‘যে দেশে থেকে এসেছো সে দেশে ফিরে যাও’ হলো একটি বর্ণবাদী জিগির যা কানাডাও আঘাত হানছে
ডিসেম্বর ৭, ২০১৯
সামান্থা বিটি: টরন্টো- জুলাই মাসে একদিন ক্যারোলাইনা কানেডা যখন তার মার সঙ্গে তাদের টরন্টোর বাড়ি থেকে রাস্তায় বেরিয়েছেন তখন তিনি দেখতে পান, একজন মহিলা তাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
মহিলাটি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এটা জেনে যে কানেডার মা স্প্যানিশ ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় কথা বলতে পারেন না এবং মহিলাটি যা বলছেন কানেডার মা তা বুঝতে পারছেন না। মহিলাটি কানেডা ও তার মা উভয়কে বলেছিলেন, ‘যে দেশে থেকে এসেছো সে দেশে ফিরে যাও।’
কানেডা হতাশায় মুহ্যমান হয়েছেন। তিনি বলেন, “এটাই আমার দেশ।”
কানেডা ও তার মা হেঁটে চলে আসেন। কিন্তু কানেডা জানান, এধরণের ঘটনা অব্যাহতভাবে হুল ফুটাচ্ছে। ৩২ বছর বয়সী ফটোগ্রাফার কানেডা হাফিংটন পোস্ট পত্রিকাকে বলেন, “এ ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে মানুষকে হতোদ্দম করে দেয়।”
কলম্বিয়ার নাগরিক কানেডা এক দশক আগে কানাডায় আসেন এবং এখানে তিনি মিশ্র জাতির মানুষ হিসাবে চিহ্নিত।
কানেডা বলেন, মিশ্রবর্ণের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রকাশ্যে অপমান করার ব্যাপারে লোকেরা ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আর এজন্যে তিনি দায়ী করেন আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিজয়ী হওয়াকে। কারণ ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের ব্যাপারেও এ ধরণের অপমানজনক কথাবার্তা বলেন এবং অভিবাসী ও শরণার্থীদের প্রতি এ ধরনের মন্তব্য করেন।
কানেডা বলেন, “সবখানেই বর্ণবাদী লোকজন আছে এবং তারা এখন এ বিষয়ে অনেক বেশি উচ্চকণ্ঠ।”
তিনি বলেন, গত গ্রীষ্মে তিনি একটি পার্কে দেখেছেন এক ব্যক্তি হিজাব পরা এক নারীকে সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করছেন। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে আগের চাকরিতে থাকার সময় তার বস কোনও রকম অনুমতি না নিয়েই তার চুলে হাত দিতেন। তিনি এটিকে “খ্যাপামি” (crazy) বলে উল্লেখ করেন। তার স্বামী হলেন জাপানি। তারা যখন একসঙ্গে বের হন তখন লোকেরা বর্ণবাদী মন্তব্য করে।
ক্যারোলাইনা বেশ কয়েক বছর ধরে টরন্টোতে বসবাস করে আসছেন, সম্প্রতি তাকে বলা হয়েছে, ”নিজের দেশে ফিরে যাও”। ছবি:হাফপোস্ট
তিনি বলেন, তিনি এই বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন যে, “অবশেষে আমরা সবাই সুখি হবার চেষ্টা করি, আমাদের প্রিয়জনের সেবাযত্ন করি এবং একটি অধিকতর ভালো জীবন অর্জনের চেষ্টা করি।” তার ভাষায়, “আমার মনে হয়, আমরা যদি ওই কথাটা মনে রাখি তাহলে পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও সহানুভূতিশীল হওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।”
কানেডার কাহিনী হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাফিংটন পোস্টের কাছে আসা এধরণের অসংখ্য অভিযোগের একটি যেখানে অনেক কানাডীয়কে নিজের দেশে চলে যেতে বা এধরণের অন্য কোনও কথা বলা হয়েছে। বেশ কিছু সংখ্যক কানাডীয় জানিয়েছেন, কানাডার বিভিন্ন শহরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় তাদের উদ্দেশে ওই বর্ণবাদী জিগিরটি ছুড়ে দেওয়া হয়েছে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে তাদেরকে নিন্দামন্দ করা হয়েছে।
শাওনা বেনেট (৩৫) হলেন জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত এবং দুবছর আগে তার আট বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে টরন্টোতে এক উৎসবে অংশ গ্রহণ করছিলেন। সেসময় এক ব্যক্তি তাদের কাছে এসে দিব্যি দিয়ে বলেন, “নিজের দেশে চলে যাও।”
