মহামারিকালে কানাডায় নবাগতরাও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে

জুন ১৬, ২০২০

এলভিরা ট্রুগলিয়া : দেশজুড়েই কানাডীয়রা কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব অনুভব করলেও অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডিয়ান স্টাডিজের এক নতুন সমীক্ষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, কিভাবে নব্য কানাডীয়দের জন্য এই মহামারি বিশেষভাবে পীড়াদায়ক।

মহামারির কারণে আর্থিক দিক থেকে যে কঠিন সময় উপস্থিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে যে, অভিবাসীদের কাছে তাদের বাড়িভাড়া, বন্ধকীর কিস্তি দেয়া এবং অন্যান্য আর্থিক দায় মেটানোর মত অর্থও নেই। ইউনেস্কোর কানাডিয়ান কমিশনের মহাসচিব সেবাস্টিয়ান গোপিল বলেন, “কানাডীয়দের স্বাস্থ্য ও তাদের মহামারি সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে জাতিগত পরিচয়, বয়স, জেন্ডার, অর্থনৈতিক অবস্থা, উদ্বাস্তু বা নবাগত হওয়া কিংবা আবাসনের অবস্থা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।”

তিনি বলেন, “যথাযথ নীতি প্রণয়ন ও কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আমাদের ওইসব বিষয় ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে।”

সমীক্ষায় দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত নতুন এবং অনেকটা প্রতিষ্ঠিত অভিবাসীদের মধ্যে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যে এক ধরণের ব্যবধান আছে। পাঁচ বছরের কম সময় ধরে কানাডায় আছেন এমন নবাগতদের মধ্যে ৪৮ শতাংশই নানা ধরণের বিল সময়মত পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। যেখানে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কানাডায় বসবাসকারী অভিবাসীদের মধ্যে এ ধরণের সমস্যায় পড়া লোকের সংখ্যা ৩১ শতাংশ।

বাড়িভাড়া এবং মর্টগেজের কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন নবাগতদের ৪২ শতাংশ। ছবি : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.কম

এদিকে, বাড়িভাড়া এবং মর্টগেজের কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছেন নবাগতদের ৪২ শতাংশ। যেটি অপেক্ষাকৃত প্রতিষ্ঠিতদের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ।

গবেষণায় প্রকাশ, কানাডায় ‘অশ্বেতাঙ্গ’দের অর্থনৈতিকভাবে নাজুক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করার প্রবণতা বাড়ছে। একইসঙ্গে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থিকভাবে নাজুক লোকের সংখ্যাও বেড়েছে।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে আসা ‘অশ্বেতাঙ্গ’ অভিবাসীদের ৭০ শতাংশই এখন নিজের পরিবারকে সাহায্য করতে হিমশিম খাচ্ছে, যেখানে সম্প্রতি আসা ‘শ্বেতাঙ্গ’ অভিবাসীদের মধ্যে একই পরিস্থিতিতে পড়েছে ৪৮ শতাংশ। কানাডায় জন্মগ্রহণকারী অশ্বেতাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদের মধ্যে ব্যবধানের পরিমাণ ৪৬ শতাংশ ও ৩৬ শতাংশের মধ্যে।

এসিএস-মেট্রোপলিসের প্রেসিডেন্ট এবং কোভিড-১৯ সোশাল ইমপ্যাক্ট নেটওয়ার্কের চেয়ারম্যান জ্যাক জাওয়াব বলেন, “সমাজে সব কানাডীয়র আবারও সমভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠা নিশ্চিত করা জন্য সম্পদের বণ্টন, নীতিমালা ও সমন্বিত কৌশল প্রণয়নের জন্য এই তথ্যচিত্র নীতি-নির্ধারকদের জন্য হবে অমূল্য দলিল।”

নাজুক অবস্থায় থাকা শ্রমিকরা আক্রান্ত হতে পারে

মেনিটোবা ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক লোরি উইলকিনসন বলেন, নবাগতরা কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। কারণ আবাসন, উপার্জন, অভিবাসনের স্ট্যাটাস, সহিংসতা বা আতঙ্ক, স্বাস্থ্যবীমা এবং ভাষা সম্পর্কিত বাধাগুলোর মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা তাদেরই বেশি। সহায়ক পেশা বা অস্থায়ী বিদেশি শ্রমিক হিসাবে নাজুক স্বাস্থ্যসেবার পরিবেশে কাজ করার সম্ভাবনা তাদেরই সবচেয়ে বেশি।

মহামারিকালে স্বাস্থ্যঝুঁকি পরিমাপের জন্য উইলকিনসন একটি মডেল দাঁড় করিয়েছেন। এতে তিনি কানাডীয় শ্রমবাজারের শ্রমিকদেরকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন: ঘরে বসে কাজ করা অভিজাত শ্রমিক, প্রয়োজনের শ্রমিক, বেতনহীন শ্রমিক এবং যাদের ‘ভুলে যাওয়া’ হয়েছে।

