কানাডার জাতীয় নির্বাচন আসন্ন : জরীপে ভোটারদের উচ্চ মাত্রার উদ্বেগ এবং রাজনীতিবিদদের প্রতি নিম্ম মাত্রার আস্থা প্রকাশ

জুলােই ১৭, ২০১৯

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ৩০ জুন, ২০১৯ : আগামী শরৎকালের কেন্দ্রীয় নির্বাচনের আগে কানাডীয়রা উদ্বেগ এবং দ্বান্দ্বিক মানসিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। সিবিসি নিউজের পরিচালিত এক নতুন জরিপে এই পরিস্থিতিরই প্রতিফলন ঘটেছে।

সমীক্ষায় ব্যক্তিগত ও বৈশ্বিক নানা কারণে সৃষ্ট গভীর উদ্বেগের বিষয়টি উঠে এসেছে। যেসব বিষয়ে কানাডীয়রা উদ্বিগ্ন তার তালিকার শীর্ষে রয়েছে খাদ্য ও গ্যাসের মতো মৌলিক ভোগ্যপণ্যের মূল্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মতো বিষয়গুলো। খবর সিবিসি নিউজ এর।

তবে সমীক্ষায় এটাও দেখা গেছে যে, কানাডার সহিষ্ণুতার আদর্শের কারণে গর্ব বোধ করলেও বিভিন্ন বিষয়ে তারা দ্বান্দ্বিক এবং পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। আবার দেশটি যে খুব বেশি পাল্টে যাচ্ছে এটা নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন কিংবা ভোটদানকে কর্তব্য বা (খুব অল্প হলেও কিছু লোকের কাছে) নিছক সময় নষ্ট করা বলে গণ্য করার বিষয়েও তাদের উদ্বেগ কাজ করে।

সিবিসি নিউজের পক্ষে Public Square Research and Maru/Blue  নামের প্রতিষ্ঠান এই জরিপ চালায়। ৩১ মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত পরিচালিত এই জরিপে অনলাইনে সাড়ে চার হাজার কানাডীয় নাগরিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

ভোটারদের উদ্বেগের শীর্ষ কারণ জীবনযাত্রার ব্যয়

জরিপে দেখা গেছে কানাডীয়রা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত। ৭২ শতাংশ কানাডীয় বলেছেন, তারা উদ্বিগ্ন বা কিছু পরিমাণে উদ্বিগ্ন। মাত্র ছয় শতাংশ মানুষ আশাবাদী বলে জানিয়েছেন আর ২২ শতাংশ বলেছেন, তারা কিছু পরিমাণে আশাবাদী।

নতুন কানাডীয়দের মধ্যে আশাবাদ একটু প্রবল। তাদের অর্ধেকের সামান্য কম সংখ্যক বলেছেন যে তারা আশাবাদী বা কিছু পরিমাণে আশাবাদী।

কোন বিষয়টি তাদেরকে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করে জানতে চাওয়া হলে ৩২ শতাংশ বলেছেন, জীবনযাত্রার ব্যয়। জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার জনগণ এবং ২৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষেরা।

জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন নাগরিকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ৮৩ শতাংশ বলেছেন, তারা নিত্যদ্রব্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো পণ্যের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে অর্ধেকের বেশি সংখ্যক বলেন, তারা আবাসন বা অবসরের পর তেমন কোনও সঞ্চয় থাকবে কিনা সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।

তালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি যা নিয়ে উদ্বিগ্ন ১৯ শতাংশ মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ অপেক্ষাকৃত বেশি আটলান্টিক কানাডা, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ও কুইবেকে। এছাড়া কিছুটা বেশি শিক্ষিত ও তরুণতর কানাডীয়দের মধ্যে এ বিষয়ে উদ্বেগ বেশি।

দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই মানুষের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন উদ্বেগের দুটি প্রধান কারণ হিসাবে দেখা গেছে।  যদিও আলবার্টা, সাসকাচুয়ান ও ম্যানিটোবায় জীবনযাত্রার ব্যয়ের বিষয়টি জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে দুই ঃ এক অনুপাতে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

