করোনা নিয়ন্ত্রণে কানাডার সাফল্য A-
দ্বিতীয় ঢেউ কি আসতে পারে?
আগস্ট 7, 2020
কানাডার সাধারণ নগরিকেরা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলেছেন ভালভাবে যেটা বিড়াট ভূমিকা রেখেছে করোনাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার জন্য। ছবি : অনলাইন
খুরশিদ আলম : করোনা (কভিড-১৯) নিয়ন্ত্রণে কানাডার সাফল্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভাল। আর সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অতি উত্তম। কানাডার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত সাত জন বিশিষ্ট মহামারী বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি সিটিভি নিউজের এক প্রশ্নের জবাবে এমনটাই মত দিয়েছেন। এই বিশিষ্ট চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীগণ করোনা নিয়ন্ত্রণে কানাডার সাফল্যকে চিহ্নিত করতে গিয়ে যে মার্ক দিয়েছেন তার মধ্যে আছে B, B+ এবং A-। অর্থাৎ ৮৬-৯০ মার্ক। একেক জন একেক মার্ক দিয়েছেন। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তারা মার্ক দিয়েছেন F, D এবং D-। অর্থাৎ ৬৬ থেকে আরো নিচের দিকে। অন্যদিকে সার্বিকভাবে বিশ^কে দিয়েছেন ঈ মার্ক যেটা ৭৩-৭৬ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
উল্লেখ্য যে, গত ছয় মাসে কানাডার উত্তরাঞ্চলে করোনার প্রকোপ একেবারেই কম বা প্রায় নেই বললেই চলে। এর মধ্যে নুনাভাট টেরিটরিতে কোন সংক্রমণই ঘটেনি। একেবারেই জিরো সংক্রামণ। এর পশ্চিমে অবস্থিত নর্থওয়েস্ট টেরিটরিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র পাঁচজন। মারা যাননি কেউ। তারো পশ্চিমে অবিস্থিত ইয়াকুন টেরিটরিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন চৌদ্দ জন। মারা যাননি কেউ। কানাডার মূল ভূখন্ডের প্রায় অর্ধেক জুড়েই এই তিন টেরিটোরির অবস্থান। অবশ্য লোক সংখ্যাও অনেক কম এই এলাকাগুলোতে। মূলত আদিবাসীদের বসবাস এখানে।
তবে যে সকল অঞ্চলে লোকসংখ্যা বেশী সেখানে সংক্রমণের হারও বেশী। এর মধ্যে আছে কুইবেক এবং অন্টারিও প্রভিন্স। ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে লোক সংখ্যা বেশী হলেও সেখানে কুইবেক এবং অন্টারিওর তুলনায় সংক্রমণের হার অনেকটাই কম। জুলাই মাসের চতুর্থ সপ্তাহের (২৬ জুলাই) হিসাব অনুযায়ী কুইবেকে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৮,৫৮৩ জন। মৃতের সংখ্যা ছিল ৫,৬৬৭ জন। আর অন্টারিওতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৮,৬৮০ জন। মৃতের সংখ্যা ২,৭৯২ জন। ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩,৪১৯ জন। মৃতের সংখ্যা ১৯১ জন। আলবার্টা প্রভিন্সেও আক্রান্তের সংখ্যা ছিল বেশী। সেখানে ২৬ জুলাই পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০,০৮৬ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১৭৮ জন। বাকি প্রভিন্সগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম। যেমন মেনিটোবা। আয়তনে প্রায় অন্টারিওর সমান। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৩৮৮ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৭ জন।
মিসিসাগায় কর্মরত ইনফেকশাস ডিজির স্পেশালিস্ট ডা. সুমন চক্রবর্তী সিটিভি নিউজকে বলেন, ‘কানাডায় করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা আসলে খুব ভাল কাজ করেছি এবং এ জন্য আমরা নিজেরা অবশ্যই গর্ব করতে পারি। তবে আমাদেরকে এমন ভাবে গর্বিত হতে হবে যাতে আমরা আত্মতৃপ্তি লাভ না করি।’
ডা. চক্রবর্তী করোনা নিয়ন্ত্রণে কানাডার সাফল্যকে A- নম্বর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য কয়েকটি দেশ যেখানকার পরিস্থিতি কানাডার মতেই ছিল, তাদের হাসপাতালগুলো কখনো কখনো করোনা রোগীর চাপে হতবুদ্ধি বা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কানাডায় আমাদেরকে কখনো রোগির চাপে এমন নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পড়তে হয়নি।’
ডা. চক্রবর্তী এ প্রসঙ্গে নিউজিল্যান্ডের উদারহরণ টেনে আনেন। তিনি বলেন, ‘করোনা নিয়ন্ত্রণে নিউজিল্যান্ডও A- পাবার যোগ্য আমার মতে। তবে নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো তাদের ভৌগলিক অবস্থান। প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে তাসমান সাগরের মাঝে একটি বিচ্ছিন্ন দেশ তারা। কানাডার সেই সুবিধাটুকু ছিল না। তাছাড়া আমাদের পাশেই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে পরিস্থিতি ভায়াবহ আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে তারা এখন। এবং এরকম একটি নিকটতম প্রতিবেশীর পাশে অবস্থান করেও আমরা করোনাকে ভালো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পেরেছি।
উল্লেখ্য যে, বিশেষজ্ঞদের অনেকেই কানাডার ফেডারেল, প্রভিন্সিয়াল ও মিউনিসিপাল সরকারগুলোর প্রশংসা করেছেন করোনা নিয়ন্ত্রণে সময়ে সময়ে তারা সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করায়। অন্যদিকে কানাডার সাধারণ নগরিকেরাও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলেছেন ভালভাবে যেটা বিড়াট ভূমিকা রেখেছে করোনাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার জন্য। সরকারী সহায়তা ও সিদ্ধান্তও করোনা নিয়ন্ত্রনে রাখার পিছনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।
অবশ্য শুরুতে স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসক, নার্স, এম্বুলেন্স কর্মী এবং অন্যান্য খাতের ফ্রন্ট-লাইন কর্মীগণ সমূহ বিপদের কথা জেনেও নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন করোনা মোকাবেলায়। ঝুঁকিটা ছিল এই কারণে যে, তখন পর্যাপ্ত সংখ্যাক পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট ছিল না কারো কাছে। এ কারণে ফ্রন্ট-লাইন কর্মীদেরকে ন্যাশনাল হিরো হিসাবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে কানাডায়।
কানাডায় করোনা ভাইরাসের আগমন ঘটেছিল এখন থেকে প্রায় ছয় মাস আগে। ঐ সময় টরন্টো প্রবাসী এক ব্যক্তি করোনার সূতিকাগার চিনের উহান প্রদেশে গিয়েছিলেন বেড়াতে বা পারিবারিক কোন কাজে। সেখান থেকে টরন্টোতে ফিরে এসে তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে ধরা পরে তার করোনা হয়েছে। কানাডায় সেটাই করোনার শুরু। এর পর ঐ ব্যক্তির স্ত্রীও করোনায় আক্রান্ত হন। সেটা ছিল দ্বিতীয় সংক্রমণের ঘটনা। কিন্তু কানাডার বিভিন্ন প্রভিন্সের চিকিৎসকগণ বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি তখন। সিটিভি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তখন কানাডার চিকিৎসকরা বলছিলেন করোনা কানাডিয়ানদের জন্য অল্প ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থাও করোনাকে মহামারী হিসাবে ঘোষণা দিতে দেরী করেছে।
টরন্টোতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। তার কয়েক সপ্তাহ পর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রাগোয়ার আক্রান্ত হন করোনায়। তিনি ব্রিটেনে গিয়েছিলেন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেখান থেকে ফিরে আসার পরই তার করোনা ধরা পড়ে। এর পরই কানাডা জুড়ে শুরু হয় মানুষজনের আতংকিত হওয়ার পালা। কারণ প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেও যখন করোনা হানা দিয়েছে তখন একে আর উপেক্ষা করার উপায় নেই। মানুষজন তখন উদভ্রান্তের মত ঝাপিয়ে পরেন গ্রোসারীগুলোতে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র খালি হয়ে যায় গ্রোসারীর রেক থেকে। আতঙ্কিত লোকজন গাড়ি ভরে জিনিষপত্র কিনে এনে স্টক করতে থাকেন বাড়িতে। ঘরে জায়গা না হলে জিনিষপত্র গ্যারাজে নিয়ে রাখছিলেন। তখন শীতকাল ছিল। তাই খাবারের আইটেমগুলো নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি ছিল না। কয়েক সপ্তাহ পরে অবশ্য এই স্টক করার প্রবণতা কমে আসে। গ্রোসারীর মালিক এবং বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে ক্রেতাদের আশ^স্ত করা হচ্ছিল এই বলে যে, কোন কিছুর অভাব হবে না। সুতরাং কেউ যেন আতঙ্কিত না হন।
কিন্তু তারপরও গ্রোসারীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে প্রায় মাস খানেক সময় লেগেছে। আর সেনিটাইজিং এর দ্রব্যাদি আউট অব মার্কেট ছিল পরবর্তী প্রায় তিন মাস ধরে।
এদিকে গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ অন্টারিও এবং কুইবেকে নতুন সংক্রমণের হার অনেকটাই কমে এসেছে। অন্টারিওতে নতুন সংক্রমণের সংখ্যা প্রতিদিন ১১০-১৯০ এর মধ্যে উঠানামা করছে। কুইবেকেও কম-বেশী একই রকম অবস্থা। অন্যান্য প্রভিন্সে আরো অনেক কম সংখ্যক মানুষ সংক্রামিত হচ্ছেন। সব মিলিয়ে গোটা কানাডার অবস্থা ক্রমশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে। আর এ কারণেই বড় বড় শহরগুলোতে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে খুলে দেয়া হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বরে স্কুলগুলো খুলে দেয়ার চিন্তা-ভাবনাও করা হচ্ছে। কিন্তু তা নির্ভর করছে পরিস্থিতি আরো উন্নত হয় কি না তার উপর। তবে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক বা পিতা-মাতাদের অনেকেই স্কুল খোলার বিষয়টিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না। তারা হয়তো শিক্ষার্থীদের স্কুলে নাও পাঠাতে পারেন যদি করোনা পরিস্থিতি ভাল করে নিয়ন্ত্রণে না আসে।
এদিকে কানাডার টরন্টোসহ আরো কিছু ঘনবসতী এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে রেস্টুরেন্ট এবং পার্কগুলো পর্যায়ক্রমে খুলে দেয়াতে সংক্রমণ পরিস্থিতি আবারো উর্দ্ধমুখী হয়ে উঠতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ এর সম্ভাবনা দেখছেন বিষেশজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকেই যদি না সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হয় সঠিক ভাবে। লক্ষনীয় যে, গত দুই তিন সপ্তাহে তরুণ ও যুবক বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট সংক্রামিতদের মধ্যে ৬০% এর বেশী নারী-পুরুষের বয়স ৪০ এর নিচে। কারণ, এই গ্রুপের সদস্যরা বেশী করে বাইরে যাচ্ছেন তাদের আত্মীয়-বন্ধু বা পরিচিতজনের সঙ্গে মিলিত হতে। তাদের ধারণা, তারা কম বয়সী বলে তাদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা কম। বা সংক্রমণ ঘটলেও সাধারণ সর্দি-কাশির বেশী কিছু হবে না। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে তা নয়। হতে পারে কম বয়সীদের ইমিউন সিস্টেম বয়স্কদের তুলনায় বেশী শক্তিশালী। কিন্তু এই কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে যাবেন তখন তাদের কাছ থেকে বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা আক্রান্ত হতে পারেন যেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। দেখা গেছে কানাডায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তাদের বেশীরভাগই সিনিয়র সিটিজেন।
