করোনায় কানাডিয়ানদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি
দেশজুড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে মদ্যপানের ঘটনা
নভেম্বর ৩, ২০২০
করোনার কারণে কানাডিয়ানদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। প্রতীকী এই ছবিতে মডেল হয়েছেন টরন্টো প্রবাসী শাপলা শালুক। ছবি তুলেছেন বিদ্যুত সরকার
খুরশিদ আলম : চলতি মাসের ১০ অক্টোবর ছিল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য: অধিক বিনিয়োগ-অবাধ প্রবাহ’। দিনটি উপলক্ষ্যে কানাডার প্রধানমন্ত্রী এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বর্তমান চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতে কেউ যেন একাকিত্ব অনুভব না করেন সে জন্য কানাডা সরকার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণদের জন্য বিশেষ পরিষেবা প্রদান করার পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সকল কানাডিয়ান যাতে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পান সে ব্যাপারেও সাহায্য করছে।”
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে করোনার এই মাহামারীকালে সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য অন্য যে কোন বছরের তুলনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে তার শরীর দূর্বল হয়ে পড়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং পরিনতিতে করোনার কাছে পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ করোনা মহামারির এই দুর্যোগকালে শরীরের পাশাপাশি মনের স্বাস্থ্য ঠিক রাখারও পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তাদের মতে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য শারীরিক স্বাস্থের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কানাডায় ইতিমধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। প্রথম ঢেউ এর তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউ এর আঘাত আরো শক্তিশালী হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রথম ঢেউ এর আঘাত প্রায় সামলে উঠেছিল কানাডা। করোনা নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ ভাল অবস্থায় ছিল। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞগণ করোনা নিয়ন্ত্রণে কানাডার সাফল্যকে মূল্যায়িত করার জন্য নম্বর দিয়েছিলেন অ-। মিসিসাগায় কর্মরত ইনফেকশাস ডিজির স্পেশালিস্ট ডা. সুমন চক্রবর্তী সিটিভি নিউজকে ইতিপূর্বে বলেছিলেন, ‘কানাডায় করোনা নিয়ন্ত্রণে আমরা আসলে খুব ভাল কাজ করেছি এবং এ জন্য আমরা নিজেরা অবশ্যই গর্ব করতে পারি। তবে আমাদেরকে এমন ভাবে গর্বিত হতে হবে যাতে আমরা আত্মতৃপ্তি লাভ না করি।’
কিন্তু গত প্রায় এক মাসে পরিস্থিতি আবার দ্রুত পাল্টাতে থাকে। শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। হু হু করে বাড়তে থাকে কারোনায় আক্রান্তের সংখ্যা। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে অন্টারিওতে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৯০০ বা তারো কিছু বেশী নতুন রোগীর সন্ধান দিতে থাকেন চিকিৎসকগণ। গড়ে প্রতিদিন ৯০৯ জন রোগী। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে কানাডিয়ানদের মানসিক চাপ। মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেলে অবনতি ঘটে মানসিক স্বাস্থ্যেরও।
অথচ নতুন আক্রান্তের সংখ্যা সেপ্টেম্বরের দিকে দৈনিক প্রায় এক শত বা কখনো কখনো তারও নিচে নেমে এসেছিল। ফলে কানাডিয়ানদের মধ্য মানসিক চাপও হ্রাস পেতে শুরু করেছিল।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, করোনার কারণে কানাডিয়ানদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। সিটিভি নিউজের পক্ষে ন্যানোস রিসার্স পরিচালিত এক জরিপে অংশগ্রহণকারী কানাডিয়ানদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে দুজনই বলেছেন করোনা শুরু হওয়ার পর তাদের মানসিক স্বাস্থ্য আগের তুলনায় আরো খারাপ হয়েছে এবং মদ্যপানের পরিমাণ ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। মদ্যপান বৃদ্ধির ঘটনা সবচেয়ে বেশী ঘটেছে আলবার্টায় (২৬%) এবং এর পরের স্থানে আছে অন্টারিও (২৩%)। জরিপের এই তথ্য সিটিভ নিউজে প্রকাশিত হয় গত ১১ অক্টোবর।
