টরন্টোতে বাড়ির মূল্যের সীমাহীন উর্ধগতি : যৌথ-মালিকানা হতে পারে সমাধান
মার্চ ১৪, ২০২০
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ডানা ব্রুকম্যান সব সময়ই টরন্টোতে বাড়ি কেনার আকাক্সক্ষা পোষণ করেছেন। কিন্তু আবাসনের বাজার অত্যন্ত চড়া হওয়ায় এই ইচ্ছা পূরণ করা ছিলো প্রায় অসম্ভব।
নগরীর আবাসন খাতের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ব্রুককম্যান বলেন, “বর্তমান বাজারে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটি সত্যিকারের লজ্জাজনক। আমি আমার প্রজন্মের কাউকে দেখিনি যে নিজের জন্য একটি বাড়ি কিনতে পেরেছে।”
কয়েক বছর আগে সহ¯্রাব্দের প্রজন্মের এই শিক্ষক তার সঙ্গী এবং একটি সন্তানকে নিয়ে এক রুমের একটি বেসমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়ায় থাকতেন। কিন্তু বাড়িভাড়াও তাদের জন্য ছিলো অত্যধিক। এই প্রেক্ষাপটে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু অর্থ পান। কিন্তু এককভাবে একটি বাসস্থান কেনার ব্যয় সঙ্কুলানের জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল না। ৩৫ বছর বয়সী ব্রুককম্যান জানতেন তার বোনও উত্তরাধিকার সূত্রে অর্থ পেয়েছেন। আর তখনই ঘটনার চাকা ঘুরতে শুরু করে।
ডানা ব্রুকম্যান বলেন, “আমাদের দুজনের কারও পক্ষেই নিজের বাড়ি কিনতে পারার সম্ভাবনা ছিল না। কারণ বাড়ির জন্য ডাউন পেমেন্ট দেওয়ার মত যথেষ্ট অর্থ আমাদের কারোরই ছিলো না। তবে যৌথভাবে আমরা সেটা করতে পেরেছি।”
বড়বোন ডানা ব্রুকম্যান সত্যিই চেয়েছিলেন নিজের টরন্টোর মহল্লায় বসবাস করতে। তাই তিনি যৌথ মালিকানায় বাড়ি কেনার সুবিধাগুলো তুলে ধরে একটি পাওয়ার-পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করেন।
ছোটবোন মিরিয়াম ব্রুকম্যান (৩০) স্বীকার করেন যে, “আমরা আগে কখনই এ বিষয়ে ভাবিনি। আমরা সত্যি সত্যিই এই নগরে বসবাস করতে এবং পারিবারিকভাবে কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি।”
এটা ছিলো সেই সময়, যখন তারা উভয়েই কানাডার এই বৃহত্তম শহরে যৌথভাবে একটি বাড়ির মালিক হবার সম্ভাবনার বিষয়ে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। এই যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে বাড়ি কেনার ধারণাটি সম্প্রতি অন্টারিও সরকার এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
চলতি মাসের আরও আগের দিকে, এই প্রদেশের সরকার যৌথ মালিকানা সম্পর্কিত একটি সমন্বিত গাইডলাইন প্রকাশ করে। এতে ধারণা দেওয়া হয় যে, এটি তরুণ ও বয়স্ক লোকেদের জন্য বাড়ি কেনা সহজ করতে, সম্ভাব্য ক্রেতাদের বাজেট সম্প্রসারণ এবং নগরীর চলমান আবাসন সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
এই ধরণের যৌথ ব্যবস্থাপনায় সাধারণত দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একটি বাড়ির মালিক হন এবং একসঙ্গে বসবাস করেন। তারা বাড়ির কিছু সুবিধা যেমন কিচেন, বাড়ির পেছনের অংশ, লিভিং রুম ইত্যাদি যৌথভাবে ব্যবহার করেন এবং তাতে কিছু ব্যক্তিগত জায়গাও থাকে।
