নিজ পরিবারের চারজনকে খুন! শোকে কাতর প্রবাসী বাংলাদেশীরা
বাঙ্গালী যুবক মিনহাজের ভয়াবহ নৃশংসতা
সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯
প্রবাসী কণ্ঠ : অবাক কান্ডে মানুষ বিস্ময়াভিভূত হয়। তবে তারও একটা সীমা থাকে। কিন্তু টরন্টোর উত্তরে অবস্থিত মার্কহাম সিটির বাঙ্গালী যুবক মিনহাজ এর ভয়াবহ নৃশংসতা সেই সীমাকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে!
সকলেরই এক প্রশ্ন – এটা কি করে সম্ভব? এতটা নৃশংস এতটা নির্দয় এবং এতটা পাষাণহৃদয় একজন মানুষ কি করে হয়?
নিজের জন্মদাত্রী মা, জন্মদাতা বাবা, আদরের ছোট বোন, শ্রদ্ধেয়া নানী সবাইকে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনামাফিক ঠান্ডা মাথায় এভাবে হত্যা করা কি করে সম্ভব হলো? আর কি কারণেই বা এই ভয়াবহ হত্যাজজ্ঞ?
প্রবাসের প্রতিটি বাঙ্গালীর এই একই প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর মিলছে না সেই প্রশ্নের। পুলিশও মুখে কুলুপ এটে বসে আছে। এখনো কিছুই বলছে না। কি ভাবে হত্যা করা হলো, কি কারণে হত্যা করা হলো এবং একজনের পক্ষে একই বাড়িতে চারজনকে কি করে হত্যা করা সম্ভব হলো এ সবই এখনো রহস্যাবৃত।
গ্রেফতার হওয়া মিনহাজ জামানকে (২৩) ইতিমধ্যে দুই দফা আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে। প্রথমবার গত ২ আগস্ট এবং দ্বিতীয়বার ৮ আগস্ট। কিন্তু কোন তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। দুই সপ্তাহ পরে আবার তাকে আদালতে হাজির করার কথা। পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, চারজনের মৃত্যুর কারণ নিরূপিত হয়েছে। কিন্তু তা এই মুহুর্তে প্রকাশ করা হচ্ছে না যেহেতু মামলাটি আদালতে চলমান রয়েছে।
ইয়র্ক পুলিশের এর পক্ষ থেকে বলা হয়, নৃশংস এই হত্যাকান্ডটি ঘটে গত ২৮ জুলাই রোববার বিকেল ৩টার দিকে টরন্টোর মারখাম উপ-শহরের ক্যাসেলমোর এভিনিউয়ের বাড়িতে। নিহতরা হলেন- মিনহাজ এর নানী ফিরোজা বেগম (৭০), মা মমতাজ বেগম (৫০), বাবা মনিরুজ জামান (৫৯) এবং বোন মালেছা জামান (২১)। এরা সবাই ক্যাসেলমোর এভিনিউর এই বাড়িতেই থাকতেন।
ইয়র্ক পুলিশের মুখপাত্র প্যাটেনডেন গণমাধ্যমকে জানান, রোববার বেলা ৩টায় তাদের কাছে একটি ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, মার্কহাম সিটির ১০০৬ নম্বর ক্যাসেলমোর এভিনিউয়ের বাড়িতে কিছু মানুষ আহত হয়ে পড়ে আছেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বাড়ির দরজায় এক যুবককে দেখতে পায় এবং তাকে গ্রেফতার করে। এই যুবকই মিনহাজ জামান এবং তিনি পুলিশের কাছে হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
হত্যাকান্ডের পর টরন্টোর বিভিন্ন মিডিয়াতে যখন খবরটি আসে তখনও প্রবাসী বাংলাদেশীরা বুঝে উঠতে পারেননি যে হতভাগ্য এই পরিবারটি বাংলাদেশী। কারণ বিস্তারিত কিছুই বলা হয়নি নিউজে। পরের দিন যখন নিহতদের ছবি ছাপা হয় মিডিয়াতে এবং একই সঙ্গে যখন এই পরিবারের পরিচিত কয়েকজন ফেসবুক এ ম্যাসেজ দেন তখন একে একে সবাই জানতে পারেন যে হত্যাকারী এবং হত্যাকান্ডের শিকার সকলেই বাংলাদেশী এবং এক পরিবারের সদস্য তারা।
অনলাইন পত্রিকা vice.com জানায় মিনহাজের এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের খবর প্রথম জানতে পারেন তার কিছু অনলাইন বন্ধু। এদের মধ্যে একজন হলেন আইয়ুব। তিনি মিনহাজের একটি ম্যাসেজ দেখতে পান যাতে লেখা আছে, “আমি আমার পরিবারে সবাইকে হত্যা করেছি এবং খুব সম্ভব আমাকে আমার বাকি জীবন জেলে কাটাতে হবে যদি আমি বেঁচে থাকি।”
আইয়ুবের তখন মাত্র ঘুম ভেঙ্গেছে। সে মিনহাজকে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, তুমি এসব কি বলছ!
