অভিবাসীদের বসবাসের জন্য সেরা দেশ কানাডা
বিশ্বে অভিবাসীদের প্রতি সবচেয়ে বেশী ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে কানাডিয়ানদের : নতুন অভিবাসীদেরকে তারা বোঝা মনে না করে একটা শক্তি হিসাবে বিবেচনা করেন
এপ্রিল ৮, ২০১৯
প্রবাসী কণ্ঠ : বর্তমান বিশ্বে বর্ণবাদ, ধর্মবিদ্বেষ আর জাতিবিদ্বেষ এক মহা দানব আকারে আভির্ভূত হয়েছে। আর এই দানবের তান্ডব দিন দিন আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশসমূহে। বিশেষত যে সকল দেশগুলোতে অভিবাসীদের অবস্থান রয়েছে বিপুল সংখ্যায়।
গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইসচার্চ শহরে অবস্থিত দুটি মসজিদে জুম্মার নামাজ এর সময় এক সন্ত্রাসীর অতর্কিত বন্দুক হামলায় ৫০ জন নিরীহ মুসল্ল্লীর নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই কথাই যেন আরো একবার প্রমাণিত হয়ে গেল।
এই নৃশংস হত্যাকান্ডে হতবাক হয়ে যায় সরা বিশ্ব। হামলার অভিযোগে পুলিশ যাকে গ্রেফতার করেছে তিনি একজন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ তিনি অশ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিদেরকে ঘৃণা করেন। তিনি তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে ঘৃণা করেন, তাদের গাত্রবর্ণকে ঘৃণা করেন, তাদের এথনিসিটিকে ঘৃণা করেন। আর ঘৃণাবোধ থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ শাসিত দেশে এই অশ্বেতাঙ্গদের স্থান নেই। তারা শ্বেতাঙ্গ শাসিত দেশে বসবাসের অযোগ্য। সুতরাং তাদেরকে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে। আর এই জন্যই তিনি হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতে চেয়েছেন যাতে অশ্বেতাঙ্গরা ভয় পেয়ে শ্বেতাঙ্গদের দেশ ছেড়ে চলে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে অভিবাসী বিরোধী একটি সেন্টিমেন্ট বা অনুভূতি বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। আর এর পিছনে ইন্ধন যোগাচ্ছে ডানপন্থী রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন হোয়াইট সুপ্রিমেসী গ্র“প বা সংগঠনগুলো। এবং এদের ভাবগুরু বা দীক্ষাগুরু হিসাবে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইসচার্চ শহরে নৃশংস হত্যাকান্ডের নায়ক নিজেই বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আদর্শ। কানাডার কুইবেক সিটিতে মসজিদে বন্দুক হামলা চালিয়ে ৬ জন মল্ল্ল্লিকে হত্যা করেছিলেন যে যুবক তিনিও বলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আদর্শগুরু।
ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর ১৬ মে ক্যালিফোর্নিয়ার আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য বক্তব্য দেয়ার সময় প্রকাশ্যেই বলেছেন, কিছু অবৈধ অভিবাসী মানুষ নয়, এরা জানোয়ার। আমেরিকায় এর আগে দেখা যায়নি, এমনভাবেই এদের বিতাড়ন করা হবে।
অভিবাসীদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন নগ্ন বক্তব্য আগেও দিয়েছেন। এবার সরাসরি অমানুষ আর জানোয়ার হিসেবে উল্ল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর মনোভাবের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। আর তার এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন লোকজনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের রক্ষণশীলরাও। ফলে সেসব দেশে অভিবাসীদের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক এবং উদ্বেগ নিয়তই কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু কানাডার পরিস্থিতি পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের তুলনায় বহুগুনে ভাল। এখানে সরকারের দায়িত্বশীল পদে থেকে কেউ অভিবাসীদেরকে জানোয়ার বলবেন এ কথা কল্পনাও করা যায় না। এমনকি রক্ষণশীল দলের সদস্য বা সমর্থকগণও এমন কথা প্রকাশ্যে বলার মত ধৃষ্টতা রাখেন না। বরং কানাডায় অভিবাসীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে অধিকাংশের।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘U.S. News & World Report’ এর এক জরীপেও দেখা গেছে ২০১৮ সালে কানাডা অভিবাসীদের জন্য সেরা দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে আছে সুইজারল্যান্ড এবং তৃতীয় স্থানে সুইডেন। ২০১৭ সালে কানাডার অবস্থান ছিল দ্বিতীয় স্থানে।
শুধু ইউএস নিউজ এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট নয়, এর প্রতিফলন দেখা যায় ওয়াশিংটন ভিত্তিক পিউ রিসার্স সেন্টারের এক সমীক্ষায়ও। ওতে বলা হয় বিশ্বের প্রথম সারির দশটি দেশের মধ্যে অভিবাসীদের প্রতি সবচেয়ে বেশী ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে কানাডিয়ানদের। নতুন অভিবাসীদেরকে তারা বোঝা মনে না করে একটা শক্তি হিসাবে বিবেচনা করেন।
অভিবাসীদের বসবাসের জন্য সেরা দেশ হিসাবে কানাডা বিবেচিত হওয়ার অন্যতম কারণ এগুলো। কারণ আরো আছে।
পিউ রিসার্স সেন্টার এর অনুসন্ধান থেকে আরো জানা যায়, অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি বা সন্ত্রাস বৃদ্ধির জন্য অভিবাসীদেরকে দায়ী করার প্রবনতা অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় কানাডিয়ান নাগরিকদের মধ্যে অনেক কম। পিউ রিসার্স সেন্টার এই তথ্য সংগ্রহের জন্য ১৮ দেশের উপর জরীপ চালায়। আর বিশ্বের প্রায় অর্ধেক অভিবাসী বাস করেন এই ১৮ দেশে। গত গত ১৪ মার্চ টরন্টো স্টার পত্রিকায় এই সংবাদটি ছাপা হয়।
উল্ল্লেখ্য যে, কানাডায় অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধিতে অভিবাসীরা দায়ী নন, বরং অপরাধের মাত্রা হ্রাসে তাদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ইতিপূর্বে স্যাটিসটিকস কানাডার এক জরীপে বলা হয়েছে টরন্টো, মন্ট্রিয়ল প্রভৃতি বড় বড় শহরে সাম্প্রতিককালে আসা অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ভয়ঙ্করসব অপরাধের মাত্রা হ্রাস পেয়েছে। এই অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রকৃতপক্ষে একধরণের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করেছে অপরাধ কমানোর ক্ষেত্রে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রন লেভি বলেন, অভিবাসীদের সম্পর্কে আগের দিনে যে একপেশে ভাবনা ছিল, অর্থাৎ অভিবাসীরাই সব নষ্টের মূলে, সে ভাবনা থেকে আজ আমরা মুক্তি পাবার পথ খুঁজে পেয়েছি। এটি সত্যি উৎসাহব্যঞ্জক একটি ব্যাপার।
অভিবাসীরা দেশের জন্য মঙ্গলময় সংযোজন এ ধারণায় যারা বিশ্বাসী তাদের মধ্যে কানাডিয়ানদের অবস্থান শীর্ষে। এ কথা বলেন টরন্টো ইউনিভার্সিটির Ethnic, immigration and pluralism studies এর পরিচালক জেফরি রিটজ্। তিনি অবশ্য উপরে উল্লেখিত পিউ রিসার্সের ঐ তথ্য অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত নন।
