আগামী তিন মাসে কানাডার অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

মে ১৮, ২০২০

প্রবাসী কণ্ঠ : কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাত্রা যদি দ্রুত কমেও আসে তবুও কানাডার জীবনযাত্রা খুব শিগগির আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। বর্তমানে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সাধারণভাবে এমনই পূর্বাভাস দিচ্ছেন- বিশেষজ্ঞরা নিজেরাই স্বীকার করছেন যে, তারা ঠিক এই মুহূর্তে তেমন ভালো কোনও পূর্বাভাস দেয়ার মত অবস্থায় নেই। কারণ, বর্তমান সময়ে বিশ্বের গতি-প্রকৃতি অর্থনৈতিক প্রবণতা বা ট্রেন্ডের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং সেটি নির্ভর করছে একটি নতুন এবং এখন পর্যন্ত ভালো করে বুঝে ওঠা যায়নি এমন একটি ভাইরাসের ওপর।

তবে কানাডা যখন লকডাউন থেকে বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে তখন কিছু বিষয় স্পষ্ট হতে শুরু করেছে এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে কানাডার অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বিষয়ে ন্যূনতম আভাস দেওয়া যেতেই পারে।

আমাদের সামনে খারাপ, ভালো এবং কুৎসিত যে কোনও পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। খবর হাফিংটন পোস্ট। রিপোর্ট করেছেন ডেনিয়েল টেনসার।

খারাপ পরিস্থিতি

সবার আগে জানা দরকার, অনেক কানাডীয় নাগরিক বেকার হয়ে পড়বেন অন্তত কিছু সময়ের জন্য। পার্লামেন্টের বাজেট সম্পর্কিত দফতরের এক নতুন পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী মাসগুলোতে ৫৪ লাখ মানুষ দেশের জরুরী সহায়তা তহবিল (সিইআরবি) থেকে মাসে দুই হাজার ডলার করে পাওয়া অর্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।

এমনকি লকডাউন তুলে নেয়ার পরও বয়স্ক ও অন্যান্য নাজুক স্বাস্থ্যের লোকেদের ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। তাদেরকে অন্য সবার চেয়ে বেশি দিন ঘরে থাকতে হতে পারে।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে সিআইবিসির অর্থনীতিবিদ বেনজামিন তাল ও টাইলর রচবের্গ এই পূর্বাভাস দেন।

আর যেসব কানাডীয় কাজ করবেন তারা কাজটা করবেন ভিন্নভাবে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো অফিসে সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা বলবৎ করা এবং সেখানে জনসমাগম ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে চাইলে অনেক কর্মীকে স্থায়ীভাবে বাসায় বসে কাজ করতে হবে।

তাল ও রচবের্গ বলছেন, মানুষে মানুষে যোগাযোগ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে কারখানা ও নির্মাণ শিল্পের সাইটগুলো কম সংখ্যক শ্রমিক দিয়ে চালানো হবে।

তারা বলেন, মানুষ বিমানে ভ্রমণ যতটা সম্ভব কমিয়ে দেবে এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বিমানযাত্রীরা এমনকি ইকোনোমি ক্লাসেও যথেষ্ট জায়গা নিয়ে বসতে পারবেন। বার ও রেস্টুরেন্টগুলোকে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হবে। সিআইবিসির রিপোর্টে বলা হয়েছে, কানাডার ৫৩ শতাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কতগুলো আবার খুলবে সেটি এক বড় প্রশ্ন।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, অনেকের মন খারাপ হবার মত ঘটনা এই যে, বড় বড় জনসমাগম হয় এমন লিগ পর্যায়ের ক্রীড়ানুষ্ঠান, সম্মেলন ও সঙ্গীতের কনসার্ট বেশ কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকতে পারে। এনএইচএল গেম সশরীরে খেলতে পারার জন্য বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে।

ভালো খবর

তবে যাদের চাকরি হঠাৎ করেই খুব জরুরী হয়ে উঠবে, যেমন, গ্রোসারি স্টোরের কেরাণী, আবর্জনা সংগ্রাহক, ডেলিভারি ম্যান ইত্যাদি পেশার লোকজনের জন্য এখনকার চেয়েও ভালো সময় আসতে পারে। এদের মত পেশার লোকেদের চাকরি ও বেতনের পরিমাণ বাড়তে পারে। লিখেছেন তাল ও রচবের্গ।

অর্থনীতি যখন সঙ্কটকাল কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট হবে তখন জনগণের জন্য চাকরি

পাওয়া সহজতর হতে পারে। তারা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি চাকরি পাবে।

সিআইবিসির মি. তাল হাফপোস্টকে ই-মেলে লিখেছেন, “অনেকের জন্য, বিশেষ করে নতুন চাকরি খোয়ানো বেশিরভাগ মানুষের জন্য পরিস্থিতিটা হবে সাময়িক। স্বাভাবিক মন্দার সময় যেটা ঘটে এবারের পরিস্থিতি সেরকম হবে না; ওই ধরণের চাকরির সুযোগ নিঃশেষ হয়ে যাবে না।”

শেষ খেলাটা হবে একটি ভ্যাকসিন অথবা চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে যা মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতার কার্যকরভাবে অবসান ঘটাবে।

তিনি যোগ করেন, “এটি হলো নিছক কিছু সময়ের প্রশ্ন। আর সেজন্যেই এখানে সরকারের সহায়তা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা হাতে কিছুটা সময় পেতে পারি।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে যে, কোবিড-১৯-এর ভ্যাকসিন বা টিকা উদ্ভাবনে ১৮ মাসের মত সময় লাগবে। তবে কোনও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের জন্য এভাবে সময় বেঁধে দেওয়ার অর্থ হলো নিছকই অনুমান। অবশ্য, কোনও একটি প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য চলছে নজীরবিহীন প্রয়াস। টিকা বা চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনে বহু সংখ্যক প্রকল্পে লাখ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে।

কুৎসিত পরিস্থিতি

কানাডীয়দের জন্য সামনে একটি বড় বিষয় রয়েছে যা পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে জটিল করে তুলতে পারে। সেটি হলো পারিবারিক ঋণের উচ্চ হার। বিপুল সংখ্যক পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পারিবারিক ঋণের বিষয়টি হয়তো টেকসই হবে না। অর্থনীতি যখন মন্দায় আক্রান্ত তখন বিশ্বের অন্য যে কোনও স্থানের চেয়ে কানাডীয়দের ভোক্তা ঋণের স্তর সর্বোচ্চ।

রয়েল ব্যাংক অব কানাডার মুখ্য অর্থনীতিবিদ ক্রেইগ রাইট বৃহস্পতিবার এক অডিও বার্তায় বলেন, “ভোক্তা ঋণের স্তর বেড়ে গেছে এবং তা অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিচ্ছে। চাকরির বাজারে সৃষ্ট আঘাতের ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”

কানাডার অর্থনীতির ৬০ শতাংশই ভোক্তাদের ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল। আর সাধারণ মন্দার সময় এই ভোক্তাদের ব্যয়ই অর্থনীতিকে টেনে তুলতে সহায়ক হয়। রাইট বলেন, “এবার মন্দা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভোক্তাদের অবস্থান খুব ভালো নয়।”

নীতি-নির্ধারকরা এই সঙ্কট সম্পর্কে সচেতন আছেন এবং এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। সব বড় ব্যাংকই মর্টগেজের ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতি ঘোষণা করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে কিস্তি পরিশোধের জন্য বাড়তি সময় দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য সুদহার এখনও প্রযোজ্য হবে এবং তা ঋণগ্রহীতার ক্রেডিট রেটিংয়ে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের জন্য তাদের ক্রেডিট কার্ডের সুদহার কমানোর ঘোষণা দিচ্ছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান ভ্যানসিটি ক্রেডিট ইউনিয়ন তাদের ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার শূণ্যতে নামিয়ে দিয়েছে।

কানাডার প্রতি ১০টি মর্টগেজ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি এরই মধ্যে সুদ বন্ধের প্রক্রিয়ার মধ্যে এসেছে। এর ফলে অন্তত আরেকটি দিক থেকে নতুন বিশ্বের চেহারা অন্যরকম হবার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে: আমরা হয়তো উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো যে, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা কত বেশি ভঙ্গুর। শেষ পর্যন্ত হয়তো কানাডীয় ভোক্তাদের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের দিনের অবসান ঘটবে।

কিন্তু, আমাদের এই বিশ্বের অবস্থা সম্পর্কে আভাস দেওয়ার প্রশ্ন যখন আসে তখন সাধারণ বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেন যে, এবার সেটা করার মত অবস্থা সত্যিই নেই।

রাইট যেমন বলেন, “আমরা মহামারী সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ নই।”