এই পরিস্থিতিতে কানাডার চিকিৎসকগণ কিছু সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন সম্প্রতি। টরন্টোর চিফ মেডিক্যাল অফিসার ডা. এলিন ডি ভিলা গত ২৭ জুলাই এক বিবৃতিতে টরন্টোবাসীদের সাবধান হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, মহামারী শেষ হয়ে যায়নি। তিনি সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্র্যাকটিস অব্যাহত রাখার জন্য বলেন। সেটি করা না হলে একজন নিজেকে যেমন ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন তেমনি অন্যদেরকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেন, করোনার সেকেন্ড ওয়েভ আসতে পারে। অন্যান্য শহর এবং দেশে তা ইতিমধ্যে ঘটছে।
ডা. ভিলা আরো বলেন, আমি আরো পরিষ্কার ভাবে বলতে চাই, আপনি যদি আপনার নির্ধারিত সার্কেল এর বাইরে কারো সাথে ডিনার বা কফি পান করতে যান সেটা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মধ্যে পড়ে না। আপনার শিশুদের নিয়ে যদি আপনি আপনার নির্ধারিত সার্কেল এর লোকদের বাইরে খেলাধূলার আয়োজন করতে যান তবে সেটাও সামাজিক দূরত্বের মধ্যে পড়ে না। বাড়িতে আপনার নির্ধারিত সার্কেল এর বাইরের লোকদের নিয়ে পার্টি করতে গেলে সেটাও সামাজিক দূরত্বের মধ্যে পড়বে না।
উল্লেখ্য যে, অন্টারিওতে করোনার প্রকোপ কমে আসার পর সরকারী ভাবে ঘোষণা দেয়া হয় যে, লোকজন মেলামেশা করার জন্য নিজস্ব একটি বলয় তৈরী করতে পারবেন যেখানে সর্বোচ্চ ১০ জন সদস্য থাকতে পারবেন। পরিস্থিতি পরবর্তী ধাপে উন্নতি না ঘটা পর্যন্ত মেলামেশা এই নির্ধারিত ১০ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
কিন্তু তরুণ ও যুবক বয়সীদের মধ্যে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ লক্ষ্য করা গেছে। তারা চিকিৎসক ও সরকারের পরামর্শ ঠিক মত মানছেন না। টরন্টোর বিচ ও পার্ক গুলোতে উইকএন্ডে তাদের মেলামেশা আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি ব্রাম্পটনে এক ব্যক্তির বাড়িতে প্রায় ২০০ লোকের উপস্থিতিতে এক পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। পরে এলাকাবাসীর অভিযোগ পেয়ে পুলিশ এসে পার্টি বন্ধ করে। ঐ পার্টির আয়োজনকারী এখন প্রায় এক লক্ষ ডলার ফাইন এর মুখোমুখি হয়েছেন।
এ সকল কারণেই গত কিছুদিন ধরে তরুণ ও যুবক বয়সী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে করোনার আক্রমণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অন্টারিওর প্রিমিয়ার ড্যাগ ফোর্ড-ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছন। তিনি বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তরুণ ও যুবক বয়সী ছেলে-মেয়েরা চিকিৎসকদের পরামর্শ মানছেন না। তারা পরামর্শ মানার বদলে বেশী মাত্রায় উন্মত্ত হয়ে উঠছেন।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ও (ডব্লিউএইচও) নতুন করে করোনা ছড়ানোর জন্য তরুণ-যুবকদেরকে দায়ী করছে।
ডব্লিউএইচওর ইউরোপ অঞ্চলের পরিচালক ড. হ্যান্স ক্লুগ বলেন, ইউরোপে নতুন করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে গেছে। তার মূল কারণ হতে পরে তরুণ-যুবকরা। এবারের সংক্রমণে তরুণদের ভূমিকা থাকতে পারে। সংস্থাটির কর্মকর্তা আরও বলেন, তরুণ-যুবকদের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে। ইউরোপে হঠাৎ করে সংক্রমণ বাড়ার কারণ হয়তো সেটাই। ইউরোপের সরকারগুলোর উচিৎ এখনই তরুণ জনগোষ্ঠীকে সঠিক বার্তা দিয়ে সতর্ক করা।
তিনি আরও বলেন, একের পর এক দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ছে। আমরা বুঝতে পারছি এটি হচ্ছে মানুষের আচরণে কারণে। কয়েকটি দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে কম-বয়সীরা অধিক মাত্রায় সংক্রমিত হচ্ছে। সুতরাং তাদেরকে কীভাবে সাবধান করা যায় তা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার প্রয়োজন।
