টরন্টোতে নিজের মা, বাবা, বোন ও নানীকে নৃশংসভাবে খুন করার জন্য ক্ষমা চাইলেন সেই মিনহাজ
নভেম্বর ৩, ২০২০
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : নিজের মা, বাবা, বোন ও নানীকে নৃশংসভাবে খুন করার জন্য মিনহাজ জামান আদালতে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি বিশেষভাবে ক্ষমা চাচ্ছি যারা আমার পরিবারকে জানতেন এমন লোকদের কাছে। গত ২৬ অক্টোবর ভার্চুয়াল আদালতে সাজার শুনানিকালে অন্টারিওর পিটারবরোর নিকটবর্তী সেন্ট্রাল ইস্ট কারেকশনাল সেন্টার থেকে তিনি এই ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এর আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর মিনহাজ তার পরিবারের চার সদস্যকে হত্যা করার কথা স্বীকার করেন। তার বিরুদ্ধে তিনটি ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার ও একটি সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডার এর অভিযোগ আনা হয়।
ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার প্রমানিত হলে স্বয়ংক্রিয় যাবজ্জীবন সাজা হয়ে যায় অপরাধীর এবং ২৫ বছরের জন্য পেরোলের কোন সুযোগ থাকে না। একাধিক ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার হলে সাজার সময়কাল আরো বৃদ্ধি পায়।
ভার্চুয়াল আদালতে সাজার শুনানিকালে আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বিচারকের কাছে আহ্বান জানানো হয় মিনহাজ যেন একটি সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের জন্য ১৫ বছর এবং তিনটি ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডারের জন্য ২৫ বছর প্যারোলের অযোগ্য থাকে। অর্থাৎ মিনহাজ ৪০ বছরের মধ্যে প্যারোলের জন্য আবেদন করতে পারবে না।
সরকারী আইনজীবী কে. জে. স্টুয়ার্ড বলেন, মিনহাজ কর্তৃক এগুলো ছিল ভয়াবহ, রাক্ষসী ও নির্মম হত্যাকান্ড। এই হত্যাকান্ডগুলো ঘটেছে এমন এক বাড়িতে যেখানে ভিক্টিমরা মিনহাজের সঙ্গে থাকতেন। একটি বাড়িকে মনে করা হয় নিরাপদ, সুরক্ষিত ও পবিত্র জায়গা। আর সেই বাড়িতে যে পরিবার গড়ে উঠে সেই পরিবার আপনাকে রক্ষা করে, আপনার যত্ন নেয়, আপনার সাথে ভাল সময় ভাগ করে নেয়, আপনাকে বিশ^াস করে, জীবনের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে আপনাকে সমর্থন করে। কিন্তু মিনহাজ এই নিরাপদ বাড়ি আর পরিবারের নীতি ও আদর্শের সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা করেছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর উপায়ে এবং নির্মমভাবে হত্যা করেছে একজনের পর একজনকে।
আদালতে উপস্থাপন করা বিবৃতি থেকে জানা যায় মিনহাজ প্রথমে তার মাকে হত্যা করে বেলা ৩টার সময়। তার প্রায় ঘন্টাখানেক পরে হত্যা করে তার নানীকে। বাড়িতে তখন অন্য কেউ ছিল না। দুই জনকে হত্যা করে মিনহাজ ভিডিও গেম খেলতে বসে। এক ফাঁকে একটু ঘুমিয়েও নেয় এবং অপেক্ষা করতে থাকে তার বোন ও বাবার জন্য। তার বোন যখন রাত ১১টায় কাজ থেকে ফিরে তখন তাকেও হত্যা করে মিনহাজ। এর ঘন্টাখানেক পর তার বাবা বাড়িতে আসলে তাকেও হত্যা করে সে।
ময়না তদন্তের রিপোর্টে বলা হয়, চারজনকেই প্রথমে শাবল জাতীয় কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। আঘাতের পর মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাদেরকে গলা কেটে হত্যা করা হয়।
ভার্চুয়াল আদালতে ভিডিও টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে সাজার পরবর্তী শুনানি আগামী ২ নভেম্বর হওয়ার কথা।
উল্লেখ্য যে, নৃশংস এই হত্যাকান্ডগুলো ঘটে ২০১৯ এর ২৮ জুলাই রোববার বিকেল ৩টার দিকে টরন্টোর মারখাম উপ-শহরের ক্যাসেলমোর এভিনিউয়ের বাড়িতে। নিহতরা হলেন- মিনহাজ এর নানী ফিরোজা বেগম (৭০), মা মমতাজ বেগম (৫০), বাবা মনিরুজ জামান (৫৯) এবং বোন মালেছা জামান (২১)। এরা সবাই ক্যাসেলমোর এভিনিউর এই বাড়িতেই থাকতেন।
অবাক কান্ডে মানুষ বিস্ময়াভিভূত হয়। তবে তারও একটা সীমা থাকে। কিন্তু টরন্টোর উত্তরে অবস্থিত মার্কহাম সিটির বাঙ্গালী যুবক মিনহাজ এর ভয়াবহ নৃশংসতা সেই সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে! সকলেরই এক প্রশ্ন এটা কি করে সম্ভব? এতটা নৃশংস এতটা নির্দয় এবং এতটা পাষাণহৃদয় একজন মানুষ কি করে হয়?
