অভিবাসীরা যেভাবে কানাডায় নিজেদের ভাষা ধরে রাখেন

ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০

রেনে হাওলে

ধর্মের মত নিজের মাতৃভাষাও জাতিগত পরিচয়ের প্রতীক হতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক সুবিধা পেতে সহায়ক হতে পারে। যেমন, অভিবাসীদের জন্য অথবা অভিবাসীদের পক্ষ থেকে দেয়া কোনও বিশেষ পণ্য বা সেবা পাবার ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া। অভিবাসী শিশুদের শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য লাভের বিষয়টিও তাদের মাতৃভাষা এবং জাতিগত পরিচয়ের প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অভিবাসীদের নিজেদের ভাষা এবং এদেশে তাদের আন্তঃপ্রজন্মের ভাষাগত সঞ্চালনও কানাডার বহুসংস্কৃতিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়। কানাডার বহুসংস্কৃতিবাদ সম্পর্কিত আইন এবং সরকারি ভাষা সম্পর্কিত আইনের প্রস্তাবনা এই দুটিতেই বলা হয়েছে যে, কানাডা বিদেশি ভাষার সংরক্ষণ ও তার মর্যাদা ও ব্যবহার বাড়ানোর বিষয়টি উৎসাহিত করবে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডায় ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসীদের জন্য নিজেদের ভাষা ধরে রাখা দিন দিন অধিকতর কঠিন হলেও অপেক্ষাকৃত নতুন অভিবাসীদের জন্য, যারা স্প্যানিশ, চাইনিজ বা পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলেন, তাদের জন্য নিজেদের ভাষা টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা সাধারণভাবে অনেকটাই বেশি।

অভিবাসীদের এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভাষার বহমানতা থাকবে কিনা তা নির্ভর করে বেশ কিছু উপাদানের ওপর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো পরিবারের মধ্যে নিজের ভাষাটি শিশুদের কাছে কতটুকু তুলে ধরা হচ্ছে সেটি। পরিবারের বাইরেও একজনের নিজের ভাষার উপস্থাপন হতে পারে। এটি হতে পারে অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার সময় যদি তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলে কিংবা ভাষাভিত্তিক কমিউনিটির পক্ষ থেকে আয়োজিত বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে এবং একই সঙ্গে একই মাতৃভাষার অন্যান্য লোকেদের সঙ্গে বৃহত্তর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এদিক থেকে বলতে গেলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব অভিবাসী কানাডায় থিতু হয়েছেন তারা ছিলেন পরিবারভিত্তিক অভিবাসী এবং অভিবাসী-ভাষার সারবত্তার ক্ষেত্রে তাদের একটি ইতিবাচক প্রভাব ছিলো। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, প্রাথমিকভাবে বয়োজ্যেষ্ঠ, বিশেষ করে মায়েদের মাধ্যমেই নিজের ভাষাটি শিশুদের মধ্যে সঞ্চালিত হয়েছে।

১৯৮১ ও ২০০৬ সালের আদমশুমারির সুদীর্ঘ ফরম থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। ওইসব আদমশুমারিতে কানাডার পরিবারগুলোর ২০ শতাংশের ওপর তথ্য সন্নিবেশ সম্পন্ন করা হয়।

২০০৬ সালে যে চারটি অভিবাসী ভাষা সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছে সেগুলি হলো, আর্মেনীয়, পাঞ্জাবি, বাংলা ও উর্দু।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নোভাস্কোশিয়ায় আয়োজিত বাঙ্গালীদের একটি অনুষ্ঠান। ছবি: গোলাম কিবরিয়া