অবশ্য নতুন কানাডীয়দের মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয়ের পরেই এসেছে কর্মসংস্থান খুঁজে পাওয়া নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি। যদিও প্রথমবারের মত ভোট দিতে পারার মত পুরনো যারা তাদের মধ্যে উদ্বেগের কারণের তালিকায় জীবনযাত্রার ব্যয়ের চেয়েও এগিয়ে আছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি।

রাজনীতি নিয়ে ভোটারদের মোহমুক্তি

আগামী অক্টোবরের নির্বাচনে ভোট পাওয়া নিয়ে লড়াইরত রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের প্রতি আন্তরিক কোনও আগ্রহ আছে এমন বিশ্বাস কানাডীয়দের আছে বলে মনে হয় না। আর যারা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা রাজনীতির ব্যাপারে আরও বেশি মোহমুক্ত।

জরিপে অংশ নেওয়া কানাডীয়দের পুরো ৮৮ শতাংশ বলেছেন, তারা মনে করেন, রাজনীতিকরা যথাকর্তব্য সম্পাদনের চেয়ে বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাপারে বেশি যতœবান। অন্যদিকে ৪৭ শতাংশ বলেছেন, কোনও দলই তাদের (জনগণের) আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে না।

অবশ্য প্রথম ভোটার হওয়া কানাডীয়দের মধ্যে এই মনোভাব খুব জেরোলো নয়। বরং ২৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে যাদের বয়স তাদেরই বেশিরভাগ মনে করেন কোনও রাজনৈতিক দলই তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মনোযোগী নয়।

যারা দেশ পরিচালনা করে তাদের সঙ্গে অন্য সবার দূরত্বের যে অনুভূতি সেটাই জনগণের রাজনীতি নিয়ে মোহমুক্তির অন্যতম কারণ বলে মনে হয়; ৭৮ শতাংশ মানুষ বলেন, তাদের বিশ্বাস, দেশ “সাধারণ মানুষ” এবং “অভিজাত শ্রেণী”র মধ্যে বিভক্ত।

এর পরও কানাডীয়রা মনে করেন, গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জরিপে অংশ নেওয়াদের এক বিরাট অংশ (৯৫ শতাংশ) বলেন, ভোট দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য এই বক্তব্যের ব্যাপারে তারা জোরালোভাবে কিংবা অনেকটাই একমত। ৭৫ শতাংশ বলেন, তারা এব্যাপারে জোরালোভাবে একমত। এই বিষয়ে এমন সর্বসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি আদিবাসী জনগণ এবং প্রথম ভোটার হওয়া লোকজনসহ সব অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান। আদিবাসী জনগণ এবং প্রথম ভোটার হলো জনেগণের এমন দুটি অংশ যারা সাধারণত কম সংখ্যায় ভোট দিতে যায়।

কার্যত সবাই ভোট দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য মনে করলেও এক-তৃতীয়াংশের সামান্য কিছু বেশি সংখ্যক মানুষ বলেন, তাদের ভোট দেওয়া না দেওয়ায় তেমন কিছুই যায় আসে না। আবার এক-চতুর্থাংশ কানাডীয় বলেন, জেনেশুনে ভোট দেওয়ার মত যথেষ্ট তথ্য তাদের কাছে নেই। এধরণের কথা বলেছেন নব্য ভোটারদের ৫৬ শতাংশ।

সহিষ্ণুতা ও অভিবাসন সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি

জরিপে কানাডীয়দের পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসার ওটাই একমাত্র উদাহরণ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনও ছিলো আরেকটি দৃষ্টান্ত: প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ এটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয় বলে মনে করেন, অন্যদিকে জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের অর্ধেকই জলবায়ু পরিবর্তন রোধের জন্য বছরে ১০০ ডলারের বেশি কর হিসাবে দিতে রাজি নন।

জরিপে দেখা গেছে, কানাডীয়রা বৈচিত্র ও অভিবাসন নিয়েও দ্বান্দ্বিক অবস্থানে রয়েছে।

একদিকে ৭৭ শতাংশ মানুষ বলছেন, “কানাডা অত্যন্ত সহিষ্ণু একটি দেশ বলে তারা গর্ব বোধ করেন এবং ৮৫ শতাংশ মানুষ বলেন, আমরা LGBTQ -ফ্রেন্ডলি। নব্য কানাডীয়রা বিশেষ করে এদেশের সহিষ্ণুতা নিয়ে গর্ব করেন (৮৬ শতাংশ) যদিও তারা এলজিবিটিকিউদের ক্ষেত্রে অনেকটাই কম সহিষ্ণু বলে জানান (৬৪শতাংশ)।

