২০১৯-এর নির্বাচনে অভিবাসন কেন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিষ্ফল বিষয় হতে পারে

একটি দল অভিবাসন-বিরোধী এমন ধারণা ওই দলের জন্য সত্যিকারের বিপদের কারণ হতে পারে

জানুয়ারী ৭, ২০১৯

এরিখ গ্রেনিয়ের

অভিবাসন ও সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাপক শোরগোল তুললেও ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে এটি একটি তুচ্ছ বিষয়ে পরিণত হতে পারে। অথবা এটি সেই দলীয় নেতার মুখে একটি চপেটাঘাতের মতো হতে পারে যিনি এটিকে ইস্যুতে পরিণত করার ঝুঁকি নেবেন।

এনভায়রনিক্স ইন্সটিটিউট-এর এক নতুন সমীক্ষায় দেখা গেছে, অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিষয়ে কানাডীয়দের মতামত গত কয়েক বছরে জরিপ প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপের ফলাফলে সাধারণভাব যেটা প্রতিফলিত হয়েছে বাস্তবে তার থেকে খুব সামান্যই নড়চড় হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৮%) কানাডীয় বলেছেন যে, অভিবাসনের হার খুব বেশি বলে তারা বিশ্বাস করেন না। অন্যদিকে ৭৬ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা মনে করেন কানাডার অর্থনীতিতে অভিবাসনের প্রভাব সার্বিকভাবে ইতিবাচক।

তবে, পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা যায় যে, অভিবাসনের হার কমিয়ে আনা এবং অভিবাসীরা যাতে কানাডীয় মূল্যবোধ গ্রহণ করে সেটা নিশ্চিত করতে বৃহত্তর প্রয়াস গ্রহণের দাবি জানানো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য শোনার মতো লোকও দেশে রয়েছে। এই দুটি নীতিই গ্রহণ করেছে কনজারভেটিভ দলের নেতৃত্বের সাবেক দাবিদার ম্যাক্সিম বার্নিয়েরের প্রতিষ্ঠিত নতুন রাজনৈতিক দল দ্য নউ পিপলস পার্টি।

অভিবাসন ও সীমান্ত নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাপক শোরগোল তুললেও ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে এটি একটি তুচ্ছ বিষয়ে পরিণত হতে পারে। ছবি : সিবিসি

এন্ড্রু শিয়ার্সের কনজারভেটিভ দলের জন্য এটি নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আসা লোকেদের কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার ঘটনা বেড়ে যাবার সময় থেকে কনজারভেটিভ পার্টি প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অভিবাসন নীতির কঠোর সমালোচনা করে আসছিলো। কিন্তু সেই সমালোচনা ছিলো আশ্রয়প্রার্থীদের বিষয়ে সরকারের গৃহীত নীতির ন্যায্যতার মধ্যে সীমিত এবং তারা দাবি করতো যে, অভিবাসীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ আবাসন, কর্মসংস্থান ও তাদেরকে সমাজে একীভূতকরণের কোনওরকম পরিকল্পনা সরকারের নেই।

কনজারভেটিভ দল সতর্কতার সঙ্গে কথা বলতো। তারা নিজেদেরকে অভিবাসনের পক্ষে বলে দাবি করতো এবং সরকার বছরে যত সংখ্যক অভিবাসী গ্রহণ করছে সেটা কমানোর দাবি তারা করেনি।

কিন্তু সেই নীতির কারণে অনেক সমর্থকের সঙ্গে দলের সম্পর্ক বিনষ্ট হয়Ñ ওইসব সমর্থকের মনোভাব এই ইস্যুতে দৃশ্যত বার্নিয়েরের দল যে অবস্থান নিয়েছে তারই অনুকূলে।

এনভায়রনিক্স ইন্সটিটিউটের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, অভিবাসনের বিষয়টি সার্বিকভাবে ভোটারদের কাছে শীর্ষস্থানীয় কোনও চিন্তার বিষয় নয়। মাত্র পাঁচ শতাংশ কানাডীয় এবং কেবল ছয় শতাংশ কনজারভেটিভ ভোটার বলেছেন যে, অভিবাসন এবং উদ্বাস্তু বিষয়ক ইস্যুটি বর্তমানের কানাডার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সংখ্যাটা ২০১৭ সালের পর মাত্র এক শতাংশ বেশি।

