কানাডার ৬০০০এর বেশি অনলাইন চ্যানেল ডানপন্থী উগ্রবাদ ছড়িয়ে দেয়ার সঙ্গে জড়িত

জুলাই 13, 2020

কানাডীয়রা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে। ছবি: সিবিসি

টরন্টো, ১৯ জুন ২০২০:  নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বেশ কিছু প্লাটফর্মে ৬৬০০-র বেশি অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে কানাডীয়রা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং এ ধরণের অন্যান্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়লগ (ISD)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ও গত ১২ জুন প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আয়রন মার্চ, ফেসিস্ট ফোর্জ, ফোরচ্যান ও গ্যাব (4chan and Gab) এর মত বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে কানাডার বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী উগ্র সম্প্রদায় সক্রিয়।

সমীক্ষার রিপোর্টে বলা হয়, এইসব চ্যানেল, দল ও অ্যাকাউন্ট থেকে তারা বিভিন্ন প্লাটফর্মের এক কোটি ১০ লাখেরও বেশি সংখ্যক ব্যবহারকারীর কাছে চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিতে পারছে। খবর সিটিভি নিউজের। রিপোর্ট করেছেন বি. নেউস্টেটার।

রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, গবেষকরা দেখেছেন, প্রান্তিক সাইট ফোরচ্যান-এর “পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট” নামের একটি বিশেষ মেসেজ বোর্ডে কানাডীয়রা ১৬ লাখেরও বেশি পোস্ট দিয়েছেন। এই বোর্ডে অন্য সব দেশ থেকে যত পোস্ট দেয়া হয়েছে কানাডীয়দের পোস্টের সংখ্যা তার ছয় শতাংশ।

রিপোর্টে বলা হয়, “আমরা দেখেছি যে, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফোরামে কানাডীয়রা অত্যন্ত সক্রিয়। ফোরচ্যান-এর ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’ প্লাটফর্ম ব্যবহারের দিক থেকে কানাডীয়রা হলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাতি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পরেই তাদের অবস্থান। আবার ‘আয়রন মার্চ’ প্লাটফর্মটি যখন সক্রিয় ছিলো তখন সেটিতেও কানাডীয়রা ছিলো তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবহারকারী সম্প্রদায়।

কানাডীয়রা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছে অনলাইন চ্যানেল, পেজ, দল এবং ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে। ছবি: সিবিসি

আইএসডির সিনিয়র রিসার্চ ম্যানেজার এবং সংশ্লিষ্ট রিপোর্টের অন্যতম লেখক জ্যাকব ডাভে শুক্রবার সিটিভিনিউজ.সিএ-কে বলেন, জনসংখ্যার দিকটি বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, আসলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডায় চরমপন্থী ব্যবহারকারীর আনুপাতিক হার বৃহত্তর।

ডাভে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এর ফলে মনে হচ্ছে এটি সত্যিই এমন একটি বিষয় যেটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।  এখানে ব্যবহারকারীদের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে লক্ষ্য করে চরম নোংরা কায়দায় ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছে।”

রিপোর্ট প্রণেতার মতে, নতুন রিপোর্টটি, “কানাডায় অনলাইনে চরমপন্থী তৎপরতা পরিমাপের এ যাবৎকালের সবচেয়ে সমন্বিত প্রয়াস।” ডানপন্থী চরমপন্থীরা কিছুটা ভিন্ন আদর্শিক পরিপ্রেক্ষিতের ওপর আস্থাশীল এবং ভিন্ন উপায়ে ও ভিন্ন প্লাটফর্মে সংগঠিত হলেও গবেষণায় দেখা গেছে, একই ধরণের ইস্যু ও ঘটনায় তারাও সমভাবে উদ্বুদ্ধ। রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে কানাডায় দক্ষিণপন্থী চরমপন্থীদের অনলাইন দলগুলোর তৎপরতা সর্বোচ্চে পৌঁছাতে সহায়ক হয়েছে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চে সন্ত্রাসী হামলা এবং কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচন।

ডাভে বলেন, “আমরা এটা ধারাবাহিকভাবেই দেখতে পেয়েছি যে, ওইসব প্লাটফর্মে মুসলিমবিরোধী আবেগ এবং মুসলিমবিরোধী ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে… টুইটারের এবং ফোরচ্যান-এ ব্যবহারকারীদের কথোপকথন অনুসরণ করে আমরা দেখতে পেয়েছি, অনেক কানাডীয় আছে যারা ক্রাইস্টচার্চের সন্ত্রাসী হামলা সমর্থন করে, এ নিয়ে উল্লাস করে, ওই হামলাকে যৌক্তিক বলে এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানোর আহবান জানায়।”

