জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ড : বর্ণবাদ ঐতিহাসিক ভাবেই আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, আইন এবং মনোভাবে গ্রথিত হয়ে আছে
যুগে যুগে বর্ণবাদ কলুষিত করেছে মানবজাতিকে : এখন সময় এসেছে পরিবর্তনের
জুন ১৬, ২০২০
খুরশিদ আলম : মানুষ আধুনিক হয়েছে। অনেক অগ্রসর হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। কিন্তু আজো অনেক মানুষ মুক্ত হতে পারেনি যুগ যুগ ধরে চলে আসা বর্ণবাদের অপরিচ্ছন্ন ও কলুষিত মানসিকতা থেকে। যুগে যুগে এই বর্ণবাদের ভয়ঙ্কর থাবা কলঙ্কিত করেছে মানবজাতিকে। আজো করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের শিকার জর্জ ফ্লয়েডের মর্মান্তিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা আবারো প্রমাণ হলো।
বর্ণবাদের কোন দেশ কাল নেই, সেই সীমানা। সব দেশে, সব অঞ্চলে, সব সমাজেই ঘৃণ্য এই বর্ণবাদ প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বিদ্যমান ছিল এবং বিদ্যমান আছে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এই বর্ণবাদ। বর্ণবাদ দাবিয়ে রেখেছে সমাজের এক অংশের মানুষকে। শোষণ নির্যাতন ও নিপীড়ন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিঃস্ব করে রেখেছে তাদের।
বিশ্বে বর্ণবাদের শিকার শুধু কৃষ্ণাঙ্গরা নন। সব দেশে সব সমাজেই দুর্বলের উপর সবলের বর্ণবাদী আচরণ, সংখ্যা লঘুর উপর সংখ্যাগুরুর বর্ণবাদী আচরণ, দরিদ্রের উপর ধনীর বর্ণবাদী আচরণ লক্ষ্য করা যায়।
গত ২৫ মে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক আফ্রিকান-আমেরিকানকে গ্রেপ্তারের পর তাকে প্রকাশ্যে রাজপথে শ^াসরোধ করে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। হত্যাকান্ডের বিষয়টি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা। এর পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। আর সেই বিক্ষোভ মিনেসোটা থেকে ছড়িয়ে পরে গোটা আমেরিকায়। তার ঢেউ এসে লাগে কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরেও। এই প্রতিবেদন তৈরীর সময়ও গোটা আমেরিকা ও কানাডা জুড়ে চলছিল তীব্র বিক্ষোভ। বর্ণবাদ বিরোধী এই বিক্ষোভে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ যাদের মধ্যে ছিলেন সাদা-কালো ও বাদামী সবাই। এমনকি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো-ও নিহত জর্জ ফ্লয়েডের স্মরণে মাটিতে হাঁটু গেড়ে ৮:৪৬ মিনিট নিরবতা পালন করেন অটোয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে। ঐ দিন পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই দেহরক্ষী দ্বারা বেষ্টিত এবং কালো মাস্ক ব্যবহার করে রাজধানী অটোয়ায় পার্লামেন্টের সামনে শুক্রবার ‘নো জাস্টিস’, ‘নো পিস’ সমাবেশে উপস্থিত হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। বিক্ষোভকারীদের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বলে স্লোগানের সময় ট্রুডো হাত তালি দিয়ে সমর্থন জানান।
এই সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সোমালি বংশোদ্ভূত (কৃষ্ণাঙ্গ) ফ্যামিলি মিনিস্টার আহমদ হোসেন। আহমদ হোসেন ইতিপূর্বে কানাডার ইমিগ্রেশন মিনিস্টারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন কোন সরকার প্রধান হাঁটু গেড়ে সম্মান প্রদর্শন করেন এবং ‘ব্ল্যাক লাইভস মেটার’ স্লোগানের সময় হাততালি দিয়ে সমর্থন জানান।
উল্লেখ্য যে, জর্জ ফ্লয়েডের ঘরের উপর হাটু চেপে ৮:৪৬ মিনিট বসে ছিলেন শে^াতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেক চাওভিন। এই সময় জর্জ বার বার আকুতি জানাচ্ছিলেন তার ঘারের উপর থেকে হাটু সরিয়ে নিতে। কারণ তিনি শ্বাস নিতে পারছিলেন না। বার বার ‘I can’t breath’ বলার পরও পুলিশ জর্জ এর ঘাড়ের উপর থেকে হাটু সরাননি। এই সময় ঐ ডেরেক চাওভিন এর সহায়তায় ছিলেন আরো তিন পুলিশ সদস্য।
পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর জনগণের বিক্ষোভকে সমর্থন জানিয়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক চার প্রভাবশালী প্রেসিডেন্টও। তারা হলেন- ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্বসূরী বারাক হোসেন ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন ও জিমি কার্টার। পৃথক বক্তৃতা ও বিবৃতিতে তারা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
কান্ডজ্ঞানহীন ও চরম বর্ণবাদী মনোভাবসম্পন্ন বর্তমান প্রেসিডেন্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন একের পর এক উস্কানীমূলক বক্তব্য দিচ্ছিলেন এবং সেনাবাহিনী নামিয়ে বিক্ষোভ দমনের হুমকী দিচ্ছিলেন তখন এক বিবৃতিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ লেখেন, তিনি ও তার স্ত্রী লরা বুশ দেশে চলমান দমন ও নিপীড়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন। তিনি আরও লেখেন, এটাই সময়, দেশের বঞ্চিত ও নিপীরিতদের দৃষ্টি দিয়ে ব্যর্থতাকে নিরীক্ষণ করা। আর এর চেয়ে আরো ভালো উপায় হলো, সহানুভূতি, প্রতিশ্রুতি, সাহসী পদক্ষেপ ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শান্তি।
অন্যদিকে জাতিগত নিধনও এর সমাধান প্রসঙ্গে ভার্চুয়াল এক আলোচনা সভায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মার্কিনিদের অনিশ্চয়তা ও কষ্টের দিকগুলো তুলে ধরেন। দাসত্বের ইতিহাস থেকে বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ পর্যন্ত কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে তিনি কীভাবে দেখেন, তা ব্যাখ্যা করেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এক বিবৃতিতে বলেছেন, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্বপ্ন ছিল কোনো মার্কিনিকে তার গায়ের রঙ দিয়ে বিচার করা হবে না, যা আজ অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু বুঝিয়ে দেয় যে, একজন মানুষের বর্ণপরিচয় নির্ধারণ করে দেয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এক বিবৃতিতে বলেন, জনগণের শক্তি ও নৈতিক বিবেক সম্পন্ন মানুষকে অবশ্যই বর্ণ বৈষম্যমূলক পুলিশ,বিচার ব্যবস্থা,সাদা ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ডের পর দশদিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও করোনার এই মহামারীকালে জনতার বিক্ষোভ সমানতালেই চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বিভিন্ন শহরে। যুক্তরাষ্ট্রে কারফিউ ভেঙ্গে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে আসেন। ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও পুলিশি অ্যাকশনের মধ্যেও বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন ফ্লয়েডের হত্যায় ন্যায় বিচার চাওয়া আন্দোলনকারীরা।
সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ২৫ মে দিনের বেলায় ফ্লয়েডকে হত্যা করা হলেও রাত থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভের প্রথম দিন থেকে ৪ জুন বৃহস্পতিবার (১০ দিন) পর্যন্ত ১০ হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক ফ্লয়েড হত্যায় চার পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হলেও শভিনকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে ফ্লয়েডকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ডেরেক শভিনের সঙ্গে থাকা অপর তিন পুলিশ কর্মকর্তা- টমাস লেইন, আলেকজান্ডার কুয়ং ও টু থাওয়ের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু করা হয়।
কিন্তু প্রতিবাদকারীরা এতে সন্তুষ্ট হয়নি। চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই হত্যার অভিযোগ আনার দাবি তুলে বিক্ষোভ চালিয়ে আসছিলেন তারা। পরে তদন্ত শেষে ওই চার পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই অপরাধের অভিযোগ এনেছেন সরকারি কৌঁসুলিরা। শভিন ছাড়া বাকি তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ফ্লয়েডকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্ত ঐ তিন পুলিশ কর্মকর্তা ফ্লয়েডকে হত্যার সহযোগিতার দায় মাথায় নিয়ে আদালতে হাজির হলে আদালত তাদেরকে জেলে পাঠায়।
শভিনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ৪০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। অন্যদিকে শভিনের সঙ্গে থাকা অপর তিন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সেকেন্ড-ডিগ্রি মার্ডারে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদেরও সর্বোচ্চ ৪০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।
উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ চলাকালে জনতা মার্কিন সিক্রেট সার্ভিসের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে কিছুক্ষণের জন্য আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য ট্রাম্প পরে বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়ার কথা অস্বীকার করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন কভিড-১৯ মহামারীতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। কিন্তু মরণব্যাধী করোনার ভীতি লোকজনকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। রাস্তা নেমে এসে দিনের পর দিন বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন লোকজন। অধিকাংশ বিক্ষোভকারীকেই অবশ্য মাস্ক পরে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিক্ষোভকারী মাস্ক ছাড়াই বিক্ষোভে অংশ নেন। এতে করে কভিড-১৯ সংক্রমণের হার আবারো বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা করছেন চিকিৎসকগণ। তারা বিক্ষোভে অংশ নেয়া ব্যক্তিদেরকে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
বিক্ষোভাকারীদেরকে মাস্ক পরার আহ্বান জানিয়েছেন কানাডার প্রধান জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার তেরেসা টাম-ও। কারণ, এখানেও বিশেষ করে অন্টারিও এবং কুইবেক প্রভিন্সে কভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা কমছেনা। দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে বৃদ্ধির হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেকটাই কম।
জুন মাসের ৫ তারিখে কানাডার প্রধান প্রধান শহরগুলোতে বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ ও মিছিলের আয়োজন করা হয়। এ দিন অটোয়া পার্লামেন্ট হাউজের সামনে বর্ণবাদ বিরোধী সমাবেশে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কিছুুটা সমালোচনারও মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ, তিনি মাস্ক পরা থাকলেও সমাবেশ স্থলে সারাক্ষণ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারেননি। আর সমাবেশ স্থলে অনেকেই মাস্ক ছাড়া ছিলেন। তিনি নিজে বার বার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলে নিজেই তা অনুসরণ করছেন না এমন অভিযোগ উঠেছে। প্রধান বিরোধী দলের নেতা এন্ড্রু শিয়ার-ও সমাবেশে যাওয়ায় কড়া সমালোচনা করেছেন জাস্টিন ট্রুডোর।
জাস্টিন ট্রুডো সমাবেশে গিয়ে কিছু লোকের সঙ্গে করমর্দনও করেছেন। যেটা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বার বার নিষেধ করা হয়ে আসছে। অন্যদিকে অন্টারিওতে এখনো বড় ধরণের সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। লকডাউনের কারণে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রতিদিনই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে প্রভিন্সে। এমন অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নিজে কি করে প্রায় চার হাজার লোকের বৃহৎ এক সমাবেশে যোগ দিলেন সেই প্রশ্ন অনেকেই তুলছেন। ট্রুডো অবশ্য এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিনি সমাবেশে গিয়েছিলেন তার সমর্থন জানানোর জন্য এবং কমিউনিটি লীডার ও কৃষ্ণাঙ্গ কানাডিয়ানরা কি বলতে চাচ্ছেন তা শুনার জন্য। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রয়োজনে তিনি কভিড-১৯ টেস্ট করাতে প্রস্তুত এরকম বড় একটি সমাবেশে যোগদান করায়।
জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডের পর অটোয়া ছাড়াও বর্ণবাদ বিরোধী সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে টরন্টো, মন্ট্রিয়ল ও ভেঙ্গুভারে। তবে এসব সমাবেশই হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। শুধু মন্ট্রিয়লে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। বর্ণবাদ বিরোধী এই সমাবেশ ও মিছিলে যোগ দিয়েছেন এনডিপি লীডার জাগমিত সিং-ও। টরন্টোর পুলিশ প্রধান মার্ক স্যান্ডার্স বর্ণবাদ বিরোধী সমাবেশে যোগ দিয়ে হাঁটু গেড়ে সন্মান জানিয়েছেন জর্জ ফ্লয়েডের প্রতি। উল্লেখ্য যে, টরন্টোর পুলিশ প্রধান নিজেও একজন কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের সদস্য। তবে তার স্ত্রী একজন শে^তাঙ্গিনী।
জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডের পর কানাডায় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো যে ভাবে সমর্থন জানিয়েছেন, বিরোধী দল এনডিপি নেতা জাগমিত সিং যে ভাবে সমর্থন জানিয়েছেন এবং টরন্টোর মেয়রসহ পুলিশ প্রধান যে ভাবে সমর্থন জানিয়েছেন তাতে করে এ কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে কানাডায় বর্ণবাদের স্থান নেই। কিন্তু সত্যি কি তাই?
