কানাডায় কট্টর ডানপন্থী জঙ্গী গ্রুপ ও হিংসাত্মক অপরাধের হার বাড়ছে

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৯

জ্যাকি হাবিব : Documenting Hate এবং Documenting Hate:New American Nazis নামের দুটি প্রামাণ্য চিত্রেরই কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নব্য নাৎসি গ্রুপগুলো। দুটি প্রামাণ্য চিত্রই তৈরি করেছে দ্য প্যাশনেট আই (The Passionate Eye)। বছরব্যাপী তদন্তের ফল এই ছবিগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু রক্তক্ষীয় সহিংসতার পেছনে সক্রিয় গ্রুপগুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে কীভাবে তাদের কর্মকা- বিনা শাস্তিতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং কীভাবে তারা অব্যাহতভাবে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়গুলিও এ দুটি প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কানাডায়ও হিংসাশ্রয়ী গ্রুপের ক্রমবিকাশ নিয়ে সেদেশবাসীর সচেতন হওয়া দরকার। হিংসাত্মক অপরাধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং একজন প্রফেসর বারবারা পেরির বক্তব্য অনুযায়ী, সারা কানাডায় কমপক্ষে ১৩০টি চরম ডানপন্থী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তিনি বলেন, এই সংখ্যাটি ২০১৫ সালের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।

বেশিরভাগ গ্রুপই তৈরি হয়েছে বিশেষ কোনও ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধ আদর্শের ভেতর থেকে। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো মুসলিম ও ইহুদি বিরোধী গ্রুপ। এছাড়া অভিবাসী, আদিবাসী, নারী, এলজিবিটি সম্প্রদায় এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা থেকেও বিভিন্ন চরমপন্থী গ্রুপ তৈরি হয়েছে।

পেরি বলেন, কানাডায় প্রতি সপ্তাহে চরম ডানপন্থীদের সমাবেশ হচ্ছে এবং এসব হিংসাশ্রয়ী গ্রুপগুলো সম্প্রতি জোট গঠন করছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত Charlottesville সিটির শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপ ‘ইউনাইট দ্য রাইট’ এর প্রতিফলন। এর মধ্যে একটি অস্বস্তিকর প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে: তাদের মধ্যে সমমতের ভিত্তিতে পরস্পরের প্রতি সংহতি আছে এবং একটি সত্যিকারের আন্দোলনের চরিত্র ফুটে উঠছে।”

ইসলাম বিরোধীতার পোস্টার হাতে নিয়ে একদল লোক টরন্টোর ডাউনটাউনে অবস্থিত মসজিদ টরন্টো’র সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজে অংশ নিতে এসে মুসল্লিগণ এমন দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যান। ছবি : ফেসবুক

Charlottesville সিটিতে সংগঠিত বর্ণবাদী দাঙ্গার মত ঘটনা কানাডায় ঘটতে পারে কিনা সেই আশঙ্কার বিষয়টি পেরি কিন্তু নাকচ করে দেননি। তিনি বলেন, “এজন্যে কেবল এক দুজন মানুষের বেপরোয়া আচরণই যথেষ্ট হতে পারে। আমি বলছি না ওই ধরণের ঘটনা এখানে আর ঘটবে না। আমাদের মধ্যে কিছু অত্যন্ত আগ্রাসী স্বভাবের মানুষ এবং কিছু সশস্ত্র গ্রুপ রয়েছে।”

তিনি থ্রি পারসেন্টার্স এর মত গ্রুপগুলোর কথা উল্লেখ করেন। ওই গ্রুপটির শাখা আছে আলবার্টা ও টরন্টোতে এবং এর সদস্যদের সামরিক ও আধা-সামরিক প্রশিক্ষণ আছে বলে জানা যায়।

পরিসংখ্যান থেকেও দেখা যাচ্ছে যে, কানাডায় হিংসাজনিত অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। হিংসার কারণে সংঘটিত অপরাধ এবং পুলিশে রিপোর্ট হওয়া এধরণের অপরাধের সংখ্যা ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এসময় পুলিশের রেকর্ডে ২,০৭৩টি হিংসাজনিত অপরাধ নথিভুক্ত করা হয়।

