দেশ কূল ধর্ম সব ছেড়ে কানাডায় আশ্রয় নিলেন সৌদি তরুণী রাহাফ
সৌদি আরবের পরিবারগুলোতে নারীর প্রতি অতিরক্ষণশীলতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে এই ঘটনায়
ফেব্রুয়ারী 5, 2019
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : দেশ থেকে পালিয়ে ও কূল ধর্ম সব ছেড়ে কানাডায় সদ্য আশ্রয় পাওয়া রাহাফ মোহাম্মদ আল-কুনের গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে। তবে পরিবারের অতিমাত্রায় শাসন থেকে বেরিয়ে দম ফেলার জন্য কোনো সৌদি তরুণীর এটাই প্রথম পলায়ন নয়। আট মাস আগে সালওয়া নামের আরেক সৌদি নারী বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। তবে তিনি একা পালাননি। সঙ্গে নিয়েছিলেন ছোট বোনকে। দুই বোন এখন বাস করছেন কানাডার মনট্রিয়লে।
বাড়ি থেকে পালানো ১৮ বছর বয়সী সৌদি তরুণী রাহাফ সম্প্রতি কানাডায় পৌঁছেছেন। পরিবারের বিরুদ্ধে অতিশাসনের অভিযোগ এনে বাড়ি থেকে পালিয়ে ব্যাংকক গিয়ে বিমানবন্দরে আটকে পড়েন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা কুয়েতে ছিলেন। তিনি কুয়েত থেকে ব্যাংকক হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ব্যাংকক থেকে তাঁকে কুয়েতে ফেরত পাঠানোর জন্য বিমানবন্দরের ভেতরে অবস্থিত হোটেলে রাখলে সেখানে তিনি নিজেকে তালাবদ্ধ করে রাখেন। রাহাফ কুয়েতে ফিরতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, তিনি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছেন। পরিবারে ফিরলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে। তিনি টুইটারে এ নিয়ে একের পর এক পোস্ট দিলে তা আন্তর্জাতিক মহলের নজরে পড়ে।
সালওয়ার গল্পটিও প্রায় একই রকম। তবে তাঁর বিষয়টি টুইটারে প্রচার না করায় সে সম্পর্কে লোকজন কমই জানেন। রাহাফের ঘটনাটি সামনে নিয়ে এসেছে সালওয়ার ঘটনাটিকেও। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে সৌদি আরবের পরিবারগুলোতে নারীর প্রতি অতিরক্ষণশীলতার বিষয়টি।
সালওয়া বলেন, সৌদি আরবে কোনো জীবন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন আর ঘরে ফিরে আসতেন। সারা দিন তাঁর কিছুই করার ছিল না। বাসা থেকে সব সময় বলা হতো পুরুষেরাই সব। জার্মানিতে পৌঁছে তিনি আশ্রয় চেয়ে আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং নিজের ঘটনা খুলে বলেন। তিনি বলেন, ‘আশ্রয়ের জন্য আমি কানাডাকে বেছে নিই। কারণ মানবাধিকারের জন্য কানাডার খ্যাতি আছে। সিরিয়ার শরণার্থীদের কানাডার আশ্রয় পাওয়ার খবর পড়ে মনে হয়েছিল, কানাডাই হতে পারে আমার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা। আমার আবেদন মঞ্জুর হওয়ার পর টরন্টোতে চলে আসি। কোনো কিছু অর্জনের এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল আমার।’
ছোট বোনকে নিয়ে এখন মনট্রিয়লে থাকেন সালওয়া। তিনি বলেন, এখানে কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কেউ তাঁকে কিছু করার জন্য বাধ্য করে না। সৌদি আরবে তাঁদের অর্থ ছিল বেশি, কিন্তু এরপরও কানাডার জীবন তাঁর কাছে আগের চেয়ে অনেক ভালো লাগে। ফরাসি ভাষা শিখছেন। সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ও আইস স্কেটিং শিখছেন। পরিবারের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই। দুই পক্ষের জন্যই এটা ভালো বলে মনে করেন তিনি।
সালওয়া বলেন, ‘এখন বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় আমার কারও অনুমতি নিতে হয় না। এটা আমাকে খ্বু আনন্দ দেয়। নিজেকে মুক্ত মনে হয়। আমার যা ইচ্ছে হয়, তা-ই করতে পরি। শরতের রং এবং তুষারপাত ভালোবাসি। মনে হয়, জীবনে কিছু একটা করছি।’
এদিকে কানাডায় আশ্রয় পেয়ে নিজের ‘নতুন করে জন্ম’ হলো বলে উল্ল্লেখ করেছেন বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা ধর্মত্যাগী সৌদি কিশোরী রাহাফ আল-কানুন।
সোমবার কানাডার এক গণমাধ্যমকে রাহাফ জানান, কানাডায় সে এখন পড়াশুনার পাশাপাশি একটি চাকরি নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চান। এছাড়া কানাডায় আশ্রয় পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত বলে জানিয়েছেন রাহাফ।
