কানাডায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরাও সন্ত্রাসী

‘ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ’ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত হলো কানাডায়

তালেবান, আল-কায়দা ও ইসলামিক স্টেট এর পাশাপাশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে কানাডার

সরকারী তালিকায় নতুন যোগ হলো Proud Boys সহ তেরটি সংগঠনের নাম।

ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২১ শ্বেতাঙ্গ বিশ্বাসী

কানাডার ফেডারেল সরকার শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী ‘Proud Boys’ কে সন্ত্রাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ছবি: অনলাইন থেকে সংগৃহীত

খুরশিদ আলম : কানাডার ফেডারেল সরকার শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী ‘Proud Boys’ কে সন্ত্রাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রাউড বয়েস নামের উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্যদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সম্প্রতি নতুন করে আলোচনায় এসেছিল গত ৬ জানুয়ারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে নজিরবিহীন তান্ডব চালানোর পর। ঐ হামলায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন ‘গণতন্ত্রের বিশ্বমোড়ল’ দাবীদার দেশটির সদ্য বিদায় নেয়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর সেই ইন্ধনে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাউড বয়েস এর সদস্যরাও পুলিশের নিরাপত্তাব্যূহ ভেঙে কংগ্রেস ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ঐ সময় চলে গোলাগুলি, ভাঙচুর ও লুটপাট। হামলার ঘটনায় একজন পুলিশ অফিসারসহ ৫ জনের মৃত্যু ঘটে। 

ফেডারেল সরকার গত ৩ ফেব্রুয়ারী প্রাউড বয়েস সহ মোট ১৩টি চরমপন্থী গ্রুপকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কানাডার এই উদ্যোগ আদর্শিকভাবে অনুপ্রাণিত চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আর কানাডাই প্রথম দেশ যারা প্রাউড বয়েস নামের সংগঠনটিকে সন্ত্রাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করেছে।

কানাডার গ্লোবাল নিউজ জানায়, ১৩ টি সন্ত্রাসী সংগঠন এর মধ্যে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদে বিশ্বাসী দল রয়েছে চারটি। এগুলো হলো- The Proud Boys, Atomwaffen Division, the Base এবং Russian Imperial Movement। আরো যে কটি সংগঠনকে তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামিক স্টেট এর ৫টি অঙ্গ শাখা, আল-কায়দার ৩টি অঙ্গ শাখা এবং হিজবুল্লাহ মুজাহিদিন। সন্ত্রাসী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই সংগঠনগুলোর পক্ষে কানাডায় কোন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো কঠিন হয়ে উঠবে। সরকার কানাডায় এদের কোন সম্পদের খোঁজ পেলে তা জব্দ করতে পারবে।

নতুন এ সংযোজনের ফলে কানাডা কর্তৃক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠনের মোট সংখ্যা দাঁড়ালো ৭৩টি যার মধ্যে ৬টি (৮%) চরম ডানপন্থী সংগঠন। 

ফেডারেল সরকারের নিরাপত্তা মন্ত্রী বিল ব্লেয়ার সাংবাদিকদের বলেন, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তলিকাভুক্তির এই কাজটি বেশ কয়েকমাস ধরেই চলছিল। আর এ কাজটি করা হয়েছে বিভিন্ন প্রমাণ ও গোয়েন্দা তথ্যের উপর ভিত্তি করে এবং আইনের বিধি মেনে। তিনি আরো বলেন, প্রাউড বয়েস এর সন্ত্রাসী কার্যক্রম ২০১৮ সাল থেকেই বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের জন্য।

উল্লেখ্য যে, প্রাউড বয়েস এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করে কানাডার নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) নেতা জাগমিত সিং এই সংগঠনটিকে সন্ত্রাসী দল হিসাবে ঘোষণা করার জন্য ইতিপূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। পরে তিনি পার্লামেন্টে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গত ২৫ জানুয়ারী প্রাউড বয়েস’কে সন্ত্রাসী দল হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাবটি পার্লামেন্টে সব দলের সদস্যদের সমর্থন লাভ করে। কানাডার ফেডারেল সরকারও তখন বলেছিল তারা প্রাউড বয়েস-কে সন্ত্রাসী দলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বিবেচনা করছে।

গ্লোবাল নিউজ ইতিপূর্বে প্রাউড বয়েস এর কানাডা চেপ্টার এর কাছে প্রশ্ন রেখেছিল এটি জানাতে যে, তাদেরকে যে সন্ত্রাসী হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে এ বিষয়ে তাদের কি অভিমত। সেই প্রশ্নের কেন উত্তর তারা দেয়নি। তবে গত জানুয়ারীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে হামলার পর তারা একটি নতুন ওয়েবপেজ খুলে যেখানে তারা দাবী করে যে তারা সন্ত্রাসী দল নয়।

অবশ্য কংগ্রেস ভবনে হামলার সময় সেখানে কানাডার পতাকা হাতে নিয়ে তাদের কয়েকজনকে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।

এই প্রাউড বয়েস এর জন্ম কানাডায়। এর জন্মদাতাও একজন কানাডিয়ান যার নাম গ্যাভিন ম্যাকিনেস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে এদের শাখা। চরম ডানপন্থী, ইমিগ্রেন্ট বিরোধী এবং নারী বিদ্বেষী এই গ্রুপের সদস্যরা সবাই পুরুষ। কানাডিয়ান মিলিটারীর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে “এই প্রাউড বয়েস একটি চরম রক্ষণশীল গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রকাশ্যেই ইসলাম বিরোধী এবং নারী বিদ্বেষী।” গ্লোবাল নিউজ এ সংবাদ জানায়।

গ্লোবাল নিউজের রিপোর্টে আরো বলা হয়, গত ৬ জানুয়ারী কংগ্রেস ভবনে যে হামলা হয় তাতে অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে এই প্রাউড বয়েস এর সদস্যরাও যোগ দেন। এদের হাওয়ায়ী (Hawaii) শাখার নেতাকে অভিযুক্ত করা হয় হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে। অন্যদিকে তাদের জাতীয় নেতা এনরিক টারিও-কেও গ্রেফতার করা হয়।

কিন্তু এর পরও তাদের তৎপরতা থেমে থাকেনি। প্রাউড বয়েস এর ‘টেলিগ্রাম’ চ্যানেলে তারা কংগ্রেস ভবনে হামলা চালানোর বিষয়টিকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রকাশ করেন। এর আগে প্রাউড বয়েস এর জাতীয় নেতা এনরিক টারিও হামলার পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করে বিবৃতি দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। 

উল্লেখ্য যে, কানাডায় প্রাউড বয়েস নামের সংগঠনটি প্রথমে সবার নজরে আসে ২০১৭ সালে। ঐ সময় রয়েল কানাডিয়ান নেভী’র কয়েকজন সদস্য নোভা স্কশিয়া প্রভিন্সের রাজধানী হ্যালিফেক্সে আদিবাসীদের একটি প্রতিবাদ সমাবেশকে পন্ড করার জন্য সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। দিনটি ছিল কানাডা ডে। ঐ দিন হ্যালিফেক্সের স্থানীয় আদিবাসীদের পক্ষ থেকে নোভা স্কাসিয়ার সাবেক গভর্নর এ্যাডওয়ার্ড কর্নওয়ালিস এর (১৭৪৯-১৭৫২) মানবতা বিরোধী অতীত কর্মকান্ডের নিন্দা জানানোর জন্য এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।

এই কর্নওয়ালিস তার সময়ে স্থানীয় অনেক আদিবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন যেটা ছিল গণহত্যার সামিল। স্থানীয় নগর কর্তৃপক্ষও ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে ডাউনটাউনের পার্ক থেকে কর্নওয়ালিস এর একটি ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলে মানবতা বিরোধী তার অতীত কর্মকান্ডের জন্য।

দি কানাডিয়ান প্রেস এর খবরে বলা হয়, কানাডা ডে-তে ঐ সেনা সদস্যরা যখন হ্যালিফেক্সে আদিবাসীদের সমাবেশ পন্ড করার জন্য গিয়েছিলেন তখন তাদের পরনে ছিল কালো রঙ এর পলো সার্ট যাতে ছিল হলুদ রেখা। এই সময় তারা কানাডার আদিকালের Red Ensign Flag হাতে নিয়ে “God Save the Queen” গান গাইতে গাইতে সমাবেশস্থলে হাজির হয়েছিলেন। এরা নিজেদেরকে কানাডার প্রাউড বয়েস (মেরিটাইম চেপ্টারের) এর সদস্য বলে পরিচয় দেন।

উল্লেখ্য যে, কানাডায় প্রাউড বয়েস এর বেশ কয়েকটি শাখা রয়েছে বিভিন্ন প্রভিন্সে। দি কানাডিয়ান প্রেস এক খবর থেকে জানা যায়, টরন্টো, মন্ট্রিয়ল, মেনিটোবা, সাস্কাচুয়ান ও ক্যালগারী-সহ বিভিন্ন স্থানে ৮টি শাখা বা চেপ্টার রয়েছে তাদের।