না। সত্যি নয়। সিবিসি নিউজ জানায়, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজেই বলেছেন, বর্ণবাদ শুধু আমেরিকার সমস্যা নয়। কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী মনোভাব কানাডায়ও বিদ্যমান। আমাদেরকে আরো কাজ করতে হবে কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যে পদ্ধতিগত বর্ণবাদী আচরণ হচ্ছে তা প্রতিহত করার জন্য। তিনি বলেন, আমরা যদিও বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে অনেকদূর এগিয়েছি কিন্তু এই সমস্যাটি এখনো কানাডায় রয়ে গেছে।
তবে অন্টারিও প্রভিন্সের প্রিমিয়ার প্রথমে দাবী করেছিলেন, কানাডায় যুক্তরাষ্ট্রের মত অন্তর্নিহিত ও পদ্ধতিগত বর্ণবাদ নেই। শে^তাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চাওভিন এর হাতে জর্জ ফ্লয়েড নিহত হওয়ার পর তিনি এ দাবী করেছিলেন। কিন্তু তার এই বক্তব্যে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরে তিনি তার আগের বক্তব্য থেকে সরে এসে স্বীকার করেন যে, কানাডায় অবশ্যই পদ্ধতিগত বর্ণবাদ রয়েছে। কিন্তু এ কথা তিনি কতটা মন থেকে বলেছেন তা বলা কঠিন।
উল্লেখ্য যে, প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড গত প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে চরম ডান পন্থীদের পছন্দের প্রার্থী ছিলেন। এই চরম বর্ণবাদী ফ্যাসিস্টদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ড্যাগ ফোর্ড অন্টারিওতে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের বর্ণবাদী কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিবেন যেমনটা দিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজ দেশে।
হাফিংটন পোস্ট, কানাডা’র এসোসিয়েট এডিটর ডেভিড মাস্ট্রাচি তার এক কলামে এই দাবী করেন। তিনি আরো জানান, Alt-right এবং the Proud Boys নামের শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী দুটি গ্রুপ ফোর্ডকে একবার মাসের শ্রেষ্ঠ Proud Boy এর খেতাব দিয়েছিল। ড্যাগ ফোর্ড অন্যান্য চরম শ্বেতাঙ্গ সংগঠনেরও সমর্থন পেয়েছিলেন নির্বাচনের আগে।
ডেভিড মাস্ট্রাচি তার কলামে আরো লিখেন, ফোর্ড এর জন্য চরম ডানপন্থীদের এই ভালোবাসা অনভিপ্রেত নয় কোনমতেই। ফোর্ড বর্ণবাদী Rebel Media -র অনুষ্ঠানে গত বছর জুন মাসে বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। এই মিডিয়ার প্রাক্তন উপস্থাপক হলেন Andrew Lawton. তিনি এই মত পোষণ করে যে যেহেতু জার্মানী অবারিত ভাবে শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার নীতি অনুসরণ করেছে সেজন্যে ওই দেশের মেয়েরা ডিজার্ভ করে ধর্ষিত হবার। আর এরকম একজনকেই ফোর্ড চাকরীতে নিয়োগ দান করেছেন।
উল্লেখ্য যে, কানাডায় সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন রক্ষণশীল গোষ্ঠি ও দলগুলো বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আর সেই সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের বর্ণবাদী কার্যক্রমও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চরম বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তা বেশ লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে। কানাডায় একটি চরম রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলেরও আভির্ভাব ঘটেছে যার নাম ‘পিপল’স পার্টি অব কানাডা’। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন কনজার্ভেটিভ পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা ম্যাক্সিম বার্নিয়ার। চরম রক্ষণশীলতা, ইমিগ্রেন্ট ও মুসলিম বিরোধীতার জন্য ইতিমধ্যেই তিনি বিতর্কের শীর্ষবিন্দুতে উঠে এসেছেন। গত ফেডারেল নির্বাচন প্রাক্কালে চরম রক্ষণশীল দল পিপল’স পার্টি অব কানাডার প্রধান ম্যাক্সিম বার্নিয়ারের ছবি সম্বলিত এক বিলবোর্ড এর বক্তব্য নিয়ে চরম বিতর্ক শুরু হয়েছিল। সুদৃশ্য ঐ বিলবোর্ডে লেখা ছিল ‘Say NO to Mass Immigration’। ভেঙ্গুভার, ক্যালগারী, হ্যলিফেক্স, টরন্টো এবং রিজাইনাতে এই বিলবোর্ড সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