অন্যদিকে, ৬৫ ভাগ মানুষ বলছেন যে, “আমরা প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর মানুষকে সমাজে জায়গা করে দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি উদার” এই বক্তব্যের সঙ্গে তারা একমত। আলবার্টা ও কুইবেকে এই মনোভাব সবচেয়ে জোরালো।

এই বিবৃতির বিষয়ে মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার মধ্যে গুরুতর বিভেদ আছে, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মাত্র ৪০ শতাংশ ওই ভাষ্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। সেই তুলনায় ৪৫ বছর বয়সীদের ৭৩ শতাংশ একমত বলে জানান।

৫৬ শতাংশ কানাডীয় বলেন, খুব বেশি সংখ্যক অভিবাসী গ্রহণ কানাডাকে পাল্টে দেবে” বলে তারা উদ্বিগ্ন। নব্য কানাডীয়দের মাত্র অর্ধেকের কম সংখ্যক (৪৭ শতাংশ) ওই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।

এর পরও, সিবিসি নিউজের জরিপ থেকে বোঝা যায়, অভিবাসনের ব্যাপারে এক ধরণের উদারতাও আছে। ৭৬ শতাংশ বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন যে, দক্ষ শ্রমিকদের কানাডায় আসতে উৎসাহী করতে আরও অনেক কিছু করার আছে। আর ৬০ শতাংশ মানুষ যখন বলছেন যে, অভিবাসীদের জাতিগত পরিচয় কি সেটি নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই তখন মাত্র ২৪ শতাংশ বলেছেন, অভিবাসী হিসাবে খুব বেশি সংখ্যক দৃশ্যমান সংখ্যালঘু (অশ্বেতাঙ্গ) এদেশে আসছে। (অন্য কানাডীয়দের মত অশ্বেতাঙ্গ কানাডীয়রাও এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হবেন বলে মনে হয়।)

সার্বিকভাবে কানাডীয়রা অভিবাসনকে কিভাবে দেখছে সেই বিবেচনার উর্ধ্বে থেকেই পাঁচভাগের চারভাগ নব্য কানাডীয় বলেন, তারা নিজেদেরকে এদেশের সম্মানিত অংশ হিসাবে অনুভব করেন।

আদিবাসী কানাডীয়রা অসম্মানিত বোধ করেন

কিন্তু আদিবাসী কানাডীয়দের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন নয়: জরিপে অংশ নেওয়া তাদের দুই-তৃতীয়াংশই জানান, তারা দেশের সম্মানিত অংশ বলে অনুভব করেন না অথবা সরকার তাদের কমিউনিটিকে বা তাদের পরিচয়কে সম্মান করে বলেও তারা বোধ করেন না।

জরিপে আদিবাসী কানাডীয়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভ্রান্ততা দেখা যায়। তাদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ বলেছেন, তাদের জন্য এদেশের আরও অনেক কিছু করার আছে (এই মত খুব জোরালোভাবে তুলে ধরেন ৫৯ শতাংশ আদিবাসী)।

প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নিয়ে বিদ্যমান অসন্তোষেরও মাত্রাগত প্রভেদ আছে। ৫২ শতাংশ কানাডীয় যেখানে বলছেন যে, আদিবাসীদের কল্যাণ ও অবস্থার পরিবর্তনে ট্রুডো খুব ভালো করছেন না বা মোটেই ভালো কিছু করছেন না, তখন আদিবাসী জনগণের নিজেদের মধ্যে এই মনোভাব পোষণকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯ শতাংশ।

সার্বিকভাবে কানাডীয় জনগণের চেয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকেদের একথা বলার সম্ভাবনা বেশি যে, দেশ ভুল পথে এগুচ্ছে (৫৬ শতাংশের বিপরীতে ৬২ শতাংশ), তারা অর্থনৈতিকভাবে তেমন সুফল পাচ্ছেন না (১৩ শতাংশের বিপরীতে ২২ শতাংশ) অথবা সরকার যথাযোগ্য কাজ করবে বলে তারা বিশ্বাস করেন না (৬০ শতাংশ থেকে ৫৩ শতাংশ)।