অন্যদিকে নতুন সন্ত্রাসী তালিকায় নাম উঠা Atomwaffen একটি আন্তর্জাতিক নব্য নাজি সন্ত্রাসী সংগঠন। জার্মানী ভাষায় এর অর্থ হলো পারমানবিক অস্ত্র। ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংগঠনটির জন্ম। পরে এর শাখা কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানীসহ ইউরোপের অন্যন্য দেশে বিস্তার লাভ করে। এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ রয়েছে। এরা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন এথনিক সম্প্রদায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তথ্যদাতা, পুলিশ এবং সরকারী আমলাদের বিরুদ্ধে সহিংস কার্যকলাপ চালানোর ব্যাপারে ইন্ধন যোগায় সমাজকে অচল করে দেয়ার জন্য। সন্ত্রাসী তালিকায় নাম উঠানোর পিছনে এই কারণগুলো উল্লেখ করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। 

The Base নামের সংগঠনটিও নব্য নাজি সন্ত্রাসীদের একটি গ্রুপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর অবস্থান। তবে কানাডায়ও এই সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে। তৎপরতা রয়েছে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং সাউথ আফ্রিকাতেও। এই সংগঠনের একজন সদস্য প্যাট্রিক মেথিউস গত ২০২০ সালের জানুয়ারীতে গ্রেফতার হন য্ক্তুরাষ্ট্রে। তিনি কানাডার সশস্ত্র বাহিনীর একজন সাবেক সৈনিক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একটি ভিডিও রেকর্ড করেন যার মাধ্যমে তিনি হিংস্র বিপ্লব এর আহ্বান জানান এবং শ্বেতাঙ্গবাদের নাম করে আক্রমণ পরিচালনা করতে বলেন। তিনি ঘোষণা দিয়ে বলেন, এটি হলো যুদ্ধের সময়। The Base এর সদস্যরা অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠিকে নিজেদের শত্রু মনে করেন।

শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের তালিকায় অপর যে নামটি এসেছে সেটি হলো The Russian Imperial Movement। এটি একটি রাশিয়ান অতিজাতীয়তাবাদী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ও চরম দক্ষিণপন্থী আধাসামরিক সংগঠন। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ এ এর মূল ঘাটি। তবে দিনে দিনে এটি রাশিয়ার বাইরেও শাখা বিস্তার করছে।

সন্ত্রাসীদের তালিকায় মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার যে সকল সংগঠনের নাম এসেছে তার মধ্যে আছে ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স, ইসলামিক স্টেট ইন দ্যা গ্রেটার সাহারা, ইসলামিক স্টেট ইন লিবিয়া, ইসলামিক স্টেট ইস্ট এশিয়া এবং ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ। এগুলো জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট এর অঙ্গ শাখা।

আল-কায়দার অঙ্গ শাখাগুলো মধ্যে যেগুলো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে আছে, জামাত নূসরাত আল-ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন, ফ্রন্ট ডি লিবারেশন ডু ম্যাকিনা (Front de Libération du Macina) এবং আনসার ডাইন। এছাড়াও আছে হিজবুল্লাহ মুজাহিদিন এর নামও। এটি বিদ্রোহী কাশ্মীরি লিবারেশন গ্রুপ।  

উল্লেখ্য যে, সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ এর নাম কানাডার সরকারী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেও বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে এই নামে কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নেই। বিবিসি’র এক সংবাদে এ তথ্য প্রকাশিত হয়।

তবে গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যেখানে দাবী করা হয় ‘ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ’ এর একজন নতুন প্রধান নির্বাচিত করা হয়েছে। বিবিসি জানায়, ভারতের জি নিউজে কাজ করেন এমন একজন সাংবাদিক একটি টুইটে এই খবরটি দিয়েছিলেন। পুজা মেহতা, যিনি ‘জি নিউজ’ এর সন্ত্রাসবাদ এবং অপরাধ বিষয়ক একজন সংবাদদাতা, তার পোস্ট করা টুইটে বলা হয়েছিল, আইএস বা আইসিস-পন্থী একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে বাংলাদেশে সংগঠনের নতুন আমীর নিয়োগের বিষয়টি ঘোষণা করা হয়েছে। এবং তার নাম ‘আবুল আব্বাস আল বাঙ্গালি’।

কিন্তু বিবিসি জানায়, আন্তর্জাতিক জিহাদি সংগঠনগুলোর তৎপরতার খোঁজ-খবর রাখেন এমন বিশেষজ্ঞরা এই দাবির ব্যাপারে গুরুতর সংশয় প্রকাশ করছেন। সুইডেনে অবস্থানরত বাংলাদেশি লেখক এবং সাংবাদিক তাসনীম খলিল বলছেন, এ নিয়ে গত কয়েক বছরে এমন তিন জনের নাম শোনা গেল, যাদেরকে বাংলাদেশে আইসিস এর নতুন প্রধান বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এসব দাবির কোনটিরই সত্যতা পাওয়া যায়নি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে আইসিস নিজেই বিবৃতি দিয়ে এই দাবির প্রতিবাদ জানিয়েছে।