কানাডার সাবেক জননিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী র্যাল্ফ গুডেল ইতিপূর্বে বলেন, ডানপন্থী, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ও নব্য নাৎসি গ্রুপগুলো কানাডীয়দের জন্য ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়। এসব গ্রুপ ইহুদি-মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উস্কে দেয় যা সহিংসতা এবং অন্য ধরনের অপরাধের মধ্যে পরিস্ফুট।
সিটিভি’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে কানাডায় ঘৃণাজনিত অপরাধ (হেইট ক্রাইম) ৪৭ শতাংশ বেড়েছে। মূলত মুসলিম, ইহুদি ও কৃষ্ণাঙ্গরা এই অপরাধের লক্ষ্যবস্তু। স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাবমতে ২০০৯ সালের পর থেকে এটি সর্বোচ্চ মাত্রার ঘৃণাজনিত অপরাধ।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুসলমানদের লক্ষ্য করে ২০১৭ সালে ঘৃণাজনিত অপরাধ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের লক্ষ্য করে ঘৃণাজনিত অপরাধ ৫০ শতাংশ বেড়েছে। বেড়েছে ইহুদিদের বিরুদ্ধেও ঘৃণাজনিত অপরাধ।
ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমসের নির্বাহী পরিচালক ইহসান গার্দি বলেন, ঘৃণাজনিত অপরাধ বৃদ্ধির সংখ্যা দেখে তাঁরা মর্মাহত।
পাশের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমবিদ্বেষ বেড়ে চলছে। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অ্যান্টি-হেইট নেটওয়ার্কের বোর্ড মেম্বার আমিরা এলঘাওয়াবি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দিক দিয়ে আসা উত্তাপ থেকে কানাডাও মুক্ত নয়।
আর তার প্রমাণও দেখা গেছে ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে কুইবেকের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞে। চরম বর্ণবাদী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কুইবেকের এক তরুণ আলেকজান্ডার বিসোনেট ইসলামিক কালচারাল সেন্টার অব কুইবেকে মুসল্লিদের উপর অতর্কিতে স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হামলা চালান। বন্দুক হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ৬ জন মুসল্লি। হামলার ঘটনায় আহত হন আরো ১৯ জন। মুসল্লিরা ঐ সময় মাগরিবের নামাজ আদায় করছিলেন। ৯/১১ এর পর কানাডায় মুসলমানদের উপর এরকম নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলা আর হয়নি।
কানাডায় মুসলমানদের উপর হামলার ঘটনা ইতিপূর্বেও ঘটেছে বেশ কিছু। এর মধ্যে আছে মসজিদ ভাঙ্গচূড়, আগুন লাগিয়ে দেয়া, আপত্তিকর দেয়ালচিত্র অঙ্কণ, মসজিদের দেয়ালের গায়ে বর্ণবাদী শ্লোগান লিখে রাখা, মসজিদ প্রাঙ্গণে শুকরের কাটা মাথা নিক্ষেপ, হিজাব/নিকাব পরিহিতা মুসলমান মহিলাদের উপর
হামলা, বর্ণবাদী মন্তব্য করা ইত্যাদি। তবে এই সমস্ত হামলায় কোন প্রাণহানি ঘটেনি। মারাত্মক জখম বা আঘাতপ্রাপ্ত হননি কেউ।
উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারের প্রধান দরজার সামনে কে বা করা শুকরের একটি কাটা মাথা র্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়িয়ে রেখে যান। তাতে একটি স্টিকারও সংযুক্ত ছিল যাতে লেখা ছিল, Bon appétit যার ইংরেজী অর্থ হলো Enjoy your meal. তার কিছুদিন পর ঐ এলাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয় যাতে লেখা ছিল এই ইসলামিক সেন্টারটি জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ঐ সব ঘটনার পর ইসলামিক সেন্টার কর্তৃপক্ষ তাদের ভবনের চারপাশে ও ভিতরে সিকিউরিটি ক্যামেরা বসান। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। ভয়াবহ এক হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হলো স্থানীয় মুসল্লিদেরকে। ইসলামিক সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ লাবিদি তখন বলেছিলেন, নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের অতিব প্রধান উদ্বেগের বিষয় ছিল। কিন্তু কি হলো শেষ পর্যন্ত?
উল্লেখ্য যে, কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কুইবেকে রক্ষণশীল বর্ণবাদীদের তৎপরতা অনেক বেশী। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি বর্ণবাদী রক্ষণশীল গ্রুপের অতিতৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে সেখানে। এর মধ্যে আছে Soldiers of Odin এবং La Meute। এরা কট্টরভাবে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রাদায় ও ইমিগ্রেন্ট বিরোধী। এবং একই সাথে মুসলিম বিরোধী। অবশ্য প্রকাশ্যে তারা এ অভিযোগ স্বীকার করেন না। কিন্তু তাদের কার্যক্রমই প্রমাণ করে তারা মুখে বলেন এক কথা আর কাজে করেন তার উল্টোটা। Soldiers of Odin এর মূল উৎপত্তি হলো ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডের Soldiers of Odin এর কার্যকলাপে অনুপ্রাণিত হয়ে কুইবেকের রক্ষণশীলদের একটি গ্রুপ এখানে একটি চ্যাপ্টার খুলেছেন। কানাডায় Soldiers of Odin এর সদস্য সংখ্যা রয়েছে বর্তমানে প্রায় ৩৫০০।
Soldiers of Odin এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা হোয়াইট সুপ্রিমেসী গ্রুপের কেউ নন। Soldiers of Odin কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী, ইমিগ্রেন্ট বিরোধী অথবা মুসলিম ইমিগ্রেন্ট বিরোধী এ জাতীয় অভিযোগও অস্বীকার করেন তারা। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে সরকার কর্তৃক মুসলিম দেশ থেকে ইমিগ্রেন্ট গ্রহণ করায় তারা বেজায় অখুশী। হ্যামিলটনের সিটি কাউন্সিলর ম্যাথিও গ্রিন বলেন, এই গ্রুপটি এন্টি মুসলিম বা এন্টি ইমিগ্রেন্ট সেন্টিমেন্ট এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
Soldiers of Odin এর মত এরকম আরেকটি গোষ্ঠি আছে যার নাম La Meute। সিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কানাডায় ইসলামী মৌলবাদ বিকাশের ব্যাপারে La Meute এর সদস্যরা আতংকিত। ফেসবুকে তাদের সদস্যের সংখ্যা এখন ৪৩ হাজারেরও বেশী। কুইবেকে তাদের উপস্থিতি ও তাদের রক্ষণশীল অভিব্যক্তি এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। ফেসবুকে তারা যে সকল তথ্য ও পোস্ট আদান প্রদান করছেন তার মধ্যে আছে হালাল পণ্য বর্জন করার আহ্বান, সরকারের মাল্টিকালচারালইজম পলিসির বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করা, কুইবেকে ইসলামী ব্রাদারহুডের প্রভাব সম্পর্কে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া ইত্যাদি।
La Meute এর প্রতিষ্ঠাতাগণ মনে করেন কুইবেক হলো উত্তর আমেরিকায় ইউরোপীয় সভ্যতার প্রধান কেন্দ্রস্থল। কিন্তু সেই কুইবেক এখন ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস থেকে সংযোগহীন হয়ে গেছে। আর এ কারণেই এখানে ইসলামী মৌলবাদ তার কালো হাত প্রসারের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
এদিকে কুইবেক সিটির ইসলামিক সেন্টারে বন্দুক হামলার পর এই প্রভিন্সের তৎকালীন প্রিমিয়ার ফিলিপ কুইয়ার্ড নিজেই স্বীকার করেন যে কুইবেকে জেনোফোবিয়া এবং বর্ণবাদে বিশ্বাসী অপদেবতারাও বাস করেন। তিনি বলেন কুইবেকের খোলা এবং সহনশীল সোসাইটি নিয়ে আমাদের প্রসন্ন থাকলে চলবে না।
কানাডায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী তৎপরতা শুরু হয় মূলত ৯/১১ এর পর। এর আগেও ছিল। তবে তার মাত্রা ছিল কম। ৯/১১ এর পর মাত্রা অনেক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী মনোভাব ছিল বহু কাল আগে থেকেই। আর সেইসব দিনে বর্ণবাদী যে সব তৎপরতা ছিল সেগুলো ছিল অতি ভয়ঙ্কর। স্মরণ করা যেতে পারে যে শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীরা KKK (KKK stands for Knights of the Ku Klux Klan, a group of white, Christian supremists) নামের এক বর্ণবাদী সংগঠনের অধীনে অতীতে ভয়াবহসব নৃসংশতা চালিয়েছেন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে। সেই সময় তাদের টার্গেট ছিল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠি। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে গুলি করে হত্যা করার পাশাপাশি ঘরের ভিতর আটকে রেখে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটিয়েছেন এরা। আজকে তাদের উত্তরসূরীরা নর্থ আমেরিকায় মুসলিম সম্প্রদায়সহ অন্যান্য সাউথ এশিয়ান, মিডল ইস্টর্ন ও আফ্রিকান অঞ্চল থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামী বর্ণের ইমিগ্রেন্ট এবং রিফিউজিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছেন এবং সমাবেশ ও মিছিল করছেন।
সাম্প্রতিককালে কানাডায় এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের বর্ণবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কানাডার মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতেও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। সিবিসি নিউজে প্রকাশিত জনাথন মন্টপেটিট এর এক প্রতিবেদনে উল্ল্লেখ করা হয় “৯/১১ এর পর থেকে কানাডার গোয়েন্দা বিভাগের অধিকাংশ মনোযোগ নিবদ্ধ করা হয় ইসলামী জঙ্গীদের উপর। কিন্তু আইএস বা আল-কায়দার মত জঙ্গী গোষ্ঠির উপর যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়ে আসছে, ততটা গুরুত্ব কানাডিয়ান সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস এবং রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এর পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে না বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের উপর।”
