করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অশ্বেতাঙ্গ সহ অন্যান্যদের সহায়তাদান কানাডার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের মূল চাবিকাঠি

বেশী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছেন নারী, অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী এবং এলজিবিটি+ সম্প্রদায়

সেপ্টেম্বর 12, 2020

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কোভিড-১৯ মহামারির নেতিবাচক প্রভাব থেকে কানাডার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কখনই সম্ভব হবে বলে কানাডীয়রা আশা করতে পারে না যদি না এই অধোগতির কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করা হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছে নারী, অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী এবং এলজিবিটি+ সম্প্রদায়। নতুন এক রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে। খবর কানাডিয়ান প্রেস এর। রিপোর্ট করেছেন অনীতা বালাকৃষ্ণন।

“কানাডার জন্য একটি নারীবাদী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা: অর্থনীতিকে সবার জন্য কর্মশীল করে তোলা” শীর্ষক রিপোর্টটি গত ২৮ জুলাই মঙ্গলবার প্রকাশ পেয়েছে। টরন্টো ইউনিভার্সিটির রটম্যান স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের  জেন্ডার ও অর্থনীতি বিষয়ক ইনস্টিটিউট এবং ওয়াইডব্লিউসিএ যৌথভাবে এই রিপোর্ট প্রণয়ন করেছে।

রিপোর্ট প্রণয়নে নেতৃত্বদানকারী নির্বাহী এবং রটম্যানের স্ট্রাটেজিক ম্যানেজমেন্টের প্রফেসর সারাহ কেপলান বলেন, “আমরা যদি স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে কোভিড-১৯-এর প্রভাব লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যাবে এটি নির্দিষ্টি পরিচিতির কয়েকটি জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ওপর অসমানুপাতিক হারে প্রভাব রেখেছে। কারা, কেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে বিষয়ে মনোযোগ না দিলে আপনি অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন না।”

“নারীদের পিছিয়ে রাখার জন্য যেসব বিষয় দায়ী সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া আমরা প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারবো না।”

মহামারির মধ্যে কানাডার পুরুষদের তুলনায় ২৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী নারীদের কর্মসংস্থান কমেছে দ্বিগুণ হারে। রিপোর্টে আরও বলা হয় দৃশ্যমান সংখ্যালঘু যেমন কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামী ও অভিবাসী নারীদের বেশিরভাগেরই ব্যক্তিগত সহায়তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী কিংবা আবশ্যকীয় অথচ স্বল্প-মজুরির কাজে নিয়োজিত হবার সম্ভাবনা বেশি, যেখানে অসুস্থ থাকলে মজুরি দেয়া হয় না বা পারিবারিক ছুটির ব্যবস্থাও নেই।

কানাডায় স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে কোভিড-১৯-এর প্রভাব লক্ষ্য করে দেখা যায় এটি নির্দিষ্টি পরিচিতির কয়েকটি জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ওপর অসমানুপাতিক হারে প্রভাব রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে নারী, অশ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী এবং এলজিবিটি+ সম্প্রদায়। ছবি : প্রবাসী কণ্ঠ

বর্ণ ও লৈঙ্গিক পরিচয়-ভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত না থাকায় এ বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহের প্রয়োজন আছে উল্লেখ করে রিপোর্টে আরও বলা হয়, আবশ্যকীয় কাজে নিয়োজিত অনেক কর্মী কোভিড-১৯ এর প্রভাব থেকে অরক্ষিত রয়েছে কারণ তারা অভিবাসী কর্মী কিংবা তারা অনিয়মিত কাজে নিয়োজিত।

ক্যাপলান বলেন, “কোভিড-১৯ কখনই মহা সমতাবিধানকারী নয়। এটি বিদ্যমান অসাম্যের এক বড় উদ্ঘাটক। তিনি  পরিসংখ্যান উল্লেখ করে দেখান যে, নারীরা এখন প্রাথমিকভাবে বয়স্ক ব্যক্তি ও স্কুলে পড়া শিশুদের সেবাদানকারী মাত্র।

রিপোর্টে সর্বস্তরের সরকার এবং একই সঙ্গে ব্যবসায়িক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশে আটটি নীতিগত লক্ষ্য বিবেচনার আহবান জানানো হয়, যেগুলো পদ্ধতিগত বর্ণবাদের অবসান, উপযুক্ত কর্মসংস্থান, পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের সুরক্ষা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের জন্য তহবিল উন্নত করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বৈচিত্র আনার বিষয়গুলিকে সমুন্নত করবে।