মিজ. উইলকিনসন বলেন, শেষ ক্যাটাগরিতে পড়েন এমন লোকের সংখ্যা কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। তাদের মধ্যে আছেন মৌসুমি শ্রমিক, আদিবাসী মানুষ, গৃহহীন এবং দীর্ঘমেয়াদে বাড়ির কেয়ারটেকার হিসাবে কর্মরতরা।

তিনি বলেন, ভুলে যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণের ঘটনা বেশি।

প্রকৃতপক্ষে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার খবর থেকে তার বক্তব্যের সারবত্তা বোঝা যায়।

ক্যালগেরির কাছে অবস্থিত কারগিলস মিট প্রসেসিং প্লান্টে সংক্রমণ উত্তর আমেরিকায় কোভিড-১৯ সংক্রমণের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এধরণের কারখানাগুলোতে বেশিরভাগ কর্মচারী হয় অভিবাসী অথবা অস্থায়ী বিদেশি শ্রমিক।

উইলকিনসন বলেন, এসব কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন স্বল্পমেয়াদে কার্যকর হতে পারে। তবে এই মহামারি সেইসব পরিবেশ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করারও সুযোগ এনে দিয়েছে যে কর্মপরিবেশে কিছু মানুষ রোগের কাছে অধিকতর নাজুক হয়ে পড়ছে। এই কর্মপরিবেশকে বিশেষজ্ঞরা অনেক সময় বলেন, “স্বাস্থ্যগত অবস্থার সামাজিক নির্ধারণকারী”। কখনও কখনও নীতির পরিণতি হিসাবে এধরণের পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং তা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার স্বাস্থ্য, ন্যায়বিচার, বৈচিত্র্য ও জনগোষ্ঠী বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মার্ক লেশান্স বলেছেন, এটা স্পষ্ট যে, এই মহামারির সবচেয়ে তাৎক্ষণিক একটি প্রভাব হতে যাচ্ছে এই যে, অভিবাসনে মন্থরতা আসবে।

২০০০ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে অভিবাসী, উদ্বাস্তু, অভিবাসী শ্রমিক এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। অস্থায়ী বিদেশি শ্রমিকরা হলো এখন অভিবাসীদের মধ্যে বৃহত্তম অংশ যাদের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিলো ছয় লাখ। লেশান্স উল্লেখ করেন যে, অভিবাসীদের এক-চতুর্থাংশের কিছু বেশি অর্থাৎ ২৬ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সহায়তা লাভ করেন। আর অভিবাসীরাই হলো মহামারিকালে কানাডার সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় পড়া মানুষদের অংশ।

আশাবাদী হবার কারণ

ওয়ার্ল্ড এজুকেশন সার্ভিসেস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামিরা মাধানি বলেন, নবাগত অনেক অভিবাসীর দুরববস্থার শিকার হওয়া খুবই উদ্বেগের। কিন্তু এমনটা সচরাচর ঘটা ঠিক হবে না।

মাধানির প্রাক্কলন অনুযায়ী ৮০ শতাংশ অভিবাসী কর্মরত। তবে অনেকেই এমন সব কাজে নিয়োজিত যা তার আগের প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

তিনি বলেন, কোবিড-১৯ মহামারি সেই বাস্তবতা পাল্টে ফেলার একটি সুযোগ হতে পারে।

“এই মহামারি হলো অভিবাসীদের জন্য কানাডার অর্থনীতিতে অধিকতর সুষ্ঠুতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারার একটি সুযোগ যেখানে কানাডার বাইরে অর্জিত তাদের দক্ষতা, শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি থাকবে।”

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার মুখ্য পরিসংখ্যানবিদ অনিল অরোরা একমত পোষণ করেন যে, কোভিড-১৯ মহামারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হতে পারে আর্থ-সামাজিক চালচিত্রের পরিবর্তন।

“মহামারি আমাদের সময়ের একটি সীমানা নির্ধারক চ্যালেঞ্জ; এটি আমাদের সবাইকে একসঙ্গে একই দিকে টেনে নিয়ে যাবে। আমরা জানি না, দ্বিতীয় অভিঘাতের চেহারা কেমন হবে, কিন্তু আমরা জানি দ্বিতীয় আরেকটি অভিঘাত আসবেই।”

এসিএস-এর সমীক্ষাটি চালানো হয় মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। এতে অংশগ্রহণ করেন দুই হাজারের বেশি মানুষ এবং পাঁচ ’শয়ের বেশি অভিবাসী। এর ভুল হবার সম্ভাব্য হার হিসাব করা যায়নি।

সৌজন্যে : নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