৬৬% টরন্টোবাসী কেবল মুষ্ঠিমেয় প্রতিবেশিকে চেনেন কিংবা কাউকেই চেনেন না
গবেষকরা বলছেন, প্রতিবেশিদের সঙ্গে জানাশোনা স্বাস্থ্যের এবং নিজেদের ভালমন্দের জন্য ইতিবাচক
ডিসেম্বর ৫, ২০১৮
মিল ট্রেনস, একটি গুগল গ্র“প। ডগ ওয়াকিং, একটি বার্ষিক স্ট্রিট পার্টি।
এগুলো হলো অভিজ্ঞ প্রতিবেশিদের বাচ্চাকাচ্চা যারা টরন্টোর কেন্দ্রস্থলের বৃক্ষাচ্ছাদিত সড়ক হেলেনা অ্যাভিনিউতে পরস্পরের সঙ্গে ভাববিনিময় করে।
১৫ বছর ধরে ওই এলাকায় বসবাসকারী চন্দ্রা সুকদেওসিং বলেন, প্রতিবেশিদের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন সামাজিক যে কোনও জমায়েতের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। বছর দশেক আগে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার দীর্ঘদিনের প্রতিবেশি সুজান সোয়েঙ্গারের ঘরে চলে যান এবং তাতে তিনি যথেষ্ট সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
সুকদেওসিং স্মরণ করেন, “তিনি (সুজান সোয়েঙ্গার) আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং একজন আত্মীয় এসে পৌঁছা পর্যন্ত আমার পাশে অবস্থান করেন।”
সুকদেওয়ের মন্তব্য, “আমার মনে হয়, প্রতিবেশি হবার অর্থ হলো অনেকটাই এরকম যেখানে আপনার মধ্যে অন্যদের প্রতি এক ধরণের একাত্মতার বোধ কাজ করে। আপনি অনুভব করবেন যে, মানুষ আপনার পাশে দাঁড়ায়।”
কিন্তু টরন্টোতে প্রতিবেশির সঙ্গে প্রতিবেশির এরকম যোগাযোগ সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে না বরং এটা একটা বিরল ঘটনা।
সিবিসি নিউজ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে এই সম্পর্ক নিয়ে। প্রতিবেদক লরেন পেলি ঐ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, সম্প্রতি প্রকাশিত টরন্টো ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা গেছে, টরন্টোর ৬৬ শতাংশ বাসিন্দা প্রতিবেশিদের মাত্র মুষ্ঠিমেয় কয়েকজনকে চেনেন অথবা কাউকেই চেনেন না। এই সমীক্ষাটি হলো এধরণের প্রথম সমীক্ষা এবং এতে টরন্টোবাসীর সম্পর্কের বিষয়গুলো তুলে আনা হয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, উত্তর আমেরিকাজুড়ে এধরণের পরিস্থিতিই ক্রমবর্ধমান হারে সাধারণ নিয়মে পরিণত হচ্ছে। তার অর্থ অবশ্য এটা নয় যে, এটা একটা ভালো অনুশীলন: সমাজবিজ্ঞানীদের মতে প্রতিবেশিদের সঙ্গে জানাশোনা মানুষের স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এবং সার্বিকভাবে সমাজের জন্য উপকারী।
প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন তার কোনও প্রতিবেশিকে চেনেন না
টরন্টো ফাউন্ডেশনের সমীক্ষার ফলাফলে জানা যায়, নগরীর বাসিন্দাদের মাত্র নয় শতাংশ জানিয়েছেন যে তারা তাদের বেশিরভাগ প্রতিবেশিকে চেনেন। আরেকটি অংশ বলেছেন তারা অনেক প্রতিবেশিকে চেনেন। কিন্তু প্রায় ৬০ ভাগ টরন্টোবাসী কেবল মুষ্ঠিমেয় প্রতিবেশিকে চেনেন।
আরেকটি উদ্ঘাটন? প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন তার কোনও প্রতিবেশিকেই চেনেন না।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, প্রতিবেশিদের চেনার বিষয়টির সঙ্গে পরিবারের আয়, শিক্ষা, কানাডায় কত প্রজন্ম ধরে আছেন বা বিশেষ মহল্লার তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই, তবে বিচ্ছিন্ন আবাসনে থাকা (অথবা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ে) এবং একই মহল্লায় বেশ কয়েক বছর ধরে অবস্থানকারীদের প্রতিবেশিকে চেনার সম্ভাবনা বেশি।
হেলেনা অ্যাভিনিউ সম্ভবত টরন্টোর একটি আদর্শ নমুনা হবার মতো মহল্লা। ওয়েস্ট সেন্ট ক্লেয়ার অ্যাভিনিউ-এর লাগোয়া দক্ষিণে এবং ওয়াইচউড বার্নস পার্ক এবং ব্যাথার্স্ট স্ট্রিট পর্যন্ত টানা সাড়ে চার ’শ মিটার দীর্ঘ এই মহল্লায় বেশিরভাগ বাড়িই আধা বিচ্ছিন্ন বা পুরো বিচ্ছিন্ন। বাসিন্দাদের বিরাট অংশ এখানে বহু বছর ধরে বসবাস করছেন। অনেকে আছেন এক বা দুই দশক কিংবা তারও বেশি সময় ধরে।