উল্লেখ্য যে, কানাডাসহ মার্কিন যুুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা একেবারে নতুন কোন বিষয় নয়। অতীতেও দেখা গেছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। আজকে মার্কিন কংগ্রেস ভবনে হামলায় অংশ নেয়া প্রাউড বয়েস-কে কালো তালিকাভুক্ত করেছে কানাডা। কেউ কেউ এই প্রাউড বয়েস’কে অতীতের কু ক্লাক্স ক্লান (Ku Klux Klan ) এর সঙ্গে তুলনা করছেন। কিন্তু কু ক্লাক্স ক্লান ছিল শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের আরো ভয়াবহ একটি সংগঠন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে কু ক্লাক্স ক্লান এর সদস্যরা সাদা আলখাল্লা ও মুখোশ পরে আমেরিকার নিরপরাধ কৃষ্ণাঙ্গদের খুন করা শুরু করে। খুন করা ছাড়া এদের অপতৎপরতার মধ্যে ছিল, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও বোমাবাজি। এরা ক্যাথলিক ও ইহুদী বিরোধী ছিল। একই সঙ্গে অভিবাসী ও কমিউনিষ্টদের ওপর আক্রমণ করত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চরম মানবতা বিরোধী দাসপ্রথা থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মার্কিন ফেডারেল সরকারের সঙ্গে দক্ষিণের ১১ টি অঙ্গরাজ্যের তীব্র সংঘাত চলে। ঐ সংঘাত মার্কিন ইতিহাসে ‘আমেরিকান সিভিল ওয়ার’ নামে পরিচিত। সেই সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধের পর মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিক অধিকার দেওয়া হয়-যে অধিকার থেকে আগে তারা বঞ্চিত ছিল। কিন্তু সেটি মেনে নিতে পারেনি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী আমেরিকানরা। আর তার প্রতিবাদ হিসেবে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার দক্ষিণে কু ক্লাক্স ক্লান নামে একটি গুপ্ত সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে ওঠে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ মার্কিনদের আধিপত্য বজায় রাখা। ক্লানের সদস্যরা ছিল অধিকাংশই প্রোটেস্টান্ট ধর্মের অনুসারী শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নাগরিক।

মাঝে মধ্যে বিরতি দিয়ে কু ক্লাক্স ক্লান এর অপতৎপরতা সত্তরের দশকেও অব্যাহত ছিল। এবং এই কানাডাতেও। বর্তমানে কু ক্লাক্স ক্লান এর অপতৎপরতা হয়তো সেভাবে নেই কানাডায়। কিন্তু তাদের উত্তরসূরীরা বিভিন্ন নামে সেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী তৎপতা চালাচ্ছে। কখনো কখনো সন্ত্রাসেরও আশ্রয় নিচেছ তারা।

এতদিন ধারণা করা হতো হোমগ্রোন মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের কারণে কানাডার জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি পাল্টেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তার উস্কানিতে পরিস্থিতি আরো দ্রুত পাল্টে যায়।

উল্লেখ্য যে, ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা যে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তা যথেষ্ট পরিমাণে বিস্তার লাভ করেছে। আর সন্ত্রাসী কার্যক্রমে তারা ইসলামী জঙ্গীদেরকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে!

মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে ৯/১১ এর ঘটনার পর ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৯ টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে এই চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা। অন্যদিকে এই একই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামী জঙ্গীরা ৭ টি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে।

রিপোর্টে আরো দেখা যায়, ৯/১১ এর পর চরমপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঐ সময় পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪৮ জন। অন্যদিকে ইসলামী জঙ্গী বা সন্ত্রাসীদের হামলায় এই সময়ের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ২৬ জন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক নিউ আমেরিকা নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই তথ্য প্রকাশ করে ২০১৫ সালে।

এদিকে কুইবেকে La Meute Ges Soldiers of Odin নামের দুটি রক্ষণশীল সংগঠন অনেকদিন ধরেই তৎপর হয়ে উঠেছে যাদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী বিদ্বেষ ছড়ানো ও বিশৃংখলা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। এরা এন্টি ইমিগ্রেন্ট ও এন্টি মুসলিম ভাবধারায় বিশ্বাসী। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিম এর পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে এই Soldiers of Odin নামের সংগঠনটি সমস্যা সৃষ্টিকারী। টরন্টোর নিকটবর্তী হ্যামিলটনের সিটি কাউন্সিলর ম্যাথিও গ্রিন অভিযোগ করেন এরা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। কানাডায় Soldiers of Odin এর সদস্য সংখ্যা রয়েছে বর্তমানে প্রায় ৩৫০০।

