বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতাকে উস্কে দেয়ার দায়ে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা হারালো অটোয়ার একটি মসজিদ

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮

১০ আগস্ট ২০১৮ : দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে অটোয়া ইসলামিক সেন্টার ও আসসালাম মসজিদের মর্যাদা বাতিল করে দিয়েছে কানাডার রেভিনিউ এজেন্সি (সিআরএ)। সেন্ট লরেন্ট অ্যাভিনিউতে অবস্থিত মসজিদটির বিরুদ্ধে “বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা” প্রচারের অভিযোগ রয়েছে।

সিআরএ জানায়, সংগঠনটি তাদের সমস্ত সম্পদ দাতব্য কাজে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা ছড়ানোর মত কর্মকান্ডে তার সম্পদ ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি সিআরএর পাবলিক বেনিফিট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছে। খবর সিবিসি নিউজ  এর।

সিআরএ বলেছে, মসজিদটিকে দাতব্য খাতে অবশিষ্ট তার সমস্ত সম্পদ আগামী এক বছরের মধ্যে কোনও যোগ্য দানগ্রাহকের কাছে হস্তান্তর করতে হবে অথবা বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ করার পর এর যা অবশিষ্ট সম্পদ রয়েছে তার সমপরিমান রিভোকেশন টেক্স প্রদান করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ও এর মর্যাদা বাতিলের কারণ সিআরএর দাতব্য প্রতিষ্ঠানের তালিকায় প্রকাশও করা হয়েছে।

দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে অটোয়া ইসলামিক সেন্টার ও আসসালাম মসজিদের মর্যাদা বাতিল করে দিয়েছে কানাডার রেভিনিউ এজেন্সি। ছবি : অনলাইন

মসজিদ কর্তৃপক্ষ ৯০ দিনের মধ্যে আপত্তি জানাতে পারবে। তারপর সিআরএ-র আপিল বিভাগের ভবিষ্যত সিদ্ধান্তেও যদি তারা সন্তুষ্ট না হয় তাহলে কানাডার কেন্দ্রীয় আদালতে অথবা কর আদালতে আপিল করতে পারবে।

মসজিদ প্রশাসনের সদস্য আলী আবদুলে বলেন, যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা  তাতে তারা মর্মাহত এবং এটি আগের প্রশাসনের সময়কার অভিযোগ। বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নিয়েছে ২০১৩ সালে। তিনি বলেন, “আমাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এটা রীতিমত ভূমিকম্পের মত। মসজিদের কোনও সম্পদ কখনই কোনও বিদ্বেষ প্রচারে বা বিদ্বেষমূলক কর্মকান্ড বিকাশের কাজে ব্যবহার করা হয়নি।” তিনি জানান, মসজিদের পক্ষ থেকে সিআরএর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

চারজন বক্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে

সিবিসির হাতে আসা সিবিএর একটি চিঠিতে চারজন বক্তার নাম উল্ল্লেখ করা হয়েছে যারা ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে অসংখ্য অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। এরা হলেন, আবু উসামা আস-সাহাবি, বিলাল ফিলিপস, সাঈদ রাজিয়া এবং আবদুল্ল্লাহ হাকিম কুইক।

চিঠিতে বলা হয়, মসজিদে বক্তব্য পেশকারীদের একটি তালিকা দিতে বলা হলে আসসালাম কর্তৃপক্ষ একটি অসম্পূর্ণ তালিকা দেয়। তবে সামাজিক মিডিয়ায় দেওয়া মসজিদের পোস্টিং পরীক্ষা করে সিআরএর কর্মকর্তারা আরও বেশি অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানতে পারেন।

চিঠিতে উল্ল্লেখিত চারজন বক্তাই ইসলামের সুন্নি মজহাবের অন্তর্ভুক্ত রক্ষণশীল সালাফি মতাদর্শের সঙ্গে জড়িত।

আস-সাহাবি হলেন নিউ জার্সিতে জন্মগ্রহণকারী একজন ইমাম। তিনি এর আগে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম গ্রিন লেন মসজিদের প্রধান ছিলেন। এটি ইংল্যান্ডের অন্যতম প্রধান মসজিদ এবং এই মসজিদ নিয়ে প্রায়ই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বহুবার অটোয়া সফর করেন এবং আসসালাম মসজিদসহ অন্যান্য স্থানেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।

চ্যানেল-৪ এ প্রচারিত আন্ডারকভার মস্ক অনুষ্ঠানের অন্যতম বিষয় ছিলেন আস-সাহাবি। সেখানে গ্রিন লেন মসজিদে তার দেওয়া খুতবা গোপনে রেকর্ড করা হয়। খুতবায় তিনি অমুসলিমদের সম্পর্কে অমর্যাদাকর বক্তব্য পেশ করেন, নারীদেরকে বলেন “স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন” এবং সমকামীদেরকে পাহাড়ের ওপর থেকে ছুড়ে ফেলা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন।

আস-সাহাবি ২০১৬ সালে এবং ২০১৭ সালে টরন্টো ও নর্থ ইয়র্কের দ্য সালাহেদীন ও আবু হুরাইরা সেন্টারেও বক্তব্য পেশ করেন।