১৬ বছর আগে জন স্মিথ যখন এই মহল্লায় আসেন তখন তিনি বেশ দ্রুতই তার বাড়ির উভয় পাশের প্রতিবেশিদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বেড়ে উঠেছেন উত্তর টরন্টোর এমন একটি মহল্লায় যেখানে বাসিন্দারা কেউ কখনও কারো সঙ্গে কথা বলেন না। জন স্মিথ কৌতুক করে বলেন, যতক্ষণ না কোন বিষয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে প্রতিবেশিদের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হয়। স্মিথ এসব দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং দ্রুত তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
নিজের বাড়ির কাছে গাছের ছায়ায় ঢাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “এই সামাজিকতা অনেক আনন্দের”।
মহল্লার বাসিন্দারা বলেন, তারা যে বার্ষিক স্ট্রিট পার্টির আয়োজনে এগিয়ে এসেছেন এবং প্রয়োজনের সময় পরস্পরের পাশে দাঁড়াচ্ছেন সেটারও বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
একইরকম অনুভূতি ব্যক্ত করলেন ৩২ বছর ধরে এখানে বসবাসকারী সিনথিয়া ড্যান-বিয়াসলি, “এই মহল্লাটি মানুষের প্রাণশক্তি ও আগ্রহের সমাবেশ ঘটাতে এক অভূতপূর্ব কাজ করেছে।” সিনথিয়া এখানেই তার প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং এখন দাদী হয়েছেন।
‘একাত্মতা বোধের প্রয়োজন আছে’
টরন্টো ফাউন্ডেশনের সমীক্ষায় জড়িত দলের মতে, যাদের ব্যাপকতর সামাজিক যোগাযোগ আছে এবং যাদের নেই তাদের সবার ক্ষেত্রে প্রভাব সৃষ্টিকারী উপাদানগুলোর মধ্যে প্রতিবেশিকে জানা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি। অন্য ভাষায়, এটা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের জোরালো নেটওয়ার্ক এবং সামাজিক সমর্থন।
সোমবার প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, “যেসব নাগরিক নিজের প্রতিবেশিদের চেনেন তাদের সামাজিক যোগাযোগও পুরোপুরি স্পষ্ট।”
বাইরের বিশেষজ্ঞরাও নিকটতম প্রতিবেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টিকে স্বাস্থ্য ও কল্যাণের ক্ষেত্রে উপকারী বলে জানান। মন্ট্রিয়লের মনোবিজ্ঞানী সুসান পিঙ্কারের মতে, সামাজিক বন্ধন বস্তুতপক্ষে দীর্ঘ ও স্বাস্থ্যকর জীবনের সবচেয়ে “শক্তিশালী আভাস দানকারী”।
পিঙ্কার বলেন, “আমরা হলাম সামাজিক জীব আর আমাদের একাত্মতা বোধের প্রয়োজন আছে।” উল্লেখ্য, সুসান পিঙ্কারের লেখা বই দ্য ভিলেজ ইফেক্ট: হোয়াই ফেস টু ফেস কন্ট্যাক্ট ম্যাটারস প্রকাশ পেয়েছে ২০১৪ সালে।
তিনি বলেন, “এটা (একাত্মতার বোধ) আমাদের শারীরীক অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য চাহিদা যেমন, খাওয়া, জলপান ও ঘুমের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ… একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাআমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মধ্যে একটি
বিশেষ ছাপ এঁকে দেয়।”
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কলাম্বিয়ার মিসৌরি ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণার কথা। ওই গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিবেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক ও স্বাস্থ্যের মধ্যে অন্তর্গত পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০১১ সালের ওই গবেষণায় দেখা যায়, এমনকি যখন কারও শিক্ষার স্তর, আয়, বয়স ইত্যাদির মত বিষয়গুলি বিবেচনায় নেওয়া হয় তখনও, যেসব লোক নিজের প্রতিবেশিকে বিশ্বাস করা যায় বলে জানান, তাদের স্বাস্থ্য অন্যদের চেয়ে গড়পরতায় ভালো।
আর পিঙ্কার বলেন, “যেসব লোক তাস খেলতে বা বইয়ের ক্লাবে বা পুরনো দিনের মতো হকি খেলতে যান তাদের স্মৃতিহীনতায় আক্রান্ত হবার আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে অনেক কম।”