নিজের দুই মেয়ে রয়েছে উল্লেখ করে ডাঃ ক্লুগ বলেন, তরুণরা গ্রীষ্মকাল ঘরে বসে থাকতে চায় না। কিন্তু তাদের যেমন নিজেদের ব্যাপারে দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি তাদের বাবা-মা, দাদা-দাদী এবং পুরো সমাজের প্রতি দায়িত্ব রয়েছে। কীভাবে সাবধান থাকতে হয়, সেই জ্ঞান এখন আমাদের রয়েছে, সুতরাং প্রতিটি মানুষকে তা কাজে লাগাতে হবে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ
করোনার মহামারী পৃথিবী থেকে কবে দূর হবে সেটা এখনো কেউ বলতে পারছেন না। তবে শেষ হতে আরো বহু সময় যে বাকি এটা মোটামুটি সবাই নিশ্চিত। কোনো কোনো দেশে এখনও প্রচুর সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। যেসব দেশ ভাইরাসটিকে ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, ঐ সব দেশেও সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় ফিরে আসা নিয়ে ভীতি রয়েছে। আর একে বলা হচ্ছে সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ।
বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শতবর্ষ আগে স্প্যানিশ ফ্লু-ও দ্বিতীয় দফায় ফিরে এসেছিল এবং তাতে প্রথম দফার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তাই প্রশ্ন উঠেছে, করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভও কি অবশ্যম্ভাবী? এবং এরকম কিছু হলে সেটা কতোখানি মারাত্মক হতে পারে? লক্ষনীয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কিছু রাজ্যে সংক্রমণ কমে গিয়ে আবারও বাড়ছে, আবার কমছে। ইউরোপের যে সব দেশে সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল সে সব দেশে সংক্রমণ কমলেও এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন রোগীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রথম ঢেউটি তখনই সমাপ্ত হয়েছে বলা যাবে যখন ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যাবে। এক্ষেত্রে সংক্রমণের হার নাটকীয়ভাবে কমে আসবে। এর পরে সংক্রমণ যখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আবার বৃদ্ধি পাবে তখনই সেটাকে দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ বলা হবে। নিউজিল্যান্ডে ২৪ দিন পর এবং বেইজিং ৫০ দিন ভাইরাসমুক্ত থাকার পর সেখানে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে সেটা বলা যাবে না। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন ইরানে যেভাবে পুনরায় ব্যাপক হারে সংক্রমণ ঘটছে সেটাকে সেকেন্ড ওয়েভের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আর সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় ফিরে আসা নিয়ে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ থাকলেও কোনো দেশে সেরকম কিছু ঘটবে কীনা সেটা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
বিবিসি জানায়, ব্রিটেনেও সেকেন্ড ওয়েভের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। তবে এরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরিই রয়ে গেছে। কারণ এখনও দেশটিতে সংক্রমণ ঘটছে। ব্রিটেনের মোট জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ শতাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয় এবং তাদের সবার দেহেই যে এই ভাইরাসটির প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি হয়েছে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
“বেশিরভাগ মানুষ এখনও আক্রান্ত হতে পারেন। ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়া হলে আবারও ফেব্রুয়ারি মাসের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে,” বলেন লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ড. অ্যাডাম কুচারস্কি।
কী কারণে সেকেন্ড ওয়েভ আসতে পারে?
করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে জারি করা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউন সহ নানান নিয়ম। কিন্তু এর ফলে অনেক দেশেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। চাকরি হারিয়েছে বহু মানুষ, বিঘ্নিত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা, স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও ঠিক মতো হচ্ছে না। তবে এটাও বাস্তবতা যে লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে অনেক দেশেই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। কানাডা তার অন্যতম উদাহরণ।
ড. কুচারস্কি বলেন, “সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে নিয়ে আসার আগে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হলে যুক্তরাজ্য ও তার প্রতিবেশি দেশগুলোতে সংক্রমণের ঘটনা অনেক বেড়ে যেতে পারে।”
এরকম ঘটনা ঘটেছে জার্মানিতে যেখানে একটি কসাইখানায় প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর এক হাজারেরও বেশি কর্মীকে আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এধরনের আক্রান্ত গ্রুপকে যদি খুব দ্রুত শনাক্ত করা যায় তাহলে সেটা বড় কোনো সমস্যা নয়। তখন স্থানীয়ভাবে লকডাউন জারি করে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব। আর সেরকম করা না হলে সেকেন্ড ওয়েবের ঘটনা ঘটতে পারে।
সেকেন্ড ওয়েভ কি প্রথম দফার মতোই হবে?
যদি সেকেন্ড ওয়েভ আসে তাহলে বুঝতে হবে কোথাও বড় ধরনের ভুল হয়েছে। বিবিসি জানায়, মহামারির শুরুর দিকে এক ব্যক্তির মাধ্যমে গড়ে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর অর্থ ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়াচ্ছিল। কিন্তু এর পর মানুষের আচরণে কিছু পরিবর্তন ঘটে, তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে শুরু করে, ফলে সংক্রমণের এই হারও কমে আসতে শুরু করে।
লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ড. অ্যাডাম কুচারস্কি বিবিসি-কে বলেন, “কোনো দেশই সব বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে না।”
তবে তাত্ত্বিকভাবে সেকেন্ড ওয়েভ প্রথম ধাপের চেয়েও খারাপ হতে পারে কারণ এখনও বহু মানুষের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে গত ২৮ জুলাই বার্তা সংস্থা রয়টার্স এর এক খবর থেকে জানা যায়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসার পর আবারও তা বাড়তে শুরু করেছে। একে সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ হিসেবে বিবেচনা করছেন কেউ কেউ। এই সংক্রমণ মোকাবিলার জন্য অনেক দেশেই নতুন করে লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
নতুন করে করোনা যেসব দেশে ছড়াতে শুরু করেছে, সেগুলো মধ্যে অন্যতম ভিয়েতনাম। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রথম সারিতে যে দেশগুলো রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম এই দেশ। দেশটিতে ১০০ দিন ধরে স্থানীয়ভাবে কোনো সংক্রমণও শনাক্ত হয়নি। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত কেউ মারাও যাননি। তবে গত ২৫ আগস্ট দানাং শহরে একজন শনাক্ত হয়েছেন। তিনি স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছিলেন। এরপর ২৬ আগস্ট রোগী শনাক্ত হন আরও তিনজন। করোনা যাতে সেখানে না ছড়াতে পারে, এই লক্ষ্যে সেখানকার ৮০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সরিয়ে নেওয়া লোকজনের অধিকাংশই স্থানীয় পর্যটক। এই ৮০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নিতে ১০০টি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ফ্লাইটগুলো ভিয়েতনামের ১১টি শহরে চলাচল করছে। এ ছাড়া নতুন রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে দেশটিতে।
অন্যদিকে চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গত ২৭ জুলাই জানিয়েছে, ৬১ জন নতুন করে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। গত এপ্রিলের পর এই প্রথম এক দিনে এত সংক্রমণ শনাক্ত হলো। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে, চীনের তিনটি অঞ্চলে গুচ্ছ সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, যাকে সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই তিন অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম জিনজিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমকি। সেখানে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ সংক্রমণ দেখা দেয়। জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই প্রদেশে নতুন করে ৫৭ জন সংক্রমিত হয়েছেন, যাঁরা সবাই স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত। এ ছাড়া লিয়াওনিং প্রদেশের দালিয়ান শহরে গত সপ্তাহে ১৪ জন শনাক্ত হন। তাঁরাও স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছিলেন।