বার বার সফর

বিলাল ফিলিপস হলেন জ্যামাইকায় জন্মগ্রহণকারী একজন কানাডীয় সালাফি মতাদর্শী যার ফেসবুকে ফলোয়ারের সংখ্যা ৬০ লাখেরও বেশি। তিনিও বহুবার অটোয়া সফর করেছেন। বেশ কয়েকটি দেশে তাকে নিষিদ্ধ অথবা বহিষ্কার করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ডেনমার্ক, জার্মানি, কেনিয়া ও যুক্তরাজ্য।

সাঈদ রেজিয়ার জন্ম সোমালিয়ায়। এই ধর্ম প্রচারক বেড়ে উঠেছেন সৌদি আরবে এবং বসবাস করেন টরন্টোতে। তিনি অটোয়া মুসলিম বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা যার সদস্য হিসাবে রয়েছে ছয়টি দল। এটি এখনও চালু রয়েছে। রেজিয়া হলেন জার্নি অব ফেইথ সম্মেলনের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা যে প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত ও গোঁড়া বক্তাদেরকে কানাডায় আমন্ত্রণ জানায়। অন্তত একবার এধরণের একজন বক্তা মুম্বাইয়ের ইমাম জাকির নায়েককে কানাডায় ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। “প্রতিটি মুসলমানেকেই সন্ত্রাসী হতে হবে” মর্মে আগে দেওয়া বক্তব্যের কারণে তাকে কানাডায় আসতে দেওয়া হয়নি। সিআরএ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি ইনস্টিটিউটের সঙ্গে রেজিয়ার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে যেটি আল-কায়েদার প্রচারণামূলক জিনিসপত্র বিলি করেছে।

সিআরএর উল্ল্লেখিত চতুর্থ বক্তা আবদুল্লাহ হাকিম কুইক একজন মার্কিনী ধর্ম প্রচারক। ইহুদি ও কাফিরদের সম্পর্কে তার অশালীন মন্তব্য এবং ইসলামে সমকামীতার শাস্তি একমাত্র মৃত্যুদন্ড এমন মন্তব্যের কারণে তাকে চিহ্নিত করা হয়।

অন্যান্য স্থানে বক্তৃতা

আবদুলে-এর মতে তার মসজিদের বিরুদ্ধে আনা বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতার অভিযোগ মূলত ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এই মসজিদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত বক্তাদের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, সিআরএ যেগুলোকে বিদ্বেষপ্রসূত বলছে সেগুলো এই মসজিদে কেউ বলেননি বরং বলেছেন অন্য কোনওখানে।

তিনি বলেন, “তারা আমাদের মসজিদে এগুলো বলেননি, বলেছেন অন্য কোথাও। আমরা মনে করি, অন্যদের বক্তব্যের কারণে দাতব্য মর্যাদা হরণ করা আমাদের জন্য যেমন, তেমনই আমাদের সম্প্রদায়ের জন্যও অন্যায্য।

তিনি বলেন, তাদের মসজিদভিত্তিক সমাজ কানাডীয় মূল্যবোধের প্রতি আন্তরিক এবং একে স্বাগত জানায় ও উচ্চকিত করে।

সিআরএ বলছে,অন্তত দুটি বক্তৃতা দেওয়া হয়েছে বিগত প্রশাসনের বিদায়ের পর ২০১৪ সালে। আর যে সময়টা তারা পরীক্ষা করেছে সেই পুরো সময়জুড়েই মসজিদের পরিচালনা বোর্ড উগ্র ও পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী ব্যক্তিদের বক্তৃতা করার সুযোগ দিয়েছে।

সিআরএর কাছে দেওয়া জবাবে মসজিদ কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলেছেন যে, ওইসব বক্তৃতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন মসজিদভিত্তিক সমাজের অন্য সদস্যরা। এরপর তারা ভবনের বেশিরভাগ বেসমেন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন যাতে আগে থেকে অনুমতি না নিয়ে কেউ সেখানে মিটিং করতে না পারে।

তারা আরও বলেছেন যে, এখন তারা সম্ভাব্য বক্তাদের ব্যাপারে আরও বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।

সিআরএ উল্ল্লেখিত বক্তৃতার লিখিত অনুলিপি বা রেকর্ড করা কপি চেয়েছিলো কিন্তু মসজিদ কর্তৃপক্ষ সেটা দেননি। আর সে কারণে সংগঠনটি তার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট ছিলো এমন যথেষ্ট প্রমাণ নেই।

সিআরএর চিঠিতে বলা হয়েছে, চরমপন্থী বলে ধারণা করা হয় এবং সহিংসতার পথ বেছে নিতে ইচ্ছুক এমন একজন বক্তার নাম কর্তৃপক্ষ গোপন করে গেছেন।

সিআরএ বলছে, মসজিদটিকে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়ার আগে অনুষ্ঠিত দুটি অডিট রিপোর্টে চিহ্নিত কিছু বিষয়, সংগঠনটির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ এবং পরবর্তী অডিটের ভিত্তিতেই তাদের দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা হরণ করা হয়েছে।

দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা হরণের অর্থ হলো মসজিদটি আর টেক্স রিসিট দিতে পারবে না, আয় করের ক্ষেত্রে কোনওরকম ছাড় বা এইচএসটি রিবেটও পাবে না।

তবে আবদুলে বলেন, মসজিদটি তার নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে।