ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না
ইতিহাসের সবচাইতে বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না
জুলাই 13, 2020
খুরশিদ আলম : ইতিহাস বড় নির্মম। কাউকে ক্ষমা করে না। আর ইতিহাসের সবচাইতে বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। মনিষীদের পর্যবেক্ষণ এটি। গেল কয়েক সপ্তাহে এই পর্যবেক্ষণটি আবারো সত্য প্রমাণিত হলো যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপ জুড়ে এক কালের ‘ক্ষমতাবান, ধনবান ও প্রাতঃস্মরণীয়’ ব্যক্তিগণ তাদের অতীত অপকর্মের জন্য নিন্দিত হচ্ছেন, তিরস্কৃত হচ্ছেন এবং অসম্মানিত হচ্ছেন। তাদের মূর্তি বা ভাস্কর্যের গায়ে কালিমা লেপন করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও ভাঙচুর করা হচ্ছে তাদের ভাস্কর্যগুলো।
এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য মিনেসোটায় শে^তাঙ্গ এক পুলিশ সদস্য কতৃক জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর। হত্যাকান্ডের বিষয়টি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমে ছড়িয়ে দেন প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা। এর পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। প্রথম দিকে প্রতিবাদের ভাষা ছিল রাজপথে প্রতিবাদ মিছিল ও স্লোগান দেওয়ার মধ্যে। তবে করোনার এই মহামারী কালেও যুক্তরাষ্ট্রের মাটি ছাপিয়ে এই আন্দোলনের বাতাস যখন কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোতে লাগে তখন এটি আরও বেগবান হয়। এখন এই আন্দোলন শুধু ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ‘আই কান্ট ব্রিদ’ লেখা প্ল্যাকার্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই আন্দোলন রূপ নিয়েছে বর্ণবাদবিরোধী কঠিন আন্দোলনে। বিভিন্ন শহরে বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত মানুষের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সড়কের নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুগ যুগ ধরে প্রায় দেবত্বের আসনে বসিয়ে এই বর্ণবাদী, দাস ব্যবসায়ী আর গণহত্যা পরিচালনাকারীদের জন্মদিন- মৃত্যুদিন পালন করা হয়ে আসছে। এদেরকে ‘জাতীয় বীর’ বা ‘মহানায়ক’ হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেয়া হয়েছে, এদের ‘অবদান’-কে মূর্ত্যমান করার জন্য মূর্তি বা ভাষ্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।
এই ‘মহানায়ক’রা তাদের ‘স্বর্ণযুগে’ মানুষের পায়ে বেড়ি পরিয়েছিলেন, মানুষকে পণ্য বানিয়েছিলেন, দাস বানিয়ে বিক্রি করেছিলেন, মহিলা দাসদের ধর্ষণ করেছিলেন, মানুষের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি এমন কি দেশ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিলেন, দখলের জন্য প্রয়োজনে গণহত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছেন। মানুষের বর্ণের জন্য তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন, তাদেরকে ঘৃণা করেছেন।
অথচ কি আশ্চর্যের বিষয়, যুগ যুগ ধরে এই মানুষগুলোই ‘প্রাতঃস্মরণীয়’ বা ‘পূজনীয়’ হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নিয়েছেন। সে কোন যাদুমন্ত্র বলে? এতসব অপকর্ম করেও তারা কি ভাবে কোন কৌশলে মানুষের মনে সুদীর্ঘকাল ধরে ‘উজ্জল নক্ষত্র’ হয়ে ‘জাজ¦ল্যমান’ হয়ে আছেন? সে এক অপার রহস্যই বটে।
কিন্তু তারা যে অপকর্ম করেছেন, দেশ দখল করেছেন, গণহত্যা করেছেন, নারী ধর্ষণ করেছেন সে সকল তথ্য সাধারণ মানুষ সবটা না জানলেও ইতিহাসবিদরা তো জানতেন। কিন্তু তারপরও সেই অত্যাচারী, ক্ষমতালোভী, অর্থলোভী, নারী লোভী, বর্ণবাদী মানুষগুলোর ভাস্কর্য কি ভাবে এতকাল ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে? আর শুধুই কি ভাস্কর্য? তাদের নামে নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ রাজপথ, অঞ্চল বা প্রতিষ্ঠানের নাম!
বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। ভারতবর্ষে উপনিবেশ সৃষ্টিকারী ইংরেজরা বিদায় নিয়েছেন সাত দশকেরও আগে। কিন্তু এখনো তাদের ভূত বাঙ্গালীদের ঘাড় থেকে নামেনি। এখনো চট্রগ্রামের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের নাম কক্স বাজার রয়ে গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের একটি দ্বীপের নাম সেন্ট মার্টিন রয়ে গেছে। ইংরেজদের নামে এখনো রয়ে গেছে কার্জন হল, ভিক্টোরিয়া পার্কসহ আরো অগুনিত রাস্তা ও স্থাপনার নাম! কেন? কোন কারণে বা কোন যুক্তিতে?
