ব্লাফার্স পার্ক সৈকতে ডুবন্ত শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে ডুবে গেল বীর দুই ভাই

অক্টোবর ৮, ২০২০

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক, ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ : রঘুভাইয়া কৃষ্টিপতির দুই ছেলে অন্টারিও লেকের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার পর দুই সপ্তাহের সামান্য বেশি সময় কেটেছে। কৃষ্টিপতি স্বীকার করেন যে, ওই রাতের পর থেকে তিনি আর ঘুমাতে পারেননি। গত বুধবার তিনি টরন্টোর সিটিভি নিউজকে বলেন, “যেদিকে তাকাই সেদিকেই আমরা ওদের দেখতে পাই। সারাক্ষণ ওদের কথার আওয়াজ শুনতে পাই। ওদের কথার শব্দ আমাদের কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।”

স্কারবরো’র ব্লাফার্স পার্কের সৈকতে এক ডুবন্ত শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে প্রাণ হারান এই দুই ভাই। ছবি: সিটিভি

গত ১৫ আগস্টের দিনটি কৃষ্টিপতির পরিবারের জন্য সৈকতে এক আনন্দের দিন হবারই কথা ছিলো।

ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন এবং পরিবারের সঙ্গে একটি সন্ধ্যা কাটানোর লক্ষ্যে তারা স্কারবরোর ব্লাফার্স পার্ক সৈকতে যাবার পরিকল্পনা নেন। এটা এমন এক জায়গা যেখানে এই পরিবারটি আগে অনেকবার এসেছে।

সিটিভি নিউজকে কৃষ্টিপতি বলেন, তার দুই ছেলে সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে লেকের স্বল্প পানিতে বিচ ভলিবল খেলছিলো। তখনই তারা সাহায্যের জন্য কারও চিৎকার শুনতে পায়।

তিনি বলেন, “আমরা কিছু কান্নার শব্দ শুনতে পাই। কেউ ডুবে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে।” তার ছোট ছেলে ২৩ বছরের কামাল অন্য কয়েকজনের সঙ্গে বিপন্নকে সাহায্য করতে এগিয়ে যায়। কৃষ্টিপতি জানান, কামাল খুব ভালো সাঁতারু এবং অন্যদের সাহায্য করার ব্যাপারে তার সুনাম ছিলো। কাউকে সাহায্য করতে ছেলের এগিয়ে যাবার সেই দৃশ্যটি শোকার্ত পিতার মনে বারবার হানা দেয়।

কামাল যখন বিপন্ন শিশুটির কাছাকাছি পৌঁছে তখন সে নিজেও পানির স্রোতের টানে বিপদে পড়ে। বলেন কামালের বাবা। এসময় ছোটভাইকে বাঁচাতে তার বড় ছেলে ২৯ বছরের পবন সাঁতরে তার কাছে যায়।

কৃষ্টিপতি বলেন, পবন সৈকতে দৌড়ে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে এবং ঘটনাস্থলের দিকে সাঁতরে যায়। আমি এখনও দেখতে পাই, আমার বড় ছেলের হাত পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। আমিও পানিতে ঝাপিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু অন্তত ২০জন মানুষ আমাকে আটকে রাখে। তারা বলে, না, না, যাবেন না, প্রচণ্ড স্রোত।”

কৃষ্টিপতি বলেন, তিনি চেয়েছিলেন, নিজেও এগিয়ে যাবেন ছেলেদের সাহায্য করতে। কারণ সৈকতে নিজেকে খুবই অসহায় বোধ করছিলেন তিনি। “আমি চিৎকার করে বলছিলাম, আমার ছেলে ডুবে যাচ্ছে, প্লিজ আমাকে যেতে দিন, যেতে দিন। কিন্তু কেউ আমাকে যেতে দেয়নি।”

পবন ছিলো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তার স্ত্রী এবং আট মাস বয়সী ছেলে আছে। তাকে পানি থেকে তুলে আনা হয়। কিন্তু একটু পরেই সে মারা যায়। তার বাবা জানান, পবন দেহের বিভিন্ন অঙ্গ দান করেছিলো এবং তাদের পরিবার বেশ কিছু মানুষকে প্রয়োজনীয় অঙ্গ ও টিস্যু দান করার সক্ষমতা রাখে।

