জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে বছর শেষ করলো লিবারেল পার্টি

ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২১

সারাদেশে জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল দল ৩৫.৭ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে শীর্ষে রয়েছে। সেই তুলনায় এরিন ও’টুলেসের রক্ষণশীল দলের সমর্থন রয়েছে ৩১ শতাংশ। ছবি : অনলাইন

কানাডার বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি এই সময়ে জাতীয় নির্বাচন হয় তাহলে লিবারেল দল নিশ্চিতভাবেই জিতবে এবং সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনও লাভ করবে।

মাত্র একটি বছর কী দারুণ পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে।

সিবিসির কানাডা পোল ট্র্যাকার-এর তথ্য অনুযায়ী, সরকারিভাবে পাওয়া নির্বাচনের উপাত্ত মিলিয়ে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে এ পর্যন্ত লিবারেল দলের জনসমর্থন বেড়েছ ৪.২ শতাংশ। রক্ষণশীল, নিউ ডেমোক্রেটস এবং ব্লক কুইবেকিস দলের অবস্থানে সামান্যই নড়চড় হয়েছে। কিন্তু গ্রিন পার্টির জনসমর্থন প্রায় তিন শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

সারাদেশে জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল দল ৩৫.৭ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে শীর্ষে রয়েছে। সেই তুলনায় এরিন ও’টুলেসের রক্ষণশীল দলের সমর্থন রয়েছে ৩১ শতাংশ। জগমিৎ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন এনডিপির জনসমর্থন ১৮.৩ শতাংশ অন্যদিকে গ্রিন পার্টির ৫.৪ শতাংশ।

সারাদেশে জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল দল ৩৫.৭ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে শীর্ষে রয়েছে। সেই তুলনায় এরিন ও’টুলেসের রক্ষণশীল দলের সমর্থন রয়েছে ৩১ শতাংশ। ছবি : অনলাইন

এক বছর আগে লিবারেল দলের জনসমর্থন ছিলো রক্ষণশীলদের চেয়ে মাত্র ০.৫ পয়েন্ট এগিয়ে। আর তা সুসংহত ছিলো সংখ্যালঘু অঞ্চলে।

কিন্তু বর্তমান হিসাব অনুযায়ী লিবারেলরা প্রায় ১৬৭টি আসনে জিতবে। রক্ষণশীলরা পেতে পারে ১১১টি আসন, ব্লক পেতে পারে ৩২টি, এনডিপি ২৭টি এবং গ্রিন পার্টি একটি আসনে জিততে পারে।

সম্ভাব্য এই ফলাফলে বর্তমানে হাউস অব কমন্সে যে অবস্থান আছে তাতে খুব একটা হেরফের হয়তো হবে না তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের জন্য যে ১৭০ আসনে প্রয়োজন হয় লিবারেলরা মোটামুটিভাবে তার কাছাকাছি পৌঁছবে। সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি এ তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন সিবিসি’র এরিক গ্রেনিয়ের। নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-

দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই লিবারেল দল এগিয়ে

গত কয়েক মাস ধরে লিবারেল দলের প্রতি জনসমর্থনের প্রবণতা অত্যন্ত স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু তার আগে দলটির জন্য বছরটি ছিল রীতিমত নাটকীয় পরিবর্তনের সময়। ২০২০ সালের প্রথম কয়েক মাসে জনসমর্থনের দিক থেকে লিবারেল দলের অবস্থান ছিল রক্ষণশীল দলের প্রায় সমান। এরপর মহামারির প্রথম দিকে দলটির প্রতি জনসমর্থন দ্রুত বেড়ে যায়।

জুন মাসের প্রথমদিকে তাদের জনসমর্থন ছিল সর্বোচ্চে এবং নির্বাচনী নজরদারি প্রতিষ্ঠানের (Poll Tracker) হিসাবে তা প্রায় ৪১ শতাংশ পৌঁছায়। অবশ্য ‘WE Charity’ সম্পর্কিত কেলেঙ্কারি লিবারেলদের শক্তি শুষে নেয়। সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে তাদের সমর্থন মোটামুটি ৩৫ থেকে ৩৬ শতাংশের মধ্যে নেমে আসে। তারপর থেকে সেটা ওই পর্যায়েই আছে।

তবে ১২ মাস আগের চেয়ে লিবারেলরা এখনও অনেকটাই ভালো অবস্থানে আছে। এই মুহূর্তে তুলনামূলকভাবে দেশের প্রতিটি অংশেই তাদের জনসমর্থন বেশি। পরিমিত পর্যায়ে হলেও তাদের জনসমর্থন অন্টারিও এবং প্রেইরি অঞ্চলে (ম্যানিটোবা ও সাসকাচোয়ান) তিন পয়েন্ট আর আটলান্টিক কানাডায় চার পয়েন্ট বেড়েছে। কুইবেকেও তাদের জনসমর্থন বেড়েছে পাঁচ পয়েন্টের মত।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন অবশ্য ঘটে পশ্চিম কানাডায়। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় লিবারলেদের জনসমর্থন এখন ৩৩ শতাংশ যা ২০১৯ সালের ডিম্বেরের চেয়ে সাত পয়েন্ট বেশি। আলবার্টাতে দলটির সমর্থন বেড়েছে নয় পয়েন্ট। কিন্তু তার পরও তারা সেখানে রক্ষণশীল দলের চেয়ে ৩০ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে।