রয়টার্স এর এক প্রতিবেদনেও বলা হয় Soldiers of Odinএর ওয়েবসাইটে একসময় এরকম বক্তব্য লেখা ছিল যাতে বলা হয়, ইসলামিস্ট অনুপ্রবেশকারীরা এ দেশে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে এবং তাদের কারণে অপরাধের মাত্রাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘মাইগ্রেন্টস নট ওয়েলকাম’ লেখা পোস্টারও দেখা গেছে মিছিলে।

আমেরিকার এন্টি ডিফেমেশন লীগ এর বার্ষিক প্রতিবেদনেও বলা হয়, হোয়াইট সুপ্রিমেসী গ্রুপের সদস্যদের সঙ্গে এই Soldiers of Odin এর সম্পর্ক রয়েছে।

লক্ষ্যনীয় যে, এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নানান ইস্যুতে তৎপর হয়ে উঠেছেন সাম্প্রতিক সময়ে। টরন্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভেঙ্কুভার সহ নানান স্থানে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, র‌্যালী ও সমাবেশ করার চেষ্টা করছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা

আধিপত্যবাদীদের তৎপরতার পর কানাডা এ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে এ কথা ভাবার কোন কারণ নেই।’

সাম্প্রতিককালে কানাডায় এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কানাডার মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সিবিসি নিউজে প্রকাশিত জনাথন মন্টপেটিট এর এক প্রতিবেদনে উল্ল্খে করা হয় “৯/১১ এর পর থেকে কানাডার গোয়েন্দা বিভাগের অধিকাংশ মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয় ইসলামী জঙ্গীদের উপর। কিন্তু আইএস বা আল-কায়দার মত জঙ্গী গোষ্ঠির উপর যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়ে আসছে, ততটা গুরুত্ব  কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এবং রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে না শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উপর।”

২০২০ সালের নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু প্লাটফর্মে ৬৬০০-র বেশি অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে কানাডীয়রা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং এ ধরণের অন্যান্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়লগ (ISD)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ও গত বছর ১২ জুন প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আয়রন মার্চ, ফেসিস্ট ফোর্জ, ফোরচ্যান ও গ্যাব (4chan and Gab) এর মত বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে কানাডার বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী উগ্র সম্প্রদায় সক্রিয়।

সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়, এইসব চ্যানেল, দল ও অ্যাকাউন্ট থেকে তারা বিভিন্ন প্লাটফর্মের এক কোটি ১০ লাখেরও বেশি সংখ্যক ব্যবহারকারীর কাছে চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতে পারছে। সিটিভি নিউজের এক খবরে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, গবেষকরা দেখেছেন, প্রান্তিক সাইট ফোরচ্যান-এর “পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট” নামের একটি বিশেষ মেসেজ বোর্ডে কানাডীয়রা ১৬ লাখেরও বেশি পোস্ট দিয়েছেন। এই বোর্ডে অন্য সব দেশ থেকে যত পোস্ট দেয়া হয়েছে কানাডীয়দের পোস্টের সংখ্যা তার ছয় শতাংশ।

রিপোর্টে বলা হয়, “আমরা দেখেছি যে, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফোরামে কানাডীদের অনেকে অত্যন্ত সক্রিয়। ফোরচ্যান-এর ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ প্লাটফর্ম ব্যবহারের দিক থেকে কানাডীয়রা হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাতি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পরেই তাদের অবস্থান। আবার ‘আয়রন মার্চ’ প্লাটফর্মটি যখন সক্রিয় ছিলো তখন সেটিতেও কানাডীয়রা ছিলো তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবহারকারী সম্প্রদায়।

আইএসডির সিনিয়র রিসার্চ ম্যানেজার এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টের অন্যতম লেখক জ্যাকব ডাভে সম্প্রতি সিটিভিনিউজ.সিএ-কে বলেন, জনসংখ্যার দিকটি বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, আসলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডায় চরমপন্থী ব্যবহারকারীর আনুপাতিক হার বৃহত্তর।

ডাভে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এর ফলে মনে হচ্ছে এটি সত্যিই এমন একটি বিষয় যেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে ব্যবহারকারীদের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে লক্ষ্য করে চরম নোংরা কায়দায় ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছে।”

