শিশুদের অভিবাসন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও দ্বন্দ্ব তাদেরকে বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতা ও বিষন্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে

সেপ্টেম্বর ১২, ২০১৮

প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : বিশ্বে কানাডা এখনো অভিবাসীদের জন্য সেরা দেশ বসবাস করার জন্য। প্রতি বছর এই দেশটিতে প্রচুর সংখ্যক অভিবাসী আসছেন স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। কেউ আসছেন দক্ষ কর্মী ক্যাটাগরীতে, কেউ আসছেন স্পন্সর হয়ে আবার কেউ আসছেন উদ্বাস্তু হয়ে। তবে যে যেভাবেই আসুক, এদের সবার পরিবারেই রয়েছে শিশু। আর এই শিশুদের কেউই কিন্তু নিজেদের ইচ্ছায় কানাডায় আসে না। তাদের বাবা-মা কানাডায় আসবেন তাই তাদেরকেও আসতে হচ্ছে। অবশ্য বাবা-মায়েদের দাবী হলো, তারা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই কানাডায় আসেন।

কানাডায় অভিবাসী হয়ে আসার প্রক্রিয়াটি সমাপন প্রধানত বাবা-মা। কিন্তু কানাডায় আসার পর অভিবাসী হিসাবে এই সব পরিবারের শিশুদের শুরু হয় আরেক নতুন অভিবাসী প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াটি হলো, কানাডা র মূলস্রোতে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেয়া। এই মূল স্রোত অভিবাসী শিশুদের জন্য একেবারেই নতুন এক জগত, নতুন এক অভিজ্ঞতা এবং নতুন এক চ্যালেঞ্জ।

নুতন একটি দেশে এসে বাবা-মায়েদের চ্যালেঞ্জ তো থাকেই। কিন্তু শিশুদের চ্যালেঞ্জগুলো প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। আর এই চ্যালেঞ্জগুলো তাদের তারুণ্যের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার বাইরেও বিভিন্ন দুরুহ ও জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়।

প্রবাসে শিশুরা নিজেদের আত্মপরিচয় গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় এবং সে ক্ষেত্রে তারা দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির টানাপোড়নের মধ্যে পড়ে যায়, যা তাদের মনে অপরিমেয় দ্বন্দ্ব-অভিঘাতের সৃষ্টি করতে পারে। ছবি: cbe.ab.ca

এই বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক কোন গবেষণা হয়নি কানাডায়। বিচ্ছিন্নভাবে বা ব্যক্তিপর্যায়ে কোন কোন মনোবিজ্ঞানী বিভিন্ন সময় কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকেন অভিভাবকদেরকে। এমনি একজন মনোবিজ্ঞানী হলেন ড. তালি শেনফিল্ড। তিনি তার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, কানাডায় অভিবাসন দীর্ঘদিনের একটি ঐতিহ্য হলেও প্রতি বছর যে হাজার হাজার পরিবার এ দেশে আসছে তাদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি চ্যালেঞ্জবিহীন নয়। বিশেষ করে শিশুদের জন্য অভিবাসন প্রক্রিয়া যে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে তা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে: প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে না ঘটলেও শিশুরা নিজেদের আত্মপরিচয় গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় এবং সে ক্ষেত্রে তারা দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির টানাপোড়নের মধ্যে পড়ে যায়, যা তাদের মনে অপরিমেয় দ্বন্দ্ব-অভিঘাতের সৃষ্টি করতে পারে।