পশ্চিমা দেশগুলোর কথায় ফিরে আসা যাক। বলা হয়ে থাকে আমেরিকা অবিষ্কার করেছিলেন ইতালীয় অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস। একটি মহাদেশ আবিস্কারের জন্য তিনি কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মানুষ কলম্বাসের স্মৃতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণও করেন। স্কুলের পাঠ্যবইতে কলম্বাসকে ‘নতুন পৃথিবীর আবিষ্কারক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৩৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারিভাবে ‘কলম্বাস দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। এ দিন সরকারি ছুটি।
কিন্তু কলম্বাস কি সত্যিই আমেরিকা আবিস্কার করেছিলেন? ‘আবিস্কার’ এর কৃতিত্ব তো তাকেই দেয়া হয় যিনি সবার আগে প্রথম কোন কিছু খুঁজে পান। কিন্তু কলম্বাস আমেরিকায় আসার বহু শত বছর আগে থেকেই তো এখানে জনবসতি ছিল। তাহলে কলম্বাস কোন অবস্থায়ই এ জনপদে প্রথম নন। এবং সেই অর্থে আবিস্কারকও নন। তাছাড়া আমেরিকায় আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কলম্বাসের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, ষোড়শ শতাব্দীতে আমেরিকায় এসে স্থানীয়দের দাস হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে রয়েছে গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগও। একজন খুনি ও অত্যাচারী শাসক হিসেবেও তার পরিচয় আছে। বলা হয়ে থাকে যে, আমেরিকার আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের জীবনে এটি ছিল সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য যে, কলম্বাস ভারতে না পৌঁছে আমেরিকায় পদার্পণ করেন।
সুদীর্ঘকাল পরে হলেও পরিস্থিতি এখন বদলাচ্ছে। কলম্বাস এখন আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের হোতা এবং স্থানীয় আদিবাসীদের হত্যার অগ্রদূত হিসেবে নিন্দিত হচ্ছেন এবং ধিকৃত হচ্ছেন। কলম্বাস দিবস পালনের যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কলম্বাসের প্রতি আমেরিকানদের আগ্রহ এবং শ্রদ্ধাবোধে চির ধরছে। হারিয়ে যাচ্ছে কলম্বাস দিবস পালনের সংস্কৃতি ও উৎসব। তাকে গণহত্যার জন্য দায়ী করে আমেরিকার বিভিন্ন শহর-নগর এমনকি রাজ্য কলম্বাস দিবস বর্জন করে আদিবাসী দিবস পালনের ধারা চালু করছে।
আর এবার ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের রোষানলে পড়ে কলম্বাসের বেশ কয়েকটি ভাষ্কর্য ভাঙচুরের শিকার হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মিনেসোটার সেইন্ট পলে গত ১১ জুন বিক্ষোভকারীরা ইতালিয়ান অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ১০ ফুট ব্রোঞ্জের মূর্তি দড়ি দিয়ে টেনে এর ভিত্তি থেকে ফেলে দেন। বর্ণবাদ ও পুলিশের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল এটি। বিক্ষোভকারীদের দাবি, বর্ণবাদ, দাসপ্রথা বা দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের ভাষ্কর্য প্রকাশ্যে রাখা যাবে না। যদি রাখতেই হয়, তবে সেগুলোকে জাদুঘরে স্থানান্তরিত করতে হবে।
মিনেসোটা ছাড়াও ৯ জুন ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডের বায়ার্ড পার্কে হাজারখানেক বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাষ্কর্য দড়ি দিয়ে টেনে মাটিতে ফেলে দেন। পরে সেই ভাস্কর্যটি একটি দড়ি দিয়ে বেধে টেনে আনা হয় স্থানীয় একটি লেকের ধারে এবং সেই লেকের পানিতে ভাস্কর্যটি ফেলে দেওয়া হয়। ১০ জুন বোস্টনের আটলান্টিক অ্যাভিনিউতে কলম্বাস পার্কে কলম্বাসের আরেকটি ভাস্কর্যের মাথা খুলে ভেঙে ফেলা হয়। ভাস্কর্যের গায়ে একজন লিখে দেন, ‘কলম্বাস গণহত্যার উপস্থাপক’। ১১০ বছর আগে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের রেন্ডলফ পার্কে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছিল। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ডর প্রতিবাদ অব্যাহত থাকায় ১৫ জুন ডেট্রয়েট শহরের মেয়র মাইক ডুগান কলম্বাসের ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দেন। বর্তমানে মূর্তিটি সংরক্ষণ করা হলেও এটি নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন বলে মেয়র জানান। ১৫ জুন মিসৌরির সেন্ট লুইসের টাওয়ার গ্রোভ পার্ক থেকে ১৪০ বছর পুরনো ক্রিস্টোফার কলম্বাসের একটি মূর্তি নিরাপত্তার খাতিরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এর আন্দোলনের মুখে বর্ণবাদীদের ভাস্কর্য ভাংচুর বা সরিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে কানাডাতেও। আন্দোলন ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠেছে এই দাবীতে যে, অতীতে যারা বর্ণবাদী ছিলেন অথবা বর্ণবাদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন সেই সকল ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ভাস্কর্য কানাডার বিভিন্ন স্থান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। এর মধ্যে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি হলেন কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড। ম্যাকডোনাল্ডকে কানাডার জাতির পিতাও বলা হয়ে থাকে। টিএনসি নিউজের এক খবরে বলা হয়, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলকারীরা দাবী করছেন, কানাডার মন্ট্রিয়লে অবস্থিত ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্যটি-সহ অন্যান্য আরো কিছু ভাস্কর্য বর্ণবাদের প্রতীক এবং একই সাথে অতীতের গণহত্যারও প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাই এগুলোকে স্তম্ভের পাদভূমি থেকে সরাতে হবে। এক অনলাইন পিটিশনের মাধ্যমে তারা কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্য সরানোর আহ্বান জানান মন্ট্রিয়লের মেয়র এবং সিটি কাউন্সিলের প্রতি। তারা ম্যাকডোনাল্ডকে বর্ণবাদী ও হোয়াইট ন্যাশনালিস্ট হিসাবে আখ্যায়িত করেন। সত্যিকার অর্থে ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্য সাংস্কৃতিক ইতিহাসে হোয়াইটওয়াশিং এর একটি উদাহরণ। পিটিশনে দশ হাজারেরও বেশী লোকের স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়।
ম্যাকগিল ইউসিভার্সিটির আর্ট ইতিহাসের অধ্যাপক চার্মাইন নেলশন বলেন, এই ভাস্কর্য বা স্মৃতিস্তম্ভগুলো অর্থহীন, তুচ্ছ জড় পদার্থ নয়। বরং এই ভাস্কর্যগুলো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা কৌশলগতভাবে বর্ণবিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য একটি তাবিজ হিসাবে ব্যবহার করছেন।
উল্লেখ্য যে, ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্য বর্তমান ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেও কানাডার বিভিন্ন স্থানে ভাংচুরের শিকার হয়েছে বেশ কয়েকবার। গত বছর মে মাসের ১৭ তারিখে মন্ট্রিয়লে Brigade de solidarité anticolonial Delhi-Dublin নামে ঔপনিবেশবাদ বিরোধী একটি দল ম্যাকডোনাল্ড এর একটি ভাস্কর্য ভাংচুর এর ঘটনা ঘটনায়। তারা একই সময় রাণী ভিক্টোরিয়ার একটি ভাস্কর্যের উপরও হামলা চালায়। ২০ মে ছিল ভিক্টোরিয়া ডে। বৃটেনের সাবেক রাণী ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে এই দিবসটি পালন করা হয় কানাডায় সরকারী ভাবে। ঐ দিন কানাডায় সরকারী ছুটি থাকে। আর এর ঠিক দুদিন আগে রাণীর ভাস্কর্যের গায়ে লাল রং লেপ্টে দেয়া হয়। কানাডায় রাণী ভিক্টোরিয়ার ভাস্কর্যের উপর হামলা এই প্রথম নয়, অতীতে এরকম ঘটনা আরো ঘটেছে। যারা রাণীর ভাস্কর্যের গায়ে রং লেপ্টে দিয়েছে তাদের ভাষ্য হলো, ঔপনিবেশবাদ এর বিরোধীতা করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
আন্দোলনকারীদের দাবী, ম্যাকডোনাল্ড কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি ছিলেন প্রচন্ড ভাবে বর্ণবাদী! তিনি কানাডার আদিবাসীদের দেখতে পারতেন না। কানাডার আদিবাসীদের সনন্তানদের জোর করে ধরে এনে বিতর্কিত আবাসিক স্কুলে ভর্তি করানোর পিছনেও তার ভূমিকা ছিল জোরালো। সেই স্কুলে আদিবাসী শিশুদের উপর চালানো হয়েছিল নির্মম অত্যাচার। যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়েছিল ঐ শিশুরা।
সা¤প্রতিক সময়ে জন এ. ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্যের উপর হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে-ম্যাকডোনাল্ড কি আসলেই বর্ণবাদী ছিলেন? এর সোজাসাপ্টা উত্তর দিতে গেলে বলতে হবে- হ্যা তিনি বর্ণবাদী ছিলেন। এবং প্রচন্ডভাবেই ছিলেন। এবং তিনি নিজেই তার জীবদ্দশায় এ কথা স্বীকার করে গেছেন।
জন ম্যাকডোনাল্ড ১৮৯১ সালে মৃত্যুর আগে প্রায় দুই দশক ধরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। দেড় ’শ বছরেরও আগে কানাডার কনফেডারেশন গঠনের পেছনে তার কিছু ভূমিকাই মুখ্য চালিকাশক্তি ছিলো বলে তিনি দেশটিতে শ্রদ্ধার পাত্র হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। তার নাম ও ছবি টাঙ্গানো রয়েছে দেশের বিভিন্ন হাইওয়ে, ভবন, স্কুল ও সড়কে। আর তিনি রয়েছেন বেশিরভাগ কানাডীয় নাগরিকের মানিব্যাগে – ১০ ডলারের নোটে ছবি হিসাবে।
তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালেই ‘কানাডা ট্রান্সকন্টিনেন্টাল রেলওয়ে’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং প্রতিষ্ঠত হয় কানাডার প্রথম আবাসিক স্কুল। আর এই আবাসিক স্কুল নিয়েই পরবর্তীতে বিস্তর সমালোচনা হয়। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেড় লাখের মত আদিবাসী শিশুকে এ ধরণের আবাসিক স্কুলে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে “শিশুদের প্রতি অবহেলা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে” বলে জানিয়েছে কানাডার ট্রæথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন। কমিশন বলেছে, ওই স্কুল কর্মসূচি ছিলো “সাংস্কৃতিক গণহত্যা”র সামিল।
ম্যাকডোনাল্ড কানাডার আদিবাসী স¤প্রদায়কে ভাল চোখে দেখতেন না। ইউনিভার্সিটি অব রিজাইনা’র এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর এবং লেখক জেমস ডাচেক লিখেছেন, “স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড দেশটি গড়ে তুলেছেন। কিন্তু তার সিদ্ধান্ত ছিল আদিবাসীদের কোন স্থান নেই এই দেশটিতে। তারা ডিসপোজএবল।”
নিউ ইয়র্ক টাইমস এর কলামিস্ট ইয়েন অস্টিন তার এক কলামে লিখেন, “ম্যাকডোনাল্ড এর যারা ভক্ত তারাও জানতেন তিনি ছিলেন একজন চরম বর্ণবাদী ব্যক্তি।”
ম্যাকডোনাল্ড কানাডায় বসবাসরত চাইনীজদেরও ভাল চোখে দেখতেন না। চাইনীজদের বিরুদ্ধেও তিনি বর্ণবাদী আচরণ করেছেন। এ্যালকোহলে তার আশক্তি ছিল ভীষণ রকমের। তিনি জনসভায় ভাষণ দেবার সময় অতিরিক্ত এ্যালকোহলের প্রভাবে বমি করে দেন এমন ঘটনাও আছে।
অবশ্য স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড যখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন কানাডায় বর্ণবাদকে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হতো না। বর্ণবাদকে সমর্থন করার পিছনে ম্যাকডোনাল্ড এর যুক্তি ছিল এই রকম – আমি এরকম একটি দেশ চালাচ্ছি যে দেশটি বর্ণবাদী মানুষে ভরা। এ কারণেই আমি বর্ণবাদকে সমর্থন করে গেছি।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া সিটি কর্তৃপক্ষ গত বছর কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং দেশটির আবাসিক স্কুল ব্যবস্থার প্রবর্তক স্যার জন এ ম্যাকডোনাল্ডের একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি সিটি হলের প্রবেশদ্বারের পাশ থেকে সরিয়ে ফেলেছে। এটি স্থানীয় আদিবাসী জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি সৌজন্যমূলক পদক্ষেপ বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আদিবাসীরা স্যার ম্যাকডোনাল্ডের মূর্তি সরিয়ে নেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
ম্যাকডোনাল্ড এর মূর্তি বা নাম সরিয়ে ফেলার দাবী কানাডার অন্যান্য অঞ্চলেও জোরদার হচ্ছে। গ্লোবাল নিউজ এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দি এলিমেন্টারী টিচার্স ফেডারেশন অব অন্টারিও দাবী করে আসছে এখানকার কিছু স্কুল থেকে তার নাম মুছে ফেলার জন্য। ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ম্যাকডোনাল্ড এর নাম একটি অনিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করছে শিশুদের মনে যখন তারা জানতে পারছে যে তিনি আদীবাসী জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর একজন স্থপতি। পিকারিং এ একটি স্কুল আছে যার নাম স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড পাবলিক স্কুল। এলিমেন্টারী টিচার্স ফেডারেশন অব অন্টারিও-র লিস্টে এই নামটি আছে। তারা চাচ্ছে এই স্কুলের নাম বদল করতে। কিন্তু স্থানীয় কনজারভেটিভ এমপি বলছেন এই দাবী ‘বিব্রতকর’।
জেমস ডাচেক আরো লিখেন এটি বোধগম্য যে অতীতে কানাডায় বর্ণবাদ বেশ জাকালোভাবেই বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড শুধু যে বর্ণবাদী ছিলেন তাই নয়, তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতিরও ছিলেন।
বর্তমানে কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড এর নামে ১৩ টি সরকারী স্কুল আছে। এর মধ্যে অন্টারিওতে আছে ৩ টি। ইতিপূর্বে এলিমেন্টারী টিচার্স ফেডারেশন অব অন্টারিও একটি রেজুলেশন পাস করে এবং ঐ রেজুলেশনে স্কুল বোর্ডসমূহের প্রতি আহ্ববান জানানো হয় এই বলে যে, স্যার জন এ. ম্যাকডোনাল্ড এর নামে যে সকল স্কুল ও ভবন আছে সেগুলোর নাম যেন পরিবর্তন করা হয়। কারণ তিনি এমন সব নিয়ম বা তন্ত্র উদ্ভাবন ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন যেগুলোর পরিনতিতে কানাডার আদীবাসীদের উপর চালানো হয়েছিল গণহত্যা।