জরিপে আরো যে তথ্য প্রকাশ পায় তা হলো, প্রতি দশ জনে চার জন কানাডিয়ান বলেছেন করোনা শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে (এপ্রিল মাসে) তাদের মানসিক স্বাস্থ্য যে অবস্থায় ছিল তার চেয়ে এখন বেশী খারাপ অবস্থায় আছে (১৬% এর অভিমত) এবং কিছুটা খারাপ অবস্থায় আছে (২৪% এর অভিমত)। এপ্রিলের দিকে ১০% কানাডিয়ান বলেছিলেন তাদের মানসিক অবস্থা খারাপ এবং ২৮% কানাডিয়ান বলেছিলেন তাদের মানসিক অবস্থা কিছুটা খারাপ।
তবে প্রায় অর্ধেক কানাডিয়ান বলেছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য করোনা শুরু হওয়ার আগে যেমন ছিল এখনো তেমনি রয়েছে। অন্যদিকে প্রতি দশজনে একজন কানাডিয়ান বলেছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল অবস্থায় আছে (৪%) অথবা কিছুটা ভাল আছে (৭%)। জরিপে অংশ নেয়া ১% বলেছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য কি অবস্থায় আছে সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।
মানসিক দুশ্চিন্তা কীভাবে শুরু হয়
মানসিক দুশ্চিন্তা শুরু হতে পারে যে কোন কিছু থেকেই। স্বাস্থ্য বা টাকা-কড়ি থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রের সমস্যা বা কোন পরিবর্তন। কারও সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিও এর কারণ হতে পারে। এর যে কোনটাই একটা গভীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এ থেকে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে যে কারোর মাঝে।
আর এখন মানসিক দুশ্চিন্তা শুরু হওয়ার নতুন এক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিমাত্রায় ছোঁয়াচে কভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব। এই মহামারী শুরু হওয়ার পর মানুষের মধ্যে এখন দেখা দিয়েছে বাইরে যাওয়া নিয়ে ভয়, নিজে সংক্রমিত হওয়ার ভয় এবং অন্যদেরকে সংক্রমিত করার ভয়, মাস্ক পরার যন্ত্রণা কিংবা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আকুতি- এরকম নানান চিন্তার সঙ্গে ভবিষ্যতে কী অবস্থা দাঁড়াবে সেই চিন্তা তো আছেই। বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, বৃটেনের দাতব্য সংস্থা ‘অ্যাংজাইটি ইউকে’ এইসব দুশ্চিন্তাকে নাম দিয়েছে করোনা-অ্যাংজাইটি। তারা বলছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে তাদের হেল্পলাইনে সাহায্য চেয়ে আসা কলের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এখন যারা সাহায্য চেয়ে কল করেন, তাদের সমস্যাগুলো স্বাভাবিক সময়ের সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। কলগুলো অনেক দীর্ঘ, বলছে এই সংস্থাটি।
কানাডাসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে লকডাউন এবং সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলার নানা বিধিনিষেধ মানুষের আগের রুটিনে অনেক বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তারা তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে আগে থেকেই যারা মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন, তাদের অবস্থা আরও খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে। এর পাশাপাশি করোনাভাইরাসের ভয়ে অনেকে এই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে যাচ্ছেন না। এতে করে অনেকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা গুরুতর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। টরন্টোতে কর্মরত ইনফেকশাস ডিজিজ স্পেশালিস্ট ড. আইজাক বোগোচ সিটিভি নিউজে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যারা এই মহামারীকালে বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তারা প্রয়োজনে হাসপাতাল ভিজিট করতে পারেন। হাসপাতালগুলো ভাইরাস মোকাবেলায় আগের চেয়ে অনেক বেশী প্রস্তুত রোগীর সেবা প্রদান করার জন্য। হাসপাতালে না গিয়ে রোগ চেপে রাখলে রোগীর অবস্থা আরো বেশী সংকটাপন্ন হতে পারে।
এদিকে নাউটরন্টো.কম এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় কোভিড-১৯ এর কারণে কানাডিয়ানদের মানসিক স্বাস্থ্য এখন বেশ তালগোল পাকাচ্ছে। গত জুলাইতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ফের শুরুর পর দেশে যে অপেক্ষাকৃত আশাবাদের সঞ্চার হয়েছিলো তা থিতিয়ে গেছে। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত মরনিউ শিপিল-এর সর্বশেষ মাসিক ইনডেক্স রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।
রিপোর্টে দেখা যায়, বিভিন্ন স্তরের কানাডিয়ানদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এতে দেখা যায়, উদ্বেগ, অবসাদগ্রস্ততা এবং বিচ্ছিন্নতা বোধ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে
যদিও শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা অপরিবর্তিত রয়েছে।
শিক্ষা খাতে কর্মরত ব্যক্তি এবং মাধ্যমিক-উত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে গুরুতর প্রভাব পড়েছে। মাধ্যমিক-উত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব স্তরের কানাডিয়ানদের চেয়ে সমীক্ষায় সর্বনিম্ন অবস্থান পেয়েছে।
রিপোর্টের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো :
– মানসিক স্বাস্থ্যে পুরুষের চেয়ে নারীদের অবস্থান নিচে
– শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে ভালো আছে। লাতিন, দক্ষিণ বা মধ্য আমেরিকান এবং পূর্ব এশীয়দের অবস্থানও নিচুতে।
– কুইবেক, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া এবং মেরিটাইম অঞ্চলের মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় অবনতি ঘটেছে।
– সন্তান নেই এমন কানাডীয়দের চেয়ে যাদের সন্তান আছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা অপেক্ষাকৃত খারাপ।
– মোটর গাড়ি শিল্প, রিয়েল এস্টেট এবং খনি ও তেল-গ্যাস খাতে কর্মরতদের মানসিক স্বাস্থ্যের স্কোর বেশ উঁচু।
– সমীক্ষায় অংশ নেওয়া কানাডিয়ানরা যেসব অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো, উদ্বেগ (২৫%), শান্ত (১৯%) এবং হতাশ (১৯%)।
অন্যদিকে সিবিসি নিউজে প্রকাশিত অ্যাঙ্গুস রেইড ইন্সটিটিউটের অনলাইনে করা ইতিপূর্বের এক সমীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, চাকরি হারানোর ঘটনা বেড়ে যাওয়া এবং স্বেচ্ছা বিচ্ছিন্নতা অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে কানাডার অর্ধেক মানুষই বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারির সময় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। আর ১০ শতাংশ বলেছেন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের “যথেষ্ট” অবনতি হয়েছে।
সাম্প্রতিক জীবন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে বলা হলে সমীক্ষায় অংশ নেয়া কানাডিয়ানদের ২০ শতাংশেরও কম মানুষ আশাবাদের কথা জানিয়েছেন। আর ১৬ শতাংশ নিজেদেরকে বিষন্নতায় আক্রান্ত বলে জানান।
১১ শতাংশ মানুষ বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা কোনরকম সমস্যা অনুভব করছেন না। ১৪ শতাংশ পুরো স্বাভাবিক আছেন বলে মনে করছেন এবং নয় শতাংশ মানুষ এমন বোধ করছেন যেন তারা অসাড় হয়ে পড়েছেন। ছয় শতাংশ কানাডিয়ান নিজেকে সুখি মনে করছেন। গত ১৫ থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত এই সমীক্ষা চালানো হয়।
অ্যাঙ্গুস রেইড কোভিড-১৯-এর প্রভাব নিয়ে যে সূচক তৈরি করেছে তাতে কানাডিয়ানদের চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে: এগুলি হলো, যারা মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছেন, যারা মানসিক ভোগান্তির শিকার, যারা আর্থিকভাবে খারাপ অবস্থায় আছেন এবং যারা মানসিক ও আর্থিক দিক থেকে গুরুতর প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণিতে আছেন দেশের সব অঞ্চলের অন্তত ২০ শতাংশ মানুষ। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের হার সর্বাধিক হলো আলবার্টায় ৩২ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন কুইবেকে ২০ শতাংশ।