ইন্দোনেশিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এক লাখ ছাড়িয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি মানুষ। এই ভাইরাসের সংক্রমণে নতুন করে মারা গেছেন ৫৭ জন। এ নিয়ে দেশটিতে মারা গেলেন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। এদিকে ইন্দোনেশিয়ায় সংক্রমণের সঠিক চিত্র উঠে আসছে না বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, দেশটিতে করোনা পরীক্ষার হার তুলনামূলক বেশ কম।
এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ জাপানে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশটির ব্যবসায়ী নেতাদের আহ্বান জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
সন্দেহভাজন এক করোনা রোগী চিহ্নিত হওয়ার সীমান্তবর্তী শহর কেসিওং লকডাউন করেছে উত্তর কোরিয়া সরকার। এ ছাড়া এই ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে পাপুয়া নিউগিনিতে পর্যটকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এশিয়ার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ায়ও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। দেশজুড়ে গত ২১ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০২ জন। তার মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই হচ্ছে মেলবোর্নের রাজ্য ভিক্টোরিয়ায়। ওই রাজ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮৪ জন। এ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত দেশটিতে মৃত্যুবরণ করেছেন ১২৮ জন। ধারণা করা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাসের এটা সেকেন্ড ওয়েভ। করোনার ফার্স্ট ওয়েভে প্রায় সামলিয়ে নিয়েছিল দেশটি। সংক্রমণ ছিল নিয়ন্ত্রিত, কমে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিল অস্ট্রেলিয়ার আক্রান্তের সংখ্যা। পুরোপুরি নির্মূলের প্রত্যাশা নিয়ে দেশজুড়ে নতুন কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল দেশটির সরকার। কিন্তু গত মাসের শেষ দিক থেকে আবার বাড়তে থাকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব। ভিক্টোরিয়া প্রভিন্সে লকডাউন থাকার পরও করোনাভাইরাস সংক্রমণ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় প্রিমিয়ার ড্যানিয়েল অ্যান্ড্রুস হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না।
এদিকে করোনা আক্রান্তে সবাইকে ছাড়িয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় সম্মিলিতভাবে যত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আমেরিকা সেই সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ২৭ জুলাই বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তৈরী এক হিসাবে দেখা গেছে, ব্রাজিল, মেক্সিকো, পেরু, কলোম্বিয়া ও আর্জেন্টিনায় মহামারীতে সংক্রমণের হার দ্রুত বাড়ছে। বিশ্বের মোট করোনা আক্রান্তের ২৬ দশমিক ৮৩ শতাংশই এখন এই অঞ্চলে। দক্ষিণ আমেরিকায় এখন ৪৩ লাখ ২৭ হাজার ১৬০ জনের মতো মানুষ মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মিলে মোট সংক্রমণের সংখ্যা ৪৩ লাখ আট হাজার ৪৯৫।
তবে করোনায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রই। ২৭ জুলাই এর হিসাব মতে দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে এখন ৪১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৯২ জনে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের(সিডিসি) বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এমন খবর দিয়েছে।
গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে মহামারী শুরুর পর শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ৯৮ দিন। আর এখন মাত্র ১৬ দিনেই সংক্রমণ ৩০ লাখ থেকে বেড়ে ৪০ লাখ হয়েছে। সংক্রমণের এই হার বলছে, প্রতি ৮২ জন মার্কিনির মধ্যে অন্তত এক জন কোনও না কোন সময় ভাইরাস আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গড়ে প্রতি ঘণ্টায় এখন দুই হাজার ৬০০’রও বেশি মানুষ ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছে।