ডাভে বলেন, এই তথ্য সমীক্ষার লেখকদের জন্য বিশেষভাবে পীড়াদায়ক যে, ২০১৭ সালে কানাডার কুইবেক সিটিতে মসজিদে হামলা চালিয়ে ছয় মুসল্লীকে হত্যা এবং আটজনকে আহত করা হয়েছিলো। “এই রিপোর্ট থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনে নেয়ার আছে, সেটি হলো এই উদঘাটন যে, কট্টর ডান চরমপন্থার প্রতি সমর্থন দেয়ার একটি অতি প্রতিষ্ঠিত ও যথেষ্ট বৃহদায়তনের অনলাইন ব্যবস্থাপনা কানাডায় রয়েছে। কিন্তু অনলাইনে ডানপন্থী উগ্রবাদী তৎপরতা রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক গণমাধ্যমের প্লাটফর্মগুলোর এখনও অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা তাদের প্লাটফর্মে দক্ষিণপন্থী উগ্রবাদ এবং নির্দিষ্ট কিছু কট্টর আন্দোলন শনাক্ত করার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু আমার মনে হয়, সমীক্ষায় যেটা দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির লক্ষ্যে এখনও কানাডায় বেশ বড়ো একটি গোষ্ঠী সক্রিয় আছে।

তিনি আরও বলেন, সামাজিক গণমাধ্যম কোম্পানিগুলিকে বিবেচনা করতে হবে কোন চরমপন্থী দলগুলোকে তারা  তাদের প্লাটফর্মে বিকশিত হবার সুযোগ দিচ্ছে এবং মূল্যায়ন করতে হবে অনলাইনে এদের উপস্থিতি সীমিত করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য ডাভে এটাও বলেন যে, অনলাইনে ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি নাগালের বাইরে চলে যায় যখন প্লাটফর্মগুলো নিজেরাই ওই উগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। “আমি আরও ব্যাপক পরিসরে চিন্তা করি যে, আমাদের এখন সেই উপায় খুঁজে বের করা দরকার, কীভাবে আমরা এ ধরণের উগ্রবাদী কথোপকথনে জড়িত লোকদের কাছে পৌঁছতে পারি এবং তাদের শুধরে দিতে পারি।”

তিনি আরও বলেন, অনলাইনে উগ্রবাদী কথোপকথনে নিয়মিত হস্তক্ষেপ করার বিষয়টি কানাডার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো বিবেচনা করতে পারে। “আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে যে প্রবণতা দেখেছি কানাডা তার বাইরে নয়। দেখা গেছে, ডানপন্থী উগ্রবাদী মনোভাবের বিপুল সংখ্যক মানুষ কানাডাকে একটি অধিকতর বিভাজিত স্থানে পরিণত করার জন্য কাজ করছে।”

“কানাডায় ডানপন্থী উগ্রবাদ, একটি অনলাইন নিরীক্ষা” শীর্ষক এই অন্তর্বর্তী সমীক্ষাটি কানাডায় ডানপন্থী উগ্রবাদ বোঝার লক্ষ্যে পরিকল্পিত একটি বৃহত্তর প্রকল্পের অংশ। অন্টারিওর টেক ইউনিভার্সিটি এই প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছে। এতে সহায়তা দিচ্ছে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি ও নিউ ব্রান্সসউইক ইউনিভার্সিটি।

আইএসডি জানায়, আগামী বছরখানেক ধরে তারা ওইসব প্লাটফর্মে ডানপন্থী উগ্রবাদের বিষয়টি আরও বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করবে এবং ভবিষ্যতে যে রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে তাতে অতিরিক্ত ডিজিটাল ফোরামগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

ডাভে বলেন, ২০২০ সালের সুনির্দিষ্ট কোনও ঘটনা, যার মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারি এবং কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বিক্ষোভের বিষয়টিও থাকবে, কানাডায় অনলাইনে ডানপন্থী উগ্রবাদী তৎপরতায় কীভাবে ভূমিকা রেখেছে সে বিষয়ে আইএসডি ধারাবাহিক সারসংক্ষেপ প্রকাশ করবে।

ডাভে বলে, “সহিংসতার মধ্য দিয়ে ডানপন্থী উগ্রবাদের প্রকাশ ঘটার ক্ষেত্রে বড়ো ধরণের উল্লম্ফন আমরা সাধারণভাবে দেখেছি, কিন্তু অনলাইনে এবং তার বাইরেও সাধারণভাবে একটি ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে যা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো ভালোভাবে নিচ্ছে না।”

তিনি আশা করেন যে, এই সমীক্ষা ও ভবিষ্যতের রিপোর্টগুলো অনলাইনে উগ্রবাদের স্বরূপ উন্মোচন করবে এবং কানাডার নেতৃবৃন্দকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দিকে এগিয়ে দেবে। তিনি বলেন, “আমি আশা করি, এ কাজের মধ্য দিয়ে আমরা এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে, ঘৃণার বিরুদ্ধে ও বিভেদ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সমাজের জন্য উদ্দীপক হিসাবে কাজ করতে পারবো।