কার্ল বলেন, তেলের দাম কমে যাবার কারণে আলবার্টার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর ফলে এই প্রদেশের অনেক পরিবার “অর্থনৈতিক অস্থিতি ও অনিশ্চয়তার” মুখে পড়েছে। এ থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, মহামারির সময় বিশেষভাবে এই প্রদেশের জনগণই কেন সবচেয়ে বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণির এক-চতুর্থাংশ লোক বলেছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরুর পর থেকে তাদের ঘরোয়া সম্পর্কে সমস্যা দেখা দিয়েছে। একই কথা বলেছেন ভালো থাকা মানুষের গ্রুপের মাত্র ছয় শতাংশ মানুষ।
এদিকে প্রতি পাঁচজন কানাডিয়ানের মধ্যে দুজনই যখন বলেছেন যে তারা উদ্বিগ্ন বা উৎকণ্ঠিত বোধ করছেন, তখন প্রতি তিনজনে একজন একথাও বলেছেন যে, তারা কৃতজ্ঞ বোধ করছেন।
অ্যাঙ্গুস রেইডের রিপোর্টে বলা হয়, “কানাডিয়ানরা যে সমস্বরে তাদের জনস্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করছেন তার কারণ এই মন্তব্যে প্রতিফলিত।
মহামারিকে কেন্দ্র করে যেসব আবেগ-অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে এমন ৩০ শতাংশ কানাডিয়ান আছেন, যারা বলেছেন যে, তারা নেহায়েতই বিরক্ত।
মহামারির কারণে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলেও ৫৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের পুরুষরা বলেছেন যে, তাদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে সামান্যই। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনার দিক থেকে ১৮ থেকে ৫৪ বছরের নারীরা সবচেয়ে এগিয়ে আছেন।
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত নারীদের মধ্যে অনেকে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে বলে জানিয়েছেন। অ্যাঙ্গুস রেইড ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক শাচি কার্ল সিবিসি নিউজকে একথা বলেন। তিনি বলেন, মহামারির কারণে ঘরে ঘরে গিয়ে শিশু ও তাদের বাবা-মায়ের যত্ন নেয়ার অংশ হিসাবে তাদের আবেগগত বিষয় নিয়ে বাড়তি তৎপরতার মধ্যে নারীদের অবস্থা সম্পর্কিত তথ্যের ব্যাখ্যা রয়েছে।
সমীক্ষায় অংশ নেয়া লোকেদের এক-চতুর্থাংশ বলেছেন, তাদের রুমের সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। ১৪ শতাংশ বলেছেন, অবনতি ঘটেছে। তবে বেশিরভাগ বলেছেন, সম্পর্কের কোনওরকম পরিবর্তন হয়নি।
উপরের এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল কানাডায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু আগে। এখন অক্টোবর থেকে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে এবং করোনায় সক্রমণের হার প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় অনেক বেশী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর কারণ হিসাবে যে সকল ঘটনাকে দায়ী করা হচ্ছে তার মধ্যে আছে- গত দুই মাসে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া, তরুণদের মধ্যে মেলামেশার হার বৃদ্ধি এবং অতি সম্প্রতি থ্যাঙ্কস গিভিং এর সময় লোকজনের মধ্যে দূরত্বের নিয়ম না মেনে সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় অনেক বেশী সক্রমণ ঘটছে বলেও কানাডিয়ানদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আগের তুলনায় আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সাথে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিও আরো বেশী ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সামনে আসছে শীত। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন এ কারণেও লোকজনের মানসিক স্বাস্থ্যের আরো অবনতি ঘটতে পারে।