এসব অপরাধের মধ্যে ৩৮ শতাংশই সহিংসতামূলক যার মধ্যে আক্রমণ, হুমকি দেওয়া এবং ফৌজদারি হয়রানির মত ঘটনা ছিলো। পেরির মতে, পুলিশের নথিভুক্ত বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটিয়েছে এমন সব ব্যক্তি যারা এই মুহূর্তে কোন বিশেষ হিংসাশ্রয়ী গ্রুপের সদস্য নয়। তার মানে হলো, আমরা যতটা চিন্তা করছি উগ্রবাদ তার চেয়েও ব্যাপকতর সমস্যা।

পুলিশের এই তথ্যগুলো তৈরি করা হয়েছে প্রতিটি ঘটনার তদন্তের ভিত্তিতে এবং প্রধানত ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের রিপোর্ট করার ইচ্ছার প্রেক্ষিতে। পেরি ব্যাখ্যা করে বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তিদের পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে না চাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো পুলিশের প্রতি অনাস্থা। তার ভাষায়, “যেসব মানুষ গে এবং যারা তৃতীয় লিঙ্গের তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় খোদ পুলিশেরই সংশ্লিষ্টতার ইতিহাস রয়েছে। সুতরাং ওইসব কমিউনিটির লোকেরা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে খুব কমই আগ্রহী হয়।”

নিজের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে পেরি বলেন, হিংসাপ্রসূত অপরাধের মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই পুলিশের কাছে জানানো হয় না।

কানাডায় ক্রমবর্ধমান প্রবণতা

কানাডার ‘এন্টি-হেইট নেটওয়ার্কের’ নির্বাহী পরিচালক ইভান ব্যালগর্ড বলেন, হিংসাশ্রয়ী গ্রুপগুলোর ইন্টারনেটে তথ্য ছড়ানো বন্ধ করাটা জরুরী। ২০১৮ সালে সূচিত এই নেটওয়ার্ক কানাডার বৃহত্তম নব্য-নাৎসী গ্রুপের পডকাস্ট বা ইন্টারনেট সাইট বন্ধ করার কাজে অংশ নিয়েছে।

কিছু হিংসাশ্রয়ী গ্রুপ অবশ্য নিজেদের বার্তা প্রচারের জন্য অধিকতর প্রচলিত পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। চলতি মাসের আরও আগের দিকে ব্যালগর্ড একটি চরম-দক্ষিণপন্থী গ্রুপের নতুন সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যে টরন্টোর ব্যাথার্স্ট ও সেন্ট ক্লেয়ার এলাকায় নব্য-নাৎসি চিত্র সংবলিত পোস্টার সাঁটার খবর পান।

তিনি বলেন, মানুষের চরমপন্থী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত ঘটছে এবং লোকেরা সংগঠিত হবার জন্য অভিন্ন কায়দায় অনলাইনে গিয়ে হিংসাশ্রয়ী প্রচারণামূলক লেখালেখি খুঁজে নিচ্ছে। তিনি বলেন, ওইসব লোকেরা ক্রমশই বেশি করে মূল ধারার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িত হচ্ছে। “আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাস্তব জীবনে সক্রিয় সাংগঠনিক ধারায় তারা টরন্টোর মেয়র পদে ফেইথ গোল্ডির প্রচারণায় সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসছে। তারা ম্যাক্সিম বার্নিয়েরের পার্টির ব্যাপারেও উৎসাহী।”

ব্যালগর্ড বলেন, কানাডার হেইট গ্রুপের সদস্যরা আমেরিকার মত নন। তারা জনমতের ব্যাপারে সচেতন, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের বাইরে থাকেন এবং নিজেদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সোচ্চার নন।

তিনি নব্য-নাৎসি গ্রুপের আরেকটি সাম্প্রতিক প্রবণতার উল্লেখ করেন, সেটা হলো, তারা নিজেদেরকে তথাকথিত ফ্রি স্পিচ বা “পুরুষের অধিকার” সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদির অনুকূলে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ অঙ্গনে এ ধরনের অনুষ্ঠানাদি ক্রমবর্ধমান হারে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