তিনি লিখেছেন, এভাবে অভিবাসী শিশুরা তাদের “ভিন্ন” পরিচয়ের জন্য কখনও বাইরের বৈরিতার মুখোমুখি হতে পারে; অনেক প্রাপ্তবয়স্ক কানাডীয় এমন ধারণার বশবর্তী হয়েই নিজেদের কর্মকান্ড চালিয়ে যান এবং মনে করেন, কানাডা হলো একটি গ্রহণকারী দেশ এবং এখানে নবাগতদের স্বাভাবিকভাবেই স্বাগত জানানো হয়। কিন্তু তরুণদেরকে সমাজের সঙ্গে “খাপ খাইয়ে” নিতে গিয়ে সর্বত্র যে চাপের মুখে পড়তে হয়, তাতে সচরাচর তাদের মনে হতে পারে যে, বাস্তবতা আসলে সেটা নয়। স্থানীয় শিশুদের চেয়ে অভিবাসী শিশুদের চরমভাবে গালমন্দের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা যে অনেক বেশি শুধু তাই নয়, তারা তাদের খাবারের পছন্দ, পোশাক, ধর্ম, আচরণ ও অন্যান্য সামাজিক প্রথার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাষ্টিক পর্যায়ে উপর্যুপরি ছোটখাট আগ্রাসী আচরণের শিকার হতে পারে।

মনোবিজ্ঞানী শেনফিল্ড এর মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের এসব সংগ্রাম কেবল সমাজের কাছেই নয় বরং তাদের নিজেদের পরিবারের কাছেও থেকে যায় অদৃশ্য। অভিবাসী শিশুদের বাবা-মা চান তাদের সন্তান যেন প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার সর্বোচ্চটা অর্জন করতে পারে- সেজন্য তারা সন্তানের ভাল শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের ওপর সর্বাধিক মনোনিবেশ করেন। আর সেক্ষেত্রে তারা প্রায়শই সন্তানের সামাজিক চাহিদাগুলো উপেক্ষা করেন। একইভাবে তারা সাধারণত অগ্রাধিকার দেন যাতে তাদের সন্তান পাশ্চাত্যের অধিকতর উদার মূল্যবোধ গ্রহণের পরিবর্তে তাদের নিজেদের সংস্কৃতির বিধি-বিধানের প্রতি অনুগত থাকে। এটা এমন এক বিষয় যা শিশুদেরকে “ভিন্ন” হিসাবে চিহ্নিত করে এবং সমাজের সঙ্গে মিলে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা হিসাবে কাজ করে। শিশু যখন বয়ঃসন্ধির দিকে এগিয়ে যায় তখন কারো সঙ্গে ডেটিং করা, গ্রহণযোগ্য পোশাক এবং কার্ফিউর (সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময় ঘরে ফেরা বা বাইরে না যাওয়া) মত বিষয়গুলি নিয়ে দ্বন্দ্ব আরও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে, যা অনেক সময় বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতা এবং বিষন্নতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

যদিও এটা বোধগম্য যে, বাবা-মায়েরা তাদের নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চান এবং তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি ধরে রাখতে চান, কিন্তু তারপরও এটা এমনভাবে করা দরকার যেখানে নমনীয়তা, ইতিবাচকতা এবং সর্বোপরি সহানুভূতিশীলতা থাকবে। সাফল্য পাবার জন্য এবং একটি সুখি, পরিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য একজন অভিবাসী শিশুরও অন্য যে কোনও শিশুর মতই দৃঢ়চিত্ততা, গ্রহণশীলতা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকতে হবে। নিজের ঘরে শিশুদেরকে এ ধরণের সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমেই কেবল বাবা-মায়েরা নিশ্চিত করতে পারেন যে তাদের শিশুরা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করার এবং তাদের আত্মপরিচয় গড়ে তোলার পেছনে যেসব জিনিস রয়েছে সেগুলোকে ভালবাসতে শিখবে।

শিশু মনোজগত বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান জে ডি’সুজার কানাডিয়ানইমিগ্রেন্ট.সিএ-তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেন, অভিবাসী শিশুদের বাবা-মা প্রায়শ সন্তানের উচ্চতর শিক্ষাগত সাফল্যের দিকে বেশি মনোযোগী হতে পারেন এবং তাদের সন্তান যে সামাজিকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হচ্ছে সে বিষয়ে অবহিত নাও থাকতে পারেন। শিক্ষাজীবনে ভালো নম্বর পাওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কানাডায় ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে সাফল্য বা জীবনমান অর্জন করা কেবল ভালো নম্বরের উপর নির্ভর করে না। ধৈর্য ও আগ্রহ হলো জীবিকা অর্জনের সর্বোত্তম উপায়। তরুণ অভিবাসীদেরকে তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু করার দিকে ঠেলে দেওয়ার অর্থ হলো তাদের ভালো করার চেয়ে বরং ক্ষতি করা।