নীতিগত বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশে শিশুপ্রযত্ন শিল্পের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে, যেমন, শিশু প্রযত্নে নিয়োজিত কর্মীদের মজুরী বাড়ানো এবং এ খাতের অভিবাসী কর্মীদের পারমানেন্ট রেসিডেন্সি দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ, যাতে “সেবামূলক-অর্থনীতিভিত্তিক খাতের কর্মীদের জন্য, যেমন শিশু ও বয়স্কদের সেবায় নিয়োজিত কর্মীদের, বৃহত্তর প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হয়।”

অন্যান্য পরামর্শের মধ্যে রয়েছে, আইনের হালনাগাদকরণ যেমন, ১৪ দিনের অসুস্থতাজনিত সবেতন ছুটি এবং সব ধরণের কর্মীদের জন্য সবেতন পারিবারিক ছুটি সংযোজন, employment insurance এর জন্য যোগ্যতার চাহিদা ৩৬০ ঘণ্টায় কমিয়ে আনা এবং বেনিফিটের হার বাড়িয়ে আয়ের ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা।

রিপোর্টে বলা হয়, “কোভিড-১৯ মহামারি  ‘ভালো চাকরি’ করা লোকজন- যাদের নিশ্চিত আয় আছে এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে সক্ষম তাদের সঙ্গে যাদের সেই সুযোগ নেই সেইসব লোকেদের মধ্যে বিদ্যমান উল্লেখযোগ্য বিভেদটা উন্মোচন করে দিয়েছে।”

কিছু সুপারিশ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার বিষয়েও স্পর্শ করেছে, যেমন, আবাসন না থাকা এবং কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী ও আদিবাসী-বিরোধী বর্ণবাদ যা মহামারির আগে থেকেই বিদ্যমান।

কেপলান বলেন যে, রিপোর্টে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে “নারীবাদে”র একটি সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে অসাম্য নির্মূলের ওপর আলোকপাত করে।

তিনি বলেন, “জাতিগত পরিচয় বা প্রতিবন্ধিতার বিষয়ে কথা না বলে আপনি কেবল নারীর ওপর প্রভাব ফেলে এমন বিষয়ে কথা বলতে পারেন না… বহু সংখ্যক মানুষ আছে যাদের চাকরি হারাবার সম্ভাবনা ছিলো সবচেয়ে বেশি, তারা হলো নারী অথবা অশ্বেতাঙ্গ নারী।” তিনি দীর্ঘমেয়াদি কেয়ারহোমস-এর স্টাফদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেন, যাদের অনেককেই একাধিক চাকরি করতে হয় স্বল্প মজুরির কারণে। এর ফলে মানুষের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা এবং কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বাড়ে।

তার ভাষায়, “অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে আমরা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের চিন্তা করি। এখন আমাদের সামাজিক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা দরকার যাতে ওইসব খাতে কর্মরত নারীদের জীবনমান উন্নীত করা সম্ভব হয়।

রিপোর্টে জাতীয় গৃহায়ন কৌশলের আওতায় এক লাখ ২৫ হাজার সামর্থের মধ্যে থাকে এমন আবাসন সুবিধা তৈরির কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহবান জানানো হয়।

রিপোর্টের প্রণেতারা চলমান মহামারিকে মহামন্দা বা বিশ্বযুদ্ধের সমতুল্য ধরে নিয়ে পুনর্গঠন পরিকল্পনায় একটি “জোরালো নিরাপত্তা জাল তৈরির” সুপারিশ করেন যেটি “আমাদের সবাইকে সুরক্ষা দেবে”।

উপরের রিপোর্ট থেকে দেখা যায় কানাডায় কভিড-১৯ এর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে আছেন অশে^তাঙ্গদের একটি অংশ যারা মূলত অভিবাসী। এই অভিবাসীদের বিশেষ করে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী নারী-পুরুষদের অর্থনৈতিক অবস্থা কানাডায় বরাবরই খারাপ অবস্থায় বিদ্যমান ছিল এবং আছে। আর এবার কভিড-১৯ এর করণে তা আরো অধোগতির দিকে গিয়েছে। এ কারণে তাদের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনার দাবী রাখে। ইতিপূর্বে কানাডিয়ান প্রেস এর আরেক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় তথাকথিত ফ্যামিলি-ক্লাসের অভিবাসীদের মধ্যে ক্রমাগত স্বল্প আয়ের ধারাবাহিকতা একটি উদ্বেগের বিষয় এবং এর একটি সমাধান হওয়ার দরকার আছে। কেবল মানবিক কারণে নয় বরং কানাডার অর্থনীতির টিকে থাকার স্বার্থেও এটা দরকার। দেশটির কনফারেন্স বোর্ডের এক নতুন সমীক্ষায় এ কথা বলা হয়েছে।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমিক ঘাটতি পূরণে কানাডা নবাগতদের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় দেশটিকে শ্রমবাজারে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকগুলো অপসারণ এবং নবাগতদের জীবনমান উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।

