শত শত কানাডীয় নাগরিকের নকল ডিগ্রি রয়েছে!

এই নকল ডিগ্রিধারীদের হাতে পড়ে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা কানাডীয়দের

অক্টোবর ৭, ২০১৭

বিশ্বের বৃহত্তম ডিপ্লোমা কারখানার ওপর সিবিসি নিউজের ‘marketplace’-এর তদন্তে দেখা গেছে যে, অনেক কানাডীয় নাগরিকই তাদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের বিষয়টি নার্স, প্রকৌশলী, কৌসুলী এবং অন্যান্য পেশার নকল ডিগ্রিধারী লোকেদের হাতে ছেড়ে দেন।

বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, জাল ডিগ্রির ব্যবসা হলো কোটি কোটি ডলারের শিল্প। নকল ডিগ্রির সবচেয়ে বড় চক্র হলো পাকিস্তান-ভিত্তিক একটি আইটি প্রতিষ্ঠান অ্যাক্সাক্ট। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক লেনদেনের কিছু নথি marketplace-এর হাতে এসেছে। তদন্তকারী দলটি কয়েক মাস ধরে হাজার হাজার ডিগ্রি লেনদেনের ঘটনা খতিয়ে দেখেছে এবং ডিগ্রি গ্রহীতাদের সামাজিক মাধ্যমের প্রোফাইল থেকে তাদের ব্যক্তিগত তথ্যাদি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছে। খবর সিবিসি নিউজের।

তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে যে, আট’শর বেশি কানাডীয় নাগরিক জাল ডিগ্রি কিনেছেন। খবর সিবিসি নিউজের।

সাবেক এফবিআই এজেন্ট অ্যালেন ইজেল, যিনি কয়েক দশক ধরে ডিপ্লোমা কারখানার ওপর অনুসন্ধান চালিয়েছেন, বলেন, “মনে রাখতে হবে যে, এটি কেবল একটি অপারেশনের ফলাফল।

সুতরাং ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদানকারী সব স্কুল থেকে সারা কানাডায় কত সংখ্যক জাল ডিগ্রি দেয়া হয়েছে তার কোনও পরিপূর্ণ তথ্য এখানে পাওয়া যাবে না।”

ইজেল একটি বইয়ের সহ-লেখক। বইটির নাম ‘Degree Mills: The Billion-Dollar Industry That Has Sold Over a Million Fake Diplomas’। তিনি হিসাব দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রে বছরে যতগুলো পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয় তার অর্ধেকই জাল।

তিনি বলেন, ভুয়া ডিগ্রির প্রভাব পড়ে দুভাবে। মানুষ বছরের পর বছর ধরে লেখাপড়া ও অর্থ ব্যয় করে যে বৈধ ডিগ্রি অর্জন করে তার দাম কমিয়ে দেয় জাল ডিগ্রি। আর তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সত্যিকারের দক্ষতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ছাড়া ভুয়া ডিগ্রি নিয়ে যেসব প্রকৌশলী ও স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি কাজ করে চলেছেন তাদের হাতে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। ইজেল বলেন, “সনদ অনুযায়ী একজন পেশাজীবীর যেসব প্রশিক্ষণ থাকার কথা সেসবের অনুপস্থিতিতে সেই পেশাজীবীর হাতে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি।”

“আমরা প্রতিদিনই সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারি”

অ্যাক্সাক্ট-এর সঙ্গে সম্পর্কিত শত শত স্কুল রয়েছে যারা বেশ কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার সুযোগ দেয়। এদের এমন ফ্যাকাল্টিও রয়েছে যারা সার্বক্ষণিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত। এমন কি কিছু কিছু স্কুলের ডিগ্রি যাচাই করার আলাদা বিভাগও রয়েছে। কোনও তৃতীয় পক্ষ থেকে সনদের অনুলিপি বা উপস্থিতির প্রমাণ চেয়ে অনুরোধ এলে এই বিভাগ থেকে সেগুলো সরবরাহ করা হয়।

কিন্তু এসব স্কুলের কোনওটিরই কোনও বাস্তব ঠিকানা নেই, ফ্যাকাল্টি ভবনের ছবি বলতে তাদের কাছে রয়েছে কিছু ছবির মজুত। আর এসব স্কুলের ওয়েবসাইটে সনদদাতা পরিষদের যে বর্ণনা থাকে সেই পরিষদও পর্যন্ত ভুয়া।

“জীবনের অভিজ্ঞতা”র ওপর ভিত্তি করে কেউ হয়তো হাইস্কুল ডিপ্লোমা, স্নাতকডিগ্রি, মাস্টার্স ডিগ্রি বা পিএইচডি ডিগ্রিও পেতে পারেন মাত্র কয়েক ’শ ডলারের বিনময়ে।

marketplace-এর ডিগ্রি অর্জন

একটি জাল ডিগ্রি অর্জনের জন্য কী করতে হয় সেটি জানার জন্য marketplace একটি শব্দের অক্ষরগুলো উল্টেপাল্টে দিয়ে তৈরি করা শব্দ (anagram) পিটার মা ল্যাক ব্যবহার করে এবং সাবেক এফবিআই এজেন্ট অ্যালেন ইজেলের সহায়তায় বাইবেলীয় বিষয় উপদেষ্টা হিসাবে আলমেডা ইউনিভার্সিটির একটি জাল ডিগ্রি কেনার সিদ্ধান্ত নেয়, যে সনদটিকে হতে হবে অবিকল কোরেসেস-এর দেয়ালে টাঙ্গানো সনদের মতো।

দেখা যায়, পিএইচডি ডিগ্রির জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হওয়াটা খুব কঠিন নয়। পিটার মা ল্যাক আলমেডা ইউনিভার্সিটির “প্রফেসর কিথ ইভান্সকে ফোন করে তার শিক্ষা ও কাজের অভিজ্ঞতার বিবরণ সম্পর্কিত একটি বানোয়াট কাহিনী শোনায়। প্রফেসর ইভান্স সঙ্গে সঙ্গে এমনকি কোনওরকম জীবনবৃত্তান্ত পাঠানো ছাড়াই তাকে ডিগ্রি দেয়ার জন্য উপযুক্ত হিসাবে গণ্য করেন।

প্রফেসর ইভান্স এরপর পিটার মা ল্যাকের কাছে গেইটসভিলি ইউনিভার্সিটির একটি ডিগ্রি বিক্রির প্রস্তাব করেন। এটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক আরেকটি স্কুল যা অ্যাক্সাক্ট-এর সঙ্গে সম্পর্কিত।

ল্যাক আলমেডা ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি দেবার জন্য পীড়াপিড়ি করতে থাকে। এরপর গেইটসভিলি ইউনিভার্সিটি একটি প্যাকেজ ডিল করার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে। প্রস্তাবে বলা হয়, তারা গেইটসভিলি ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে একটি পিএইচডি ডিগ্রি এবং আলমেডা ইউনিভার্সিটি থেকে বাইবেলীয় কাউন্সেলিং বিষয়ে একটি পিএইচডি ডিগ্রি দেবে তবে বিনিময়ে ল্যাককে ৩,২০০ মার্কিন ডলার দিতে হবে। এত বেশি অর্থ দাবি করার বিষয় নিয়ে অভিযোগ জানালে গেইটসভিলি দুটি ডিগ্রির দাম কমিয়ে ২,৫০০ মার্কিন ডলার দেয়ার প্রস্তাব করে।

এর কয়েক সপ্তাহ পর ডাকযোগে একটি পার্সেল আসে, কিন্তু একটি সমস্যা দেখা দেয়: সেখানে মাত্র একটি ডিগ্রির সনদ পাঠানো হয়েছেÑ সেটা হলো গেইটসভিলি ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির ডিগ্রি।

আলমেডা ইউনিভার্সিটির বাইবেলীয় কাউন্সেলিং বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রির বিষয়টি নিয়ে গেইটভিলির সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরে ঝগড়াঝাটি করার পর গেইটভিলি থেকে ল্যাককে আরেকটি ডিগ্রি পাঠানো হয়। এবার তারা সেটি পাঠায় ই-মেলে।

কিন্তু এবারও একটি সমস্যা থেকেই যায়, ডিগ্রিটি দেয়া হয় সাইকোলজি বিষয়ে, বাইবেলীয় কাউন্সেলিং বিষয়ে নয়।

এ নিয়ে আরও বেশি ঝগড়া করার পর গেইটসভিলি আরও একটি ডিগ্রি পাঠায় ই-মেলের মাধ্যমে, এবার অবশ্য ঠিক বিষয়েই ডিগ্রি দেয়া হয়।

সব মিলিয়ে marketplace তিনটি পিইউচডি ডিগ্রি অর্জন করে তার মধ্যে একটি আবার বিনে পয়সায়। তার প্রাপ্ত নম্বর হচ্ছে ৩.৯২ জিপিএ। সেইসঙ্গে ক্লাশে উপস্থিতির দলিলপত্রও ছিলো।

দায়-দায়িত্ব কার?

টরন্টোর একজন ফৌজদারি বিষয়ক আইনজীবী মাইকেল জাস্কি বলেন, “আপনি যদি জেনেশুনে জাল সনদের ভিত্তিতে কাজ করে যেতে থাকেন তাহলে এই অপরাধের জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।” তিনি বলেন, “এটি হচ্ছে প্রতারণা। এটি হলো অসততার অপরাধ। নিশ্চিতভাবে আপনিই নিজেকে অপরাধের কাছে সমর্পণ করছেন।”