আসনের বিবেচনায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় সমর্থন বেড়ে যাওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পোল ট্র্যাকারের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিজয়ের জন্য দলটি যত আসন পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিলো এখনকার হিসাবে লিবারেল দল সারাদেশে ১২টি আসন বেশি পেতে পারে আর এর অর্ধেকই আসবে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে।

কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচনে জেতার প্রশ্ন এলে অন্টারিও সত্যিকারের পার্থক্য গড়ে দেয়। গত নির্বাচনের পর থেকে এখানে দলটি সব সময়ই শীর্ষস্থানে রয়ে গেছে এবং এই মুহূর্তে রক্ষণশীল দলের চেয়ে প্রায় ১০ পয়েন্ট এগিয়ে আছে। ম্যানিটোবার কথা ছেড়ে দিলেও শুধু কুইবেক ও আটলান্টিক কানাডা মিলিয়ে লিবারেলরা প্রায় ১৪০ আসন পেতে পারে। একটি সংখ্যালঘু সরকারের পুননির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করার জন্য যা যথেষ্টের চেয়েও বেশি।

লিবারেল দল লাভবান হয়েছে ট্রুডোর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার কারণে। ‘Research Co’-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ট্রুডোর জনপ্রিয়তা এখন ১৫ পয়েন্টের বেশি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে সংস্থার চূড়ান্ত জরিপে তার জনপ্রিয়তা ছিলো ১৩ পয়েন্টেরও কম।

রক্ষণশীলরা কোনও ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি

আলবার্টার ব্যতিক্রমটুকু ছাড়া জরিপের ফলাফলে মনে করার কারণ নেই যে, রক্ষণশীলদের পিছিয়ে পড়া থেকে লিবারেলরা লাভবান হয়েছে। সব দিক বিবেচনায় রক্ষণশীল দলটি ১২ মাস আগে যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই রয়ে গেছে।

কিন্তু সেটি রক্ষণশীল দলের প্রধান এরিন ও’টুল এর জন্য কোনও ভালো বিষয় নয়।২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পর আলবার্টা ও আটলান্টিক কানাডা ছাড়া সর্বত্র দলটির সমর্থন দুই পয়েন্ট বা কিছু কম পাল্টেছে। আটলান্টিক কানাডায় রক্ষণশীল দল চার পয়েন্ট অর্জন করেছে কিন্তু সেখানে এখনও তারা লিবারেল দলের চেয়ে ১৯ পয়েন্ট পিছিয়ে। আলবার্টায় রক্ষণশীল দল আট পয়েন্ট খুইয়েছে।

ওয়েস্টার্ন কানাডায় রক্ষণশীল দলের সমর্থন এখনও অনেকটাই সংহত আছে। আলবার্টায় দলটির সমর্থন ৫৩ শতাংশ এবং প্রেইরি অঞ্চলে ৪৬ শতাংশ। ম্যানিটোবার চেয়ে সাসকাচোয়ানে দলটির সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।

কিছু জরিপে দেখা গেছে, রক্ষণশীল দলের সবচেয়ে ভালো প্রাদেশিক শক্ত ঘাঁটি হিসাবে আলবার্টাকে সরিয়ে দিয়েছে সাসকাচোয়ান।

কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, ম্যানিটোবাতে রক্ষণশীলদের সমর্থন কমে যাচ্ছে। এই জরিপে এই প্রদেশে রক্ষণশীলদের সমর্থন আট পয়েন্ট কমেছে বলে দেখানো হয়েছে। আর উইনিপেগ শহরে লিবারেল দলের সমর্থন ১২ পয়েন্ট বেড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এই শহরে ২০১৯ সালে লিবারেল দলের সমর্থন ছিল মাত্র দুই পয়েন্ট।

লড়াইয়ের মূল ময়দানগুলিতে লিবারেল দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আসার মত শক্তি অর্জনের জন্য রক্ষণশীল দলের প্রধান এরিন ও’টুল এর এখনও অনেক কিছু করার আছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় দলটির অবস্থান এখন তৃতীয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা যাচ্ছে, গ্রেটার টরন্টোতে রক্ষণশীল দল এখনও লিবারেল দলের চেয়ে বেশ বড় ব্যবধানে পিছিয়ে। এখানেই ও’টুল এর নিজের আসন।

কুইবেকে রক্ষণশীল দলের জনসমর্থন মাত্র ১৭ শতাংশ। ২০১৯ সালের তাদের যে অর্জন তা কার্যত অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। যদিও ‘ÔLéger’-এর জরিপ অনুযায়ী, কুইবেক সিটি ও আশেপাশের এলাকায় রক্ষণশীল দল জনসমর্থনে আট পয়েন্ট এগিয়ে আছে, তবু প্রদেশজুড়ে ফরাসীভাষীদের মধ্যে দলটি এখনও অনেক পেছনে, তৃতীয় অবস্থানে।

