কানাডায় নারী পাচারের রূঢ় বাস্তবতা : দৃষ্টি আকর্ষণে টরন্টোতে মেয়েদের কৌশল

এপ্রিল ৯, ২০২০

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : সম্প্রতি টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে হেঁটে যাবার সময় আপনি হয়তো দেখে থাকবেন ঘরোয়া পোশাকে মেয়েরা দোকানের সামনের জানালার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে তারা তাদের শহর, প্রদেশ ও সারাদেশে যৌনতার জন্য নারী পাচারের রূঢ় বাস্তবতার দিকে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ কাজ করেছে।

দুটি মেয়ের মাঝখানে একটি সাইনবোর্ডে বড় অক্ষরে লেখা ছিলো, “পাচারকারীদের কাছে মেয়েরা নিছকই পণ্য। সন্দেহের বাইরে থাকা মেয়েরাও যৌন ব্যবসায়ে প্রলুব্ধ হচ্ছে এবং অন্যের লাভের জন্য নিজের দেহ বিক্রি করছে। এটি হলো যৌন পাচার, আর এখানে তা ঘটছে ঘরে ঘরে।” খবর সিটিভি নিউজের। রিপোর্ট করেছন কায়লা গুডফিল্ড।

“দি এলি,” “দি আমারা,” “দি সামান্থা,” “দি মায়া” এবং “দি মিলেশা” নামের মেয়েরা সেদিন ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউর ঠিক পশ্চিমে কুইন স্ট্রিট ওয়েস্টের ব্যস্ত সময়ে দোকানের সামনের কাচের পেছনে পণ্যের আদলে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়েছিলো। তাদের পরনে ছিলো উজ্জ্বল রঙের পোশাক যাতে পাশ দিয়ে যাবার সময় পথচারীদের দৃষ্টি বেখেয়ালেই তাদের দিকে আকৃষ্ট হয়।

“বিপননযোগ্য মেয়েরা” শিরোনামের এই মনোযোগ আকর্ষণী কার্যক্রম চালানো হয় টরন্টোর কোভেনান্ট হাউসের উদ্যোগে এবং তাতে অংশীদারিত্ব ছিলো টরন্টো পুলিশের মানব পাচার ইউনিটের। কোভেনান্ট হাউসের একজন মুখপাত্র জুলি নিউবয়ের গত বৃহস্পতিবার বলেন, শনিবার অন্টারিওতে মানব পাচারবিরোধী সচেতনতা দিবস পালনের প্রাক্কালে এই প্রচারণা কার্যক্রম চালানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো, “সচেতনতা সৃষ্টি, এ বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলা এবং কানাডায় মানব পাচার রোধে সহায়তাদান।”

একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “এটা স্বীকার করে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ঘরোয়াভাবে যৌন পাচারের যত ঘটনা ঘটে তার ৯৩ শতাংশ মেয়েই কানাডার নাগরিক। এসব ঘটনা আমাদের প্রদেশে, টরন্টোতে এবং সারা কানাডাতেই ঘটছে।”

সারাদেশে যৌনতার জন্য নারী পাচারের রূঢ় বাস্তবতার দিকে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টা : ছবি : সিটিভি নিউজ

তিনি বলেন, “আমাদের এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে, এসব যে ঘটছে সে বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটা বিরতিহীনভাবে

চালিয়ে যেতে হবে, যাতে বাবা-মা, অভিভাবক এবং তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সংলাপের সূচনা করা যায় এবং তারা বুঝতে পারেন যে, যৌন পাচার আসলে কি জিনিস।”

‘এটি ভুল বোঝা একটি ইস্যু’

টরন্টো পুলিশের মানব পাচার ইউনিটের এক সদস্যও সেই বৃহস্পতিবার সকালে কুইন স্ট্রিট ওয়েস্টের ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন। তিনি মনে করেন, “এ ধরণের যৌন পাচারের ঘটনা তদন্তে” পুলিশ কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বে আসা জরুরী।

ডেভিড কোরেয়া নামের ওই ডেপুটি সার্জেন্ট মানব পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধের শিকারদের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ ও আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুলিশ সার্ভিসের ভূমিকা শক্তিশালী শরিক হিসাবে। তিনি বলেন, “মানব পাচারের বিরুদ্ধে আমাদের একটি শক্তিশালী তদন্ত টিম আছে যা মূলত কাজ করে জোর করে যৌনতায় নামানো, এই পথে নিয়ে আসা অপ্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের রক্ষায়।” তিনি বলেন, এই চলমান সমস্যা সম্পর্কে টরন্টোবাসীকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে এই প্রচারণা হলো একটি জোরালো আন্দোলনের অংশ। তিনি বলেন, “বিষয়টি সত্যিকারভাবেই জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।”

কোরেয়া এবং নিউবয়ের উভয়েই যৌন পাচারের শিকার হওয়া মেয়েদের জন্য সহায়ক হতে পারে এমন উপকরণ যেমন হট লাইন এবং ওয়েবসাইটের মত বিষয়গুলোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