জেফরি রিটজ্ আরো বলেন, অন্যান্য দেশের মত কানাডা অভিবাসী বিষয়ে তেমন বিভক্ত নয়। এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোও অভিবাসীদের দলে টানার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। এমনকি রক্ষনশীল দলও। দেখা গেছে অন্যদেশের বামপন্থী দলগুলো অভিবাসন বিষয়ে যতটা ইতিবাচক, তারচেয়ে অনেক বেশী ইতিবাচক কানাডার রক্ষণশীল ডানপন্থী দল।
পিউ রিসার্স সেন্টার এর জরীপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৬৮ কানাডিয়ান বলেছেন, অভিবাসীগণ দেশকে শক্তিশালী করে তোলার পিছনে ভূমিকা রাখছেন। তবে শতকরা ২৭ জন মনে করেন নতুন অভিবাসীগণ দেশটির জন্য বোঝা। কারণ তারা কানাডিয়ানদের চাকরী দখল করে নিচ্ছেন এবং তাদের অনেকেই সরকারের ভাতা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন।
অভিবাসীদের প্রতি জোরালো ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন দেশের তালিকায় কানাডার পরেই রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। পিউ রিসার্সের জরীপে সেদেশের শতকরা ৬৪ জন নাগরিক অভিবাসীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এর পরের অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্য ও সুইডেন। এই উভয় দেশের শতকরা ৬২ জন নাগরিক মনে করেন অভিবাসীগণ দেশের জন্য মঙ্গলজনক। জাপানে এই হার শতকরা ৫৯ জন।
কিন্তু জরীপে দেখা গেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬টি দেশে অভিবাসীদের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব কমে এসেছে। মূলত ২০১৪ সালের পর থেকে ইউরোপে উদ্বাস্তু আগমনের
সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গ্রীস, জার্মানী ও ইটালীতে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অভিবাসীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
তবে অধিকাংশ দেশেই দেখা গেছে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের চেয়ে অভিবাসীদের প্রতি বেশী ইতিবাচক। পিউ রিসার্সের ২৪ পাতার গবেষণা রিপোর্টে এই কথা বলা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে আরো দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে যারা উচ্চ শিক্ষত, যাদের বয়স অল্প এবং যাদের আয় বেশী তাদের মধ্যে অভিবাসীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বেশী। তারা মনে করেন অভিবাসীগণ তাদের মেধা ও শ্রম দিয়ে দেশকে শক্তিশালী করছেন।
কানাডায় উদার ও রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের মধ্যে অভিবাসীদের প্রতি জোরালো সমর্থনই লক্ষ্য করা গেছে। যারা উদারপন্থী রাজনৈতিক দলের সমর্থক তাদের মধ্যে অভিবাসীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে শতকরা ৮১ জনের। আর যারা রক্ষণশীল দলের সমর্থক তাদের মধ্যেও শতকরা ৬৫ জন নতুন অভিবাসীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।
পিউ রিসার্সের জরীপে দেখা গেছে জাপান, মেক্সিকো, সাউথ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং সুইডেন এর নাগরিকেরা মনে করেন অভিবাসীরা তাদের সমাজের সঙ্গে একীভূত হতে ইচ্ছুক। তবে হাঙ্গেরী, রাশিয়া, গ্রীস, ইটালী, জার্মানী, পোল্যান্ড, ইসরয়েল এবং অস্ট্রেলিয়ার জনগণ মনে করেন অভিবাসীরা তাদের সমাজে একীভূত হতে ইচ্ছুক নন। কানাডার নাগরিকেরা এ বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত।