এক্ষেত্রে দায়-দায়িত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মালিকরা যৌথভাবে বহন করেন, এর ফলে বাড়ির মালিকানার জন্য ব্যয় হওয়া অর্থ ভাগাভাগি হয়ে যায়।
টরন্টোর রিয়েল এস্টেটের ব্রোকার রাইয়ান রবার্টস বলেন, তিনি দেখেছেন, মার্কেটে আসার জন্য অনেক সময় ভাইবোন মিলে বাড়িঘর কিনছে। হাফপোস্ট কানাডা পত্রিকাকে তিনি বলেন, “এটা এমন এক প্রক্রিয়া যা ভবিষ্যতে খুব ভালোভাবেই অব্যাহত থাকবে। এখানে কিছু বিষয় আছে যেগুলো সুস্পষ্টভাবে ঠিকঠাক করে নিতে হয়, যেমন, শতকরা হারে খরচের ভাগ করে নেওয়া অথবা রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি।”
প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছেন যে, এধরণের বাড়ির মালিকানার জন্য এর ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আইনগতভাবে লিপিবদ্ধ করা খুব জরুরী। তাতে বাড়ির সংস্কার ও ট্যাক্স ইত্যাদিসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ কীভাবে হবে, বাড়িটি কীভাবে ব্যবহার করা হবে এবং যে কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হবে সবকিছুই লিখিত থাকতে হবে। যৌথ মালিকানার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একজন পেশাদার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ তা না করলে ভবিষ্যতে গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ব্রæকম্যান নামের দুই বোনের জন্য এটি ছিলো অর্থবহ। তারা দুজনেই বিবাহিত। তবে তারা যে বাড়িটি কিনেছেন তাতে দুটি ইউনিট ছিলো যেটিকে তারা তিনটি অংশে ভাগ করেন। উপরের ফ্লোর নেন বড় বোন, তার স্বামী ও তাদের বাচ্চা। নিচের ফ্লোর নেন ছোটবোন ও তার সঙ্গী। আর বেসমেন্ট ভাড়া দেন কিছু বাড়তি আয়ের জন্য। এক পর্যায়ে একই ছাদের নিচে তারা ছয় থেকে সাতজন মানুষ বসবাস করেন। তাদের জন্য এতে কোনও সমস্যা হয়নি। তবে তারা মানেন যে, সবার ক্ষেত্রে এ ধরণের ব্যবস্থা যুৎসই নয়।
ডানা বলেন, “আমার মনে হয়, এমন কারও সঙ্গে এধরণের ব্যবস্থাপনায় যাওয়া উচিৎ যাকে আপনি খুব ভালো করে চেনেন। আমাদের আরও এক বোন আছে, কিন্তু তার সঙ্গে এটা কোনওভাবেই সম্ভব ছিলো না।”
৯৯ শতাংশ সমমনা দুটি দম্পতি এমন ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে এলেও এখানে এমন কিছু সিদ্ধান্তের ব্যাপার থাকে যেখানে বড় রকমের আপসরফা করতে হয়, কারণ পরবর্তী সময়ের দাম ভাগাভাগির প্রশ্ন এলে অনেকেই তেমন সুখি হতে পারে না। যেমন, তাদেরকে যখন বলা হয় যে তিন বছরের মধ্যে তাদের বাড়ির ছাদ পাল্টাতে হবে তখন তাদেরকে করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাদেরকে বন্ধকির টাকাও সমানভাবে ভাগ করে নিতে হয় যদিও হয়তো একটি দম্পতি অন্য দম্পতির চেয়ে বেশি জায়গা ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে।
বড় বোন ডানা বলেন, “আমাদেরকে অনেকবার ঘরোয়া মিটিং করতে হয়েছে এবং সমস্ত বিষয়গুলো আলোচনা করে নিতে হয়েছে। আপনাকে বোঝাপড়া করার সর্বোচ্চ ইচ্ছা রাখতে হবে।”
যৌথভাবে বাড়ি কেনা দুই দম্পতিকে বড় ধরণের সংস্কার কাজের ভেতর দিয়েও যেতে হয়। তখন তাদেরকে একই ফ্লোর শেয়ার করতে হয়। এটিকে তারা বলেন, সাময়িকভাবে একজনের ওপর আরেকজনের বসবাস।