মহামারী বিস্তারের শুরুর দিকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল নিউ ইয়র্কে। সেখানে পরিস্থিতি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যেই হাসপাতালগুলোতে রোগী উপচে পড়ছে। অথচ কীভাবে এ মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা যায়; তা নিয়ে ফেডারেল সরকার, অঙ্গরাজ্য, গভর্নর এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে চরম মতবিরোধ চলছে। মাস্ক পরা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতি শুরু হয়েছে। অনেক আমেরিকান মনে করেন, মাস্ক পরা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করার মাধ্যমে তাদের সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। খোদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এমনটাই মনে করতেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনিও জনসমক্ষে মাস্ক পরতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তিনি এও বলেছেন, যখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয় না শুধু তখনই মাস্ক পরুন।
করোনা আসলে গোটা পৃথিবীর চিত্রই পাল্টে দিয়েছে। মানুষের কর্মজীবন, সামাজিক জীবন, এমনকি পারিবারিক জীবনও পাল্টে দিয়েছে এই ভাইরাস। পাল্টে দিয়েছে দেশে দেশে রাজনৈতিক চিত্রও। কবে শেষ হবে এই করোনার উৎপাত তা কেউই বলতে পারছেন না এখনো। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই অধির অপেক্ষায় আছেন করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা কবে আসবে বাজারে।
কিন্তু ভ্যাকসিনও করোনাকে দূর করতে পারবেনা এমন দাবি করছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। গত ২২ জুলাই বিবিসি’র খবরে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন দেশটিতে বহু বছর এই করোনাভাইরাস থাকবে এবং এটা চিরতরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিশেষজ্ঞরা আরো দাবি করছেন, যদি ভ্যাকসিন আসেও তবুও চিরতরে যাবে না করোনা ভাইরাস। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ওয়েলকাম ট্রাস্টের পরিচালক প্রফেসর স্যার জেরেমি ফারার হাউজ অফ কমন্সের একটি হেলথ কমিটিতে বলেন, বড়দিনের আগে কিছুই স্বাভাবিক হবে না। এটি দশকজুড়েও চলতে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে গত ২৩ জুলাই আল জাজিরা’র এক খবরে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ২০২১ সালের আগে করোনার টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। প্রতিনিয়ত রেকর্ড সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই ভাইরাসে। বিশ্বব্যাপী প্রতি মুহূর্তে প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি টিকার অগ্রগতি মানুষের মনে আশার সঞ্জার করেছে। আশা করা যাচ্ছে, চলতি বছরের শেষের দিকেই করোনার টিকা সহজলভ্য হবে বিশ্বে।
কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কর্মসূচির প্রধান মাইক রায়ান ২০২১ সালের প্রথম চার মাসের আগে করোনার টিকা পাওয়ার প্রত্যাশা না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, করোনার টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আমরা ভালো উন্নতি করছি। বেশ কয়েকটি টিকা তৃতীয় ধাপে আছে, ট্রায়াল চলছে। এগুলোর একটাও এখনও ব্যর্থ হয়নি। সবগুলোই মানবদেহের জন্য নিরাপদ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করতে সক্ষম। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এই টিকাগুলো বিশ্বব্যাপী সহজলভ্য হতে ২০১২ সালের প্রথম অংশ লেগে যাবে। এরপর হয়তো দেখব যে বিশ্বের সকল মানুষই করোনার টিকা পাচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
করোনা বার বার ফিরে আসবে না
বিশে^ কররোনা পরিস্থিতির ব্যাপারে এবার সুখবর দিলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা জানায়, সারা বিশ্বে করোনা ভয়াবহ হয়ে উঠলেও ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো প্রতিবছর নির্দিষ্ট ঋতুতে আর হাজির হবে না এই মারণভাইরাস। ব্যাপক আকার ধারণ করার পর ধীরে ধীরে কমে যাবে এই ভাইরাসের প্রদুর্ভাব। সংস্থার মুখপাত্র ড. মার্গারেট হ্যারিস জেনেভায় এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে বলেন, করোনা কোনো সিজনাল ভাইরাস নয়। কিংবা এটি বারবার ফিরে আসবে এমনটাও নয়।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৭০ লাখেরও বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৬ লাখ ৬৮ হাজার ২৫০ জন। জুলাই মাসের ৩১ তারিখের হিসাব এটি।