তবে সিংহভাগ ইউরোপিয়ান নাগরিকেরা মনে করেন অভিবাসীদের উপস্থিতির কারণে সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে। জরীপে দেখা গেছে ইউরোপের ১১টি দেশের মধ্যে ৭টি দেশের নাগরিকেরাই মনে করেন অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি পেতে পারে।
কানাডার চিত্র একটু ভিন্ন। এখানে শতকরা ৮০ জন নাগরিক মনে করেন অপরাধ বৃদ্ধির জন্য অভিবাসীদেরকে দায়ী করা যাবেনা। আর শতকরা ৬৫ জন নাগরিক মনে করেন অভিবাসীরা সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধির জন্য ঝুঁকি নয়। তবে এর বিপরীত মত প্রকাশ করেন যথাক্রমে শতকরা ১৭ জন ও ৩৫ জন।
কানাডায় দেখা গেছে অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় জঙ্গী সন্ত্রাসীদের হামলা অনেক কম হয়েছে। সে দিক বিবেচনায়ও কানাডা অভিবাসীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে আছে। তবে ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি কুইবেক সিটিতে এক শ্বেতসন্ত্রাসীর হামলায় ৬ জন মুসল্লি নিহত হন। অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে ইসলামী জঙ্গীদের হাতেও নিহত হন সেনাবাহিনীর দুইজন সদস্য। ড্যানফোর্থে নিহত হন এক মহিলা। তবে এর পরও কানাডা সর্বোচ্চ নিরাপদ দেশগুলোর একটি হিসাবেই বিবেচিত হয়।
উল্ল্লেখ্য যে, গোটা পাশ্চাত্যভূমে অভিবাসী বিরোধী মনোভাব তরঙ্গায়িত হতে হতে এখন জলোচ্ছাসে রূপ নিয়েছে কোন কোন দেশে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কানাডায় এই তরঙ্গের আঘাত এখনো এসে লাগেনি। কারণ, Environics Institute এর এক সমীক্ষায় ইতিপূর্বে দেখা গেছে প্রতি ১০ জন কানাডিয়ানের মধ্যে ৮ জন মনে করেন দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অভিবাসীদের প্রয়োজন রয়েছে। তারা আরো মনে করেন, কানাডায় অভিবাসীদের সংখ্যা এখনো খুব বেশী নয়। তবে কেউ কেউ মনে করেন অভিবাসীদের প্রবেশের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখলে অপরাধীদের প্রবেশের সুযোগ কম থাকে।
অভিবাসীদের সম্পর্কে কানাডিয়ানদের এই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে যখন দেশটিতে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী প্রবেশ করেছেন এবং যাদের মধ্যে রয়েছে ৩২ হাজারেরও বেশী সিরিয়ান উদ্বাস্তু। ঐ সময় Environics Institute এর নির্বাহী পরিচালক কিথ নিউম্যান বলেছিলেন, অভিবাসীদের সম্পর্কে কানাডিয়ানদের এই ইতিবাচক মনোভাব গত ১৫ মাসে একই রয়েছে অথবা কিছুটা উন্নত হয়েছে। এই জরীপটি যৌথভাবে চালায় Environics Institute এবং Canadian Race Relations Foundation। খবর Globe and Mail এর।
উল্ল্লেখ্য যে, পাশ্চাত্য বিশ্বে জেনোফোবিয়া (ীবহড়ঢ়যড়নরধ) বা বিদেশীদের সম্বন্ধে অহেতুক ভয়ের একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে সাম্প্রতিক বছর গুলোতে। কিন্তু কানাডার পরিস্থিতি কি? এখানেও কি ঐ জেনাফোবিয়ায় ভুগছেন লোকজন? জরীপ পরিচালনাকারীদের অভিমত- না, এখানে জেনোফোবিয়া এখনো গড়ে উঠেনি।
কানাডায় ৭৫% অধিবাসী মনে করেন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভিবাসীদের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। টরন্টোতে এই মতের সমর্থকদের সংখ্যা বেশী এবং যারা উচ্চ শিক্ষিত (ইউনিভার্সিটি ডিগ্রিধারী) তারাও এই মতের পক্ষে।
জরীপে আরো বলা হয়, অধিকাংশ কানাডিয়ান আগামীতেও এই বিশ্বাস ধরে রাখবেন যে, কানাডার অর্থনৈতিক উন্নয়নে অভিবাসীদের ভূমিকা ইতিবাচক। তারা আরো বিশ্বাস করেন যে কানাডা কর্তৃপক্ষ উদ্বাস্তুদের নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য রাখে এবং একই সাথে সম্ভাব্য অপরাধীদেরকেও।