ডাভে বলেন, “আমরা এটা ধারাবাহিকভাবেই দেখতে পেয়েছি যে, ওইসব প্লাটফর্মে মুসলিমবিরোধী আবেগ এবং মুসলিমবিরোধী ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। টুইটারের এবং ফোরচ্যান-এ ব্যবহারকারীদের কথোপকথন অনুসরণ করে আমরা দেখতে পেয়েছি, অনেক কানাডীয় আছে যারা ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলা সমর্থন করে, এ নিয়ে উল্লাস করে, ওই হামলাকে যৌক্তিক বলে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর আহবান জানায়।”

গত এক দশক বা তারো কিছুটা বেশী সময়ের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সন্ত্রাসীরা কানাডাসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ মাত্রার বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র,কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে।

নরওয়ের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১১ সালে। অ্যান্ডার্স ব্রেইভিক নামের এক শ্বেতাঙ্গ যুবক নরওয়ের রাজধানী অসলোর এক সরকারি ভবনের সামনে বোমা হামলা চালিয়ে ৮ জনকে হত্যা করেন। তারপরই ওই হত্যাকারী স্বয়ংক্রিয় একটি বন্দুক হাতে নিয়ে উটোয়া দ্বীপে গিয়ে হাজির হন। দ্বীপটিতে তখন ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ব্রেইভিক সেই সম্মেললে আগত লোকজনের উপর এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করেন। এতে প্রাণ হারান আরও ৬৯ জন। পরে ব্রেইভিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ।

উল্লেখ্য যে, হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে ইন্টারনেটে প্রায় ১৫০০ পাতার একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করেছিলেন ব্রেইভিক। ঘোষণাপত্রে তার উগ্র শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ভাবনা প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া অভিবাসী ও মুসলিমবিরোধী ধ্যানধারণাও প্রকাশিত হয়েছিল।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে হামলাকারী শ্বেতাঙ্গ যুবক ব্রেন্টন টেরান্ট এই ব্রেইভিকের দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন বলে এক মেনিফেস্টোতে উল্লেখ করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সন্ত্রাসীরা বেশ কিছু হামলা চালায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে এক শিখ মন্দিরে হামলা। ২০১২ সালের ৫ আগস্ট সেখানে শিখ ধর্মাবলম্বীদের একটি মন্দিরে গুলি করে ৬ জনকে হত্যা করেন ৪০ বছর বয়সী ওয়েড মাইকেল পেজ নামে শ্বেতাঙ্গ এক উগ্রবাদী। ঐ সময় এক ধর্মীয় উৎসবের প্রস্তুতি চলছিল মন্দিরে। পরে এক পুলিশ অফিসারের গুলিতে হামলাকারী ওয়েডও নিহত হন। ওয়েড ছিলেন সাবেক মার্কিন সেনা। জানা যায়, মুসলিম ভেবেই ওই হামলাটি করেছিলেন ওয়েড।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে আরেক মর্মান্তক হত্যাকান্ডের ঘটনা। ঐ সময় দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আফ্রো-আমেরিকান গির্জায় হামলা চালিয়ে নয়জন প্রার্থনারত কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন ড্যানিয়েল রুফ নামের এক ব্যক্তি। ড্যানিয়েল ছিলেন একজন স্বঘোষিত শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী।

পরের ঘটনাটি ঘটে ২০১৮ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার পিটার্সবার্গে ইহুদিদের একটি উপাসনালয়ে উপর্যুপরি গুলি চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করা হয়। ‘ট্রি অব লাইফ’ নামে ওই উপাসনালয়ে ৪৬ বছর বয়সী হামলাকারী রবার্ট বোয়ার্স একটি সেমিঅটোমেটিক রাইফেল এবং হ্যান্ডগান নিয়ে গির্জায় ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করেন। প্রত্যক্ষ দর্শীরা জানান, গুলি করার আগে রবার্ট চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘এ মানুষগুলোর জন্যই আমাদের দেশের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। এদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।’

পুলিশ জানায়, হামলার আগে কয়েক দিন ধরেই একটি ওয়েবসাইটে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে পোস্ট দিয়ে আসছিলেন রবার্ট। হামলার আগেও এক পোস্টে তিনি লেখেন ‘আমাদের লোকজনকে হত্যা করা হচ্ছে, বসে থেকে এটি আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। তারপরই গির্জায় ঢুকে হামলা চালান রবার্ট। যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের অনুপ্রবেশে ইহুদিরাই সহযোগিতা করছে বলে মনে করতেন রবার্ট।

যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালে। লাস ভেগাসে একটি গানের অনুষ্ঠানে আগত প্রায় বাইশ হাজার লোকের উপর পার্শ্ববর্তী একটি হোটেল কক্ষ থেকে এলোপাথারী গুলি চালিয়ে ৬১ জনকে হত্যা করেন স্টিফেন ক্রেগ প্যাডক নামের এক শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি। ঐ ঘটনায় আহত হন মোট ৮৬৭ জন যাদের মধ্যে ৪১১ জনই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। পরে হামলাকারী স্টিফেন হোটেল কক্ষেই আত্মহত্যা করেন। তবে স্টিফেন ঐ হামলার ঘটনাটি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে করেছিলেন কি না তা জানা যায়নি।

আর যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাটি ঘটে চলতি সালের ৬ জানুয়ারী। ঐ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ভবনে নজিরবিহীন সন্ত্রাসী তান্ডব চালায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত ব্যক্তিরা। ঐ হামলায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন দেশটির সদ্য বিদায় নেয়া প্রেসিডেন্ট চরম বর্ণবাদী ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শের ধারক ও প্রচারক ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর সেই ইন্ধনে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা কংগ্রেস ভবনের ভেতরে ঢুকে হামলা চালায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ঐ হামলার ঘটনায় একজন পুলিশ অফিসারসহ ৫ জনের মৃত্যু ঘটে। হামলার দিন উগ্রবাদী ঐ শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা ‘যুদ্ধের প্রস্তুতি’ নিয়ে এসেছিলেন এমন বক্তব্য দেন কংগ্রেস ভবনে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজত চারজন কর্মকর্তার মধ্যে তিনজন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারী কংগ্রেসের শুনানিতে অংশ নিয়ে এ তথ্য জানান তারা। কংগ্রেসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স কমিটিতে ঐ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

কানাডায় সবচেয়ে ভয়াবহ শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারী। ঐদিন ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মাগরিব নামাজ আদায়কালে আলেকজান্ডার বিসোনেট নামের এক যুবক অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হামলা চালায়। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন। কুইবেক শহর এলাকায় শরণার্থীদের স্বাগত জানাতে কাজ করে এমন ফেসবুক গ্রুপ ‘বিয়েনভেন্যু অক্স রিফিউজি-ভিলে ডি কুইবেক’ দাবি করেছে, বিসোনেট ‘লে পেন’ পন্থী (লে পেন ফ্রান্সের কট্টরপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট পার্টির নেতা। এই দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা নারী বিদ্বেষী এবং চরমভাবে ইমিগ্রেন্ট বিরোধী) এবং নারীবাদ বিরোধী অবস্থানের জন্য লাভাল ইউনিভার্সিটি এবং সামাজিক মাধ্যমে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী, ডোনাল্ড ট্রাম্প, কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী সমালোচক রিচার্ড ডাউকিনস এবং ক্রিস্টোফার হিচেন্সের পেইজেও তার পেইজ থেকে ‘লাইক’ করা হয়েছে বলে জানা যায়।

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নিউজিল্যান্ডে আরেক হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গ যুবক ব্রেন্টন টেরান্ট। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদ ঘিরে পরিচালিত হয় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা। ঐ হামলায় প্রায় অর্ধশত মুসলিমের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। উল্লেখ্য, ঐ ঘটনার পর ব্রেন্টন টেরান্টকে হাতকড়া পরা অবস্থায় যখন রিমান্ডের জন্য আদালতে হাজির করা হয়, তখন তার মুখে ছিল হাসি এবং হাতের আঙ্গুলের ইশারায় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের প্রতীক। হামলার আগে তিনি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৭০ পৃষ্ঠার একটি ইশতেহারও পাঠিয়েছিল। যাতে তার শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ষড়যন্ত্রসহ চিন্তা ও জিঘাংসার প্রতিফলন ঘটে। এ থেকেই সম্যক বোঝা যায় যে, উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ তাকে কতটা ঠান্ডা মাথার খুনীতে রূপান্তরিত করেছে। এমনকি তিনি উক্ত ইশতেহারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পেরও প্রশংসা করেছেন।

মূলত জঙ্গিবাদ ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ ঘুরে-ফিরে একই বস্তু। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ আর সন্ত্রাসবাদ আলাদা কোন বিষয় নয়। একটির সঙ্গে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বা একে অপরের পরিপূরক। ৯/১১ এর ঘটনার পর থেকে বিশ্বব্যাপী নতুন করে যে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পরেছে তার পিছনে রয়েছে মূলত পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ। আর এই স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে পরাশক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে বাধিয়েছে যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধের কারণেই তৈরী হয়েছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও জঙ্গী সংগঠন। আল-কায়দা, তালেবান, আইএস নামের বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও জঙ্গী সংগঠনগুলো এভাবেই তৈরী হয়েছে। এবং এরই ধারাবাহিকতায় পাশ্চাত্যে বিভিন্ন দেশে তৈরী হয়েছে হোমগ্রোন সন্ত্রাসী।