ওই একই সময়ের মধ্যে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে উল্লেখ করেন এমন লোকের সংখ্যা পাঁচ পয়েন্ট বেড়ে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ অর্থনীতির পরেই রয়েছে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটি।

এনভায়রনিক্স-এর গবেষণায় স্বাস্থ্যসেবা, সরকারের কর্মকান্ড, সামাজিক ইস্যু এবং বেকারত্বের মতো বিষয়গুলিকেও অভিবাসনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন কানাডীয়রা।

কুইবেকে অভিবাসনের ইস্যুটি সামান্য ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে গেছে

কুইবেকে অভিবাসনের বিষয়টি গুরুত্বের তালিকায় নিচের দিকে ঠাঁই পেয়েছে। সেখানে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী প্রবেশ করেছে এবং অংশত অভিবাসন ইস্যুকে কেন্দ্র করেই সদ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

কুইবেকবাসীদের মধ্যে মাত্র সাত শতাংশ তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে অভিবাসনকে চিহ্নিত করেছেন। অভিবাসনের পরিমাণ, উদ্বাস্তু হওয়ার বৈধতা এবং অর্থনীততে অভিবাসনের প্রভাব নিয়ে কুইবেকবাসীর মতামত সারাদেশের জনমতের অনুরূপ।

সুতরাং, কুইবেকে জেতার সূত্র হিসাবে যারা অভিবাসন ইস্যুটিকে বেছে নিতে চান তারা গত অক্টোবরের প্রাদেশিক নির্বাচনে কোয়ালিশন অ্যাভেনির কুইবেক-এর (সিএকিউ) বিজয় থেকে ভুল শিক্ষা নিচ্ছেন বলেই মনে হয়।

সিএকিউ কুইবেকে অভিবাসী গ্রহণের সংখ্যা কমানো এবং যাদের নেওয়া হবে তাদেরকে সমাজে একীভূত করার জন্য আরও বেশি কিছু করার প্রতিশ্র“তি দেয়। কিন্তু লিবারেল দলের সাবেক প্রিমিয়ার ফিলিপ্পে কিলার্ড-এর সরকার সেখানে প্রচারণায় অভিবাসন বিষয়টি ইস্যু হয়ে ওঠার আগেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলো। আর সিএকিউ নেতা ফ্রাঁসোয়া লেগল্ট এই ইস্যুতে অস্পষ্ট অবস্থান নেওয়ায় প্রায় হারতে বসেছিলেন।

কনজারভেটিভ, পিপিসির ভোটারদের অবস্থান একই সমতলে

অভিবাসন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কানাডীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিভেদ কিন্তু কোনও অঞ্চল, বয়সভিত্তিক গ্র“প বা শিক্ষার স্তরের মধ্যে দেখা যায়নি বরং সেই বিভেদ দেখা যাচ্ছে বড় দলগুলোর সমর্থকদের নিজেদের মধ্যেই। লিবারেল এবং নিউ ডেমোক্রেটসরা উভয়েই অভিবাসনের বিষয়টিকে একইরকম ইতিবাচকভাবে দেখে, কিন্তু কনজারভেটিভ দলের ভোটাররা এটিকে দেখে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। অবশ্য তারা একাই যে আলাদাভাবে দেখে বিষয়টা এখন আর তেমন নয়।

লিবারেলদের মধ্যে কেবল ২২ শতাংশ এবং নিউ ডেমোক্রেটদের মধ্যে ২৪ শতাংশ ভোটার মনে করেন যে, কানাডা খুব বেশি সংখ্যক অভিবাসী গ্রহণ করছে। কিন্তু ৫২ শতাংশ কনজারভেটিভ এবং ৪৭ শতাংশ পিপিসি সমর্থক একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন।

এদিকে কনজারভেটিভদের ৫৮ শতাংশ এবং বার্নিয়ের-এর সমর্থকদের ৫৫ শতাংশ মনে করেন উদ্বাস্তু হওয়ার আবেদনের বেশিরভাগই অবৈধ। এই দাবি সমর্থন করেন লিবারেল দলের কেবল ৩০ শতাংশ এবং নিউ ডেমোক্রেটদের ৩২ শতাংশ সমর্থক।

আর পিপিসির ৭৩ শতাংশ ও কনজারভেটিভ দলের ৭০ শতাংশ সমর্থক মনে করেন, অনেক বেশি সংখ্যক অভিবাসীই কানাডীয় মূল্যবোধ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটা সমর্থন করেন ৩৮ শতাংশ লিবারেল ও ৪০ শতাংশ নিউ ডেমোক্রেটস।