বেনেট বলেন, “আমি রেগে গিয়ে তাকে বলি যে, তুমি তো আদিবাসী নও, এটা তোমারও নিজের দেশ নয়।” তিনি বলেন, “আমার মেয়ে ওই ঘটনার কথা এখনও প্রায়ই উল্লেখ করে। আর আমি সব সময়ই জবাব দিই, ‘এসো আমরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াই।’
কানাডা দেশে বিদেশে নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ হিসাবে তুলে ধরে। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো হাজার হাজার সিরীয় উদ্বাস্তুকে কানাডায় আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং ২০১৭ সালে তিনি বিদেশিদের ব্যাপারে ট্রাম্পের কিছু বিরূপ সমালোচনার বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন।
কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, “অন্তর্ভুক্তি কেবল যে সবচেয়ে চৌকস একটা কাজ তাই নয়, এটিই সবচেয়ে যথার্থ কাজও।”
যাই হোক, ট্রুডো কিন্তু বহুসংস্কৃতিবাদের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়া একজন প্রগতিশীল নেতা হিসাবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন খুবই যতেœর সঙ্গে। যদিও গত নির্বাচনের সময় তার বর্ণবাদী মনোভাব প্রকাশ করে এমন কিছু ছবি ও ভিডিও প্রকাশ পেয়ে যায়।
এদিকে ২০০৯ সাল থেকে কানাডায় হিংসাপ্রসূত অপরাধের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। জাতীয় পরিসংখ্যানেই তা দেখা যাচ্ছে।
গত বছর জাতি, বর্ণ, ধর্ম, লৈঙ্গিক অবস্থা, ভাষা, প্রতিবন্ধিতা, যৌনতা বা বয়সের কারণে বিদ্বেষী হয়ে ঘটানো অপরাধের ১,৭৯৮টি ঘটনা পুলিশের কাছে এসেছে। যেখানে ২০১৬ সালে এধরণের অপরাধের ঘটনা ঘটে ১,৪৯০টি। পুলিশে রিপোর্ট হওয়া ঘটনাগুলোর মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের সমাধান হয়েছে। এছাড়াও অনেক বেশি সংখ্যক ঘটনা ঘটে থাকতে পারে যা পুলিশকে জানানোই হয় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কানাডার ঘৃণাবিরোধী নেটওয়ার্ক-এর হিসাবে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধের সংখ্যা পুলিশে রিপোর্ট হওয়া ঘটনার চেয়ে ২০ থেকে ১০০ গুণ বেশি হতে পারে।
একজন শ্বেতাঙ্গ নাগরিক বেনোইট কোভিলার্ড বলেন, চলতি গ্রীষ্মের আগে তিনি আর কখনই কোনও রকম বর্ণবাদের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি।
আসলে তিনি ফ্রান্স থেকে অভিবাসী হয়ে কানাডায় আসেন ১৫ বছর আগে এবং তার নিজের ভাষায়, বৈচিত্রের প্রতি এখানকার অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাব দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন।
যাই হোক, জুন মাসে তার শ্বশুড়ের ড্রাইভওয়ে মেরামতে নিম্নমানের কাজ করায় কোভিলার্ড একজন ঠিকাদারকে অভিযোগ জানান। তার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী মূলত চীনা। আর ঠিকাদার ভেবেছিলো কোভিলার্ডও চীনাই। সে কোভিলার্ডের অভিযোগ নাকচ করে দেয়, হাসতে থাকে এবং তাকে বলে, “কেন তুমি চীনে চলে যাও না?” কোভিলার্ড বলেন, “আমি সত্যিই মর্মাহত হই। আমি খুবই ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ি।”
কোভিলার্ডকে এই যন্ত্রণা পেতে হচ্ছে তার স্ত্রী অ্যাঞ্জেল এবং তার বাবা-মা হেনরি ও রেইনবো জেং এর জন্য। তারা কিন্তু মাথা নিচু করে সব সময় কাজ করে যান এবং কঠোর পরিশ্রম করেন। অধিকতর সৌভাগ্যের আশায় বেশ কয়েক দশক আগে তারা চীন থেকে কানাডায় আসেন।
রেইনবো জেং যখন ঘটনা জানতে পারেন তখন তিনি বলেন, তিনি নৈরাশ্য বোধ করছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, “কেন কানাডায় থাকতে হবে?”
