“আমি কি বর্ণবাদী?”

কানাডীয়দের প্রতি বিসি’র মানবাধিকার কমিশনারের আহবান, নিজেই পরীক্ষা করুন

ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২১

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক ; ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার জনসংখ্যার ৪৮.৯ শতাংশ অশ্বেতাঙ্গ। এই প্রদেশে মহামারির মধ্যে এবং তার আগে বর্ণবাদী ঘটনা বেড়ে যায়। এতে করে সেখানে বাসিন্দাদের প্রতি আত্মসমালোচনার আহবান জানিয়ে প্রচারণা শুরু করা হয়।

একটি ছোট্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে প্রদেশজুড়ে প্রচারণা শুরু করা হয়, “আমি কি বর্ণবাদী?”

গত নভেম্বরের শেষদিক থেকে কালো পটে সাদা হরফে লেখা এই শব্দগুলি ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সর্বত্র বিলবোর্ড ও বাস স্টেশনগুলোতে শোভা পাচ্ছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার মানবাধিকার কমিশনার মিজ. কাসারি গোবিন্দার বলেন, এই প্রচারণার লক্ষ্য হলো ব্রিটিশ কলাম্বিয়াবাসীদের নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে বলা। খবর নিউকানাডিয়ানমিডিয়া.সিএ-এর।

গোবিন্দার চান কানাডীয়রা “সবার ভেতরে বিদ্যমান বদ্ধমূল ধারণাগুলি সম্পর্কে নিজের মনের ভেতরে নজর দিক এবং আরও বেশি সচেতন ও চিন্তাশীল হয়ে উঠুক।”

এই প্রদেশের জন্য এক জটিলতর সময়ে এই প্রচারাভিযান শুরু করা হয়। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিসিতে ঘৃণাজনিত অপরাধ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। শুধু চলতি বছরেই মেট্রো ভ্যাঙ্কুভার এলাকায় ২০১৯ সালের তুলনায় ঘৃণাজনিত অপরাধ বেড়েছে ১১৬ শতাংশ। ভ্যাঙ্কুভার পুলিশ বিভাগ এই বৃদ্ধির হার রেকর্ড করেছে।

এসব ঘৃণাজনিত অপরাধে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এশীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। গত বছর যেখানে এশীয় সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ ছিল ৯টি সেখানে ২০২০ সালে একই ধরনের অপরাধের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮টিতে। তার মানে শতকরা বৃদ্ধির হার হলো ৮৭৮ ভাগ।

একটি ছোট্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে প্রচারণা শুরু করা হয়, “আমি কি বর্ণবাদী?” গত নভেম্বরের শেষদিক থেকে এই শব্দগুলি ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সর্বত্র বিলবোর্ড ও বাস স্টেশনগুলোতে শোভা পাচ্ছে। ছবি : বিসি অফিস অব দি হিউম্যান রাইটস

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় বর্ণবাদ

স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার ২০১৬ সালের আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার গ্রেটার ভ্যাঙ্কুভার এলাকায় জনসংখ্যার ৪৮.৯ শতাংশ অশ্বেতাঙ্গ। এর মধ্যে ককেসীয় জাতিগোষ্ঠীর বাইরে প্রধান হলো চীনা, দক্ষিণ এশীয় ও ফিলিপিনো।

ন্যাদাইন এস* বিসি-তে অধ্যয়নরত একজন কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র দুই জায়গাতেই বসবাস করেছেন। একজন ক্রীড়াবিদ হিসাবে তিনি বহু টিমে কখনও একমাত্র কখনও মুষ্ঠিমেয় কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের একজন হিসাবে অংশ নিয়েছেন। তিনি প্রায়শ অনুভব করেছেন যে, দলের সহ-খেলোয়াড়রাই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, “তারা যখন আমার পাশে থাকে তখন এক ধরণের কৃষ্ণাঙ্গের স্বরে কথা বলে অথবা আমাকে ইবোনিক্সে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যবহৃত ইংরেজি ভাষা) কিছু বলার অনুরোধ জানায়। “তারা সব বাতি নিভিয়ে দেয় এবং এমন ভান করে যেন আমাকে দেখতেই পাচ্ছে না।

এর ফলে তাকে সব সময়ের জন্য তার জাতিগত পরিচয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। তিনি বলেন, “আমি আমার গায়ের কাল রঙের ব্যাপারে সব সময়ই খুব সচেতন থেকেছি।” “বর্ণবাদ এমন এক বিষাক্ত মানসিকতা যা বিশ্বজুড়ে মানুষকে প্রভাবিত করে।”

সম্প্রতি বিসি-তে কর্মরত নাইজেরীয়-কানাডীয় জোশুয়া অনউগবোনু টরন্টোর বহুসংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তার বেড়ে ওঠার বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, “ওই রকম পরিবেশে একাকী হয়ে পড়া কঠিন নয়।”