বি.সিতে এনডিপির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব

জরিপে যদিও দেখা যাচ্ছে জাগমিত সিং-এর এনডিপি গত ১২ মাসে খুব বড় কোনও অগ্রগতি অর্জন করেনি, তবু দেশের কিছু এলাকায় দলটি প্রান্তিকভাবে কিছুটা ভালো অবস্থানে আছে। ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও আলবার্টাতে দলটি দুই পয়েন্ট এবং প্রেইরি অঞ্চলে তিন পয়েন্ট এগিয়েছে। যদিও তারা কুইবেক ও আটলান্টিক কানাডায় কিছুটা পিছিয়েছে।

অবশ্য সাম্প্রতিক বেশ কিছু জরিপ এনডিপির প্রতি অধিকতর আশাবাদের সঞ্চার করে। জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ছয়টি জরিপের মধ্যে পাঁচটিতেই এনডিপির প্রতি ১৯ থেকে ২৩ শতাংশ জনসমর্থন আছে বলে দেখা গেছে। আর অক্টোবরের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে অনুষ্ঠিত ১৭টি জরিপের মধ্যে ১৩টিতে দলটি প্রথম বা দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বলে দেখানো হয়।

ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে গত ২৪ অক্টোবরের নির্বাচনে এনডিপি’র বিজয়ের পাশাপাশি এই বিস্ময়টি ঘটলো। আর এই বিজয় সম্ভবত কোন দুর্ঘটনা নয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার বাসিন্দারা প্রদেশ এবং জাতীয় পর্যায়ের দলগুলোকে আলাদা করার চিন্তা করছেন কিনা তা নিশ্চিত করে বলার কোনও উপায় নেই। এই বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ের দল এনডিপির আপাত অর্জনকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

তবে এনডিপি সত্যিকারের অর্জনের দিকে যাচ্ছে এমন কিছু নির্দেশকও আছে। ‘রিসার্চ কো.’ এর তথ্যমতে, সিং-এর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা দেশের অন্য যে কোনও অংশের চেয়ে বি.সিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। আর সেটা গত সেপ্টেম্বরে যতটা ছিল তার চেয়েও ভালো।

Bloc Québécois ধর্তব্যের বাইরের আসন পেতে পারে কিন্তু জনসমর্থন পাচ্ছে না

Yves-François Blanchet তার দল Bloc Québécois কে সাফল্যের সঙ্গে আবারও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কিন্তু গত নির্বাচনের পর থেকে দলটি খুব বেশি অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।

পোল ট্র্যাকারের জরিপ মতে কুইবেকে দলটির জনসমর্থন মাত্র ৩০ শতাংশের নিচে। সেটি ২০১৯-এর পর সামান্যই পাল্টেছে। ওই নির্বাচনে দলটি ৩২.৫ শতাংশ ভোট ও ৩২টি আসন পেতে সক্ষম হয়। আরেকটি নির্বাচন এলে তাদের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে ওই ৩২টি আসন ধরে রাখতে পারা।

জরিপ প্রতিষ্ঠান ‘Léger’-এর তথ্যমতে, ফরাসীভাষী কুইবেকবাসীর কাছে Bloc Québécois হলো প্রথম পছন্দের দল। এই দলের প্রতি

তাদের সমর্থনের পরিমাণ ৩৮ শতাংশ। কিন্তু গ্রেটার মন্ট্রিলের বাইরে এবং কুইবেক সিটি অঞ্চলে দলটির সমর্থন লিবারেল দলের চেয়ে মাত্র পাঁচ পয়েন্ট বেশি। গ্রেটার মন্ট্রিলের বাইরে তারা লিবারেল দলের চেয়ে ১১ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে। কুইবেক সিটি অঞ্চলে Bloc Québécois পিছিয়ে আছে রক্ষণশীল দলের চেয়ে।

অন্য দলগুলো আসন ছিনিয়ে নেয়ায় সংখ্যালঘু সরকারের প্রতিকূলতা বেড়ে যায়, কিন্তু তাতে হাউজ অব কমন্সে Bloc Québécois এর প্রভাব বাড়ে। কিন্তু অটোয়ায় এই প্রভাব বজায় রাখতে হলে দেশের বাকি অংশে ট্রুডোর দলের যে অর্জন করতে পারে তার মোকাবেলায় Bloc Québécois-কে আরও বেশি আসনে জয় পেতে হতে পারে।

গ্রিন দলের পতন

মহামারির রাজনৈতিক উত্থানের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সম্ভবত গ্রিন পার্টি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে সারাদশে ২.৬ পয়েন্ট জনসমর্থন হারানো দলটি দুটি অঞ্চলে, ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও আটলান্টিক কানাডায় যে ধসের মুখে পড়েছে তা আরও বেশি মারাত্মক।

উভয় অঞ্চলে দলটি পাঁচ পয়েন্ট করে হারিয়েছে এবং তাদের মোট জনসমর্থন এখন মাত্র আট পয়েন্টের মত।