়, একই বয়সের অভিবাসী নয় এমন কানাডীয়দের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে মাত্র ৩০% শতাংশের।

শ্রমবাজারের ঘাটতি উচ্চতর শিক্ষিত অভিবাসীদের দিয়ে পূরণ করা কানাডার অর্থনীতির জন্য স্বল্পমেয়াদে লাভজনক হতে পারে। দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়নে অভিবাসনের প্রভাব আরও দীর্ঘতর সময়ে অনুভবযোগ্য নির্দিষ্ট করে একারণে যে, বেশিরভাগ অভিবাসীরই কানাডায় জন্মানো সন্তান থাকবে। এসব শিশু বা যুবাকে “অভিবাসী পটভূমির শিশু” হিসাবে বিবেচনা করা হবে যেমনটা এই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার মতে, নির্দিষ্ট এই পারিবারিক ইতিহাস থাকার প্রেক্ষিতে, যেহেতু তাদের বাবা-মা একটি নতুন পরিবেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছে, অভিবাসী পটভূমির শিশুরা অন্য শিশুদের চেয়ে অনেক দিক থেকেই ভিন্নতর হয়ে থাকে (স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা ২০১৭)। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, তাদের মধ্যে একটি মিশ্র সংস্কৃতির বিকাশের সম্ভাবনা বেশি থাকে যার ভিত্তি হলো তাদের বাবা-মায়ের এবং তারা যে সমাজে জন্মেছেন সেই সমাজের সংস্কৃতি, কিন্তু এরপর তা প্রভাবিত হয়েছে পরিবারের বাইরে তাদের বন্ধু, শিক্ষক এবং যেসব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সঙ্গে তারা মেলামেশা করেছে এবং একই সঙ্গে সেইসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি দিয়ে যেগুলোতে তারা যাওয়া-আসা করেছে (স্কুল, কর্মস্থল ইত্যাদি)। এভাবে তারা দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে অবদান রাখছে।

অভিবাসী পটভূমির শিশুরা কানাডার সাধারণ শিক্ষার স্তর বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে পারে। ইউরোপীয় কিছু দেশের সঙ্গে না মিললেও কানাডায় সাধারণভাবে অভিবাসী নয় এমন শিশুদের তুলনায় অভিবাসী পটভূমির শিশুদের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় যোগদান ও তা সম্পন্ন করার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা তাদের গবেষণায় উপরের যে তথ্যগুলো তুলে ধরেছে তা যে কোন অভিবাসী বাবা-মায়ের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তবে দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী ছেলে-মেয়েরা কানাডায় সাফল্যের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও সত্যি যে তারা শুরু থেকেই পুষ্প বিছানো পথে হাঁটেনি। স্কুল-কলেজে বুলিং (ইঁষষুরহম) এর মোকাবেলা করা, চাকরী ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়া, ঘরে ও বাইরে দুই সংস্কৃতির মোকাবেলা করাসহ আরো কিছু বাধা তাদেরকে অতিক্রম করতে হয়েছে। আর এই সব বাধা অতিক্রম করে তারা আজ সফল প্রজন্ম হয়ে দাড়িয়েছে, মনের দুঃখ গোছাচ্ছে বাবা-মায়ের।

একাডেমিক এচিভমেন্টসহ চাকরী ক্ষেত্রে সাফল্যের অনেক নজীর রয়েছে কানাডায় দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে। এক বাঙ্গালী তরুণের নাম এখানে উল্লেখ করা যায় যিনি ইংরেজীতে প্রথম উপন্যাস লিখেই কানাডায় আলোচনার ঝড় তুলেন। টরন্টো স্টার, গ্লোব এন্ড মেইল-সহ কানাডার মেইনস্ট্রিমের খ্যাতিমান পত্রিকাগুলোতে তাঁর উপর ছাপা হয় বিভিন্ন প্রতিবেদন। এই তরুণের নাম গালিব ইসলাম।

গালিব ইসলামের জন্ম বাংলাদেশে। ১৯৮১ সালে। এরপরে বাবার হাত ধরে সে পাড়ি জমায় নাইজেরিয়াতে। বাবা সেখানে কাজ করতেন। পরে ’৮৮ সালে গালিবের পরিবার ইমিগ্র্যান্ট হয়ে কানাডায় আসেন। অনেক লেখকের মতো গালিবও শৈশবে স্বপ্ন দেখতো লেখক হওয়ার। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গালিব টরন্টো ইউনির্ভাসিটিতে এম এ ভর্তি হন ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ বিভাগে ২০০৪ সালে। গালিবে ভাষ্য, “আমি শুধু একজন লেখকই হতে চাইনি-আমি ভেতর থেকে একটি উপন্যাস লেখার তাগিদ অনুভব করছিলাম। এবং মার্গারেট এটউডকে ভাবতাম আমার ‘মেন্টর’ হিসেবে।” গালিবের লেখা সেই উপন্যাসটির নাম-‘ফায়ার ইন দ্য আননেমবল কান্ট্রি’। এ উপন্যাস সম্পর্কে মার্গারেট এটউডের মন্তব্য, ‘ আমি পান্ডুলিপি দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। তার ভাবনায় মৌলিকতা আছে এবং সে যে একজন প্রতিভাবান লেখক, এই উপন্যাসে তার সুষ্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছে সে।

প্রবাসের এই দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুনদের সাফল্যগাঁথার কথা উঠে এসেছে অন্য একটি গবেষণা পত্রেও যেটি কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল স্যোসাল সাইন্স রিসার্স জার্নালে। টরন্টো ইউনিভারসিটির অধ্যাপক জেফরী জি. রিটজ্ ও অধ্যাপক নাওকো হকিংস এবং মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল ইউনিভারসিটির অধ্যাপক হিদার জ্যাং তাদের ঐ গবেষনা পত্রে উল্লেখ করেছেন, কানাডায় মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠির মধ্যে যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৯ তাদের বাৎসরিক আয় ৫০ হাজার ডলার। অন্যদিকে চীনা বংশোদ্ভূত দ্বিতীয় প্রজন্মের তরুনদের বাৎসরিক আয় ৬৩ হাজার ডলার।

কানাডায় দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য এথনিক গ্রুপের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সাফল্যও কমবেশী একইরকম। অধ্যাপক তিনজন তাদের গবেষণা পত্রে আরো উল্লেখ করেন যে, চীন এবং দক্ষিণ এশীয় তরুন ছেলে মেয়েদের মধ্যে গ্রাজুয়েশন লাভ করার হারও মেইনস্ট্রিম ছেলে মেয়েদের তুলনায় বেশী।

কেন এমনটি হচ্ছে? সবাই জানেন কানাডা একটি উন্নত দেশ। এখানকার ছেলে মেয়েরা লেখা পড়া করার জন্য যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। আর সাধারণভাবে সকলেরই বিশ্বাস, শ্বেতাঙ্গরা সব ক্ষেত্রেই সেরা। কিন্তু সেই সেরাদেরকেও হার মানাচ্ছে অভিবাসী অশ্বেতাঙ্গরা! বিশেষ করে চীন ও দক্ষিণ এশীয় ছেলে-মেয়েরা!

এই চিত্রটি কেবল কানাডার ক্ষেত্রেই যে সত্যি তা নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়াতেও দেখা গেছে এই একই চিত্র। ঐ দুটি দেশেও প্রচুর সংখ্যক প্রথম প্রজন্মের চীনা ও দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী বাস করেন। তাদের ছেলে-মেয়েরাও কানাডার অভিবাসী ছেলে-মেয়েদের মত লেখাপড়া ও চাকরীর ক্ষেত্রে মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে আছে। উপরে উল্লেখিত ঐ তিন অধ্যাপকের পরিচালিত গবেষণায় এই তথ্যই উঠে এসেছে। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, উল্লেখিত তিনটি দেশেই এশিয়ান ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা ক্ষেত্রে মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে আছে। অর্থনৈতিক সাফল্যের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ঐ তিনটি দেশে এশিয়ান ছেলে-মেয়েরা মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের চেয়ে এগিয়ে আছে।

তাদের গবেষণায় আরো দেখা যায় চাইনীজ ছেলে-মেয়েরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠির তুলনায় চাইনীজ ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার হার ১৫% বেশী। কানাডায় এই হার ২০% এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১৭%।

কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াতে মেইনস্ট্রিম জনগোষ্ঠির তুলনায় অন্যান্য এথনিক গ্রুপের ছেলে-মেয়েরা বেশী মাত্রায় ম্যানেজারিয়াল ও প্রফেশনাল জব দখল করে আছে। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে চাইনীজ ও দক্ষিণ এশীয় ছেলে-মেয়েরা বেশী এগিয়ে থাকায় তাদের পেশাগত সাফল্যও বেশী। আবার ঐ তিনটি দেশে যে সকল চাইনীজ ও দক্ষিণ এশীয় ছেলে-মেয়েরা ম্যানেজারিয়াল ও প্রফেশনাল জব করছে তাদের সংখ্যা সমবয়সী মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশী।

চীন ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের ছেলে-মেয়েরা কেন সাফল্যের দৌড়ে মেইনস্ট্রিম ছেলে-মেয়েদের তুলনায় এগিয়ে আছে সেই রহস্য লুকিয়ে আছে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের মধ্যেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রী লংকা, মালদ্বীভস্, নেপাল, ও ভূটান। টরন্টো ইউনিভারসিটির অধ্যাপক জেফরী জি. রিটজ বলেন, “চীন ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে গত দুই বা তিন দশকের মধ্যে আগত অভিবাসীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের ছেলে-মেয়েদের সাফল্যের পিছনে সম্ভবত এটি একটি কারণ হতে পারে। প্রবাসে আসার পর প্রথম প্রজন্মের এই অভিবাসীদেরকে অর্থনৈতিক চাপসহ আরো নানারকমের চাপের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু তা সত্বেও এই অভিবাসীরা শিক্ষার কদর ও প্রয়োজনীতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বুঝিয়ে দেন তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে। আর এই কারনেই হয়তো তাদের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত হয় এবং কর্মক্ষেত্রেও তারা সাফল্য লাভ করে।”