কানাডিয়ান কর্ম অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ১৪ সপ্তাহের কর্মসূচিতে অংশ নেয়া নবাগত তরুণদের ন্যূনতম মজুরি দিচ্ছে
ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২১
সোনিয়াগান্ধি চিন্নাস্বামী রেজিনায় ডিন রেনউইক স্টুডিওতে ছয় সপ্তাহের ট্রেনিং শেষে খন্ডকালীন চাকরি নিয়ে ফেস মাস্ক সেলাই করেন। কারখানার প্রডাকশন ম্যানেজার ম্যাথিউ ডোনেলি (পেছনে) বলেন, চিন্নাস্বামী ট্রেনিং এর সময় তার দক্ষতা এবং কাজের প্রতি আগ্রহের প্রমাণ দিয়েছেন। ছবি : বনি এ্যালেন /সিবিসি
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ফ্যাশন ডিজাইনার সোনিয়াগান্ধি চিন্নাস্বামী ভারতের একটি অন্যতম বড় শহরের পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে কানাডায় চলে আসেন। তার স্বামী একজন শেফ এবং সাসকাচুনের একটি হোটেলে চাকরি পেয়েছেন।
২৮ বছরের চিন্নাস্বামীকে রেজিনা শহরে নিজের পেশায় কাজ পেতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তিনি জানান, কানাডায় কোনও পরিচিত ব্যক্তির রেফারেন্সের অভাবে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন এবং এক পর্যায়ে এদেশে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ে ভুগতে থাকেন।
তিনি বলেন, “তারা যখন বলতো, কাজের কোনও অভিজ্ঞতা নেই? – কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতা? – তখন কী বলবো ভেবে পেতাম না, কারণ কেউ আমাকে কাজ দিলে তবেই তো অভিজ্ঞতা হতে পারে, তাই না?”
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম সময় আগে কানাডায় আসা নবাগতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সাধারণভাবে অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।
টেক্সটাইল ও ফ্যাশন ডিজাইন বিষয়ে কলেজের ডিগ্রিধারী চিন্নাস্বামী তার ইংরেজি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন, কিন্তু তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, তাকে যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ দেয়া হলে তার দক্ষতা ও কাজের গুণাগুণই নিজেদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।
তিনি যথার্থ বলেছিলেন। ডিসেম্বর মাসে চিন্নাস্বামী রেজিনায় তৈরি পোশাকের জন্য খ্যাত ফ্যাশন হাউজ ডিন রেনউইক ডিজাইন স্টুডিওতে চাকরি করতে শুরু করেন। এর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থে পরিচালিত একটি ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তার জন্য কিছুটা সহায়ক হয়েছে।
সবেতন অভিজ্ঞতা অর্জন
কানাডাজুড়ে ২৭০টিরও বেশি কর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হয়েছে এবং এতে করে যে হাজারও কর্মী উপকৃত হবে বলে আশা করা হচ্ছে চিন্নাস্বামী তাদেরই একজন। অশ্বেতাঙ্গ, নবাগত, প্রতিবন্ধী এবং গৃহহীন ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত লোকজনসহ ৩০ বছরের কম বয়সী যারা জীবনের পথে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার তাদের জন্যই ওইসব কর্মসূচি।
তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে কেন্দ্রীয় সরকার তার যুব কর্মসংস্থান ও দক্ষতা কৌশল (YESS) কর্মসূচির মাধ্যমে গত মার্চে প্রায় পাঁচ শ’ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে।