তিনি নিজে যদিও উল্লেখযোগ্য কোনও বর্ণবাদী আচরণের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি কিন্তু তার পরিবারের সদস্যরা এধরণের আচরণের বিষয়ে আলোচনা করছেন এমন স্মৃতি তার আছে। “তারা যে আচরণের শিকার হয়েছেন তার কিছু কিছু সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।”

তিনি বলেন যে, ওইসব আলোচনা শোনার পর একজন মানুষ নিজেকে “চিন্তার ক্ষেত্রে তিক্ত, ক্রুদ্ধ অথবা হীনম্মন্যতার আবহে আটকে পড়া” বলে অনুভব করতে পারে। অবশ্য, তিনি বলেন, এটি একই সঙ্গে একজন মানুষকে “তার নিজের এবং সে কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে আরও বেশি জানার এবং আত্মপরিচয় নিয়ে গর্বিত হওয়ার মত সক্ষমতাও দিতে পারে।”

তার এই মন্তব্য গোবিন্দার-এর চিন্তারই অনুরূপ, যিনি মনে করেন, সমাজের পরিবর্তন সূচিত হয় আত্ম-চিন্তন থেকে।

তিনি বলেন, “আমাদের জন্য দরকার আমাদের নিজের বদ্ধমূল ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং আমাদের চারপাশে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এবং পদ্ধতিগত যে বর্ণবাদ রয়েছে তার মোকাবিলা করা। পদ্ধতিগত বর্ণবাদ আছে আমাদের আইনে, নীতিতে এবং শিক্ষায়।”

বিসির মানবাধিকার কমিশনারের অফিস ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এর আগে ১৭ বছর ধরে সেখানে প্রাদেশিক মানবাধিকার কমিশন ছিল না। মানবাধিকার কমিশনার হিসাবে গোবিন্দারের নিয়োগ হয়েছে এমন দৃঢ় আস্থা থেকে যে তিনি প্রদেশটিকে পদ্ধতিগত বর্ণবাদ সম্পর্কিত বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলবেন।

তিনি বলেন, “বর্ণবাদ ন্যূনতম পর্যায়ে থাকার সুবাদে কানাডার একটি নিরাপদ জায়গা হিসাবে সুনাম রয়েছে। কিন্তু এই ধারণার মধ্যে ইতিহাসের এবং বর্তমান সময়ে এই প্রদেশে ও পুরো দেশে আদিবাসী ও অশ্বেতাঙ্গ জনগণ যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে তার সত্যিকার প্রতিফলন ঘটেনি।”

গোবিন্দার বলেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধ লড়াইয়ের প্রধান উপায় হলো শিক্ষা: বর্ণবাদ কি, এটি কিভাবে চিহ্নিত করা যাবে এবং বিসি ও কানাডায় আমাদের অভিন্ন ইতিহাসটা কেমন সেটা জানা। এই লক্ষ্যে কমিশনারের দফতর তার জনসচেতনতার কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে ওয়েবভিত্তিক উপকরণের মাধ্যমে যা bchumanrights.ca এই ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।

কমিশনার আশা করছেন, শিক্ষা মানুষকে সক্রিয় হবার এমনকি পারস্পরিক মিত্রতা বোধের প্রেরণা সৃষ্টি করবে।

তিনি বলেন, “একজন দর্শকের চেয়েও বেশি কিছু হোন, নিজে কিছু করুন। কারও বিরুদ্ধে বিদ্বেষজনিত ঘটনা বা জাতিগত অবিচার ঘটতে দেখলে আপনি তার মিত্র হিসাবে পাশে দাঁড়াতে পারেন।”

তিনি যোগ করেন, সবার আগে কাজে নামার আগে সর্বপ্রথম নিজের এবং অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। “যেখানে আপনি যথেষ্ট নিরাপদ সেখানে আপনি হয়রানি বা সহিংসতার শিকার হতে যাওয়া লোকেদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। তাদের সমর্থন দিতে পারেন।”

“তারা যদি ঘটনাটি সম্পর্কে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে চায় তাহলে এ বিষয়ে তাদের সাহায্য করুন।”

ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের বিষয়ে রিপোর্ট করা যায় বর্ণবাদ-বিরোধী নেটওয়ার্ক Resilience BC-র মাধ্যমে। যারা রিপোর্ট করবেন তাদেরকে ঘটনার স্থান, তারিখ, সময় এবং কী ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছিলো সে বিষয়ে বিস্তারিত দলিল ও তার প্রাসঙ্গিক পটভূমি সঙ্গে দিতে হবে। এছাড়া, বিসি-র মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল মানবাধিকার লংঘনের যে কোনও ঘটনা সম্পর্কে অভিযোগের বিচার করে থাকে। বিসির মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী জাতি, বর্ণ, বংশ বা জন্মস্থলের ভিত্তিতে বৈষম্য করাও মানবাধিকার লংঘনের মধ্যে পড়ে।

*ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতি অনুযায়ী নাম পাল্টানো হয়েছে।