কিন্তু গুরুত্ব আরোপ করার মতো একটি বিষয় হলো – উত্তর আমেরিকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুধু ইসলামী জঙ্গীরাই চালাচ্ছেন তা সত্য নয়। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরমপন্থী ও বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরাও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সাম্প্রতিককালে তাদের কার্যক্রম যথেষ্ট পরিমাণে বিস্তার লাভ করেছে। শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে তারা ইসলামী জঙ্গীদেরকেও পিছনে ফেলে দিয়েছেন! ২০১৫ সালের ২৮ জুন টরন্টো স্টার এ প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে এই তথ্য জানা যায়।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে ৯/১১ এর ঘটনার পর এ পর্যন্ত ১৯ টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন এই বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা। অন্যদিকে এই একই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামী জঙ্গীরা ৭ টি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন।
৯/১১ এর পর বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪৮ জন। ঐ বছর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে গত ১৭ জুন সাউথ ক্যারোলিনায় অবস্থিত একটি চার্চে যেখানে গণহত্যার শিকার হন ৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসী। চরম বর্ণবাদী এক শ্বেতাঙ্গ যুবক এই গণহত্যার নায়ক। অন্যদিকে ইসলামী জঙ্গী বা সন্ত্রাসীদের হামলায় এই সময়ের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন ২৬ জন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক নিউ আমেরিকা নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই তথ্য প্রকাশ করে।
কানাডায় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় যখন তখন বর্ণবাদের শিকার হন পুুলিশ কর্তৃকও। দেখা গেছে টরন্টোতে পুলিশ যখন তখন যেখানে সেখানে পথচারীদের গতিরোধ করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দেয়। এই জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ার সময় আক্রমণাত্মক প্রশ্নও করে পুলিশ। ব্যাপারটা এমন নয় যে আটককৃত ব্যক্তি কোন অপরাধ করেছেন। আর এই জিজ্ঞাসাবাদের প্রধান শিকার হন কৃষ্ণাঙ্গ কানাডিয়ানরা। এ কারণে অনেকেই পুলিশের এই জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়াকে ((carding policy) বর্ণবাদী আচরণ বলে মনে করছেন এবং এই প্রক্রিয়াটিকে বন্ধ করার দাবী জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন থেকেই।
টরন্টোর সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামী জনগোষ্ঠিই যে দীর্ঘদিন থেকে অশোভন এই প্রথাটি বাদ দেওয়ার জন্য দাবী জানিয়ে আসছেন তা নয়। রাজনীতিবিদ, নাগরিক অধিকার আদায়ের নেতৃবৃন্দ, আইনী কতৃপক্ষ এবং সাবেক একাধিক মেয়রও এই ক্ষতিকারক প্রথাটি বাতিল করার পক্ষে কথা বলে আসছেন।
উল্লেখ্য যে, কানাডার সাবেক অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী আহমেদ হুসেন বলেছেন, তিনি নিজে কানাডায় বর্ণবাদী আচরণের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। আহমেদ হুসেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ কানাডিয়ান। ইতিপূর্বে হ্যালিফ্যাক্স-এ লিবারেল দলের এক কনভেনশনে হুসেন বলেন, তরুণ বয়সে তিনি বর্ণবাদী আচরণ দেখেছেন। “একদিন সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরুলে পুলিশের গাড়ি জোরে ব্রেক কষে তার সামনে এসে থামে এবং নিছক গায়ের রং কালো বলেই পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।”
সোমালিয়া থেকে কানাডায় আসা হুসেন বলেন, “এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য মোটেই নতুন কিছু ছিলো না, একজন পুলিশ অফিসার আমার কাছে আসেন এবং জিজ্ঞাসা করেন তুমি কোথায় যাচ্ছ, তোমার পকেটে কি আছে, তুমি কোথায় থাকো? আরও পরে একটি মুদি দোকানে আমাকে হেনস্তা হতে হয়, আমাকে অনুসরণ করা হয়, কারণ আমার গায়ের রং কালো।”
এগুলোকে ‘মনোবল দুর্বল করে দেওয়ার মতো’ ঘটনা হিসাবে বর্ণনা করে হুসেন বলেন, তিনি এসব বিষয় মোকাবিলা করতে শিখেছেন। তবে অন্যান্য দেশের মতো কানাডায় বর্ণবাদ এখন আর সেভাবে বিদ্যমান নেই উল্ল্লেখ করে হুসেন বলেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কানাডাকে আরও অনেক কিছু করতে হবে। তিনি বলেন, “প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, আপনি যখন এ ধরণের অভিজ্ঞতার কথা ভাবেন তখন আপনি অনুধাবন করতে পারেন যে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে আমাদেরকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। আর এইসব বিষয়ে অবশ্যই কথা বলতে হবে কারণ আমাদের অনেকের জন্যই এটি একটি বাস্তবতা।”
কানাডায় কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণ বহুকাল আগে থেকেই যেমন ছিল, তেমনি ছিল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইয়লা ডেসমন্ড এর নাম এখন অনেকই জানেন। কারণ তার প্রতিকৃতি এখন কানাডীয় ব্যাংক নোটে ছাপা হচ্ছে। তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণের একজন তীব্র প্রতিবাদকারী।
ডেসমন্ডকে একদিন জোর করে সিনেমা হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত এলাকায় আসন গ্রহণ করার জন্য। তিনি বৈধ টিকিট নিয়েই প্রবেশ করেছিলেন সিনেমা হলে। সময়টা ছিল ৮ নভেম্বর, ১৯৪৬ সাল। ঐ সময় তাঁকে বলা হয় তিনি যেহেতু কৃষ্ণাঙ্গ তাই তিনি মেইন ফ্লোরের কোন আসনে বসে মুভি দেখতে পারবেন না। কারণ সেটি শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত। তাঁকে বসতে হবে বেলকনির কোন আসনে। ৩২ বছর বয়সী ভাইয়লা ডেসমন্ড বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেন এবং বেলকনির আসনে না গিয়ে মেইন ফ্লোরের আসনেই গিয়ে বসেন যে স্থানটি শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। থিয়েটার কর্তৃপক্ষ ডেসমন্ডকে ঐ স্থান থেকে সরে যেতে বললেও তিনি সরে যান নি। এরপর পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেফতার করে এবং ঐ রাতটি তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। পরের দিন তাঁকে আদালতে নেয়া হলে বিচারক ডেসমন্ডকে ২০ ডলার জরিমানা করেন এবং আদালতের খরচ বাবদ আরো ৬ ডলার জরিমানা করেন।