এনভাইরনিক্স সম্ভবত সবচেয়ে গভীর বিভক্তিমূলক সাড়া পেয়েছে যখন তারা জানতে চেয়েছে যে, অভিবাসীরা দেশের ভালো করছে নাকি খারাপ করছে। লিবারেল দলের ৬২ ভাগ সমর্থক বলেছেন, অভিবাসীরা দেশের ভালো করছে, আর মাত্র ছয় ভাগ সমর্থক বলেছেন খারাপ করছে। কনজারভেটিভ এবং পিপিসি সমর্থকরা এ বিষয়ে তিনভাগে বিভক্ত।

কনজারভেটিভদের মধ্যে ২৮ শতাংশ বলছেন অভিবাসীরা দেশের ভালো করছে, ৩১ শতাংশ বলছেন খারাপ করছে এবং ৩২ শতাংশ বলছেন, অভিবাসীদের তেমন কোনও ভূমিকা নেই।

এ থেকে বোঝা যায় যে, ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় এই বিষয়টি যদি মুখ্য হয়ে ওঠে তাহলে এন্ড্রু শিয়ার্স নাজুক পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। দলটি নিজের সমর্থকদের সঙ্গে পা মিলিয়ে এগুতে পারছে না এমন অবস্থা দেখা দিতে পারে। স্বাভাবিকভাবে সেটা তেমন কোনও সমস্যা হয়ে উঠবে নাÑ কারণ এইসব ভোটার লিবারেল বা এনডিপির পক্ষে যাবেন না তবে বার্নিয়েরের পিপলস পার্টি হয়তো কিছুটা সুবিধা পেলেও পেতে পারে।

২০১৯ সালে লিবারেল দলের বিজয়ের চাবিকাঠি হতে পারে অভিবাসীরা

অভিবাসনের বিষয়টি হয়তো কেন্দ্রীয় নির্বাচনে মুখ্য ইস্যু হয়ে উঠবে না, তবে অভিবাসীরাই সেই নির্বাচনে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন।

জরিপের ফলাফলে ধারণা করা যাচ্ছে যে, আগামী বছরের নির্বাচনে লিবারেলরা যদি বিজয়ী হয় তাহলে সেই বিজয়ে অভিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান

হতে পারেন। জরিপ অনুযায়ী কানাডায় জন্মগ্রহণকারী ভোটারদের মধ্যে কনজারভেটিভ দল লিবারেলদের চেয়ে দুই পয়েন্ট এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু অন্যত্র জন্মগ্রহণকারী ভোটারদের মধ্যে লিবারেল দল কনজারভেটিভদের চেয়ে ১৬ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছে। এটাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবধান তৈরি করে দিচ্ছে এবং ট্রুডো সরকারের পুননির্বাচিত হওয়ার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করছে।

অভিবাসীরা কানাডার ভালো করছে নাকি খারাপ করছে এই প্রশ্নে যেসব মতামত দেওয়া হয়েছে তা থেকে একটি উল্লেখ করার মতো পার্থক্য উঠে এসেছে। মতামতে ১৫ থেকে ৫৪ শতাংশের ব্যবধান দেখা যায়। অভিবাসীরা বলেছেন, অভিবাসনের কারণে কানাডাকে আরও ভালো করে তুলছে। তবে অন্ততপক্ষে তিন প্রজন্ম ধরে কানাডীয় এমন লোকেদের ক্ষেত্রে মতামতের ব্যবধান ৪০ থেকে ১৯ শতাংশ।

এথেকে বোঝা যায়, অভিবাসীরা যে মূল্যবোধ নিয়ে এদেশে আসেন তারা সে বিষয়ে খুবই স্পর্শকাতর। অভিবাসন আরও ভালোভাবে সম্পন্ন করা বা বছরে অভিবাসী গ্রহণের হার কমানোর নীতি হয়তো অভিবাসন আর নিবৃত্ত করবে না। তবে একটি দল অভিবাসন-বিরোধী এমন ধারণা ওই দলের জন্য সত্যিকারের বিপদের কারণ হতে পারে।

সংক্ষেপে বললে, অভিবাসন সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্য না নিয়ে কোনও দল নির্বাচনে গেলে এই ইস্যুটি তাদের জন্য ভারসাম্য রক্ষার একটা জটিল কাজ হয়ে উঠবে।

– সিবিসি নিউজ