ডানা বলেন, “এসব সংস্কার ছিলো খুবই খারাপ। তবে এটি হলো সমাপ্তির দিকে যাওয়া। কাজটা করে ফেলুন, দেখবেন এক সময় যেমনটা চেয়েছিলেন সেভাবেই শেষ হয়েছে।”
সংস্কারের কারণে তারা যে অস্বাভাবিকভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে নেয়, উভয় পরিবারই সেটা ভালোভাবেই পেরিয়ে আসে। ডানা মিরিয়ামের দায়িত্ব নেন। যার ফলে মিরিয়ামের পক্ষে অল্প দূরে নিজের জায়গা কিনে নেওয়া সম্ভব হয়। তারা যৌথভাবে কেনা যে বাড়িতে তিন বছর বসবাস করেন সেটির দাম এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়। এর ফলে তাদের বিরাট লাভ হয় এবং তারা উভয়েই নিজের বাড়ির মালিক হতে সক্ষম হন।
বড় বোন ডানা বলেন, “এটি সত্যিই একটি বড় সমাধান হতে পারে। আমরা এখনও খুবই ঘনিষ্ঠ।”
তবে যৌথ-মালিকানা সবার জন্য নয়।
ডানা হাফপোস্টকে বলেন, “প্রত্যেকের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেওয়াটা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। আমি নিশ্চিত নই যে, এ ধরণের আয়োজনে যেরকম দ্ব›দ্ব নিরসনের দক্ষতা ও যোগাযোগ থাকার দরকার হয় তা এখনকার বেশিরভাগ বাচ্চার আছে।”
“আপনি যদি ইতিবাচকভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হবেন বলে ১০০ ভাগ নিশ্চিত না হন তাহলে কখনই যৌথ মালিকানার দিকে যাবেন না।”
ছোটবোন মিরিয়ামও ডানার বক্তব্যে সায় দিয়ে পরিস্থিতিটাকে কখনও “কৌশলী” বলে বর্ণনা করেন।
“যারা পরস্পরকে ভালোভাবে জানেন না তারা যদি এ ধরণের উদ্যোগে এগিয়ে আসেন তাহলে তাদেরকে অনেক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হবে। তাদেরকে খুবই সহজ সরল মনের অধিকারী হতে হবে এবং তাদের সফলতার জন্য অনেককিছু আইনগতভাবে লিখেপড়ে নিতে হবে।”
রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে জড়িত লোকেরাও আপনাকে একই কথা বলবে, কারণ একটি বাড়ি কেনার সঙ্গে অনেক সত্যিকারের ঝুঁকি জড়িয়ে থাকে। সেটা আপনি একাই কেনেন বা যৌথভাবে।
কোনও বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিলে সরকারের সুপারিশ হলো পেশাজীবীদের সহায়তা নেওয়া এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী জটিলতাগুলো এড়িয়ে সমস্যার সমাধান বের করে দেওয়া।
তবে বাড়ির মালিক হওয়া যদি আপনার লক্ষ্য হয়, তাহলে ‘ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয়’। বিশেষ করে যদি সাধ্যের মধ্যে থাকা, বাড়ির অবস্থান এবং স্থানীয় কমিউনিটির দিকটি আপনার বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়।
মিরিয়াম বলেন, চারজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বাড়ির নানা ধরণের বিল পরিশোধ করছে এবং বেসমেন্ট ভাড়া দেওয়া হয়েছে এমতাবস্থায় বাড়িটি ছিলো “সত্যিই সাধ্যের মধ্যে।” কিন্তু বর্তমানের প্রতিযোগিতামূলক সময়ে দুই বোনের পরামর্শ হলো আপনি যদি বাড়ির মালিক হতে চান তবে অন্য সম্ভাব্যতার ব্যাপারেও খোলা মনে ভেবে দেখতে হবে।
মিরিয়াম স্বীকার করেন যে, “এটি অবশ্যই বাড়ি কেনার একটি ভালো উপায়। যদি আপনি টরন্টোতে বসবাস করতে চান তাহলে আপনাকে সৃজনশীল হতে হবে।”
-সৌজন্যে : জন রুমলে, হাফপোস্ট