টরন্টো ইউনিভার্সিটির মনোবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক স্টিভ জর্ডনস কানাডিয়ান প্রেসকে বলেন, করোনা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আগামী শীতে বিষন্নতায় রূপ নিতে পারে, বিশেষ করে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর। তার মতে করোনা নিয়ে এ পর্যন্ত যত উৎকণ্ঠা তৈরী হয়েছে সেটা কানাডিয়ানদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর অন্যতম প্রধান প্রভাব ফেলেছে। আর উৎকণ্ঠার কারণগুলো হলো, স্বাস্থ্য, চাকুরীর নিরাপত্তা এবং কবে নাগাদ জীবন আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসবে।
স্টিভ জর্ডনস আরো বলেন, আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণে ইতিপূর্বে যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছিলাম তাতে আমরা দেখেছি কাজ দিয়েছিল। কানাডায় করোনা নিয়ন্ত্রণ বেশ ভালভাবেই এগুচ্ছিল। এই বিষয়টি আমাদেরকে উৎসাহিত করে এবং আমাদের ক্ষমতা আছে এমন একটি ধারণা দেয়। কিন্তু আবার আমরা দেখলাম দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে এবং সংক্রমণের হার আগের চেয়ে বেশী হচ্ছে। সে কারণে আবারো নানারকম নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে। এই বিষয়টি আমাদের মাঝে যে অনুভূতি সৃষ্টি করেছে তা হলো, আমরা আগে যাই করেছি তা আসলে কাজে দেয়নি। করোনা আবারো ফিরে এসেছে। এখন কেউ যদি এভাবে চিন্তা করেন তবে করোনার উৎকণ্ঠা একসময় ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় রূপ নিবে। মনোবিদ্যায় যাকে অসহায়ত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয়, সেটি প্রশ্রয় পেলে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জয়ী আমরা হবোই এই বিশ^াসটুকু না থাকলে মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। শীত আসছে, সেই সাথে দিনের আলোও কমে আসছে, কমে যাবে সামাজিক যোগাযোগের পরিমাণও। বাইরে যাওয়া একেবারেই কমে যাবে। সেই সাথে চাকুরীর নিরাপত্তাও হ্রাস পাবে। জর্ডনস বলেন, আমরা আশঙ্কা করছি, এ সকল কারণে হয়তো বিষণ্নতার হার বেড়ে যেতে পারে কানাডিয়ানদের মধ্যে।
মূলত: বিভিন্ন সমীক্ষায় যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো, বিশ^ব্যাপী করোনার দীর্ঘস্থায়ী অবস্থান, এর তীব্রতা এবং সামাজিক দূরত্ব ও পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য চিন্তা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষের মধ্যে ব্যাপকহারে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। আর এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থেকে অনেকের মাঝেই দেখা দিয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি।
মানসিক উৎকন্ঠা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়
করোনা ভাইরাস সৃষ্ট মহামারির কারণে গত কয়েক মাসে সকলের জীবনে যেসব নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে মানসিক দুশ্চিন্তা যেন অনেক বেড়ে গেছে। এক নতুন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, অভিভাবকরা বিশেষ করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাদের সন্তানদের নিয়ে।
আর এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় কী? বিবিসি এ বিষয়ে সম্প্রতি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, কেউ মানসিক উৎকন্ঠা বা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন, তার মানে এটা মানসিক চাপ বা কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত হওয়ার চাইতে বেশি কিছু। আমরা সবাই কমবেশি কোন না কোন বিষয়ে চিন্তায় থাকি, বা মানসিক চাপে ভুগি। এগুলো মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এরকম প্রতিক্রিয়া দেখানো ভালো।
কিন্তু কেউ যখন সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকেন, যেটা রীতিমত ভীতিকর হয়ে উঠে এবং যা থেকে আর মুক্তি পাওয়া যায় না, তখন সেটাই আসলে মানসিক উৎকন্ঠা বা দুশ্চিন্তা। এই সমস্যা এতটাই তীব্র হয়ে উঠতে পারে যে এটি একজন মানুষের পুরো জীবন বিপর্যস্ত করে দিতে পারে, তার নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজকর্মে বিঘ্ন তৈরি করতে পারে।
এর ফলে সেই ব্যক্তিকে সারাক্ষণই খুব চিন্তিত মনে হবে, তিনি ক্লান্তিতে ভুগবেন এবং কোন কিছুতেই মন বসাতে পারবেন না। তার ঘুমাতে অসুবিধা হবে এবং বিষন্ন বোধ করবেন।