রেজিনার ওপেন ডোর সোসাইটি নবাগতদের জন্য ১৪ সপ্তাহের কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচি চালানোর জন্য অর্থ চেয়ে আবেদন করে। এই সংস্থাটি এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভের ব্যাপারে অভিবাসী ও শরণার্থীদের সহায়তা দিয়ে থাকে।
সংস্থাটি যখন অংশগ্রহণকারীদের জন্য আট সপ্তাহের প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূটির আয়োজন করে তখন তাদেরকে ন্যূনতম মজুরির সমান অর্থ দেয়। প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে চিঠিপত্র লেখা, সাক্ষাৎকার দেবার বিষয়ে দক্ষতা অর্জন এবং কর্মস্থলের আচরণগত সংস্কৃতি ইত্যাদি। এরপর শুরু হয় কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন সম্পর্কিত ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ। সংস্থাটি নবাগতদেরকে কাজ দেবে এমন সব স্থানীয় কোম্পানিকে ভাড়া করে। এদের জন্য অর্থ দেয় অটোয়া অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার।
রেজিনা ওপেন ডোর সোসাইটির একজন প্রশিক্ষক মিজ. উইলো লোরগা বলেন, তরুণ শরণার্থী ও অভিবাসীদের জন্য কাজে ঢুকতে পারার গুরুত্বটা খুবই অর্থবহ। তিনি বলেন, “কানাডায় চাকরিপ্রার্থীদের জন্য পরিচিত ব্যক্তির তিনটি রেফারেন্স থাকতে হয়। অনেক সময়ই তাদের সেটা থাকে না। প্রশিক্ষণমূলক চাকরিতে ঢোকার ফলে তাদের একটি রেফারেন্স তৈরি হয়, এতে করে কানাডীয় কর্মঅভিজ্ঞতা অর্জিত হয় এবং সামাজিক সংযোগের পথ তৈরি হয়।”
লোরগা বলেন, তিনি প্রাথমিকভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, কোভিড-১৯ মহামারিকালে স্থানীয় কোম্পানিগুলি হয়তো ইন্টার্নিদের কাজে নিতে অনীহ হতে পারে এবং তেমনটা না ঘটায় তিনি স্বস্তি বোধ করছেন।
রেজিনার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি মার্কেটিং ফার্মে তার দুজন শিক্ষার্থী ইন্টার্নি শেষে স্থায়ী চাকরি পেয়েছে।
হাফসা দাগমাস্তার (২৬) ও রাজদ্বীপ কাউর (২৯) দুজন ভারতীয় কমপিউটার প্রোগ্রামার। দুজনেরই কমপিউটার সায়েন্সে ব্যাচেলর ডিগ্রি আছে। মিনহাসের আবার তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিও আছে।
তারপরও কানাডায় আসার পর উভয়কেই নিজেদের পেশায় চাকরি খুঁজে পেতে যথেষ্ট লড়াই করতে হয়েছে।
ফার্মাসি অ্যাসিস্টেন্ট স্বামীর সঙ্গে দুবছর আগে সাসকাচুনে আসা দাগমাস্তার বলেন, চাকরির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি হতাশায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি সব ছেড়েছুড়ে দিতে যাচ্ছিলাম, চাকরি পাবার আশা হারিয়ে যাচ্ছিলো। আমাকে চাকরির ইন্টারভিউর জন্য কেউই ডাকছিলো না। আমার কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতা ছিলো না। আর আমার জীবনবৃত্তান্তেও কিছু সমস্যা আছে।”
এসব কারণে দাগমাস্তার রেজিনা ওপেন ডোর সোসাইটির ইয়েস প্রোগ্রামে ভর্তি হন। তিনি বলেন, একজন কাউন্সিলর তার জীবনবৃত্তান্তের সমস্যাগুলি কানাডীয় কর্মস্থলের সংস্কৃতিমাফিক ঠিকঠাক করে নিতে সাহায্য করেন। এরপর তাকে একটি অনলাইন মার্কেটিং ফার্মে ওয়েবসাইট ডেভেলপার হিসাবে ছয় সপ্তাহের ইন্টার্নশিপে ঢুকিয়ে দেন।
কোম্পানিগুলি ন্যূনতম মজুরির চেয়েও বেশি দেয়
তার নতুন মালিক স্ট্রাটেজি ল্যাব-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা জেফ মেস্ট্রাক এই শহরে আসা নতুন মেধাবিদের খুঁজে নিতে আগ্রহী। তাই তিনি এ ধরণের কর্মীদের তার কাছে পাঠাতে বলেছিলেন রেজিনা ওপেন ডোর সোসাইটিকে। তিনি বলেন, ছয় সপ্তাহের জন্য কর্মীদের সুযোগ দেয়া “আসলে চাকরির জন্য দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণের সহজ একটি উপায়।”
মেস্ট্রাক বলেন, সাধারণভাবে তিনি কারও নিখুঁত জীবনবৃত্তান্তের ওপর আস্থাশীল নন এবং দেখেছেন যে, সেটি কারও চরিত্রের প্রতিফলন ঘটায় না।
তার ভাষ্য, “এটা বলা খুব সহজ যে, আমি এটাতে ভালো, ওটাতে ভালো”… হ্যাঁ, খুব ভালো, কিন্তু যখন প্রশ্ন উঠবে, আপনি মানুষ হিসাবে কেমন, আপনি কতটা কাজের? মানুষের সঙ্গে আপনি কীভাবে কথা বলেন? আপনার সঙ্গে সকালে দেখা হলে কি হেসে কথা বলেন? এসব ছোটখাটো বিষয় কখনই জানা যাবে না, যতক্ষণ না আপনি কর্মস্থলে যোগ দিচ্ছেন।”
সাসকাচুনে এই দুজন ইন্টার্নের জন্য মেস্ট্রাক ন্যূনতম মজুরি অর্থাৎ ঘণ্টায় ১১.৪৫ ডলারের পরিবর্তে ১৫ ডলার করে দিচ্ছেন কারণ তিনি মনে করেন, জীবনযাত্রার জন্য এটাই যুক্তিসঙ্গত মজুরি। তবে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যূনতম মজুরির অর্থই তাকে দেয়।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার যে অর্থ দিচ্ছে তাতে করে তার ছোট্ট কোম্পানির জন্য এ ধরণের কর্মসূচি নেয়াটা কিছুটা কম ঝুঁকিপূর্ণ হয়।
তিনি বলেন, “আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে, কেন্দ্রীয় সরকারের অবদান না থাকলে অনেক কোম্পানির পক্ষেই এমন কর্মসূচি নেওয়া কঠিনতর হবে, শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে যাচ্ছে তা না জেনেই কাউকে ছয় সপ্তাহের জন্য মজুরি দিয়ে যাবো এমনটা কেউ বলতে পারবে না। সরকারের কর্মসূচি না থাকলে কোম্পানিগুলি কীভাবে এমন উদ্যোগ নিতে যাবে আমার জানা নেই। আমি তাদেরকে বলতে চাই, ‘ধন্যবাদ।’”
এখন ইন্টার্নশিপ শেষ হয়ে যাবার পর মেস্ট্রাকের ওয়েবসাইট ডিপার্টমেন্ট দুই কর্মীকেই প্রকল্পের চাহিদা অনুযায়ী যত বেশি সম্ভব ততটাই খণ্ডকালীন কাজ করার সুযোগ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তারা এটিকে সার্বক্ষণিক স্থায়ী চাকরিতে রূপান্তর করতে পারার আগ পর্যন্ত এটি চলবে।
‘আমি এমন সুযোগ পাবো আশা করিনি’
যদি স্ট্রাটেজি ল্যাবে তাদের সার্বক্ষণিক স্থায়ী চাকরি না হয় তাহলে মেস্ট্রাক তাদের জন্য রেফারেন্স হিসাবে কাজ করবেন এবং মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবেন।
আর এই বিষয়টি নিয়ে তিনি রোমাঞ্চিত বলে জানান দাগমাস্তার। তিনি বলেন, “এখন আমি আরও বেশি আস্থাবান বোধ করছি।”
এদিকে, ডিন রেনউইক ডিজাইন স্টুডিওর প্রোডাকশন ম্যানেজার ম্যাথিউ ডোনেলি বলেন, কোনও কর্মীর সঙ্গে সময় না কাটালে সে কতটা নিষ্ঠাবান বা কাজের প্রতি তার নীতিগত অবস্থান কি সেটা অনুমান করা তার জন্যও কঠিন।
ছয় সপ্তাহ ধরে তত্ত¦াবধানের পর তিনি চিন্নাস্বামীর কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট সন্তুষ্ট এবং ইন্টার্ন শেষে তাকে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, “আপনাকে কাজটা ভালোবাসতে হবে। এখানে সত্যিকারের সফল হতে হলে আপনাকে ডিজাইন ভালোবাসতে এবং কাজটা উপভোগ করতে হবে।”
নতুন কাজের জায়গায় চিন্নাস্বামী সপ্তাহে তিন শিফট কাজ করছেন। তবে অর্থনৈতিক অবস্থা এবং মৌসুমের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে তিনি আরও বেশি সময় কাজে আসার প্রতিশ্রুতি দেন।
তিনি বলেন, “আমি সত্যিই, খুব, খুব আনন্দিত কারণ আমি যে এই সুযোগ পাব তা আশাই করিনি।”
-প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় সিবিসি নিউজে। প্রতিবেদক বনি অ্যালেন।