মিনহাজ এরপর আইয়ুবকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি ছবি দেখতে চাও?
এরপরই মিনহাজ আইয়ুবকে কিছু ছবি পাঠায়। ছবিতে দেখা যায় মিনহাজের পরিবারের সদস্যরা ফ্লোরে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায় এবং তাদের গলা কাটা। মিনহাজের আরো কয়েকজন অনলাইন বন্ধু এই তথ্য এবং ছবিগুলো পায়। এরা সবাই ‘Void Perfect World’ নামের একটি অনলাইন ভিডিও গেম এর সদস্য।
ছবি দেখে এরা সবাই হতবাক। কি করবে বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ, তারা একজন আরেকজনকে বাস্তব জগতে চিনেন না। কখনো তাদের মধ্যে দেখ সাক্ষাৎ হয়নি। ঠিকানাও জানেন না তারা মিনহাজের। কিন্তু কিছু একটা করতে হবে এই তাগিদ অনুভব করেন সবাই। আর সেই তাগিদ থেকেই চেষ্টা করতে থাকেন দ্রুত মিনহাজের প্রকৃত পরিচয় ও ঠিকানা খুঁজে বের করতে এবং পুলিশকে তা জানাতে।
বোন মালেছা জামান
এর কয়েক ঘন্টা পর টরন্টো পুলিশের কয়েকজন সদস্য গোপনে হাজির হন মার্কহাম সিটির ১০০৬ নম্বর ক্যাসেলমোর এভিনিউয়ের বাড়িতে। এবং আবিষ্কার করেন এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের অবর্ননীয় ঘটনা। চার চারটি গলা কাটা রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে মেঝেতে। পুলিশ জানায়, তারা প্রথমে খবর পায় মার্কহামের ক্যাসেলমোর এ অবস্থিত এক বাড়িতে কিছু লোক আহত হয়ে পড়ে আছে। আর সেই খবরের ভিত্তিতেই তারা ঐ বাড়িতে অভিযান চালায়।
মিনহাজের অনলাইন বন্ধুদের কেউ কেউ তাকে দীর্ঘদিন ধরেই চিনতেন। তারা জানতেন মিনহাজ কানাডায় বাস করেন। ইউনিভার্সিটিতে যান। তিনি গেম পছন্দ করেন।
vice.com আরো জানায় মিনহাজ মাঝে মধ্যে অনলাইনে তার খেলার সাথীদের বলতো সে তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করবে। তখন সাথীরা মনে করতেন এটি মিনহাজের এক ধরনের ভুতুড়ে তমসাচ্ছন্ন রসিকতা। মিনহাজ তার অনলাইন বন্ধুদের আরো বলতেন তিনি একজন সাবেক মুসলিম। তিনি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে উপহাস বা বিদ্রুপও করতেন। গত মার্চ মাসেও তিনি তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার কথা বলেছেন। এমনকি নিজেকেও হত্যা করার কথা তিনি বলেন তার বন্ধুদেরকে। কিন্তু সবাই মিনহাজের এ ধরনের কথাবার্তাকে বাজে রসিকতা হিসাবেই বিবেচনা করে আসছিলেন।
আসলে টেকনলজির এই যুগে ইন্টারনেটে হুমকী-ধামকী এমনকি হত্যার হুমকী প্রদান এখন আর বিরল কোন বিষয় নয়। প্রতিদিনই এগুলো হচ্ছে কোথাও না কোথাও। কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে। ফলে এগুলো আজকাল আর তেমন গুরুত্ব পায়না যতক্ষণ না কোন ঘটনা সত্যি সত্যিই ঘটে।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক মিনহাজের এক অনলাইন খেলার সাথী বলেন, গত কয়েক মাস ধরে তিনি আত্মহত্যার বিষয়ে খুব বেশী কথাবার্তা বলে আসছিলেন। কিন্তু আমার কাছে তা তমসাচ্ছন্ন রসিকতা বলেই মনে হতো। যখন তিনি দিন তারিখ উল্লেখ করে তার পরিবারের সদস্যদেরকেও হত্যা করার কথা বলতেন তখন আরো বেশী করে মনে হতো তিনি সত্যি সত্যি ভুতুড়ে ও তমসাচ্ছন্ন রসিকতা করছেন।
অনলাইন গেমের একজন মাডারেটর জানান, মিনহাজ যে প্লাটফরমে অনলাইন গেম খেলতেন সেখান থেকে তাকে গত ১১ জুলাই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তার ক্রমাগত ‘racist statements ’ চুড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছানোর কারণে।