ভাইয়লা ডেসমন্ড দমার পাত্রী ছিলেন না। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়কে চ্যালেঞ্জ করেন এবং বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু সেখানেও রায় তাঁর পক্ষে যায় নি। সুপ্রিম কোর্টে তাঁর করা আপীল বাদ হয়ে যায়।
ভাইয়লা ডেসমন্ড মৃত্যুবরণ করেন ১৯৬৫ সালে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫০। আর সিনেমা হলের ঘটনা ঘটেছিল তিনি যখন তার বয়স ছিল ৩২ বছর।
তবে ভাইয়লা ডেসমন্ড সেদিন বর্ণবাদ আর আদালতের বিচারে কাছে পরাজিত হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি জিতেছেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৪৫ বছর পর তাঁকে মরণোত্তর ক্ষমা প্রদান করা হয়। ২০১০ সালে নভাস্কোশিয়ার তৎকালীন লেফটেনেন্ট গভর্নর মেয়ান ফ্রান্সিস এই ঘোষণা দেন এবং ঐ একই সময় নভাস্কোশিয়ার তখনকার প্রিমিয়ার ডেরেল ডেক্সটার সরকারীভাবে ভাইয়লা ডেসমন্ড এর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
ভাইয়লা ডেসমন্ডকে বলা হয়ে থাকে কানাডার রসা পার্কস। রসা পার্কস ছিলেন আমেরিকায় নাগরিক অধিকার রক্ষায় অগ্রদূত। তাঁর জন্ম ১৯১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী। তিনি থাকতেন আলাবামায়। ১৯৫৫ সালে তিনি একদিন যাত্রীবাহী এক বাসে উঠে গন্তব্যস্থানে যাচ্ছিলেন। ঐ সময় এক শ্বেতাঙ্গ যাত্রী সিটে বসার জন্য রসা পার্কসকে সিট ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু রসা পার্কস সিট ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
ঐ সময় আমেরিকায়ও বর্ণবাদ বেশ তীব্র আকারেই ছিল। কিন্তু রসা পার্কস এর সাহসী ভূমিকায় সেদিন জেগে উঠেছিল বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন। শহর জুরে কৃষ্ণাঙ্গরা বয়কট করেছিলেন বাস সার্ভিস। বছর খানেকেরও বেশী সময় ধরে চলে এই বয়কট আন্দোলন। পরে সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় দেন যে বাসে শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা অসাংবিধানিক তখন এই বয়কটের আন্দোলন থামে। এর পর রসা পার্ক আমেরিকায় নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেন।
আজ কানাডায়ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় এবং বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রতীক হয়ে উঠেছেন ভাইয়লা ডেসমন্ড। জীবদ্দশায় তিনি বর্ণবাদ বিরোধী যে আন্দোলন করে গেছেন এককভাবে তার স্বীকৃতি মিলেছে প্রায় ৭২ বছর পর। ডেসমন্ড বেঁচে থাকলে আজ খুবই গর্বিত হতেন। এ কথা ইতিপূর্বে বলেছেন তার ছোট বোন ৯১ বছর বয়সী ওয়ান্ডা রবসন।
উল্লেখ্য যে, অতীতে কানাডায় বর্ণবাদী আচরণ প্রকাশ্যেই করা হতো। বর্ণবাদ তখন অলিখিত বৈধতা পেয়েছিল। এই ধরণের আচরণকে সেই সময় অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হতো না। কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড নিজেই একজন প্রচন্ড বর্ণবাদী শাসক ছিলেন। বর্ণবাদকে সমর্থন করার পিছনে তার যুক্তি ছিল এই রকম- ‘আমি এরকম একটি দেশ চালাচ্ছি যে দেশটি বর্ণবাদী মানুষে ভরা। এ কারণেই আমি বর্ণবাদকে সমর্থন করে গেছি।’
কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, যে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করার জন্য আজ দশ ডলারের ব্যাংক নোটে ডেসমন্ড এর ছবি এসেছে, সেই একই নোটে আছে ম্যাকডোনাল্ড এরও ছবি যিনি ছিলেন প্রচন্ড ভাবে বর্ণবাদী! তাকে কানাডার ফাদার অব নেশনও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু তিনি কানাডার আদিবাসীদের দেখতে পারতেন না। ইউনিভার্সিটি অব রিজাইনা’র এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর এবং লেখক জেমস ডাচেক লিখেছেন, “স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড দেশটি গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত ছিল আদিবাসীদের কোন স্থান নেই এই দেশটিতে। তারা ডিসপোজএবল।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস এর কলামিস্ট ইয়েন অস্টিন তার এক কলামে লিখেন,
“ ম্যাকডোনাল্ড এর যারা ভক্ত তারাও জানতেন তিনি ছিলেন একজন চরম বর্ণবাদী ব্যক্তি।”
ম্যাকডোনাল্ড কানাডায় বসবাসরত চাইনীজদেরও ভাল চোখে দেখতেন না। চাইনীজদের বিরুদ্ধেও তিনি বর্ণবাদী আচরণ করেছেন। তার বিরুদ্ধে নারী বিদ্বেষ এর অভিযোগও রয়েছে! কানাডার আদিবাসীদের সন্তানদের জোর করে ধরে এনে বিতর্কিত আবাসিক স্কুলে ভর্তি করানোর পিছনেও তার ভূমিকা ছিল জোরালো। সেই স্কুলে আদিবাসী শিশুদের উপর চালানো হয়েছিল নির্মম অত্যাচার। যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়েছিল ঐ শিশুরা।
জন এ. ম্যাকডোনাল্ড এর শাসনামল গত হয়েছে বহু বছর আগে। কিন্তু কানাডায় এখনো কিছু সংখ্যক লোক আছেন যারা বর্ণবাদী। কেউ কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ কেউ অপ্রকাশ্যে। যারা রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন তাদের বেশীরভাগই বর্ণবাদী। কানাডায় মুসলিম ইমিগ্রেন্টদেরকে সুনজরে দেখেন না এই রক্ষণশীলদের সিংহভাগ। আরো যাদেরকে সুনজরে দেখা হয় না তাদের মধ্যে আছেন – আদিবাসী, সাউথ এশিয়ান, এশিয়ান, ইহুদী এবং কৃষ্ণাঙ্গ ইমিগ্রেন্টরা। ইতিপূর্বে প্রকাশিত ফোরাম রিসার্স এর এক জরীপে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। জরীপে দেখা গেছে কুইবেক প্রভিন্সে শতকরা ৫৭ জন কোন না কোন এথনিক গ্রুপকে সুনজরে দেখেন না। আলবার্টায় এই হার ৪৫%, আটলান্টিক কানাডায় ৩৯%, ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ৩৫% এবং অন্টারিও, মেনিটোবা আর সাচকাচুয়ানে ৩৩%।