নিজের জন্মদাত্রী মা, জন্মদাতা বাবা, আদরের ছোট বোন, শ্রদ্ধেয়া নানী সবাইকে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনামাফিক ঠান্ডা মাথায় এভাবে হত্যা করা কি করে সম্ভব হলো? আর কি কারণেই বা এই ভয়াবহ হত্যাজজ্ঞ?
ইয়র্ক পুলিশের মুখপাত্র প্যাটেনডেন সে সময় গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, রোববার বেলা ৩টায় তাদের কাছে একটি ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, মার্কহাম সিটির ১০০৬ নম্বর ক্যাসেলমোর এভিনিউয়ের বাড়িতে কিছু মানুষ আহত হয়ে পড়ে আছেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বাড়ির দরজায় এক যুবককে দেখতে পায় এবং তাকে গ্রেফতার করে। এই যুবকই মিনহাজ জামান এবং তিনি পুলিশের কাছে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
হত্যাকান্ডের পর টরন্টোর বিভিন্ন মিডিয়াতে যখন খবরটি আসে তখনও প্রবাসী বাংলাদেশীরা বুঝে উঠতে পারেননি যে হতভাগ্য এই পরিবারটি বাংলাদেশী। কারণ বিস্তারিত কিছুই বলা হয়নি নিউজে। পরের দিন যখন নিহতদের ছবি ছাপা হয় মিডিয়াতে এবং একই সঙ্গে যখন এই পরিবারের পরিচিত কয়েকজন ফেসবুক এ ম্যাসেজ দেন তখন একে একে সবাই জানতে পারেন যে হত্যাকারী এবং হত্যাকান্ডের শিকার সকলেই বাংলাদেশী এবং এক পরিবারের সদস্য তারা।
অনলাইন পত্রিকা ারপব.পড়স জানায় মিনহাজের এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের খবর প্রথম জানতে পারেন তার কিছু অনলাইন বন্ধু। এদের মধ্যে একজন হলেন আইয়ুব। তিনি মিনহাজের একটি ম্যাসেজ দেখতে পান যাতে লেখা আছে, “আমি আমার পরিবারে সবাইকে হত্যা করেছি এবং খুব সম্ভব আমাকে আমার বাকি জীবন জেলে কাটাতে হবে যদি আমি বেঁচে থাকি।”
আইয়ুবের তখন মাত্র ঘুম ভেঙ্গেছে। সে মিনহাজকে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি এসব কি বলছ!
মিনহাজ এরপর আইয়ুবকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি ছবি দেখতে চাও?
এরপরই মিনহাজ আইয়ুবকে কিছু ছবি পাঠায়। ছবিতে দেখা যায় মিনহাজের পরিবারের সদস্যরা ফ্লোরে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায় এবং তাদের গলা কাটা। মিনহাজের আরো কয়েকজন অনলাইন বন্ধু এই তথ্য এবং ছবিগুলো পায়। এরা সবাই ‘ঠড়রফ চবৎভবপঃ ডড়ৎষফ’ নামের একটি অনলাইন ভিডিও গেম এর সদস্য।
পরে বিষয়টি পুলিশকে জানায় তারা। এবং পুলিশ এসে মিনহাজকে গ্রেফতার করে।
মিনহাজ তার অনলাইন বন্ধুদের সঙ্গে যে সকল তথ্য শেয়ার করেছিলেন তা থেকে জানা যায় তিনি টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম বছরেই তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দেন। তবে বিষয়টি তিনি তার পরিবারের কাউকে জানাননি। দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে তিনি
ডিপ্রেশনেও ভুগতে থাকেন। ঐ সময় তিনি নাস্তিক হয়ে উঠেন এমন তথ্যও তিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করেন। আর সেই সময় থেকেই তিনি পরিকল্পনা করতে থাকেন বাবা মা বোন ও নানীকে খুন করার। মিনহাজ লেখাপড়া ছেড়ে দিলেও বাড়ি থেকে নিয়মিত বের হতেন ইউনিভার্সিটির নাম করে। ঘরে বাবা মা’কে বলতেন ক্লাশ খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য হয় না। তাই দুপুর নাগাদই তিনি বাড়ি চলে আসেন।
বাড়ি থেকে বের হয়ে মিনহাজ যেতেন মলে। সেখানে ঘুড়ে বেড়াতেন। একটি কমিউনিটি জিমনেশিয়ামেও যেতেন তিনি। কিন্তু চার বছর পর যখন ইউনিভার্সিটি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে কনভোকেশন বা সার্টিফিকেটের কথা। তিনি তখন বাড়িতে জানান যে এ বছর জুলাই মাসের ২৮ তারিখে তার গ্রাজুয়েশন ডে। এবং সেই ২৮ তারিখের মধ্যেই তিনি তার হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কারণ তা না হলে তার এতদিনের প্রতারণা ফাঁস হয়ে যাবে। এভাবেই মিনহাজ তার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন।