কুইবেকে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মুসল্লিদের স্মরণে ২৯ জানুয়ারীকে জাতীয় স্মরণ দিবস হিসাবে ঘোষণা

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসের ২৯ তারিখে ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেক এর মসজিদে শ্বেতাঙ্গ এক সন্ত্রাসীর গুলিতে যারা নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন তাদের প্রতি সম্মান জানাতে এবং বেঁচে যাওয়াদের সাথে সংহতি প্রকাশ করার জন্য ঐ দিনটিকে এবার ‘জাতীয় স্মরণ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করা হলো। ফেডারেল লিবারেল সরকার এই ঘোষণা দেয়। দিবসটিকে ইসলামোফোবিয়া’র বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও ব্যবহার করা হবে। কানাডার হেরিটেজ মিনিষ্ট্রি থেকে গত ২৮ জানুয়ারী এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। খবর সিবিসি নিউজের।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, “কানাডায় ইসলামোফোবিয়া একটি মূর্তমান এবং নিত্যদিনের বাস্তবতা। আমাদের একটি দায়িত্ব রয়েছে ভুক্তভোগীদের স্মরণ করা এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে এবং একই সাথে কানাডায় অধিকতর একটি অন্তর্ভুক্তমূলক সমাজব্যবস্থা তৈরীর চেষ্টা অব্যাহত রাখা।”

‘জাতীয় স্মরণ দিবস’ এর এই সিদ্ধান্তটি আসলো গত বছর ১ ডিসেম্বর কুইবেকে দুটি স্মারকস্তম্ভ উদ্বোধনের পর। ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেক এর মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্মরণে এই স্মারকস্তম্ভ দুটি স্থাপন করা হয়। এর একটি স্থাপন করা হয় মসজিদের পাশে এবং অন্যটি স্থাপন করা হয় Parc de la Visitation heritage সেন্টারে।

উল্লেখ্য যে, গত ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী সন্ধ্যায় ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মাগরিব নামাজ আদায়কালে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হাতে নিয়ে হামলা চালায়। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন।

মসজিদে মাগরিব নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের উপর হামলা চালানোর পর গাড়িতে করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন আলেকজান্ডার। ঘটনাস্থল থেকে কিছু দুর গিয়ে ২৭ বছর বয়সী ঐ যুবক নিজেই ৯১১ এ কল করে পুলিশ ডাকেন এবং গুলিবর্ষণের ব্যাপারে পুলিশকে সহযোগিতার কথা বলেন। পুলিশ কর্মকর্তারা তার গাড়িতে তল্লাসী চালিয়ে দুটি রাইফেল এবং একটি একে-৪৭ রাইফেল উদ্বার করেন।

২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মুসল্লিদের স্মরণে নবনির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের সামনে কুইবেক সিটি ইসলামিক সেন্টারের সদস্যগণ। ছবি: আলেজান্ডার ডুভাল/ রেডিও কানাডা

হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন :

অধ্যাপক খালেদ বেলকাসেমি : কুইবেকের লাভাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খালেদ বেলকাসেমি (৬০)। তিনি কানাডায় আসেন আলজিরিয়া থেকে।

আজেদ্দিন সুফিয়ান : স্থানীয় এক গ্রোসারীর মালিক আজেদ্দিন সুফিয়ান (৫৭)। তিনি মরোক্কো থেকে কানাডায় আসেন তিন দশক আগে লাভাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র হিসাবে।

আব্দেল করিম হাসান : সরকারের তথ্য প্রযুক্তি কর্মী আব্দেল করিম হাসান (৪১)। কানাডায় এসেছিলেন আলজেরিয়া থেকে।

আবু বকর থাবতি: ৪৪ বছর বয়সী আবু বকর থাবতির। তিনি একটি ফার্মেসীতে কাজ করতেন।

মামাদু তানৌ ব্যারি : গিনি থেকে আসা মামাদু তানৌ ব্যারি (৪২)। তিনি কাজ করতেন স্থানীয় একটি কসমেটিক কোম্পানীর টেকনিশিয়ান হিসাবে।