এদিকে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলকারীরা শুধু ম্যাকডোনাল্ড এর ভাস্কর্য সরানো দাবীতেই সীমাবদ্ধ নন। তারা চিহ্নিত আরেক বর্ণবাদী রায়ারসন এর ভাস্কর্য সরানোর দাবীও করছেন। টরন্টোতে যারা থাকেন তারা সবাই রায়ারসন নামটার সঙ্গে পরিচিত। তার পুরো নাম এগারটন রায়ারসন। টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত রায়ারসন ইউনিভার্সিটি তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে। আর এই ইউনিভার্সিটির চত্ত¡রে রয়েছে তার একটি ভাস্কর্য। কিন্তু এই রায়ারসন যে শুধু একজন বর্ণবাদী ব্যক্তি ছিলেন তাই নয়, নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষেয়েও এই রায়ারসন সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টিএনসি নিউজ জানায় আন্দোলনকারীরা প্রায় পাঁচ হাজার স্বাক্ষর সম্মলিত এক পিটিশন উপস্থাপন করেন যাতে বলা হয়, রায়ারসন বর্ণবাদ, নারী বিদ্বেষ এবং সাংস্কৃতিক গণহত্যার প্রতীক। ইউনিভার্সিটি চত্ত্বর থেকে তার ভাস্কর্য অবিলম্বে সরাতে হবে।
বলা হয়ে থাকে যে টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভার্সিটি ‘ডাইভার্সিটি’র এক অনন্য উদাহরণ। কিন্তু ১৯৪৮ সালে এই ইউনিভার্সিটির নামকরণ করা হয়েছে এক বিতর্কিত ব্যক্তির নামে। ২০১৭ সালে এই ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের পক্ষ থেকে একটি আন্দোলনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল রায়ারসনের ভাস্কর্যটি সরানোর জন্য। কিন্তু ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাতে সায় দেয়নি। তবে ভাস্কর্যটির পাশে একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে যেখানে সাংস্কৃতিক গণহত্যায় এগারটন রায়াসন এর ভূমিকা কি ছিল তা লেখা রয়েছে।
সাম্প্রতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রায়ারসন ইউনিভার্সিটির একজন সাবেক ছাত্র মাজ খান গ্লোবাল নিউজকে বলেন ইতিপূর্বেকার আন্দোলনের কিছুটা সাফল্য দেখে তিনি রায়ারসনের ভাস্কর্য সরানোর দাবীতে পিটিশন শুরু করেছেন। তিনি আরো বলেন, রায়ারসন ইউনিভার্সিটি সবসময় সমতা এবং অন্তর্ভুক্তি’র কথা প্রচার করে আসছে। কিন্তু এই ইউনিভার্সিটির নামকরণ এবং তার চত্ত¡রে এমন একজন লোকের ভাস্কর্য স্থাপন করে রাখা হয়েছে যা সমতা ও অন্তর্ভুক্তির উল্টো অর্থ বহন করে। আমরা এমন এক ব্যক্তিকে বিভিন্ন উপলক্ষে স্মরণ করি যার অতীত কর্মকান্ড কানাডার বর্তমান আদর্শ ও মূল্যবোধের ঠিক উল্টোটি।
এদিকে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন চলা কালে টরন্টোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম বদল করার দাবীও উঠেছে। সড়কটির নাম ‘ডান্ডাজ স্ট্রিট’। সুদীর্ঘ এই সড়কটি টরন্টোর কিংস্টন রোড থেকে শুরু করে প্রায় হ্যামিলটনের কাছাকাছি গিয়ে শেষ হয়েছে। ডান্ডাজ এর পুরো নাম হ্যানরি ডান্ডাজ। তিনি ছিলেন একজন বৃটিশ রাজনীতিবিদ। ডান্ডাজ একসময় বৃটেনের ‘হোম সেক্রেটারী’ ছিলেন। ‘সেক্রেটারী অব ওয়ার’ এর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা অবস্থায় তিনি প্রায় সাড়ে ছয় লাখ দাস এর স্বাধীনতা প্রদানের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তার এই ভূমিকার কারণে বৃটেনে দাস ব্যবসা বন্ধ হতে অতিরিক্ত আরো ১৫ বছর সময় লাগে। তিনি সে সময় দাসদের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছিলেন মহা অত্যাচারী এক ব্যক্তি।
দাবী উঠে বৃটেনের এককালের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিল এর ভাস্কর্য অপসারনেরও। টরন্টো-সহ কানাডার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে চার্চিলের ভাস্কর্য। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এর একজন সদস্য টিএনসি নিউজকে বলেন, বৃটিশ সাম্রাজ্য ধর্ষণ, গণহত্যা, শ্বেত আধিপত্যবাদ এবং দাস ব্যবসা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন কেউ বলেন বৃটিশ সাম্রাজ্য ভাল জিনিস ছিল তখন আসলে এই অর্থই প্রকাশ হয় যে, বৃটিশ সাম্রাজ্য উপনিবেশের জন্য ভাল ছিল, ভাল ছিল দাস ব্যবসা প্রসারের জন্য এবং ভাল ছিল সাম্রাজ্যবাদী হিসাবেও।
বর্ণবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে কানাডায় আরো যাদের ভাস্কর্য অপসারণের দাবী উঠেছে তাদের মধ্যে আছেন ক্যাপ্টেন জর্জ ভেঙ্গুভার, স্যামুয়েল ডি চ্যাপলেইন, জেমস ম্যাকগিল ও কুইন ইসাবেলা।
জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকে কেন্দ্র করে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ এর আন্দোলনের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ে বৃটেনেও। সেখানে দাসত্ব ও বর্ণবাদের অবসানের প্রতিবাদ হিসেবে গত ৭ জুন এডওয়ার্ড কলস্টনের একটি ভাস্কর্যের গলায় দড়ি দিয়ে টেনে নামিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। কলস্টনের ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার পর আরো দাবী উঠেছে, ব্রিটেনে নানা জায়গায় বর্ণবাদ ও দাস ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যেসব ভাস্কর্য আছে সেগুলোও অপসারণ করতে হবে।
বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিস্টল শহরের বিকাশ ও সমৃদ্ধির ইতিহাসের সঙ্গে দাস ব্যবসা সরাসরি জড়িত রয়েছে। তাই কয়েক শতাব্দী ধরে ব্রিস্টলে কলস্টনের স্মৃতিকে সম্মানিত করা হচ্ছে। কলস্টন এভিনিউতে তার ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৯৫ সালে। তবে এই মূর্তির নিচে ব্রিস্টল শহরের সবচাইতে জ্ঞানী-গুণী সন্তানদের অন্যতম হিসেবে তার বন্দনা থাকলেও দাস ব্যবসার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার কুখ্যাত অতীতের কোন উল্লেখ ছিল না।
বৃটেনের ব্রিস্টলের বাসিন্দা কবি মাইলস চেম্বার্স বিবিসিকে বলেন, ‘কিছু লোক আছে যারা বুঝতেই পারে না যে সেই দাসত্বের প্রভাব এখনো কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের জীবনে অনুভব করেন। দাসদের উত্তরসূরিরা অর্থনৈতিকভাবে এখনো দরিদ্র, মানসিকভাবে তারা নিজেদের নিকৃষ্ট বলে অনুভব করেন, আফ্রিকান-ক্যারিবিয়ান পুরুষরা এখনো বিসদৃশ সংখ্যায় কারাগারে, তারা পড়াশোনায় ভালো করতে পারছেন না, কাজ পাচ্ছেন না বা পেলেও কম বেতন পাচ্ছেন। দাসপ্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেলেও এসব বদলায়নি। সেই ইতিহাসের কারণে আমরা এখনো দাসত্বের অনুভূতি থেকে বের হতে পারিনি। কলস্টনের মূর্তি সরিয়ে ফেললে বা কিছু নাম বদলে ফেললে বর্ণবাদ বা দাস মনোবৃত্তি পাল্টে যাবে না। কিন্তু তখন কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্দেশ্যে এটা বলা সহজ হবে যে তোমরা আমাদের সমান, তোমরা ব্রিটিশ, তোমাদের মূল্য আছে এবং তোমাদের সঙ্গে অন্যদের কোনো পার্থক্য নেই।’
উল্লেখ্য যে, একসময় ব্রিটেনে দাস ব্যবসার একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল রয়াল আফ্রিকান কোম্পানির হাতে। আর এই কোম্পানির ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন কলস্টন ১৬৮৯ সালে। ধারণা করা হয়, ১৬৭২ সাল থেকে ১৬৮৯ সাল পর্যন্ত কলস্টনের জাহাজে করে প্রায় ৮০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ, নারী ও শিশুকে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। তাদের গায়ে এ সি কোম্পানির নামে সিল মেরে আমেরিকাগামী জাহাজে তোলা হতো। শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় তাদের শুইয়ে দেওয়া হতো জাহাজের খোলের মধ্যে। ১৬৯৮-১৮০৭ সাল পর্যন্ত ব্রিস্টল থেকে মোট ২,১০০টি জাহাজ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের নিয়ে আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। ব্রিস্টল শহরের বেশ কিছু রাস্তার নামকরণও করা হয়েছে কলস্টনের নামে। এখন এ সবের নাম পরিবর্তনের দাবী উঠেছে।
বিবিসি জানায়, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের জের ধরে বৃটেনে আরেক দাস ব্যবসায়ীর ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়েছে। তিনি হলেন বিখ্যাত দাস ব্যবসায়ী রবার্ট মিলিগান। লন্ডনের ডকল্যান্ডসের জাদুঘরের বাইরে থেকে ৯ জুন তার ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হয়েছে। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান বলেছেন, ‘দাস ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নগরীর সমস্ত মূর্তি সরিয়ে ফেলা এবং রাস্তার নাম বদলে দেওয়া উচিত।’ রবার্ট মিলিগানের ভাস্কর্যটি ১৮১৩ সালে স্থাপন করা হয়। তার নামে লাইম হাউজে একটি রোডের নামও রয়েছে। এতদিন ধরে মিলিগানের ভাস্কর্যটি সরানো না হলেও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার এর এই আন্দোলনের সময় জাদুঘর র্কর্তৃপক্ষ জানায়, জাদুঘরের বাইরের প্রাঙ্গণে মূর্তিটি বহু বছর ধরে অস্বস্তিকরভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। স্থানীয় জনগণের ইচ্ছায় মিলিগানের মূর্তি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি’র খবরে বলা হয়, আন্দোলনের মুখে বৃটেনের এককালের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এর একটি ভাস্কর্য ঢেকে রাখা হয়। তার আগে অবশ্য ঐ ভাস্কর্যের গায়ে সবুজ রং স্প্রে করে তাকে বর্ণবাদী আখ্যা দেন আন্দোলনকারীরা। চার্চিল ছিলেন সব সময় একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। তিনি তার বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কখনো গোপন করেননি। বর্ণবাদী শ্রেণি বিভাগে বিশ্বাস করতেন তিনি। তার এই শ্রেণি বিভাগে সবার ওপরে স্থান ছিল শ্বেতাঙ্গ প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের। এর পরের অবস্থানে ছিল শ্বেতাঙ্গ ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের। এর পরের অবস্থানে ভারতীয়রা এবং তারও নিচে আফ্রিকানরা। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের নির্মম আচরণের একজন কঠিন সমর্থক ছিলেন উইনস্টন চার্চিল।
কৌতুহলের বিষয় হলো, এই চার্চিল ছিলেন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন সাহিত্যিকও। ২০০২ সালের এক জরিপে বিবিসি বর্ণবাদী চার্চিলকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটন’ বলে উপাধিও দেয়!
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর থেকে বৃটেনে লর্ড ক্লাইভের ভাস্কর্য অপসারণেরও দাবি উঠে। ইংল্যান্ডের ছোট্ট শহর শ্রুসবেরির কেন্দ্রের খোলা চত্বরে এক উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে আছে রবার্ট ক্লাইভের এমন একটি ভাস্কর্য। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের সামনেও রয়েছে রবার্ট ক্লাইভের একটি ভাস্কর্য। ব্রিটেনে তার পরিচয় ‘ক্লাইভ অব ইন্ডিয়া’ নামে। ক্লাইভের ভাস্কর্য অপসারণের জন্য বেশ কয়েকটি আবেদনপত্র খোলা হয়েছে চেঞ্জ-ডট-অর্গ ওয়েবসাইটে। প্রতিটিতেই রবার্ট ক্লাইভকে একজন বর্ণবাদী, লুটেরা এবং দুর্বৃত্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তার মতো মানুষকে মূর্তি বানিয়ে স্মরণ করার কোনো কারণ নেই।
এদিকে গোটা ইউরোপ ও আমেকিায় বর্ণবাদী আন্দোলন জোরদার হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধিকে নিয়েও। গান্ধী নাকি ছিলেন বর্ণবাদী! ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ তুলে তাঁর মূর্তি অপসারণের দাবি তোলা হয়েছে। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিস্টলে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকারীরা সপ্তদশ শতকের দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কোলস্টনের মূর্তি নামিয়ে ফেলার পরপরই গান্ধীর মূর্তি অপসারণে পিটিশন দাখিলের বিষয়টি প্রথম সামনে আসে। এর আগে গত বছর ম্যানচেস্টারের কিছু শিক্ষার্থী একই দাবি তুলেছিলেন। সেখানেও গান্ধীর বিরুদ্ধে ‘কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বর্ণবাদী মনোভাবের’ অভিযোগ তোলা হয়। অবশ্য এ বিষয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ফয়সাল দেবজি বিবিসিকে বলেন, ‘গান্ধীর মূর্তি অপসারণ নিয়ে এই বিতর্ক অবান্তর। অন্য সবার মতোই তাঁর ভুল থাকতে পারে। কিন্তু তাঁকে অন্য দাস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলাটা বাড়াবাড়ি।’
উল্লেখ্য যে, ঊনবিংশ শতকের শেষপাদে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকালে গান্ধী কৃষ্ণাঙ্গদের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। আর এ বিষয় নিয়েই গান্ধীর বিরুদ্ধে এই বর্ণবাদের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি মহাত্মা গান্ধীর জীবনীকার ও পৌত্র রাজমোহন গান্ধী এর আগে এ সম্পর্কে বলেছিলেন, এটা সত্য যে তিনি কখনো কখনো দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের বিষয়ে সংস্কারগ্রস্ত ছিলেন।
বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, গান্ধী যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় আইনজীবী হিসাবে কাজ করতেন তখন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের ব্যাপারে তিনি বর্ণবাদী মনোভাব পোষণ করতেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনও বলা হয় যে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করতেন না।
গার্ডিয়ানের লেখক মাইকেল কনেলান এবং উপাধ্যক্ষ ময়ুখ সেন গান্ধী সম্পর্কে তাদের গবেষণা গ্রন্থে এমন কিছু তথ্য দিয়েছেন।
এছাড়া ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার দুজন অধ্যাপক অশ্বিন দেশাই ও গুলাম ওয়াহেদের ‘দ্য সাউথ আফ্রিকান গান্ধী: স্ট্রেচার বেয়ারার অব দ্য এম্পায়ার’ নামে গবেষণাধর্মী বইটিতেও গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকার জীবন সম্পর্কে চমকপ্রদ সব তথ্য বেরিয়ে আসে।
১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত প্রায় ২১ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন গান্ধী। সেখানে যাওয়ার পর পর শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন তিনি, এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তবে তাঁর আন্দোলন ছিল ভারতীয়দের প্রতি ইউরোপীয়দের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে। দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে তিনি কোন অবস্থান নেননি। এ ব্যাপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক কিংশুক চ্যাটার্জি বিবিসি বাংলাকে জানান, ‘এই ব্যাপারে বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, গান্ধী দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য কিছু করেননি।’
বিবিসি’র প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘এই ব্যাপারটা নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে শুরু করে আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতারাও বলেছেন যে, গান্ধী অনেক বড় রাজনীতিবিদ। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি যে আন্দোলন করেছিলেন সেখানে শুধু ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সামগ্রিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের দাবিতে তিনি কোন আন্দোলন করেননি।’
দক্ষিণ আফ্রিকায় বিত্তশালী ভারতীয় ব্যবসায়ী ও শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে গান্ধীর ওঠাবসা থাকলেও কৃষ্ণাঙ্গদের সংস্পর্শ তিনি এড়িয়ে চলতেন। ১৮৯৩ সালে নাটাল পার্লামেন্টকে লেখা এক চিঠিতে তিনি ভারতীয়দের, আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের চাইতে উন্নত জাতি হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে ভারতীয়রা ‘বর্বর আফ্রিকানদের’ চাইতে উন্নত। ১৯০৪-সালের এক স্মারকলিপিতে আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের আপত্তিকর দক্ষিণ আফ্রিকান গালি কাফফির, এমনকি ‘বর্বর’ ও ‘অসভ্য’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
এ বিষয়ে মি. চ্যাটার্জি বলেন, ‘গান্ধী শুধু চেয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা যে অন্যায় করছে, সেটা যেন ভারতীয়দের সঙ্গে না হয়। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার থেকে ভারতীয়দের অধিকারকে আলাদা করতে উনি যেসব যুক্তি দেখিয়েছিলেন, সেখানে এই বিতর্কিত মন্তব্যগুলোও ছিল।’
এমন নানা কারণে গান্ধীকে বর্ণবাদী আখ্যা দিয়ে গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর ঘানার রাজধানী আক্রার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গান্ধীর মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়।
কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করার পর আজকে কানাডা সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপে বর্ণবাদ বিরোধী যে উদ্দীপনা ও আবেগ সৃষ্টি হয়েছে তার পরিনতিতে হয়তো কিছু সংখ্যক ভাস্কর্য অপসারিত হবে, কোন কোন ভাস্কর্যের স্থান হবে যাদুঘরে। তবে বেশীরভাগ ভাস্কর্যই আরো বহুকাল থেকে যাবে যথাস্থানে। কারণ, অনেক দেশেই ক্ষমতায় আছেন রক্ষণশীল দলের রাজনীতিকগণ যারা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বর্ণবাদের সমর্থক, উপনিবেশবাদের সমর্থক, সা¤্রাজ্যবাদের সমর্থক। তারা চাইবেন না তাদের ভাবগুরু ও স্বার্থগুরুদের নাম ইতিহাসের পাতায় নতুন পরিচয়ে চিহ্নিত হোক যে পরিচয়ে কোন আভিজাত্য থাকবে না, কোন কৃতিত্ব থাকবে না, কোন বাহাদুরীও থাকবে না। থাকবে কেবল তাদের পঙ্কিল পরিচয়। যে পরিচয় মানুষকে ঠকানোর পরিচয়, মানুষকে ঘৃণা করার পরিচয়।
তবে আন্দোলন যখন শুরু হয়েছে তখন দূর ভবিষ্যতে হলেও বর্ণবাদী এই ব্যক্তিদের ভাস্কর্যের ঠিকানা হবে যাদুঘরে। ইতিহাসের পাতায়ও তারা চিহ্নিত হবেন নতুন পরিচয়ে। কারণ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। এমনটাই আশা আন্দোলনকারীদের।