অন্যদিকে ইপসস-এর এক জরিপে দেখা গেছে কানাডীয়দের প্রায় অর্ধেকই স্বীকার করেন যে, তাদের মধ্যে বর্ণবাদী চিন্তা-চেতনা আছে এবং আগের বছরগুলোর তুলনায় এখন তারা সেইসব চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একান্তভাবে গ্লোবাল নিউজের জন্য পরিচালিত ঐ জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ এদেশে বর্ণবাদকে একটি গুরুতর সমস্যা বলে মনে করেন। অথচ ১৯৯২ সালে বর্ণবাদকে গুরুতর সমস্যা বলে মনে করতো ৬৯ শতাংশ মানুষ। অংশ গ্রহণকারীদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষ নিজেকে বর্ণবাদী নন বলে দাবি করেছেন তবে অনেকেই বলেছেন যে, তারা বর্ণবাদী চিন্তা-ভাবনা লালন করেন কিন্তু সেগুলো তারা অন্য কারও সঙ্গে আলোচনা করেন না।
ইপসস-এর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট সিন সিম্পসন বলেন, “আমরা দেখেছি যে, (প্রায়) ৫০ শতাংশ মানুষ বর্ণবাদী চিন্তা-ভাবনা থাকার বিষয়টিকে যথার্থ এবং প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক বলে মানেন।”
এরকম পরিস্থিতিতে বর্ণবাদের শিকার হয়ে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড এর নিহত হওয়ার ঘটনা কানাডিয়াদের কাছে কতটা গুরুত্ব পাবে তা অনুমান করাটা কঠিন নয়। বিশেষ করে বিশে^র বিভিন্ন দেশে যখন রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, জেনোফোবিয়া (ইমিগ্রেন্ট বিরোধী মনোভাব) ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন এরকম আশংকা অমূলক নয় যে, মানব সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার কাজটি এখনো সুদূরপরাহত।
অবশ্য বর্ণবাদ মানব সমাজ থেকে একেবারে নির্র্মূল হবে এমন ধারণা বা আশা করাটাও অবাস্তব সন্দেহ নেই। কারণ, একজন বর্ণবাদের শিকার হন শুধু তার গায়ের রঙ এর কারণে নয়। এর পিছনে আরো অনেক কারণ থাকে। ধর্ম, গোত্র, সম্প্রদায়, ভাষা, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি আরো কিছু কারণে মানুষ মানুষ কর্তৃক বর্ণবাদের শিকার হন। বর্ণবাদের সংজ্ঞাটা বেশ বিস্তৃত। শুধু গায়ের রঙ এর মধ্যে তা সীমাবদ্ধ নয়।
সন্দেহ নেই, মানব সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় অকল্পনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে। কিন্তু আজো অনেক মানুষ মুক্ত হতে পারেনি বর্ণবাদের লজ্জাকর মানসিকতা থেকে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবাটাও যে এক ধরণের হীনমন্যতা এই ধারণাটা অনেকের নেই।
বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে জর্জ ফ্লয়েড নিহত হওয়ার পর কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতি প্রদান করা হয়। ঐ বিবৃতিতে বলা হয়-
এখন সময় এসেছে সকল কানাডিয়ানকে এটি অনুধাবন করা যে, এখানে এন্টি ব্ল্যাক রেসিজম বা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী মনোভাব বিদ্যমান। কানাডায় বর্ণবাদ নেই বা থাকলেও খুব সামান্য পরিমাণে বিদ্যমান, এমন ধারণাটা বাস্তব অর্থে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার পথে একটি বাধা।
সারা পৃথিবীতে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ জর্জ ফ্লয়েডের নিহত হওয়ার ঘটনায় জোরালো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন, তখন অনেকেই দুঃখ, ক্রোধ এবং উদ্বেগকে মোকাবেলা করছেন। কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন জর্জ ফ্লয়েডের আত্মীয়-বন্ধুদের এবং তার পুরো কমিউনিটির সদস্যদের প্রতি গভীরতম সহানুভূতি জানাচ্ছে।
বিবৃতিতে কমিশন আরো বলে, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী মনোভাব শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বিদ্যমান তা নয়। কানাডায়ও অনেক আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ব্যক্তি তাদের কৃষ্ণবর্ণের জন্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন অথবা হুমকী অনুভব করেন।
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমাদেরকে অবশ্যই প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে কেন কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের লোকদের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেশী থাকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারীতে থাকার যখন তারা রাস্তায় বের হন, কেন তাদের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেশী থাকে দোকান কর্মীদের নজরদারীতে থাকার যখন তারা বাজার করতে যান অথবা কেন তাদের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেশী থাকে হোটেল বা রেস্টুরেন্ট কর্মীদের নজরদারীতে থাকার যখন তারা খাবার কিনতে বা খেতে যান? আমাদেরকে প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে কেন কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা বেশী থাকে ঘৃণাজনিত অপরাধ বা বিদ্বেষের শিকার হওয়ার। আরো প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে কেন অপরাধ বিচার ব্যবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গদেরকে বেশী সংখ্যায় দেখা যায় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে।
কানাডায় কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদী আচরণ এবং পদ্ধতিগত বৈষম্যের শিকড়গুলো অনেক গভীরে প্রথিত। বর্ণবাদ ঐতিহাসিক ভাবেই আমাদের সমাজে, আমাদের সংস্কৃতিতে, আমাদের আইনে এবং আমাদের মনোভাবে গ্রথিত হয়ে আছে।
কমিশন আরো বলে, বর্ণবাদী মন্তব্য এবং বর্ণবাদী আচরণ, তা যতই সুক্ষ্ম বা লঘু হোক অবশ্যই সেটি অবজ্ঞা করা যাবে না অথবা বরদাস্ত করা যাবে না। এখন সময় এসেছে পরিবর্তনের। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এর ভাষায়,“ there comes a time when silence is betrayal”. সেই সময়টি এখন।