আল-কায়দা, তালেবান, আইএস-সহ বিভিন্ন নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর কার্যক্রম প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে পাশ্চাত্যের দেশগুলো তাদের নিজেদের আবাসভূমিতে নিরাপদে আছে এমন একটা সন্তুষ্টি নিয়ে বেশ কিছুদিন স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল ঐ সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলোর কিছু অনুসারী

তৈরী হয়ে গেছে তাদের নিজ আবাসভূমিতে যাদেরকে বলা হচ্ছে হোমগ্রোন সন্ত্রাসী। এই হোমগ্রোন সন্ত্রাসীদের জন্ম বা শিশুকাল থেকে বেড়ে উঠা পাশ্চাত্যের দেশুগুলোতেই। তাদের কেউ কেউ ঐ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগ দিতে পারি জমিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে। আবার কেউ কেউ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে অবস্থান করে সেখানেই সন্ত্রাসী হামলা চালানোর চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা-সহ অন্যান্য পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এই হোমগ্রোন সন্ত্রাসীরা প্রধানত এককভাবে বা গুটি কয়েকজন মিলে বেশ কিছু সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের টনক নাড়িয়ে দেয়। যেমন ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বরের প্যারিসের কয়েকটি স্থানে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলায় মারা গেছেন ১২৩ জন। মারাত্মক আহত ৮৯ জনসহ আহত হয়েছেন প্রায় ৩০০ জনের কাছাকাছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সের ইতিহাসে একসঙ্গে এত লোক মারা যায়নি।

ইতিপূর্বে কানাডার রাজধানী অটোয়াতে অবস্থিত পার্লামেন্ট ভবনও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। ঐ হামলায় নিহত হয়েছেন একজন তরুন কানাডীয় সৈন্য। হামলাকারী বন্দুক নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনের ভিতর পর্যন্ত ঢুকে গিয়েছিল। তারও আগে কুইবেকে একজন কানাডীয় সৈন্য নিহত হয়েছেন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে। তিউনিশিয়ার এক মুসলমান যুবক গ্রেফতার হয়েছেন কানাডার ভিয়া (ারধ) রেল সেতু ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করায়। পাকিস্তানী এক মুসলমান যুবক গ্রেফতার হয়েছেন টরন্টোর মার্কিন কনসুলেট অফিস উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করায়। মন্ট্রিয়লের বিমান বন্দর থেকে ১০ জন যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছিল যারা জঙ্গী সংগঠন আই এস এর সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য দেশ ত্যাগ করতে যাচ্ছিল। সন্ত্রাসী সংগঠন আই এস এ যোগ দেওয়ার জন্য ৪ জন বাঙ্গালী তরুণ কানাডা ছেড়েছেন এমন খবরও রয়েছে। কয়েক বছর আগে টরন্টোতে গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৮ জন মুসলমান যুবক যারা পার্লামেন্ট ভবন সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। একদিকে এই হোমগ্রোন সন্ত্রাসীদের অপতৎরতা, অন্যদিকে পাশ্চাত্যে এক শ্রেণীর রাজনীতিকদের উস্কানী মিলে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মনে তৈরী হয়েছে বিভিন্ন ধরণের ফোবিয়া। তারা ভাবতে থাকেন ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ইমিগ্রেন্টরা ক্রমশ তাদের ভূমি, চাকরী, ব্যবসা ইত্যাদি দখল করে নিচ্ছেন। ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে জন্মহার বেশী বলে খুব শীঘ্রই শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিনত হবে। তাছাড়া বহু শতাব্দী ধরে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্ভট এক ধারণা। সেই ধারণা হলো, জগতে তারাই শ্রেষ্ঠ জাতি। এই সমস্ত ধারণা বা ফোবিয়া থেকে তাদের মধ্যে তৈরী হয়েছে হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন পাশ্চাত্য দেশসমূহের উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃবৃন্দ। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার জলজ্যান্ত ও সুষ্পষ্ট উদাহরণ। ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত বিদ্বেষকে উসকে দিয়ে ট্রাম্পের মত আরো অনেকেই ক্ষমতায় যাওয়ার পথ খুঁজছেন। আর তার অবসম্ভাবী পরিনতি হচ্ছে পাশ্চাত্য দেশ সমূহে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়া। আর কানাডাও তা থেকে মুক্ত নয়।