অভিবাসন নিয়ে কানাডিয়ানদের মধ্যে উদ্বেগ

কানাডিয়ানদের মনে যে ভীতিনির্ভর অনুমান রয়েছে তার পেছনে বিশ্বজুড়ে চরম ডানপন্থী উত্থানের সম্পর্ক থাকতে পারে

মার্চ 3, 2019

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ইপসস-এর এক নতুন জরিপে দেখা গেছে, অভিবাসন নিয়ে কানাডীয়দের মধ্যে উদ্বেগ ২০১৭ সালে যে পর্যায়ে ছিলো ২০১৮ সালে তা আরও জোরালো হয়ে ওঠে। তবে কানাডীয়রা যেটা বিশ্বাস করছে তার কিছু কিছু হয়ত বাস্তব তথ্য-প্রমাণভিত্তিক নয়।

বিশেষভাবে গ্লোবাল নিউজ এর জন্য সম্পাদিত এই জরিপে দেখা গেছে, ৫৪ শতাংশ মানুষ বলেছেন যে, এই মুহূর্তে কানাডা অভিবাসীদের স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত উদার।

ইপসস-এর সিইও ড্যারেল ব্রিকার বলেন, বর্তমানে অভিবাসীরা যে প্রক্রিয়ায় কানাডায় ঢুকছে সেই প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কানাডীয়রা অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়।

ব্রিকার বলেন, “বর্তমান কানাডায় অভিবাসীদের বিষয়ে মানুষের যতটা না মনোযোগ তার চেয়েও বেশি মনোযোগ অভিবাসন প্রক্রিয়ার প্রতি।”

তিনি বলেন, “অভিবাসনের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে যে নেতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনিয়মিতভাবে কানাডায় প্রবেশ করা আশ্রয়প্রার্থীদের বিপুল ¯্রােত। ২০১৭ সালে শুরু হবার পর থেকে ৩৬ হাজারেরও বেশি আশ্রয়প্রার্থী কানাডায় এসেছে। কেন্দ্রীয় রক্ষণশীল দলীয় রাজনীতিকরা এটিকে একটি ‘সঙ্কট’ হিসাবে অভিহিত করে জাস্টিন ট্রুডোর সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।”

কানাডার কনফারেন্স বোর্ডের এক সমীক্ষায় বলা হয়, অভিবাসনের পরিমাণ কমানো হলে তা ২০৪০ সালের মধ্যে দেশটির অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। ছবি : গ্লোবাল নিউজ

আর ওই সংখ্যাটা যখন নিয়মিত সীমান্ত পেরিয়ে আসা লোকেদের সঙ্গে যোগ হয় তখন দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ এভাবে কানাডায় ঢুকেছে। ওই বছরেই কানাডায় উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ছিলো ৫০,৪৬৯ জন। অর্থাৎ উদ্বাস্তু হিসাবে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে কানাডায় এসেছে।

এর আগেও কানাডা একই ধরণের পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে। যেমন, ২০০১ সালে ৪৪,৬৪০ জন উদ্বাস্তুর মর্যাদা চেয়ে আবেদন করে।

জরিপে অন্য যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, দ্য গ্রেট হোয়াইট নর্থ অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলের শ্বেতাঙ্গপ্রধান অঞ্চল নবাগতদের স্বাগত জানানোর ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়। গত জুলাইতে দি গ্লোব এ্যান্ড মেইল প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, আগের সরকারের চেয়ে ট্রুডোর সরকারের সময় ওই অঞ্চল সফরের ভিসার আবেদন অনেক বেশি সংখ্যায় নাকচ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালে যেখানে এধরণের ভিসার মোট ১০ লাখ আবেদনের মধ্যে ১৮ শতাংশ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিলো সেখানে ২০১৬ সালে ২০ লাখ আবেদনের বিপরীতে প্রত্যাখ্যান করা হয় ২৬ শতাংশ আবেদন। এদিকে ২০১৮ সালের শুধু প্রথম তিন মাসেই নাকচ করে দেওয়া হয় মোট ভিসা আবেদনের ৩০ শতাংশ।

ব্রিকার বলেন, কানাডীয়রা মনে হয় বিশ্বের অন্যান্য স্থানে জেগে ওঠা অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের শিকারে পরিণত হচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। কিন্তু পূর্ব-ইউরোপের কিছু দেশে যেভাবে দেখা হচ্ছে বাস্তবে সমস্যাটি সেই পর্যায়ের ধারেকাছেও নেই।

ব্রিকার বলেন, “আমি মনে করি না যে, বিশ্বের অন্যত্র আমরা যেমনটা দেখতে পাচ্ছি তা থেকে কানাডা মুক্ত রয়েছে। সুতরাং, হ্যাঁ, হতে পারে যে কেউ একটা ম্যাচর কাঠি ছুড়ে দিলো এবং বিষয়টি জলন্ত ইস্যুতে পরিণত হলো। আমরা যেহেতু বিষয়টিকে একটি বিশ্বজনীন ইস্যু হিসাবে দেখি, কানাডায় জনমনের উদ্বেগ ফ্রান্স বা জার্মানিতে যেমনটা আছে তেমন নয়।”