প্রায়শই এমন কিছু লক্ষণ চোখে পড়বে, যার প্রভাব শরীরেও পড়বে। যেমন হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘন ঘন নিশ্বাস নেয়া, শরীর কাঁপা, ঘাম হওয়া, মাথা ঘোরা, ডায়ারিয়া এবং অসুস্থ বোধ করা।
মানসিক উৎকন্ঠার অনেক রকমফের আছে। কারও ক্ষেত্রে এটা হয়তো খুবই মৃদু, কারও ক্ষেত্রে এটি খুবই তীব্র হয়ে উঠতে পারে। প্রতি দশ জনের একজন জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে মানসিক দুশ্চিন্তায় বা কোন ধরণের ফোবিয়া বা ভীতিতে আক্রান্ত হবেন। কিন্তু অনেকেই এরজন্য চিকিৎসকের কাছে যান না।
বিবিসি’র প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মানসিক দুশ্চিন্তায় ভোগা মানুষদের প্রথমেই উচিৎ নিজেই নিজেকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার চেষ্টা করা। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অব সাইক্রিয়াট্রিস্টসের পরামর্শ হচ্ছে, নিজেকে নিজে সাহায্য করার কিছু কৌশল আছে, প্রথমে সেটাই চেষ্টা করা উচিৎ। যেমন:
– কোন বন্ধু বা আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলা
– কোন সেল্ফ হেলপ গ্রুপ বা অনলাইন সাপোর্ট গ্রুপে যোগ দেয়া
– রিল্যাক্সেশন বা শারীরিক-মানসিক শিথিলকরণের কৌশল শেখা
– যোগ ব্যায়াম, শরীরচর্চা, বই পড়া এবং গান শোনা। এগুলো খুব সহায়ক হতে পারে
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মদ পান এবং ধূমপান বন্ধ করলেও মানসিক উৎকন্ঠা অনেক কমে যায়।
যুক্তরাজ্যে মানসিক দুশ্চিন্তা বিষয়ক একটি সংস্থা অ্যাংজাইটি-ইউকে’র নিকি লিডবেটার বলেন, কেউ যেন মানসিক দুশ্চিন্তা চেপে রেখে একা একা না ভোগেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
করোনার এই মহামারীকালে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার আরো কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আস্থাভাজন ব্যক্তিদের পরামর্শ নিন। তাঁরা আপনাকে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে সহায়তা করবেন বিভিন্নভাবে। আর গুজবে কান না দিয়ে পরিবারের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। বিভিন্ন মাধ্যমে এখন উড়ছে অতিপ্রচার, অপপ্রচার এবং বিভিন্ন গুজব। এসব গুজবে কান দেবেন না। পরিবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত সময় কাটান। সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করুন, রুটিন বিষয়গুলো, যেমন ঘুম, ঠিক সময়ে খাবার, বাড়িতে হালকা ব্যায়াম ইত্যাদি বন্ধ করবেন না। সুষম আর নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করুন। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। সময়মতো ঘুমান, হালকা ব্যায়াম করুন এবং অবশ্যই নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। ধূমপান, মদ্য পান বা নেশা এড়িয়ে চলুন।
অধ্যাপক ডা. হেলাল আরো বলেন, শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন হলেও আত্মীয়-বন্ধুদের খোঁজ রাখুন। প্রায় আবদ্ধ শহরে বিচ্ছিন্নতার জন্য অসহায় লাগতে পারে। তাই বন্ধু আর স্বজনদের সঙ্গে ই-মেইল, টেলিফোন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে যোগাযোগ রাখুন। পরস্পরের খোঁজ রাখুন। দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আপনি নিজে বা পরিবারের সদস্যরা প্রচারমাধ্যমে/সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সারাক্ষণ করোনা সংক্রমণ আর এর পরিণতি নিয়ে তথ্য, সংবাদ ও ভিডিও দেখবেন না। এতে নিজের ওপর মানসিক চাপ তৈরি হবে। করোনা নিয়ে সঠিক তথ্য জানার পাশাপাশি অন্যান্য অনুষ্ঠানও উপভোগ করুন।
মনে রাখতে হবে, মানসিক রোগও কিন্তু ‘রোগ’। অন্যান্য রোগের মতোই এ রোগে মানুষের দেহে আর মনে পরিবর্তন ঘটে। কিছু মানসিক রোগে ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপিও প্রয়োজনীয়। তাই বিশেজ্ঞদের পরামর্শ হলো, প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাহায্য নিন। করোনার এই মহামারীকালে মানসিকভাবেও সুস্থ্য থাকুন।