উল্ল্লেখ্য যে, কানাডায় অভিবাসীর সংখ্যা গত প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সর্বশেষ হিসাব (২০১৬) অনুযায়ী দেখা যায় বর্তমানে কানাডার মোট জনসংখ্যার ২১.৯%-ই অভিবাসী। এই অভিবাসীদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। বাকীদের নাগরিকত্ব লাভের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। খবর সিবিসি নিউজের।
স্ট্যাটিসটিকস কানাডার হিসাবে দেখা যায়, ১৯২১ সালে কানাডার মোট জনসংখ্যার মধ্যে অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল ২২.৩%। ২০০৬ সালে সংখ্যা ছিল ১৯.৮%।
নতুন অভিবাসীদের মধ্যে ৬০% এর বেশী এসেছে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। আফ্রিকার অবস্থান এর পরে। ইউরোপ থেকে এগিয়ে আছে আফ্রিকা। এর একটি কারণ, কুইবেক প্রভিন্স ফ্রেন্স ভাষার লোকদেরকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে বেশী। অতীতে আফ্রিকার যে সকল দেশে ফ্রেঞ্চ কলোনী ছিল ঐ সকল দেশের লোকজন এখনো ফেঞ্চ ভাষায় দক্ষ। আফ্রিকা থেকে আসা নতুন অভিবাসীদের অর্ধেকই কুইবেকে বসতি স্থাপন করেছে।
স্টাটিসটিকস কানাডার হিসাবে (২০১৬) দেখা যায় ৭.৭ মিলিয়ন কানাডিয়ান দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তভূক্ত। শতকরা হিসাবে কানাডার মোট জনসংখ্যার ২২.৩%। ১৯৮১ সালের তুলনায় এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৭%। ধারণা করা হচ্ছে ২০৩৬ সালের মধ্যে কানাডার এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা হবে দৃশ্যমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।
অভিবাসীদের বসবাসের জন্য কানাডা সেরা দেশ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার পিছনে আরো কয়েকটি কারণ রয়েছে। উপরে বর্ণিত তথ্য ও সমীক্ষা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে অভিবাসীদের প্রতি সিংহভাগ কানাডিয়ানদের মনোভাব ইতিবাচক। অভিবাসীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যাদের আছে তাদের সংখ্যা অনেক কম। সুতরাং এই দেশটিকে ভালবাসার যথেষ্ট কারণ রয়েছে অভিবাসীদের।
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও কানাডার মাল্টিকালচারালইজম, বিশ্ব মানের চিকিৎসা ব্যবস্থা, বিশ্ব মানের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশ্ব মানের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, জনগণের জানমালের যথেষ্ট নিরাপত্তা, শক্তিশালী অর্থনীতি, অভিবাসীদের গ্রহণে কানাডিয়ানদের আন্তরিকতা, স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশসহ আরো কিছু বিষয় রয়েছে যার কারণে অভিবাসীরা পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাসের জন্য কানাডাকে সেরা দেশ হিসাবে বিবেচনা করেন।
কানাডার মাল্টিকালচারালইজম
কানাডার রাজনীতিকগণ গত চার দশক ধরে অভিবাসনকে সমর্থন দিয়ে আসছেন যা কানাডার ডেমোগ্রাফিক অবয়বকে দিয়েছে নতুন রূপ। কানাডাকে দিয়েছে মাল্টিকালচারাল সোসাইটির পরিচয়।
কানাডা একটি মাল্টিকালচারের দেশ। এটি শুধু কথার কথা নয়। রাষ্ট্রিয়ভাবেই গত চার দশকেরও বেশী সময় ধরে এটি স্বীকৃত হয়ে আসছে কানাডায়। ১৯৭০ দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো উদ্যোগে রাষ্ট্রিয়ভাবে গৃহীত হয় এই পলিসি। বলা হয়ে থাকে যে, “Multiculturalism in Canada is the sense of an equal celebration of racial, religious and cultural backgrounds ”।