জরিপে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ কানাডীয় মনে করে যে, অভিবাসীদের ব্যাপকভাবে আগমনের ফলে কানাডীয় নাগরিকদের জন্য চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তার পরও কানাডায় বেশিরভাগ অভিবাসন হচ্ছে মূলত শ্রমিক ঘাটতি পূরণ করতে যেটা কানাডার জনবল পূরণ করতে সক্ষম নয়।

কানাডার বেকারত্বের হার ২০১০ সালের ৮.৫ শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে; শুধু তা-ই নয়, বরং গত মে মাসে প্রকাশিত কানাডার কনফারেন্স বোর্ডের এক সমীক্ষায় দাবি করা হয় যে, অভিবাসনের পরিমাণ কমানো হলে তা আসলে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশটির অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।

রিপোর্টে বলা হয়, তরুণ এবং কর্মক্ষম অভিবাসীদের নিয়ে আসার কারণে কানাডার বয়োবৃদ্ধ জনগণের বিষয়টিরও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে।

রিপোর্টে বলা হয় যে, অভিবাসন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হলে কানাডায় ২০৪০ সালের মধ্যে ২৬.৯ শতাংশ মানুষ হবে ৬৫ বছর বা তার চেয়েও বেশি বয়সী। সেই সঙ্গে গ্লোবাল নিউজ এর আগে রিপোর্ট করেছিলো যে, অভিবাসন বন্ধ করা হলে কানাডার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.৯ শতাংশ থেকে ১.৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে।

ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ইন্টারগ্র“প রিলেশন্স সম্পর্কিত অ্যাসেস ল্যাব-এর প্রধান ভিক্টোরিয়া আ্যাসেস ওই সময় এক সাক্ষাৎকারে গ্লোবাল নিউজ -কে বলেন যে, কনফারেন্স বোর্ড অব কানাডার রিপোর্টের সঙ্গে তিনি একমত।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “অভিবাসন না হলে আমাদের শ্রমশক্তি সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। অভিবাসীরা আমাদের শ্রমশক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে কারণ তারা একেবারেই তরুণ বয়সে এখানে আসছে আর তাদের জীবনের অনেক দীর্ঘ সময় সামনে থেকে যাচ্ছে কাজ করার জন্য।”

ইপসস জরিপে আরও দেখা গেছে যে, এতে অংশ গ্রহণকারীদের অর্ধেকেরও বেশি বলেছেন যে, উচ্চতর শিক্ষা ও যোগ্যতাসম্পন্ন অভিবাসীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কানাডা সরকার অভিবাসীদের এদেশে আসার অনুমোদন দেওয়ার সময় তাদের শিক্ষা ও পেশাদারি অবস্থান বিবেচনা করেই দিচ্ছে এবং তারা বেছে বেছেই কাজটি করছে।

অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী আহমেদ হুসেন গত অক্টোবরে ঘোষণা করেন যে, ২০২১ সালে কানাডা অভিবাসনের পরিমাণ সাড়ে তিন লাখে বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে এবং তাদের বেশিরভাগই নেওয়া হবে শ্রমবাজারের দক্ষ কর্মশক্তির ঘাটতি ও শূন্যতা পূরণের জন্য।

ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সিন রেহাগ অভিবাসন সম্পর্কে কানাডীয়দের মনে যে ভীতিনির্ভর অনুমান রয়েছে তার পেছনে বিশ্বজুড়ে চরম ডানপন্থী উত্থানের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ধারণা ব্যক্ত করেন।

রেহাগ বলেন, “এটা মোটেও আশ্চর্যের নয় যে, জরিপে সাম্প্রতিক সময়ে কানাডায় অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ ধরা পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চরম ডানপন্থী আন্দোলনের বিকাশের কারণে মানুষ এখন বিদেশিদের সম্পর্কে ভীতি এবং বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কণ্ঠ মেলানোতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।”

তিনি আরও বলেন, “এছাড়াও কানাডায় কিছু দায়িত্বহীন রাজনীতিক নিজেদের

ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে কানাডার সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হওয়া বা কানাডার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে মিথ্যা ও উদ্বেগজনক প্রচারণা চালিয়ে অভিবাসী ও উদ্বাস্তু হিসাবে আবেদনকারীদের বিষয়টিকে দানবীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে।”

তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, অভিবাসনবিরোধী আবেগ কাজে লাগানোটা দীর্ঘমেয়াদে হিতে-বিপরীত হতে পারে।

তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক উদ্বেগজনক রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি সত্তে¡ও কানাডীয়রা শেষপর্যন্ত বুঝতে সক্ষম হবে যে, আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে না, তারা বুঝতে পারবেন যে, উদ্বাস্তু হিসাবে যতো লোক আসছে সেটা নিয়ন্ত্রণের অযোগ্য নয়, তারা বুঝবেন যে, একটি পদ্ধতি ঠিকমতই কাজ করছে এবং অভিবাসী ও উদ্বাস্তুরা কানাডার সমাজের জন্য বিরাট অবদান রেখে চলেছে।”