এতে বলা হয়, ফ্যামিলি-ক্লাসের অভিবাসীদের স্বল্প পরিমাণে আয় করা এবং তাদের আয়ের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে নিম্ন পর্যায়ে থেকে যাওয়া একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর একটি সমাধান হওয়া দরকার। অভিবাসী পরিবারগুলোকে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাহায্য করার জন্যই এটা করতে হবে।”

যেহেতু কানাডা তার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য অভিবাসীদের সাহায্যের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তাই, এটা করা হলে নবাগতদের মানব পূঁজির বিনিয়োগ থেকে কানাডা শ্রমবাজারে লাভবান হবে।

সমীক্ষায় তিনটি শ্রেণির অভিবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে কীভাবে অবদান রাখছেন তার পরিমাপ করা হয়। এতে দেখা যায় যে, ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সরকার ইকোনোমিক-ক্লাসের অভিবাসীদের প্রতি বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে এলেও পরিবার-শ্রেণির অভিবাসীরা ধারণক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে এবং অভিবাসী পরিবারগুলোর জন্য সুফল বাড়িয়ে তুলতে পারেন বেশি।

পারিবারিক পুনরেকত্রীকরণ এবং ব্যক্তিগত স্পন্সরশিপ প্রোগ্রামের আওতায় কানাডায় আসা নবাগতরা দেশটির মানুষের গড় আয়ের তুলনায় অনেক কম আয় করেন বটে, তবে তাদের পরিবারে শিশুদের দেখাশোনার মত লোক থাকায় তারা বেশি সময় ধরে কাজ করার ও পরিবারের আয় বাড়ানোর সুযোগ পান।

পারিবারিক পুনরেকত্রীকরণের ফলে অভিবাসীদের সমাজে থিতু হওয়ার এবং সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার বিষয়টিও জোরদার হয়। এটি তাদের ধারণ ক্ষমতা আরও পোক্ত করতেও সহায়ক হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, “এই বিষয়গুলো অথনৈতিক উন্নয়ন নীতিতে পারিবারিক পুনরেকত্রীকরণের উপযোগিতা সপ্রমাণ করে। কারণ এটি অর্থনীতিতে চাহিদার বিস্তার ঘটায় এবং কর্মীর যোগান দানের মাধ্যমে শ্রম সরবরাহ সংযোজন করে। এই প্রতিবেদন বিশেষভাবে প্রযোজ্য আটলান্টিক কানাডার প্রদেশগুলোর জন্য যেখানে অর্থনৈতিক শ্রেণির অভিবাসীদের পারিবারিক শ্রেণির অভিবাসীর সংখ্যা বেশি।

সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয় যে, এর প্রাপ্ত ফলাফল ফ্যামিলি-ক্লাসের অভিবাসীদের বিষয়টিকে অর্থনৈতিক নীতির আলোকে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই পর্যায়ে ধরে রাখতে হরে কানাডাকে নবাগতদের নিয়মিত প্রবাহের ওপর অব্যাহতভাবে নির্ভর করতে হবে এটি ধরে নিয়েই সমীক্ষা প্রতিবেদনে ওই কথাগুলো বলা হয়েছে।

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০৩৪ সালের মধ্যে কানাডায় মানুষের মৃত্যুর হার জন্মহারকে ছাড়িয়ে যাবে। এর অর্থ হলো শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়ে আসবে যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করার যান্ত্রিক ব্যবস্থার অগ্রগতিও রোধ করতে পারবে না।

সমীক্ষায় দেখা যায়, অভিবাসীদের জন্য কানাডার দরজা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হলে দেশে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র শ্রমশক্তি থাকবে, সুদের হার হবে উচ্চ পর্যায়ের এবং সামাজিক পরিষেবাও হ্রাসপ্রাপ্ত হবে। অন্যদিকে জনসংখ্যার এক শতাংশ হারে অভিবাসী আগমন বাড়ানো হলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে মাঝারি ধরনের।

প্রতিবেদনে শেষ যে কথা বলা হয় সেটি হলো, “কানাডার ইতিহাসের সব পর্যায়েই সমৃদ্ধির মুখ্য বিষয় ছিলো অভিবাসন এবং আগামী দিনে অভিবাসন আরও বৃহত্তর ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। সুতরাং কানাডার জন্য অভিবাসন থেকে উপকৃত হবার প্রচেষ্টায় সক্রিয় থাকার দরকার আছে।”