মিনহাজের আরেক অনলাইন বন্ধু জানান, হত্যাকান্ডের দিন দুই আগে মিনহাজ এক চাটগ্রুপে এসে বলেন, আমি এখন ফান করার জন্য লগইন করেছি। তিনি এলোমেলো বা লক্ষ্যহীনভাবে খেলার কিছু ছবিও পোস্ট করেন। একই সময় তিনি এলোমেলোভাবে একথাও বলতে থাকেন যে, তার জীবন অবসান হতে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, কেউ তার উপর গোয়েন্দাগিরি করছেন তাই যত শীঘ্র সম্ভব এই জীবন অবসানের ঘটনা ঘটাতে হবে।
কেউ আসলে আগে থেকে উপলদ্ধি করতে পারেননি মিনহাজ তার এ সকল কথাবার্তার মাধ্যমে প্রকৃত পক্ষে কি বোঝাতে চাচ্ছেন। অথবা কি ভয়াবহ ঘটনা তিনি ঘটাতে যাচ্ছেন।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক মিনহাজের আরেক অনলাইন খেলার বন্ধু জন (ছদ্ম নাম) বলেন, এর পর মিনহাজ এর একাউন্ট থেকে আর কোন কথাবার্তা আসছিল না। পরে জন এর নজরে আসে একটি বার্তা। জনকে পাঠানো ঐ বেতালা বার্তায় মিনহাজ জানান তিনি তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছেন। একই সাথে তিনি কয়েকটি ছবিও পাঠান যেখানে দেখা যাচ্ছে দুই জন মহিলা মেঝেতে পড়ে আছেন এবং চারিদিকে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
জন বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছি ছবিগুলো রিয়েল। কিন্তু তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এরকম একটি ঘটনা ঘটতে পারে। হয়তো মিনহাজ আগের তুলনায় আরো বেশী মাত্রার তামাশা করছে। তাদের এক খেলার সাথী এরকম ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে পারে এটা কি সত্যিই সম্ভব?
এরপর মিনহাজ জানান তিনি তার বোনকে হত্যা করতে যাচ্ছেন। এবং এর পর তিনি একজন মৃত মহিলার ছবি পাঠান। আর এরা যে সত্যি সত্যি তার পরিবারের সদস্য সেটি প্রমাণ করার জন্য মিনহাজ তাদের পরিবারের একটি গ্রুপ ছবি পাঠান যেখানে দেখা যাচ্ছে একটি পার্টিতে কেক কাটা হচ্ছে।
মিনহাজ এর পর জনকে জানান তিনি তার বাবাকে হত্যা করার জন্য অপেক্ষা করছেন। তার বাবা ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বাসায় ফিরবেন বলেও তিনি তার অনলাইন বন্ধুকে জানান।
এটি ছিল মিনহাজের বন্ধুদের জন্য একটি চূড়ান্ত মুহুর্ত। এ পর্যায়ে এসে তারা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন যে মিনহাজ সত্যি সত্যি বাড়িতে কয়েকটি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে এবং আরেকজনকে হত্যা করার জন্য অপেক্ষা করছে।
জন তখন অনলাইন বন্ধুদের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টা করছেন এবং প্রাণান্তকরভাবে চেষ্টা করছেন কানাডায় কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য যিনি স্থানীয় পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন।
এর কিছুক্ষণ পরেই মিনহাজ একজন বয়স্ক পুরুষের গলাকাটা লাশ এর ছবি পাঠায় জনকে। জন বলেন, আমরা প্রাণান্তকরভাবে চেষ্টা করছিলাম অন্তত আরেকটি হত্যাকে ঠেকানোর জন্য। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আমরা স্থানীয় পুলিশকে যথাসময়ে অবহিত করতে পারিনি বিষয়টি।
বয়স্ক ঐ পুরুষটি ছিলেন মিনহাজের বাবা। একে একে চারজনকে হত্যা করার পর মিনহাজ বিষয়টি তার অসংখ্য অনলাইন বন্ধুদের জানাতে থাকে। এদের মধ্যে উপরে উল্লেখিত আইয়ুবও আছেন। অনলাইনে মিনহাজ যে ম্যাজেসটি দেন তার শুরুটা ছিল এরকম – “I just slaughtered my entire family…”।
মার্কহাম সিটির এই ১০০৬ নম্বর ক্যাসেলমোর এভিনিউয়ের বাড়িতে পুলিশ আবিষ্কার করে চারজনে গলা কাটা রক্তাক্ত লাশ। হত্যাকারী মিনহাজকে এই বাড়ির সামনে থেকেই গ্রেফতার করা হয়। ছবি : সিটিভি
মিনহাজের অনলাইন খেলার সাথী জন এবং আইয়ুব সহ আরো কয়েকজন মিলে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন স্থানীয় পুলিশকে হত্যাকান্ডের বিষয়টি জানাতে। কিন্তু তারা সঠিকভাবে জানতেন না মিনহাজ কোথায় কোন সিটিতে থাকেন।
vice.com জানায় ঐ সময় এদের মধ্যে কেউ একজন মিনহাজকে জিজ্ঞেস করেন আপনি এখন কি করবেন? কারণ তাদের আশংকা ছিল মিনহাজ হয়তো আরো খুন করতে পারেন। উত্তর মিনহাজ জানিয়েছিলেন, আমি আমার বান্ধবীকে দেখতে যাব। এ কথা বলার পর মিনহাজের অনলাইন বন্ধুরা চেষ্টা করছিলেন তাকে কোন না কোনভাবে ঘরের মধ্যেই ব্যস্ত রাখতে। কারণ বান্ধবীর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি হয়তো তাকেও খুন করার চেষ্টা করতে পারেন। পাশাপাশি চেষ্টা করা হচ্ছিল তার কাছ থেকে তার বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করার। কিন্তু মিনহাজ তার বাড়ির ঠিকানা দেয়নি কাউকে।
বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে মিনহাজের অনলাইন বন্ধুরা চেষ্টা করছিলেন তার আইপি এ্যাড্রেস খুঁজে বের করতে। আইপি এ্যাড্রেস এর মাধ্যমে অনলাইন ব্যবহারকারী ব্যক্তিটি কোন সিটিতে বাস করেন সেটি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। হয়তো এর মাধ্যমে তার বাড়ির ঠিকানাও বের করা যেতে পারে।
তবে অনলাইনের মাধ্যমে কারো বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। অনেক চেষ্টা করে তারা একজন মিনহাজকে খুঁজে পায়। কিন্তু তার ঠিকানা ছিল কানাডার নিউ ব্রান্সউইক এ। গ্রুপের একজন অন্তত এইটুকু জানতেন যে মিনহাজ নিউ ব্রান্সউইক এ থাকেন না। ফলে আবারো শুরু হয় ঠিকানার সন্ধান। এবার তারা চেষ্টা করেন মিনহাজের স্কাইপ একাউন্ট এর আইপি এ্যাড্রেস খুঁজে বের করার জন্য। এবং কিছুটা সফল হন। তারা জানতে পারেন মিনহাজ গ্রেটার টরন্টোর কোথাও থাকেন। এবং তার ঐ অনলাইন বন্ধুদের একজন আবার মিনহাজের বাড়ির খুব কাছাকাছি থাকেন। ঐ মহিলার নাম বিয়ানকা। কিন্তু তখনো বাড়ির ঠিকানা তারা খুঁজে পাননি।
বিয়ানকা জানান, ঘটনার ঐ রাতে আমি ঘুমুতে পারিনি। আমার বাড়ি থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে এমন এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে! আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। আর আমরা যখন জানতে পারলাম তিনি তার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা করছেন তখন আমাদের ভয় হচ্ছিল এই ভেবে যে, এবার বুঝি ঐ বান্ধবীও খুন হবেন। এই ভয় আমাকে আরো তাগিদ দেয় মিনহাজের বাড়ির ঠিকানা আরো দ্রুত খুঁজে বের করার।
উৎকণ্ঠার সময় খুব দীর্ঘ হয়। তবে শেষ পর্যন্ত মিনহাজের ঠিকানা খুঁজে বের করার একটা মোক্ষম ক্লু পাওয়া যায়। মিনহাজ তার পরিবারের সদস্যদের খুন করার পর পরিচিত কিছু অনলাইন বন্ধুর ইমেইল ঠিকানা চাইছিলেন। কারণ, তিনি তাদেরকে কিছু অর্থ পাঠাতে চান PayPal এর মাধ্যমে। তিনি জানান, যেহেতু আপনি আমার ভাল বন্ধু তাই আপনাকে কিছু অর্থ পাঠাতে চাই। আমি এখন যে জায়গায় যাচ্ছি সেখানে আমার অর্থের আর কোন প্রয়োজন নেই। অনেককেই আমি ইতিমধ্যে অর্থ পাঠিয়েছি।
বিয়ানকা খুঁজে দেখলো পূর্ববর্তী একটি পেমেন্ট এসেছে মিনহাজের PayPal একাউন্ট থেকে এবং সেখান থেকেই অবশেষে মিনহাজের বাড়ির
ঠিকানা পাওয়া যায়।
মিনহাজের অনলাইন বন্ধু জন জানায়, ঠিকানা খুঁজে বের করতে গিয়ে তাদেরকে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হয়েছে। ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথে বিয়ানকা পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন।
বাড়িতে পুলিশ এসেছে টের পেয়ে মিনহাজ তার অনলাইন বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এই বলে যে, “Police are here, Goodbye.”
মিনহাজ তার অনলাইন বন্ধুদের সঙ্গে যে সকল তথ্য শেয়ার করেছেন তা থেকে জানা যায় তিনি টরন্টোর ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম বছরেই তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দেন। তবে বিষয়টি তিনি তার পরিবারের কাউকে জানাননি। দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে তিনি ডিপ্রেশনেও ভুগতে থাকেন। ঐ সময় তিনি নাস্তিক হয়ে উঠেন এমন তথ্যও তিনি তার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করেন। আর সেই সময় থেকেই তিনি পরিকল্পনা করতে থাকেন বাবা মা বোন ও নানীকে খুন করার। মিনহাজ লেখাপড়া ছেড়ে দিলেও বাড়ি থেকে নিয়মিত বের হতেন ইউনিভার্সিটির নাম করে। ঘরে বাবা মা’কে বলতেন ক্লাশ খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য হয় না। তাই দুপুর নাগাদই তিনি বাড়ি চলে আসেন।
বাড়ি থেকে বের হয়ে মিনহাজ যেতেন মলে। সেখানে ঘুড়ে বেড়াতেন। একটি কমিউনিটি জিমনেশিয়ামেও যেতেন তিনি। কিন্তু চার বছর পর যখন ইউনিভার্সিটি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে কনভোকেশন বা সার্টিফিকেটের কথা। তিনি তখন বাড়িতে জানান যে এ বছর জুলাই মাসের ২৮ তারিখে তার গ্রাজুয়েশন ডে। এবং সেই ২৮ তারিখের মধ্যেই তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কারণ তা না হলে তার এতদিনের প্রতারণা ফাঁস হয়ে যাবে।
মিনহাজ তার অনলাইন বন্ধুদের আরো জানান, তিনি যদি তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেন তবে তারা আর জানতে পারবেন বা তিনি কতটা অপদার্থ বা অকৃতকার্য ছিলেন। তিনি অনলাইন কথাবার্তায় নিজেকে প্রায়ই ‘সাবহিউম্যান’ বা ‘সম্পূর্ণ মানুষ নয়’ এই বলে আখ্যায়িত করতেন। হত্যাকান্ডের পরে মিনহাজ জানান, আমি নিজেকে খুন না করে পরিবারের সদস্যদের খুন করেছি, কারণ আমি একজন নাস্তিক। আমি বিশ্বাস করি মৃত্যুর পর পরকালের কোন জীবন নেই। সে কারণে আমি মরতে চাই না এবং মৃত্যুকে ভয় পাই। মিনহাজ আরো জানান, আমি আমার বাবা, মা, বোন এবং নানীকে খুন করেছি, কারণ আমি চাইতাম না আমার মত একজন ব্যক্তির জন্য তারা কখনো লজ্জা বা গ্লানি অনুভব করুক। আমি আমার ভীরুতার কারণে নিজেকে খুন না করে পরিবারের সবাইকে খুন করেছি। আমি জানি আমার এই সব বক্তব্য লোকজনের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। কিন্তু অমি যা করে ফেলেছি এবং যা আমার পরিকল্পনা ছিল তা এখন করা হয়ে গেছে।
vice.com জানায় হত্যাকান্ড চলাকালে মিনহাজের যে ক’জন অনলাইন খেলার সাথী তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছিলেন এবং পুলিশকে অবহিত করার চেষ্টা করছিলেন তাদের কয়েকজন এখনো ট্রমাতে ভুগছেন। তাদের এই মানসিক আঘাত হয়তো তাদের আরো ভুগাবে। এদেরই একজন বলেছেন, আমি ঠিকমত খেতে পারছি না। আরেকজন বলেছেন আমি ঘুমাতে পারছি না।
মিনহাজের দুই চাচা ও এক আন্টি তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন টরন্টোতে। একজন থাকেন মন্ট্রিয়লে। তারাও ট্রমাটাইজ হয়েছেন নিশ্চই। ট্রমাটাইজ হয়েছেন মিনহাজের বাবা মা’র সঙ্গে যাদের পরিচয় বা বন্ধুত্ব ছিল তারাও। মিনহাজের এক চাচা সামছু জামানকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা গেছে সিটিভি নিউজের সঙ্গে কথা বলার সময়। গত ২ আগস্ট টরন্টোর নাগেট মসজিদে নিহত চারজনের জানাজা অনুষ্ঠানেও অনেককে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখা গেছে। সকলেরই এক প্রশ্ন – এটা কি হলো? এবং কেন হলো?
সিটিভি নিউজকে মিনহাজের চাচা সামছু জামান বলেন, তারা খুব সুখী পরিবার ছিলেন। আমি এখন চিন্তাও করতে পারছি না যে আমার ভাই আর নেই। আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি, ভাবীকে হারিয়েছি, ভাগ্নীকে হরিয়েছি, হারিয়েছি ভাইয়ের শাশুড়িকেও। তারা আমার পরিবারের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। প্রতিদিনই তাদের সঙ্গে আমার কথা হতো।
সামছু জামান আরো বলেন, ঘটনার মাত্র দুদিন আগে মিনহাজের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। সে খুব শান্ত এবং ঠান্ডা প্রকৃতির ছেলে। তার সঙ্গে আমার গত সপ্তাহখানেক আগেও কথা হয়েছে। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা কি ভাবে কি হয়ে গেল।
জানাজার দিন সামছু জামান সিবিসি নিউজের সঙ্গেও কথা বলেন। তিনি জানান, তার ভাই মনিরুজ্জ জামান খুবই বন্ধুসুলভ ও মিত্রভাবাপন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ছিলেন খুবই সুখী। তাদের এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে কমিউনিটি হতবাক হয়ে পড়েছে। আমি নিজে অসহায় বোধ করছি। আল্লাহ নিহতদের মঙ্গল করুন।
মনিরুজ্জ জামানের পারিবারিক বন্ধু মোহাম্মদ আলীও সিবিসি নিউজকে জানান, তিনি ছিলেন খুবই কেয়ারিং পার্সন। পরিবারটি খুবই সুখী ছিল একসাথে।
নিহত পরিবারটি মার্কহাম সিটিতে বসবাস করতেন। টরন্টো সান পত্রিকা জানায়, মার্কহাম সিটির মেয়র ফ্রাঙ্ক স্কারপিটি জানাজার দিন নাগেট মসজিদে উপস্থিত ছিলেন নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে। মেয়র বলেন, ঘটনাটি পুরো কমিউনিটিকে আহত করেছে। নাড়া দিয়েছে সবাইকে। আমাদেরকে এর উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরো বলেন, এই দুঃখজনক পরিস্থিতে আমাদেরকে সমর্থনের জন্য একে অপরের দিকে তাকাতে হবে।
মেয়র ফ্রাঙ্ক স্কারপিটি বিদেহীদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।
নিহত মনিরুজ্জ জামানের ভাই সামছু জামান এর বরাত দিয়ে পত্রিকাটি আরো জানায়, মিনহাজ ভিডিও গেম এর প্রতি আসক্ত ছিল। তার কোন বন্ধু ছিল না। শুধু অনলাইন ভিডিও গেমের বন্ধু ছিল তার।
গত ২ আগস্ট শুক্রবার নাগেট মসজিদে নিহতদের জানাজা অনুষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম হয়। এই সময় লাশগুলোকে ঘিরে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন অনেকেই। তাদেরকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। যারা সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করছিলেন, এক পর্যায়ে তারাও অশ্রুসজল হয়ে পড়েন।
টরন্টো স্টার জানায়, জানাজা শুরুর আগে নিহত মনিরুজ্জ জামানের ভাই সামছু জামান উপস্থিত আত্মীয়-বন্ধু ও কমিউনিটির লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমার ভাই, ভাবী, ভাগ্নী বা ভাইয়ের শাশুড়ি যদি কোন ভুল করে থাকে তবে তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন দয়া করে।
সামছু জামান টরন্টোর বাংলাদেশীসহ সকল মুসলিম কমিউনিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার জন্য এবং জানাজায় উপস্থিত থাকার জন্য। তিনি ইয়র্ক রিজিয়নের পুলিশ কর্তৃপক্ষকেও ধন্যবাদ জানান তাদের সাহায্যের জন্য। আরো ধন্যবাদ জানান মার্কহাম সিটির মেয়র ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খালিদ ওসমানকে যারা জানাজায় উপস্থিত হয়ে সমবেদনা জানান।
সামছু জামান বলেন, আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি ক্রেজিনেস এর কারণে। এখন সবাইকে ভাবতে হবে কেন আমি আমার ভাই ভাবীসহ অন্যান্যদেরকে হারিয়েছি। আমরা কমিউনিটি হিসাবে কিছু একটা করতে পারি। তিনি আরো বলেন, আমি আমার ভাতিজা মিনহাজের মধ্যে কখনো এমন কিছু দেখতে পাইনি যার পরিনতি হতে পারে আজকের এই ট্র্যাজিডি। আমরা কিছুই জানতাম না। কোন ধারণাই ছিল না।
মনিরুজ্জ জামান এর পারিবারের সঙ্গে ভাল জানাশুনা এমন একজন হলেন জাকিয়া আলম। তিনি টরন্টো স্টার পত্রিকাকে বলেন, মনিরুজ্জ জামান ও তার স্ত্রী মমতাজ বেগম খুবই সামাজিক ছিলেন। তারা প্রায়ই বাংলাদেশীদের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। মাত্র কিছুদিন আগে তারা তাদের ২৫তম বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠানও করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ঐ বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠানে ছেলে মিনহাজ তার বাবা মা‘কে সে কতটা ভালবাসে সেই বিষয়ে রীতিমত একটি বক্তৃতাও দিল!