কানাডায় হিংসাশ্রয়ী বক্তব্যের বিরুদ্ধে ‘আইন দুর্বল’

অটোয়ার আইনজীবী রিচার্ড ওয়ারম্যান কানাডার হিংসাশ্রয়ী কর্মকা- সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেন গত ২০ বছর ধরে। তার বিশেষ লক্ষ্য ছিলো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ এবং নব্য-নাৎসি আন্দোলন। কানাডায় মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠারও অনেক আগেই তিনি ইন্টারনেটে ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে ১৬টি মামলায় বাদী হিসাবে সাফল্য লাভ করেন। এসব মামলায় দৃষ্টান্তমূলক রায় এসেছে। তার মধ্যে প্রথম মামলাটিতে একটি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে ঘৃণাপ্রসূত প্রচারণা সরিয়ে নিতে ব্যর্থতার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

আরেকটি মামলায় ইন্টারনেটে ঘৃণা ছড়ানোর অপরাধে কানাডায় সর্ব প্রথম কারাদ- দেওয়া হয়। সেই কারাদ- দেওয়া হয় অন্টারিওর লন্ডনের নব্য-নাৎসি টমাজ উইনিকিকে। উইনিকি বহুসংস্কৃতিবাদ, অশ্বেতাঙ্গ জনগণ, অভিবাসী এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে ইন্টারনেটে অব্যাহতভাবে বিদ্বেষমূলক লেখা প্রচার করছিলেন। তাকে এসব লেখালেখি থেকে বিরত থাকতে আদালত নির্দেশ দিলেও তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। এজন্যে তাকে নয় মাস করাদ- ভোগ করতে হয়।

এত সব ঘটনার পরও, পেরি বলেন, এ বিষয়ে কানাডার আইন যথেষ্ট নয়। তার ভাষায়, “আইন দুর্বল এবং তার প্রয়োগে দুর্বলতা আরও বেশি।”

পেরি ব্যাখ্যা করেন যে, কানাডার বর্তমান আইনে হিংসাশ্রয়ী সংগঠন গড়ে তোলার কারণে জনমনে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি, বিশেষ করে কানাডার মানবাধিকার আইনের ১৩’শ অনুচ্ছেদে যেখানে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য সম্পর্কে বলা হয়, সেটি ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হারপার-এর সরকার বাতিল করে দেয়।

পেরি বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো হিংসাশ্রয়ী গ্রুপগুলোকে সন্ত্রাসী গ্রুপ থেকে পৃথক করে রাখার প্রয়াস চালায়। তারা শুধু কট্টর ইসলামী গ্রুপগুলোর জন্যই সন্ত্রাসী অভিধাটি প্রয়োগ করতে চায়। পেরি মনে করেন, চরম ডানপন্থী গ্রুপগুলোকেও সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসাবেই চিহ্নিত করা উচিৎ।

হেইট গ্রুপের উত্থানের বিরুদ্ধে

পেরি বলেন, কানাডীয়রা চরম-ডানপন্থীদের কর্মকা-ে প্রতিবাদে বিরল উপস্থিতি দেখিয়েছে, অনেক সময় তাদের উপস্থিতি বিক্ষোভকারীদের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ঘৃণা ছড়ানো বক্তব্য বা অপরাধ ঘটতে দেখলে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবাদ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষভাবে জোর দেন।

এক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থারও ভূমিকা রাখার প্রয়োজন আছে। পেরি বলেন, কানাডীয়রা যদিও চরম-ডানপন্থী গ্রুপগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হয়ে উঠছে, কিন্তু তারপরও আমরা মুখ্যত অজ্ঞই থেকে গেছি। তার ভাষায়, “কানাডীয়রা খুবই আত্মতুষ্ট। (যুক্তরাষ্টে) এটা আরও বেশি, কিন্তু আমরা এখানে বিষয়টিকে আর অস্বীকার করে থাকতে পারি না, এটি সত্যিই ভয়ংকর।” -সৈজন্যে : সিবিসি নিউজ