আমরা জানি বিশ্বে কানাডাই প্রথম দেশ যেখানে মাল্টিকালচারালইজমকে রাষ্ট্রিয় নীতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা আসে ১৯৭১ সালে। পরে ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে ২৭ জুনকে কানাডার মাল্টিকালচারালইজম দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে প্রতি বছর এই দিনটি মাল্টিকালচারালইজম দিবস হিসাবে পালন হয়ে আসছে।
কানাডা পৃথিবীর অন্যতম শান্তির দেশ
কানাডা পৃথিবীর অন্যতম শান্তির দেশ হিসাবেও বিবেচিত হয়। ইতিপূর্বের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রথম দশটি শান্তির দেশের তালিকায় কানাডার অবস্থান অষ্টম। গ্লোবাল পিস ইন্ডেক্স সম্প্রতি এই রিপোর্টটি (২০১৬) প্রকাশ করে। তাদের রিপোর্টে আরো দেখা যায় কানাডা ইউরোপের বাইরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে শান্তি ও নিরাপত্তার বিচারে। আর উত্তর আমেরিকায় কানাডার অবস্থান সর্বোচ্চ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুদূর পিছিয়ে আছে কানাডার তুলনায়।
কানাডায় অভিবাসীদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক কম
অভিবাসী ও কানাডায় জন্মগ্রহণকারী শ্রমিকদের মধ্যে কর্মসংস্থানের ব্যবধান কমে আসছে। নিয়োগদাতারা নবাগতদের ওপর ক্রমবর্ধমান হারে আস্থা রাখার কারণে এমনটা ঘটছে। স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার নতুন এক গবেষণা থেকে এই তথ্য জানা যায়। খবর সিবিসি নিউজের।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা তার শ্রমশক্তি বিষয়ক সমীক্ষার মাধ্যমে নবাগতদের কর্মসংস্থানের ওপর লক্ষ্য রাখতে শুরু করে ২০০৬ সালে। এরপর কর্মে নিয়োজিত হওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত বয়সের অভিবাসীদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম ছিলো ২০১৭ সালে ৬.৪ শতাংশ।
অনেকেই কানাডায় আসার প্রথম কয়েক বছরে তীব্র জীবন-সংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরেন, কিন্তু তথ্য-উপাত্ত থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, তারা শেষ পর্যন্ত কোনও না কোনও কাজ খুঁজে পান যদিও সেটা তাদের প্রত্যাশিত কর্মক্ষেত্রে হয়তো নয়।
নবাগতরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গৃহায়ন ও খাদ্য শিল্পে কম বেতনের কাজ পান তবে শ্রমশক্তির এক-তৃতীয়াংশ কিন্তু ঠিকই বেশি বেতন পাওয়া যায় এমন শিল্পে চাকরি পান যেমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা, রিয়েল এস্টেট, রেন্টাল ও লিজিং কোম্পানি এবং সেইসঙ্গে বিভিন্ন পেশাদারী প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক খাত ইত্যাদি।
অভিবাসীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতের হার কানাডিয়ানদের চেয়ে বেশী
নতুন আসা অভিবাসীরা শুধু যে নিজেরাই উচ্চ শিক্ষিত তাই নয়, তারা এ দেশে আসার পর তাদের ছেলে-মেয়েদেরকেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন। আর এ কারণেই
অভিবাসীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষার হার
মূলধারার কানাডিয়ানদের তুলনায় বেশী। সম্প্রতি সরকারের এক অভ্যন্তরীন অনুসন্ধানে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। খবর টরস্টার নিউজের।