অ্যাঞ্জেল অবশ্য কিছুটা কম বিস্মিত হয়েছেন তবু তিনিও নিজেকে “আবেগাপ্লুত ও প্রান্তবর্তী” বলে বোধ করেন। তিনি বলেন, লোকজন প্রায়ই তার স্বামীর চেয়ে তার সঙ্গে ভিন্নভাবে আচরণ করে। যেমন, মুদির দোকানে লোকজন তার সঙ্গে কমই বন্ধুসুলভ আচরণ করে, সহযোগিতার হাতও বাড়ায় কম এবং বেশি অধৈর্য দেখায়।
তিনি বলেন, “এমনটা প্রায়ই ঘটে তবে খুবই ছোটখাটো বিষয়ে। যেভাবেই হোক আমি এখন এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এবং এ সব বিষয়ে তেমন মনোযোগ দিই না।”
কোভিলার্ড বলেন, তিনি ঘটনাটি পুলিশকে জানাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে বলা হয়েছে যে, এক্ষেত্রে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব হবে না। সঙ্গে বাচ্চা নিয়ে ফেরার সময় তিনি বলেন, “কানাডা আরও বেশি খোলামেলাভাবে বর্ণবাদী হয়ে উঠছে” দেখে তিনি শঙ্কিত।
গত আগস্ট মাসে মন্ট্রিলে মাইকেল কেপলান (৭১) তার সিনাগগের সামনের সিঁড়িতে বসে একটি বই পড়ছিলেন। ওই সময় বাচ্চার ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এক মহিলা এগিয়ে আসেন। মহিলাটি কেপলানকে বলেন, শহরে আরও বেশি বেশি গীর্জা প্রতিষ্ঠা করা দরকার।
কেপলান বলেন, “আমি কাঁধ ঝেঁকে চুপ করে থাকি। আর তখনই দৃশ্যটা কদাকার হয়ে ওঠে। মহিলাটি উচ্চকণ্ঠে বেশ ক’বার কসম খেয়ে বলেন, আমার মত লোকেরা নাকি বিদ্যালয়ের জন্য বিরক্তির সৃষ্টি করছি এবং তার বাচ্চার ক্ষতি করছি।” মহিলাটি কেপলানকে যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে যেতে বলে।
শেষ পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মহিলাটি চলে যায়। কিন্তু তার কথার অনুরণন রয়ে যায় কেপলানের মনে। কারণ এর আগে মন্ট্রিলে আর কখনই তিনি এধরণের এন্টি-সেমেটিক মনোভাবের মুখোমুখি হননি। তিনি হতভম্ব হয়েছেন এটি ভেবে যে, ওই মহিলার ভাষায় কী আশ্চর্যজনকভাবে কুইবেকের রাজনীতিকদের বার্তার প্রতিফলন ঘটেছে!
কুইবেকে সম্প্রতি একটি নতুন আইন পাস করা হয়েছে যাতে সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনকালে কোনও ধরণের ধর্মীয় প্রতীক যেমন হিজাব অথবা ইহুদিদের কিপ্পাহ (টুপি) ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
“এটি জঘন্য এবং পিচ্ছিল ঢালুপথ।” -সৌজন্যে: হাফপোস্ট