রাহাফ আরো বলেন, আমি যা করেছি সেটা অবশ্যই আমার জন্য অনেক রিস্কি ছিল।
সিবিসি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাহাফ জানান, সৌদিতে থাকাকালীন সময় আমার মনে হত আমার স্বপ্ন পূরন হচ্ছিল না। কানাডায় আসার পর আমার মনে হল আমার নতুন করে জন্ম হল।
এখন আমি নতুন করে অনেক কিছু শিখবো যা আগে শিখিনি। এছাড়া যা আগে চেষ্টা করিনি তা চেষ্টা করবো এবং একটা স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্থ হওয়ার চেষ্টা করবো। জানান রাহাফ।
সৌদি আরবের অভিভাকত্ব আইন অনুযায়ী বাবার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরেও যেতে পারে না মেয়েরা। বাবার আদেশ না মানলে যেতে হয় জেলে। রাহাফের দাবি পরিবার তাকে প্রায়ই হত্যার হুমকি দিতো।
রাহাফ বলেন, স্বাধীন জীবনের জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়ে সৌদি আরব থেকে পালিয়েছেন তিনি। তবে এখনও পালাতে না পারা অনেক নারী ধুঁকে ধুঁকে জীবন কাটাচ্ছেন সৌদিতে। থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফেরত পাঠালে আত্মহত্যা করবেন বলেও ঠিক করেছিলেন তিনি।
রাহাফ বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে দাসীর মতো আচরণ করা হতো। আমরা যেন তাদের সম্পত্তি। আমি মানুষকে আমার গল্প বলতে চাই। জানাতে চাই সৌদিতে নারীদের সঙ্গে কী করা হচ্ছে।’
ভাইয়ের হাতে শারিরীক নির্যাতনের শিকার হন বলেও জানান রাহাফ। তিনি বলেন, ‘ছোট করে চুল কাটার কারণে আমাকে ছয় মাস একটি কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়। বলা হয়, পুরুষের মতো চুলকাটা ইসলামে জায়েজ নেই।’
রাহাফ বিবিসিকে জানিয়েছেন, ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছেন তিনি। সৌদি আরবে ধর্মত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
সৌদি আরবের অভিভাবকত্ব আইন অনুযায়ী বাড়ির বাইরে যাওয়া থেকে শুরু করে সব কাজের জন্য পুরুষ অভিভাবকদের অনুমতি নিতে হয় মেয়েদের। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ থেকে সৌদি
থেকে পালিয়ে আসার ঘটনা ঘটছে।
এদিকে রাহাফ এর জন্য নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হয়েছে। কানাডায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়ের পাওয়ার ক্ষেত্রে রাহাফের জন্য কর্মরত কস্টি নামের প্রতিষ্ঠান ওই নিরাপত্তারক্ষী ভাড়া করেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়, কস্টির নির্বাহী পরিচালক মারিও কালা নিরাপত্তার এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, রাহাফকে অনলাইনে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাই নিরাপত্তাঝুঁকির আশঙ্কায় রাহাফের জন্য রক্ষী নেওয়া হয়েছে। তিনি স্বাভাবিক জীবন শুরু করেছেন। এখন যে তিনি ‘কখনো একা নন’এটা নিশ্চিত করতে নিরাপত্তারক্ষী রাখা হয়েছে।
কানাডায় পৌঁছাতে পারার জন্য রাহাফ কানাডীয় সরকার ও থাই সরকার এবং জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভাগ্যবানদের একজন। আমি জানি, অনেক অভাগা নারী পালানোর চেষ্টা করার জন্য হারিয়ে গেছেন অথবা নিজেদের বাস্তবতা পরিবর্তনের জন্য কিছুই করতে পারেননি।’
রাহাফকে এমন এক সময় কানাডা আশ্রয় দিয়েছে, যখন দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা বিরাজ করছে। গত বছর সৌদি আরব কয়েকজন নারী অধিকারকর্মীকে কারাবন্দী করলে কানাডা তাঁদের মুক্তির দাবি করেছিল। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সৌদি আরব কানাডার সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করে এবং কানাডা থেকে তাদের অনেক শিক্ষার্থীকে সৌদি আরবে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
এই পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের নিজে গিয়ে রাহাফকে স্বাগত জানানোর ঘটনা সৌদি আরবকে আরও ক্ষুব্ধ করেছে বলে মনে করছেন সমালোচকেরা।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তিনি সেটাই করেছেন, যা নিজের মেয়ের জন্য করতেন।