ভাষার বহমানতার বিষয়টি বিভিন্ন ভাষা গ্রুপের ক্ষেত্রে ভিন্ন। কিছু ভাষা গ্রুপে (ওলন্দাজ, ইতালীয়, ক্রেওল এবং তাগালোগ) মায়ের মাতৃভাষাটাই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাছে সঞ্চালিত হয়ে আসে হয় তাদের মাতৃভাষা হিসাবে অথবা ঘরে সবচেয়ে বেশি বলেন বা প্রায়শ বলেন এমন ভাষা হিসাবে। কিন্তু তাদের নিজের ভাষায় কথা বলার পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি নয়। কথা বলার মধ্য দিয়ে ভাষার সঞ্চালন খুবই জোরালো হলো আর্মেনীয়, পাঞ্জাবি, চীনা, ফারসি, তুর্কি, বাংলা ও উর্দু ভাষা গ্রুপে। এসব ভাষা গ্রুপের শিশুদের কথোপকথনে নিজের ভাষা ব্যবহারের পরিমাণ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। অবশ্য, কোনও কোনও ভাষা যেমন, পর্তুগীজ, গ্রিক, ক্রেওল এবং হিন্দির ক্ষেত্রে যারা বলেছেন যে, এটি তাদের মাতৃভাষা বা ঘরের ভাষা, তাদের চেয়ে যারা বলেছেন, তারা এই ভাষাটি বলতে পারেন তাদের সংখ্যা শতকরা হিসাবে অনেক বেশি।

অভিবাসীদের ভাষার বহমানতা সাধারণভাবে বাড়ছে

১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সব ভাষা গ্রুপের  ক্ষেত্রেই কানাডায় জন্মানো ১৮ বছরে কম বয়সী ৪১ শতাংশ শিশুর মধ্যে অভিবাসী ভাষা সঞ্চালিত হয়েছে। ২০০৬ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, কানাডায় জন্মানো একই বয়স গ্রুপের  অভিবাসী শিশুদের ৫৫ শতাংশের মধ্যে তাদের নিজের মাতৃভাষা সঞ্চালিত হয়েছে- অর্থাৎ এই সঞ্চালনের পরিমাণ ১৪ শতাংশ বেড়েছে।

১৯৮১ ও ২০০৬ সালের মধ্যে অভিবাসনের কাঠামো অনেকাংশে পাল্টে গেছে। আর এই পরিবর্তনের হয়তো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে অভিবাসী-ভাষার সঞ্চালনার মাত্রার ক্ষেত্রে। সেই একই পরিবর্তন ঘটেছে নারীদের আর্থ-সামাজিক রেখাচিত্রে। এই রেখাচিত্র নারীদের শিক্ষার স্তর, তাদের জন্ম-ভূমির দেশে ভাষার ঐতিহ্য (ওইসব দেশে ইংরেজি ও ফরাসী ভাষার মর্যাদার প্রেক্ষিতে) এবং তারা যে মাতৃভাষা গ্রুপের  সদস্য সেই ভাষাগ্রুপের  সঙ্গে সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮১ সালে সাত শতাংশ অভিবাসী মায়ের ছিল ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি যা ২০০৬ সালে বেড়ে হয়েছে ২৮ শতাংশ। ১৯৮১ সালে ১৩ শতাংশ নারী এসেছেন এমন সব দেশ থেকে যেখানে ইংরেজি ও ফরাসী ভাষার বিশেষ মর্যাদা আছে যেটি ২০০৬ সালে বেড়ে হয়েছে ৫৩ শতাংশ।

মাতৃভাষার দিক থেকে বললে, ১৯৮১ সালে বেশিরভাগ অভিবাসীর মাতৃভাষা ছিল ইউরোপীয় কোনও ভাষা। কিন্তু পরবর্তী ২৫ বছরে সেই দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়, যখন বেশিরভাগ অভিবাসীর মাতৃভাষা হয়ে যায়, চীনা, তাগালোগ, পাঞ্জাবি, আরবি ও স্পেনিশ।

কিন্তু যেহেতু বেশি শিক্ষিত মায়েদের জন্য তাদের মাতৃভাষা শিশুদের মধ্যে বহমান রাখার সম্ভাবনা কম সেহেতু ১৯৮১ সালের তুলনায় ২০০৬ সালে অভিবাসী ভাষার সঞ্চালনের মাত্রা জোরালোই ছিল এবং মায়েদের শিক্ষার হার অপরিবর্তিত থাকলে সেটা একই রকম থাকার সম্ভাবনা ছিল বেশি।

একাধিক প্রজন্মের মানুষ কানাডায় বসবাসের কারণে অভিবাসী ভাষার সঞ্চালন হার হ্রাস পাচ্ছে :

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে ভাষার সঞ্চালন কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা জরিপ করে দেখার জন্য ১৯৮১ সালের মায়েদের

তুলনা করে দেখা হয় তাদের মেয়েদের সঙ্গে যারা ২৫ বছর পর ২০০৬ সালে নিজেরা মা হয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভাষা সঞ্চালনের গতি বিপরীত মুখে বয়ে গেছে। ১৯৮১ সালে ৪১ শতাংশ মা তার মাতৃভাষা নিজের শিশুদের মধ্যে সঞ্চালিত করতেন। অথচ তাদের সন্তানরা যখন মা হয়েছে তখন সেই নতুন মায়েদের ওই প্রবণতা মাত্র ২৩ শতাংশের। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ভাষার সঞ্চালন সময়ের সঙ্গে যেভাবে পাল্টে গেছে তার পেছনে অন্য কোনও উপাদানের চেয়েও সবচেয়ে বেশি যে উপাদান প্রভাব রেখেছে সেটি হলো ‘বিয়ের বাজার’। অনেক সমীক্ষাতেই যেমনটা দেখা গেছে যে, অভিবাসী মায়েদের কানাডায় জন্মানো মেয়েরা এমন একটি বিয়ের বাজারে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে প্রাধান্য রয়েছে ইংরেজি ও ফরাসীভাষী সম্ভাব্য জুটির যারা অভিবাসী-ভাষা মোটেই জানে না।

এদিকে, ইতালীয়, গ্রিক ও চীনা ভাষা গ্রুপে এই নিন্মগতি দেখা গেলেও যাদের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি তাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রজন্মের নারীদের থেকে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ভাষার সঞ্চালন সবচেয়ে জোরালো দেখা গেছে (৫৩ শতাংশ)।

২০০৬ সালের মায়েদের অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ২৫ বছর আগে তাদের মায়েদের চেয়ে ভিন্নতর ছিলো। গড় হিসাবে তারা মা হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম বয়সে, শতকরা হারের দিক থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মায়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিলো আর ২০০৬ সালের মায়েরা তাদের পুরো শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকাল কাটিয়েছে কানাডায়। শৈশবের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত মানুষের মূল্যবোধ ও আচরণের ওপর স্থায়ী প্রভাব রাখে। তার মধ্যে সন্তানের কাছে নিজের মাতৃভাষা সঞ্চালনের ইচ্ছার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মাতৃভাষা সঞ্চালনের দিক থেকে দুটি ভাষাগ্রুপের লোকেরা অন্যদের থেকে বাইরে অবস্থান করেছে। পাঞ্জাবি ভাষাগ্রুপে ১৯৮১ সালের নারীদের নাতি-নাতনিদের এক-তৃতীয়াংশ তাদের নানীর মাতৃভাষার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। কিন্তু গ্রিক ভাষাগ্রুপের ক্ষেত্রে এই হার হলো এক-চতুর্থাংশ- গ্রিক ভাষাভাষী যেসব অভিবাসী কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে তারা তুলনামূলকভাবে বেশ দীর্ঘকাল ধরেই এদেশে আছে।

পরিবারের গঠন-কাঠামোর সঙ্গেও ভাষা সঞ্চালনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। স্কুলে যাবার বয়স হয়নি এমন শিশু (প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের) এবং ইংরেজি ও ফরাসীর কোনটিই জানেন না এমন বয়স্ক ব্যক্তি পরিবারে থাকলে এই দুটি উপাদান ভাষার সঞ্চালনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

অভিবাসী ভাষায় কথা বলেন এমন নতুন কেউ এলে ভাষাটি জীবন্ত রাখতে সহায়ক হয়:

এছাড়া, নতুন অভিবাসীদের অব্যাহত আগমন তাদের মাতৃভাষা সঞ্চালনে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। সাধারণত এসব অভিবাসীর কানাডার সরকারি ভাষার ওপর তেমন দক্ষতা থাকে না, সেজন্যে তারা নিজেদের ভাষাভাষী মানুষের প্রাধান্য আছে এমন শহর বা কমিউনিটিতে জড়ো হয়, যেখানে ইংরেজি বা ফরাসীর একচেটিয়া প্রভাব নেই এবং দৈনন্দিন জীবনে ওই দুটি ভাষা খুব বেশি ব্যবহার করতে হয় না। -সৌজন্যে : কানাডাবাউন্ডইমিগ্রেন্ট.কম

– রেনে হাওলে হলেন স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার সোশিয়াল অ্যান্ড অ্যাবঅরিজিনাল স্ট্যাটিস্টিকস ডিভিশনের সিনিয়র অ্যানালিস্ট।