তিনি আরো বলেন, সরাসরি কঠোরতা অবলম্বন বেশিরভাগ অভিবাসী পরিবারের ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবি বলেই ধরে নেওয়া হয়, কিন্তু নিছক মজা করতে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের অবাধ্য হওয়ার পেছনে এটিই সবচেয়ে বড় কারণ। নিরাপত্তার জন্য কার্ফ্যু এবং বিধিবিধান জারী করা গুরুত্বপূর্ণ, তবে অতিরিক্ত নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ বাবা-মার সঙ্গে ছেলেমেয়ের বিশ্বাসের সম্পর্কের ক্ষতি করে।

এরপর এটিই হয়তো বিদ্রোহী হয়ে ওঠার আশঙ্কা সৃষ্টি করে। বাবা-মা তাদের সযতেœ লালিত সন্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে ভীত থাকেন আর টিনএজাররা কানাডীয় পরিবেশে তাদের নবলব্ধ স্বাধীনতার বিষয়টি বুঝতে অক্ষম বা তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন এমন বাবা-মার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারানোর শঙ্কায় থাকে।

অভিবাসী শিশুদের এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় মনোবিজ্ঞানী ড. তালি শেনফিল্ড বাবা-মার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন তার প্রবন্ধে। পরামর্শগুলো এখানে তুলে ধরা হলো: –

বাবা-মার জন্য কিছু টিপস

একটি অভিবাসী শিশুকে সহায়তার বিষয়টি শিখতে হবে সে যেসব অভিনব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করছে তা উপলব্ধি করা ও সেগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে এবং এরপর তাকে সমঝোতার শিক্ষা দিতে হবে যাতে সে তার চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে পারে। অভিবাসী শিশুর বাবা-মা হিসাবে আপনি নিচের কৌশলগুলি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে খাপ খাওয়ানোর

ক্ষেত্রে তাকে যে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা লাঘব করতে পারেন:

– স্কুলে বুলিইং বা গালমন্দের শিকার হলে আপনার শিশুর মধ্যে যেসব আভাস ফুটে ওঠে সে সম্পর্কে সতর্ক থাকুন এবং তার সঙ্গে কথা বলে সে যে ইস্যুগুলো নিয়ে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে সেগুলো মানিয়ে চলার বিষয়ে তাকে উৎসাহিত করুন। বুলিইং বা গালমন্দের শিকার হওয়ার লক্ষণ হলো শরীরে ছোটখাট জখম (যেমন ছড়ে যাওয়া বা কালশিটে দাগ), কাপড় ছিড়ে যাওয়া, কিছু হারিয়ে ফেলা (স্কুলের বই, রুমাল ইত্যাদি), স্কুলে যেতে ভয় পাওয়া (শিশু তখন শরীর খারাপের অজুহাতে যেমন, মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা ইত্যাদি, স্কুলে যাওয়া বাদ দিতে চাইবে), সামাজিক মেলামেশা কমিয়ে দেওয়া, মনগত সমস্যা এবং তার খাওয়া ও ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন। যদি মনে হয় যে আপনার শিশু বকাঝকার শিকার হয়েছে তাহলে তার স্কুলের স্টাফ বা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা জরুরী; স্কুলগুলো সাধারণত জাতিবিদ্বেষ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” মনোভাব গ্রহণ করে এবং সেজন্যে স্টাফদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। আপনার শিশু যদি স্কুলে নিজের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গভীর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে তাহলে তাকে তার নিজের জাতিগত পরিচয়ের অন্য শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়াটা সহায়ক হতে পারে: ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ক্লাব এবং অন্যান্য নেটওয়ার্ক হয়তো তাকে এমন সব সঙ্গী জুটিয়ে দিতে পারে যারা তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হতে পারে এবং তার মনে অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে যে, সে একেবারে নিঃসঙ্গ নয়।