পুলিশের বেশ বড় রকমের অনুসন্ধান তৎপরতায় পরদিন কামালের লাশ পাওয়া যায়।

আবেগের প্রাবল্য কমে এলে কৃষ্টিপতি নিজের ছেলেদের নিয়ে কতটা গর্বিত সেকথা বলার সময় চোখের জলে তার মুখ ভেসে যাচ্ছিলো। একই রকমের অনুভূতি জানিয়েছে ঘটনাস্থলের পুলিশের লোকেরাও।

“প্রথম যে পুলিশ অফিসার আমার কাছে আসেন তিনি বলেন, আপনার উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, আপনার ছেলেরা বীর। ওই কথাটিই এখনও আমার কানে বাজছে।”

আমি দেখতে পাই আমার ছেলে পানির দিকে সাঁতরে যাচ্ছে, এই দৃশ্য আমার মনকে এখনও ছিন্নভিন্ন করে দেয়। বলেন বাবা রঘুভাইয়া কৃষ্টিপতি। ছবি: সিটিভি নিউজ

পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা যতই বিয়োগান্তক হোক না কেন, এমন ঘটনা কিন্তু সেদিনই প্রথম ঘটেনি। ওই দিনই মাত্র ঘণ্টা দুয়েক আগে নৌকা চালকেরাসৈকত থেকে ভেতরের দিকের পানিতে এক ব্যক্তির ভাসমান মরদেহ খুঁজে পায়। কৃষ্টিপতি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, যখন

ওই লাশ পাবার ঘটনার তদন্ত হচ্ছে তখনও কর্তৃপক্ষ কেন সৈকত বন্ধ করে দেয়নি? তিনি আরও জানতে চান, সৈকতের কাছে গভীর পানি বা তীব্র স্রোতের এলাকা কোনও কিছু দিয়ে চিহ্নিত করা হয়নি কেন?

তিনি বলেন, “পানি উপরে খুবই নিথর। কিন্তু কেউ জানে না নিচে কী প্রচণ্ড স্রোত বইছে। তাদের তো অন্তত কিছু সতর্কবার্তা দেওয়া উচিৎ ছিলো, লাল ফিতা বা পতাকা টাঙ্গানো- কোনও একটি সতর্কতা! সেখানে কোনও সতর্কবার্তা ছিলো না।”

আর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় লাইফ গার্ডদের ছুটি হয়ে গেলেও সৈকতে অনেক লোকজন থাকে। কৃষ্টিপতি জানতে চান, কেন সেখানে পানিতে নেমে বিপদে পড়া মানুষের জন্য ভেসে থাকার আরও বেশি ব্যবস্থা এবং উদ্ধার সামগ্রী নেই?

ডিক্সন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড স্পোর্টস কমিটির সদস্য আলী খান বলেন, কৃষ্টিপতির পরিবার সৈকতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে যে আহবান জানিয়েছে তিনি তা সমর্থন করেন।

তিনি বলেন, তিনি চান ব্লাফার্স পার্কে কঠোর নিরাপত্তা নীতি গ্রহণ করা হোক। বিশেষ করে জনগণকে  সেখানকার পানির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তথ্য দেয়া ও শেখার সুযোগ করে দেয়া উচিৎ, বিশেষভাবে পানির নিচের স্রোতের ধরণ এবং দেখা যায় না এমন বিপজ্জনক স্রোত সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা উচিৎ। সুদক্ষ সাঁতারু বা একেবারে নতুন, যেই হোক না কেন সবারই পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

কৃষ্টিপতি বলেন, মেয়রের দপ্তরের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি আস্থা পাচ্ছেন যে, তার ছেলেদের মৃত্যু বৃথা যায়নি, ততক্ষণ তিনি থেমে যাবেন না। তিনি আশা করছেন যে, এধরণের ট্রাজেডি যাতে অন্য কারও ক্ষেত্রে ঘটতে না পারে সেটি তারা নিশ্চিত করতে পারবেন।

“প্লিজ, কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিন যাতে আর কোনও বাবা-মাকে কাঁদতে না হয়। কোনও তরুণ যেন ডুবে না মরে।”