জাকিয়া আলম বলেন, আমরা বিস্ময়াভিভূত। আমরা জানিনা দোয়া করা ছাড়া কি করতে হবে। তিনি আরো বলেন, মনিরুজ্জ জামানের পরিবারের এই পরিনতির পর আমি আমার নিজের ছেলের (২৩) সঙ্গে অধিক সময় ব্যয় করছি। আমার ছেলে আমার এ আচরণে কিছুটা বিস্মিত হয়েছে বটে। কিন্তু আমি চাই তাকে ভাল করে জানতে। তার ভিতর কি হচ্ছে সেটা আমার জানা প্রয়োজন।
প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মনিরুজ্জ জামান এর সহধর্মীনি মমতাজ বেগম এর ঘনিষ্ঠ বন্ধবী মিসেস নাসিমা বলেন, এই পরিবারের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাদেরকে কাছে থেকে দেখেছি। তারা স্বামী স্ত্রী দুজনেই ছিলেন খুবই ভাল। খুবই ভাল ব্যবহার করতেন সবার সঙ্গে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে খুব ভাল বোঝাপড়াও ছিল। ভাবী ছিলেন খুবই হাসি-খুশী একজন মহিলা। তবে তাকে কখনো তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কথা বলতে শুনিনি। গত জুন মাসের ২৯ তারিখে আমি ও আমার স্বামী হাবীব ভূইয়া ওদের বাসায় গিয়েছিলাম একটি অনুষ্ঠানে। ওদের ২৫তম বিবাহ বার্ষিকীর প্রাথমিক অনুষ্ঠান ছিল ঐ দিন। পরে স্কারবরো কনভেনশন সেন্টারে মূল অনুষ্ঠানটি হয়। সেদিন বাসায় আরো অনেকেই গিয়েছিলেন। আর আমি তাদের ছেলে মিনহাজকে ঐ দিনই প্রথম দেখি। কিন্তু প্রথম দেখাতেই আমার কাছে মনে হয়েছিল ‘হি ইজ নট ওকে’। আমরা কয়েকজন মহিলা পার্টির এক ফাকে কিচেন এর ডাইনিং টেবিলে বসে কথা বলছিলাম। এরই এক ফাকে মিনহাজ উপর থেকে নিচে নেমে এসে ফ্রিজটা খুললো। তখন তার নানী তাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি খুঁজছো? সে বললো খাবার। নানী বললেন, তুমিতো খুঁজে পাবে না। তুমি উপরে যাও। আমি নিয়ে আসছি। এই সময় আমার স্বামীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, বাড়িতে এত লোক, এত ছেলে-মেয়ে, ওকে উপরে যেতে বললেন কেন। ওতো নিচে বসেই খেতে পারতো। ওর বয়সী ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারতো। তখন মিনহাজের নানী বললেন, তুমিতো আমার নানুভাইকে চিন না। সে খুব লাজুক ধরনের। সে সাধারণত কারো সামনে খায় না। সে খাবার নিয়ে উপরে তার রূমে চলে যায়। অনেক সময় নিচে নামেও না। সেল ফোনে কথা বলে বিভিন্ন জিনিষ চায়। আমিতো ওকে ছোটবেলা থেকেই মানুষ করেছি। আমি জানি ওর স্বভাব।
মিসেস নাসীমা বলেন, মিনহাজের নানীর এই কথা শুনে আমার কাছে মনে হয়েছিল ছেলেটি আসলেই একটু অন্যরকম। আমার এই ধারনার সমর্থন আমি এই পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পর্ক আছে এমন একজনের কাছেও পেয়েছি। পরে মিনহাজ উপরে চলে যায় এবং তাকে আর সেদিন নিচে নেমে আসতে দেখিনি।
মিসেস নাসিমা আরো জানান, পরে মিনহাজকে দ্বিতীয় দিন দেখি বিবাহ বার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানে। সেদিন সে ফ্যামিলি মেম্বারদের এক টেবিলে বসেছিল। অনুষ্ঠানে তার তৈরী একটি ভিডিও প্রদর্শিত হয়েছিল। ভিডিওটি সে তার বাবা মা’কে নিয়ে করেছিল। ভিডিওটি প্রদর্শিত হওয়ার পর অনুষ্ঠান সঞ্চালক মিনহাজকে কিছু বলতে বলেন উপস্থিত অতিথিদের উদ্দেশ্যে। সে প্রথম রাজী হচ্ছিল না। পরে পাঁচ কি সাত মিনিটের একটি বক্তব্য দেয় সে। কিন্তু তার কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। কেমন যেন জড়ানো ছিল তার বক্তব্যটি।
মিসেস নাসিমা বলেন, এর কদিন পর মমতাজকে আমার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলাম। সে তার স্বামী ও ঢাকা থেকে আসা আরো দুজন আত্মীয়কে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ছেলে-মেয়েরা আসেনি। আর যেদিন হত্যাকান্ডটি ঘটলো তার মাত্র দুদিন আগে মমতাজ আমাদেরকে আবারো নিমন্ত্রণ করেছিল এক বারবিকিউ পার্টিতে। পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল ব্লাফার্স পার্কে। আমি কাজ শেষে আমার স্বামীকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন সেখানে মিনহাজও উপস্থিত ছিল। তবে সে এক কোনে বসে আইপ্যাডে গেম খেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কারো সাথে কোন কথাবার্তা নেই, কাউকে সালামও দেয়নি। সেদিন কিন্তু মমতাজকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। মুখটা কেমন কালো হয়ে ছিল। তার মুখে বরাবর যেমন হাসি-খুশী ভাবটা থাকে তেমনটা ছিল না। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, এটা কি কোন পারিবারিক কারণে, নাকি কোন ডিপ্রেশন থেকে, নাকি সেই দুপুর থেকে এখানে আছে বলে তাকে এমন দেখাচ্ছিল। মিনহাজের নানীকেও খুব অন্যমনষ্ক লাগছিল। আমার স্বামী তাকে তিনবার সালাম দেওয়ার পরও তিনি লক্ষ্য করেন নি বা রেসপন্স করেননি। পরে আমি বিষয়টি উনার নজরে আনলে তিনি সালাম এর জবাব দেন।
মিসেস নাসিমা সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, আমি এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি ছেলেটি সম্পর্কে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, ছেলেটি যে এত দীর্ঘ সময় ধরে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না এটা কি পরিবারের কেউ বুঝতে পারেনি? উত্তরে তারা বলেন, মমতাজ বেগম সবসময়ই বান্ধবীদের বলতেন তার ছেলে খুবই ভাল ছাত্র। সে ফুল স্কলারশীপ নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। মমতাজ বেগম নাকি মাঝে মধ্যে ছেলেকে ইউনিভার্সিটিতে ড্রপও করতেন এবং পিকআপও করতেন। বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
নিহত মনিরুজ্জ জামান কানাডায় আসেন ৮০ দশকে। প্রথমে মন্ট্রিয়লে ছিলেন। পরে টন্টোতে চলে আসেন। মনিরুজ্জ জামান বাংলাদেশে নামকরা একজন সাতারু ছিলেন, গোল্ড মেডেল পাওয়া। তার বন্ধুমহলের সূত্রে জানা যায়, মার্কহামের বাড়িটি ছাড়াও টরন্টোতে আরো দুটি বাড়ি রয়েছে তাদের। মনিরুজ্জ জামান টরন্টোর ইবপশ ঞধীর’র একজন কর্মী ছিলেন। মেয়ে স্থানীয় একটি গ্রোসারীতে পার্টটাইম কাজ করতেন। মিনহাজের দুই চাচা এক আন্টি থাকেন টরন্টোতে। এক চাচা থাকেন মন্ট্রিয়লে। তার নানী কানাডার ইমিগ্রেন্ট ছিলেন। দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরেই তিনি কানাডায় ছিলেন। গত ৭ অগাস্ট তার বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ছিল। তার আদর যতেœই বলতে গেলে শিশুকাল থেকে বড় হয়েছেন মিনহাজ ও তার বোন।
মনিরুজ্জ জামানের আপন এক খালাও থাকেন টরন্টোতে। মনিরুজ্জ জামানের বাবা মা’ও টরন্টোতে থাকতেন। তবে ওনারা দুজনেই ইন্তেকাল করেছেন এখানে। পিকারিং এ তাদের দাফন করা হয়েছে।
মিনহাজের বাবা, মা, নানী ও বোনকে দাফন করা হয়েছে টরন্টোর উত্তরে ভন সিটির রিচমন্ট হিল মুসলিম কবরস্থানে।