– এমন কিছু বিধি-বিধান ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দেওয়ার চেষ্টা করুন যার মধ্যে তার মনে সক্রিয় উভয় সংস্কৃতির প্রতিফলন থাকে। টিন এজ শিশুদের জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত কোনও সংস্কৃতি সব জাতির মধ্যে নেই, যার ফলে শিশুর বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছার পর্যায়ে বাড়তি জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে; আপনি যদি তেমন কোনও জাতির সদস্য হন তাহলে আপনার জন্য ভালো হবে কানাডার “যুব সংস্কৃতির” সঙ্গে পরিচিত হওয়া। (একই টিভি শো দেখা, একই সঙ্গীত শোনা এবং বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের জন্য তৈরি মিডিয়ার অন্যান্য বিষয়গুলোর চর্চা এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।) এটা উপলব্ধি করা জরুরী যে, কানাডায় এই সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে টিন এজ শিশুদের মধ্যে সমাজের একজন হয়ে ওঠা ও তাদের আত্মপরিচয় গড়ে তোলার বিষয়টি প্রায়শ স্বাস্থ্যকর আত্মমর্যাদা তৈরির শ্রেষ্ঠ উপায়।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, মাদকের ব্যবহার, স্কুলে আচরণবিধি এবং যৌনতার মত বিভিন্ন বিষয়ে পাশ্চাত্যের বিশ্বাস ও প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সঙ্গে অপরিচিত বাবা-মায়েদের জন্য এগুলো অস্বস্তিকর মনে হলেও এ নিয়ে উদ্বেগপূর্ণ প্রতিক্রিয়া না দেখানোই জরুরী। তার পরিবর্তে এসব ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করুন এবং বাচ্চাদের জন্য এমন কিছু ন্যায়সঙ্গত বিধি-বিধান ও সীমানা নির্ধারণ করে দিন যেগুলোতে আপনার বাচ্চার নিরাপত্তার বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। যুক্তিসঙ্গত সমঝোতার নীতি তৈরি করার জন্য আপনার সন্তানের সঙ্গে কথা বলাও একটি ভাল ধারণা; উদাহরণ স্বরূপ, আপনার সন্তানকে একটি বিশেষ ধরণের পোশাক পরতে হবে এই বিষয়টি যদি আপনার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে (ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কারণে) তাহলে এমন একটি সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টা করুন যেন সে ওই বিশেষ পোশাক পরলে তাকে তার ইচ্ছা অনুযায়ী অন্য কোনও জিনিস দেওয়া হবে, যেমন, নির্দিষ্ট কোনও জুতা কিংবা লেটেস্ট মডেলের কোনও প্রযুক্তিগত ডিভাইস ইত্যাদি। এ ধরণের সমঝোতার ফলে বাবা-মায়ের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন যেমন নিশ্চিত হচ্ছে তেমনই আপনার সন্তানকেও এমন কিছু দেওয়া হচ্ছে যা তার জন্য তার সহপাঠী বন্ধুদের সংস্কৃতির সঙ্গে আরও ভালোভাবে একাত্ম হতে সহায়ক হচ্ছে।

– আপনার সন্তানকে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে উৎসাহিত করুন। শিশু, বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির শিশুরা তাদের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে প্রায়শই স্বল্পভাষী হয়ে থাকে আর সেজন্যে তারা সুস্থ-স্বাভাবিক উপায়ের চেয়ে অনেক কম প্রকাশ করেই কথা শেষ করে। অভিবাসী শিশুদের ক্ষেত্রে এটি তাদের দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।