ইব্রাহিম ব্যারি : ইব্রাহিমও (৩৯) এসেছিলেন গিনি থেকে। কাজ করতেন কুইবেক হেলথ ইন্সুরেন্স বোর্ডে।

কুইবেক শহর এলাকায় শরণার্থীদের স্বাগত জানাতে কাজ করে এমন ফেসবুক গ্রুপ ‘বিয়েনভেন্যু অক্স রিফিউজি-ভিলে ডি কুইবেক’ দাবি করেছে, খুনি আলেকজান্ডার বিসোনেট ‘লে পেন’ পন্থী (লে পেন ফ্রান্সের কট্টরপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টির নেতা। এই দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা নারী বিদ্বেষী এবং চরমভাবে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী) এবং নারীবাদ বিরোধী অবস্থানের জন্য লাভাল ইউনিভার্সিটি এবং সামাজিক মাধ্যমে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী, ডোনাল্ড ট্রাম্প, কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী সমালোচক রিচার্ড ডাউকিনস এবং ক্রিস্টোফার হিচেন্সের পেইজেও তার পেইজ থেকে ‘লাইক’ করা হয়েছে বলে জানা যায়।

ঘটনার পরপরই সেদিন কানাডার শোকার্ত প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, কানাডা এই ঘৃণ্য সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসবে খোলা হৃদয়ে এবং ঐক্যের ডাক নিয়ে। কানাডার পার্লামেন্টে দাড়িয়ে তিনি বলেন, কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে পরিচালিত হামলায় যে ৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে তা সন্ত্রাসী ঘটনা। এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটানো হয়েছে কানাডার বিরুদ্ধে, কানাডিয়ানদের বিরুদ্ধে। তিনি কানাডায় বসবাসরত ১০ লাখ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। কানাডার ৩৬ মিলিয়ন হৃদয় আপনাদের সঙ্গে সহমর্মী। আপনারা জেনে রাখুন আমরা আপনাদেরকে মূল্যায়ন করি। আপনারা কানাডার সমৃদ্ধিতে অবদান রেখেছেন অপরিমেয় ভাবে। আপনরা এ দেশেরই অংশ।

উল্লেখ্য যে, আলেকজান্ডারকে প্রথমে মানসিক রোগী হিসাবে চিহ্নিত করারও চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে তার সাজা কম হয় বা জেল থেকে তিনি মুক্তি পান। পরে আদালতের বিচারক তাকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন এবং ৪০ বছর কোন প্যারলের সুযোগ পাবেনা এ কথাও বলা হয়েছে রায়ে। সেই সাথে এও বলা হয়েছিল যে, “আলেকজান্ডার কুসংস্কার থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তার মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা আছে।”

পরবর্তীতে আলেকজান্ডারের পক্ষে এই রয়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে আপিল কোর্ট আলেকজান্ডারের সাজা ১৫ কমিয়ে দেন। আলেকজান্ডারের আইনজীবী চার্লস অলিভিয়ার এতে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “কুইবেক এবং কানাডায় মানবাধিকারের সম্মানের জন্য এ রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।”

বিচারকের রায়ে সেদিনের হামলার ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অনেকেই হাতাশা প্রকাশ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, যে মাত্রায় অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, রায়ে তার প্রতিফলন ঘটেনি। তাদের মতে, আলেকজান্ডারের আইনজীবী মানবাধিকারের কথা বলেছেন। কিন্তু সেদিন যারা নির্মম ভাবে খুন হয়েছেন এবং যারা আহত হয়েছেন তাদের মানবাধিকার কি রক্ষা হয়েছে? ৬ জন নারী তাদের স্বামী হারিয়েছেন। বিভিন্ন বয়সের ১৭ জন সন্তান চিরতরে হারিয়েছেন তাদের পিতাকে। তাদের মানবাধিকার কি আপিল কোর্ট রক্ষা করেছে?