নিউবয়ের বলেন, এসব উপকরণ থেকে এই “ভুল বোঝা ইস্যু” সম্পর্কে মেয়েরা অতিরিক্ত তথ্য জানতে পারবে। তিনি বলেন, “প্রলুব্ধকরণ, প্রস্তুতকরণ এবং সুযোগ নেয়ার লক্ষণগুলো ধরতে সক্ষম হওয়াটা যৌন পাচার প্রতিরোধে সহায়তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েরা, তাদের বাবা-মা এবং অভিভাবকরা এই বিষয়ে যত বেশি জানতে পারবেন ততই তারা নিজেদেরকে রক্ষা করার বিষয়ে সমৃদ্ধ হবেন।”

কোভেনান্ট হাউস ২০১৬ সালে পাচারবিরোধী পরিকল্পনা প্রকাশ করে এবং এখন পর্যন্ত সংস্থাটি দুই শতাধিক মেয়েকে সহায়তা দিয়েছে।

মেয়র বললেন, বিষয়টি ‘লোকচক্ষুর অন্তরালে বিরাজমান’

টরন্টো সিটি কর্তৃপক্ষ গত বছর বলেছিলো, কানাডায় মানব পাচার নিয়ে উদ্বেগ গত এক দশক ধরে বাড়ছে।

২০১৯ সালের ১৮ জুন সিটি কাউন্সিল একটি প্রতিবেদন তৈরি করে যাতে মানব পাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপের রূপরেখা তুলে ধরা হয়। অন্যসব সংস্থা, করপোরেশন এবং বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে সিটির কর্মকর্তারা এসব পদক্ষেপেরর প্রস্তাব করেন।

ওই সময় নগর কর্তৃপক্ষ টরন্টো পুলিশ সার্ভিসের দেয়া মানব পাচার সম্পর্কিত পরিসংখ্যান তুলে ধরে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে উল্লেখিত দোকানের বাইরে টরন্টোর মেয়র জন টোরি বলেন, “সচরাচর দেখা যায় না এমন প্রদর্শনী” “লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা” বিষয়টির সমাধানে কার্যকর।

তিনি বলেন, শহরজুড়ে, বিশেষ করে হোটেলগুলোতে যে মানব পাচারের ঘটনা ঘটে চলেছে সে বিষয়ে জনগণের নজরদারি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে হোটেলগুলো এ ধরণের কর্মকান্ডের ঘাঁটি যেখানে প্রধানত যুবতী মেয়েরা এবং একেবারেই তরুণ, আমি বোঝাতে চাই, যাদের বয়স এমনকি ১৩ বছরের মধ্যে এবং আমার ধারণা তাদের গড় বয়স হবে ১৭ বছর, এর শিকার হয়।” তিনি আরও বলেন, “এখানে তাদেরকে কার্যত আটক করে রাখা এবং যৌন ব্যবসায় যোগ দিতে বাধ্য করা হতে পারে।”

মন্ত্রী বললেন, একটি মেয়ের দাম হতে পারে তিন লাখ ডলার

নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী জিল ডানলপ এমন আবেগের কথাই ব্যক্ত করলেন যে, যৌন পাচার হলো এই প্রদেশে এবং দেশজুড়েই এমন একটি ইস্যু যেটি নিয়ে খুব বেশি রিপোর্ট করা হয় না। তিনি আরও বলেন, সচেতনতা বাড়ানো, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

“আমরা জানি, একটি মেয়ের দাম হতে পারে তিন লাখ ডলার এবং মানব পাচার বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়াটা সবার আগে দরকার। কারণ আমার মনে হয়, অনেক মানুষই অনুধাবন করেন না যে, অন্টারিওতে আমাদের সমাজেই এসব ঘটনা ঘটছে।”

জোনস বলেন, টরন্টোর কেন্দ্রস্থলে ব্যস্ত সড়কে দোকানের কাচের জানালার পেছনে যে মেয়েরা দাঁড়িয়ে থেকেছে তারা “ইস্যুটি আপনার সামনে তুলে ধরেছে।”

তিনি বলেন, “এটি দেখতে কেমন সেটি উঠে এসেছে। যৌনতার জন্য মানব পাচারের বিষয়টি আপনার মহল্লায়, আপনার সড়কে কেমন দেখায় সেটি তারা দেখিয়ে দিয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা (সরকার) বুঝি যে, নিছক জনসচেতনতা গড়ে তোলাই যথেষ্ট নয়, ওই কিশোরী মেয়েদেরকে এই ব্যবসা থেকে প্রাথমিকভাবে বের করেও আনা সম্ভব হবে না। আমাদেরকে সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করতে হবে যাতে প্রয়োজনের সময় সব সেবা হাতের কাছে পাওয়া যায়।”

তিনি বলেন, অন্টারিও সরকার “আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে” কিছু আইনগত পরিবর্তন নিয়ে আসবে যা এই ইস্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করার বাড়তি হাতিয়ার হিসাবে কাজে দেবে।