ঐ অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে অভিবাসী পরিবারের ৩৬% ছেলে-মেয়ের (যাদের বয়স ২৫-৩৫ এর মধ্যে) ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি রয়েছে। আর এই একই বয়সের মূলধারার কানাডিয়ান ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি রয়েছে ২৪% জনের।
কানাডায় রয়েছে বিশ্ব সেরা বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে উল্ল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাক্গিল বিশ্ববিদ্যালয়, ম্যাক্মাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
যে সকল পরিবারে পিতা-মাতা উচ্চ শিক্ষিত হয়, সে সকল পরিবারের সন্তানেরাও সাধারণভাবে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে থাকে। কানাডায় অভিবাসী পরিবারেও তাই দেখা গেছে। এখানকার নতুন অভিবাসী পরিবারের পিতা-মাতাদের মধ্যে মূলধারার কানাডিয়ান পরিবারের পিতা-মাতার তুলনায় উচ্চ শিক্ষিতের হার বেশী।
অন্য এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে আসা ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী অভিবাসীদের মধ্যে শতকরা ৫৪.২ জনের ব্যাচলর ডিগ্রি রয়েছ। ১৯৯০ এর দশকে এই হার ছিল শতকরা ৩০.৫ ভাগ।
অভিবাসীদের মধ্যে যেখানে শতকরা ৫৪.২ জন এর ব্যাচেলর ডিগ্রি রয়েছে, সেখানে মূলধারার কানাডিয়ানদের মধ্যে এই হার শতকরা ২৭.৯ ভাগ। এই অনুসন্ধানটি চালান এসোসিয়েশন অব কানাডিয়ারন স্টাডিজ এর গবেষক জ্যাক জেকব। পেশায় তিনি কনকর্ডিয়া ইউনিভার্সিটির স্যোশলজি এ্যান্ড পাবলিক এ্যাফেয়ার্স এর অধ্যাপক।
কানাডার প্রতি একাত্মতার শক্তিশালী অনুভূতি রয়েছে ব্যাপক সংখ্যক অভিবাসীর
ইতিপূর্বে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিক্স কানাডার গবেষণা পত্রে দেখা গেছে কানাডায় যারা ১৯৮০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রবেশ করেছেন তাদের মধ্যে শতকরা ৯৩ ভাগেরই কানাডার প্রতি খুবই শক্তিশালী বা শক্তিশালী অনুভূতি রয়েছে।
এটি নিছক একটি জরীপ তথ্য নয়। এটি গবেষণা পত্র। ১৮২ টি দেশ থেকে আসা ৭০০৩ জন অভিবাসীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য পরীক্ষা করে এই বিষয়টি জানা গেছে।
এই ৯৩% এর মধ্যে দেখা গেছে ৬৯% অভিবাসীর খুবই শক্তিশালী অনুভূতি রয়েছে কানাডা এবং একই সাথে তারা যে দেশ থেকে এসেছেন সেই দেশের প্রতি। আর মাত্র ২৪% অভিবাসীর খুবই শক্তিশালী অনুভূতি রয়েছে শুধু কানাডার জন্য।
কানাডায় রয়েছে বিনামূল্যে বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা
অভিবাসীদের কাছে কানাডার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হওয়ার আরেকটি কারণ এখানকার বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা বিনামূল্যেই গ্রহণ করতে পারেন সবাই। হাসপাতাল, ক্লিনিক, ফ্যামিলি চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, প্যাথলজী এগুলোর সেবা বিনামূল্যেই পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে কানাডা হেলথ কেয়ার খাতে প্রতিজনের পিছু গড়ে ৬,৩২৩ ডলার ব্যয় করেছে। কানাডায় বসবাসকারীদের গড় আয়ু ৮২.৩০ বছর যা যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে মানুষদের চেয়েও বেশী। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের গড় আয়ু যথাক্রমে ৮০.৯৬ এবং ৭৮.৬৯ বছর।
এ সব মিলিয়েই অভিবাসীদের বসবাসের জন্য বিশ্বে সেরা দেশ এখন কানাডা।