গবেষকরা বলছেন, এটি মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা এবং দৈনন্দিন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। রিয়ারসন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী চেরিল তিলুকসিং বলেন, আপনি যখন আপনার প্রতিবেশিদের চেনেন তখন “আপনি জানেন যে, আপনি একটি যত্নের জায়গায় আছেন যার সঙ্গে আপনার জোরালো একাত্মতাবোধ রয়েছে।”
পার্কডেল-এর বাসিন্দা ২৪ বছর বয়সী মিস বেরিল-অ্যান মার্ক-এর কাছেও এটা সত্য। তিনি কয়েক বছর আগে ওয়েস্ট কুইন স্ট্রিটের স্থানীয় পাঠাগারে মহল্লাবাসীর সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করেন।
তিনি বলেন, বাচ্চাদেরকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার পর স্থানীয় মায়েদের সেখানে সমবেত হওয়া একটা নিয়মিত প্রথায় পরিণত হয়। সেখানে মায়েরা কোনওদিন তাদের শিশুদের বাড়ির কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য করেন কোনও দিন হয়তো অন্যদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে খান।
মিস মার্ক সহাস্যে বলেন, “এটা সার্বিকভাবে এবং আমার মানসিক অবস্থার জন্য কল্যাণকর হয়েছে। আমার পরিবার, পারিবারিক নানা কাজ ইত্যাদি রীতিমত যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। মহল্লার বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশাটা আমার জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।”
ডিজিটাল যোগাযোগেরও ভূমিকা রয়েছে
প্রতিবেশিদের সঙ্গে মেলামেশার উপকারিতা স্পষ্ট, কিন্তু তারপরও টরন্টোতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ কেন প্রতিবেশিদের কাছে টেনে নেয় না?
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির পাবলিক পরিসি সম্পর্কিত টবম্যান সেন্টারের ফেলো মার্ক জে. ডিউকেলম্যান বলেন, উত্তর আমেরিকাজুড়ে বর্তমান সময়েরই একটা লক্ষণ এটা, ডিজিটাল যোগযোগের উত্থানকে স্বাগতম।
বিলীয়মান মহল্লাজীবন: আমেরিকান সমাজের রূপান্তর শীর্ষক বইয়ের লেখক ডিউকেলম্যান বলেন, “আমরা এখন আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাচ্ছি যারা আগে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলো।”
একথা বলে তিনি কিন্তু সামাজিক মিডিয়ার সেলিব্রিটিদের বোঝাননি। এক দশক আগের কথা ভাবুন যখন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একজন বাইরে চলে গেলে তার সঙ্গীর পক্ষে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার আর কোনও উপায়ই থাকতো না যতক্ষণ না তিনি রাতের খাবার খেতে বাসায় ফিরতেন। এখন আপনি যে কোনও সময় আপনার প্রিয়জনকে লিখিত বার্তা পাঠাতে, ফোনকল দিতে বা মুখোমুখি হতে পারছেন। কেউ তো বলতেই পারে, কেন প্রতিবেশিদের পেছনে সময় ব্যয় করবেন যখন আপনার ঘণিষ্ঠজনকে কেবল একটি ক্লিক করেই পেয়ে যাচ্ছেন?
পিঙ্কার বলেন, “এটা হতে পারে, আমাদের যদি প্রতিবেশিদের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকে তাহলে আমরা শেষ হয়ে যাবো, আমাদের খামারগুলো ভস্মীভূত হয়ে যাবে।”
বর্তমান সময়ে আমাদেরকে কোনও এক সময়ের পরিচিত জনদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়োজন নেই। ব্যাংকের টেলার যন্ত্র অনলাইনে ব্যাংকিংয়ের সুবিধা দিচ্ছে, অনলাইনে কেনাকাটার সুযোগ হওয়ায় বাইয়ের দোকানিরা অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এর অর্থ এই নয় যে মানুষকে তার পাশের দরোজার প্রতিবেশিসহ মহল্লার লোকেদের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পর্কও চুকিয়ে ফেলতে হবে।
তিলুকসিংহ বলেন, “এরপর যখনই আপনি নিজের গাড়ির কাছে যাবেন এবং দেখবেন যে পাশের ঘরের আরেকজন তার গাড়ির দিকে যাচ্ছেন কিংবা যখন কারো সঙ্গে লিফটে উঠবেন তখনই তাদের সঙ্গে কথা বলুন। নিজেকে পরিচিত করুন এবং দেখুন সেটা কোথায় গিয়ে ঠেকে।”