উদাহরণ হিসাবে সুজির (গোপনীয়তার স্বার্থে নাম পাল্টে দেওয়া হয়েছে) ঘটনাটি এক্ষেত্রে উল্ল্লেখ করা যেতে পারে: টিন এজার সুজি ১০ বছর বয়সে চীন থেকে অভিবাসী হিসাবে কানাডায় আসে। সে সব সময়ই ছিলো শান্ত ও চুপচাপ ধরণের মেয়ে। তার মা লিলির বক্তব্য অনুযায়ী, বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছার পরই সুজির সবকিছু পাল্টে যায়। “আমি ও তার বাবা যা কিছুই বলি না কেন সবকিছুকেই সে অবজ্ঞা করতে থাকে, অনেক দেরি করে ঘরে ফিরতে শুরু করে, আমাদের নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি অনেক বেশি সমালোচনামুখর ও বিদ্রুপাত্মক হয়ে ওঠে। আচরণ ও সাজপোশাকে “কানাডীয়” হওয়ার চেষ্টায় সুজি শুধুই ইংরেজিতে কথা বলতে, খোলামেলা পোশাক পরতে এবং শুধুই ওয়েস্টার্ন মিউজিক শুনতে শুরু করে। আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, কী করবো। আমার মনে হচ্ছিলো, মা হিসাবে আমি ব্যর্থ হয়েছি।”

শেষ পর্যন্ত লিলি যখন সুজির সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে সক্ষম হন তখন বেরিয়ে আসে যে, সঙ্কটের মধ্যে পড়ার কোনওরকম ঐকান্তিক ইচ্ছা থেকে নয় বরং তার ভেতরে পরস্পরবিরোধী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত অসন্তোষই তার আচরণগত পরিবর্তনের কারণ। সুজি বড় হওয়ার সময় দেখেছে যে, তার সব বন্ধুরাই অনেক বেশি অবসর সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছে, তাদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্যও অনেক শিথিল এবং তারা পরিবারের সঙ্গে আচরণের সময় অনেক বেশি উষ্ণ ও লৌককতাবর্জিত।

সুজি ব্যাখ্যা দিয়েছে এই বলে যে, “শৈশবে আমি যখনই কোনও বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছি তখনই আমার প্রতি তার বাবা-মায়ের আচরণ দেখে আমি ঈর্ষা বোধ করেছি। আমার বাবা-মা আমার প্রতি অনেক বেশি কঠোর ছিলেন। আমার মনে হয়েছে এটা অন্যায্য।”

সুজিকে তার বিদ্রোহাত্মক আচরণের জন্য আগে যেভাবে শাস্তি দেওয়া হতো সে পথে না গিয়ে তাকে কথা বলতে উৎসাহিত করার মাধ্যমে সুজি ও তার বাবা-মা উভয়েই সম্ভবত তাদের সম্পর্কের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব অনেক কম অনুভব করেছিলো আর সুজি তার নিজের ঐতিহ্যকে আর তেমন চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করেনি। সুজির এই অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, শিশুকে যে সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেটির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে, তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে হবে এবং যখন সে কোনও কিছুকে অন্যায্য বলে মনে করে বা তার বন্ধুদের থেকে দূরত্ব সৃষ্টিকারী বলে ভাবে তখন তার বক্তব্য শুনতে হবে। শিশুকে তার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুর প্রাণবন্তু ও সুসম্পর্ক রক্ষা করা।

– সাংস্কৃতিক বিষয়ে আপনার শিশুর সঙ্গে ইতিবাচক হওয়ার চেষ্টা করুন। তাদের ওপর কোনকিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে স্বভাবগতভাবেই তারা সেটি প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং বাবা-মায়ের উচিৎ হবে শিশুর সামনে ইতিবাচকভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড উপস্থাপন করা। আপনার নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদানে নির্মিত চলচ্চিত্র দেখার জন্য শিশুর সঙ্গে সময় কাটান, পছন্দের খাবার রান্না করুন ইত্যাদি। একটি পরিবার হিসাবে একসঙ্গে সময় কাটানোর মধ্য দিয়ে যে সুখকর স্মৃতি তৈরি হবে সেটাই আপনার শিশুর মনে আজীবন তার নিজের উত্তরাধিকার

লালন করার কারণ নিশ্চিত করবে।

– আপনার শিশুকে মৌখিক ও ধ্বণিবিহীন যোগাযোগের পার্থক্য সম্পর্কে শিক্ষা দিন। শুধু ইংরেজি বা ফরাসী কিংবা উভয় ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারলেই এটা নিশ্চিত হয় না যে একটি শিশু দক্ষতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে। বাবা-মাকে এটা মাথায় রাখতে হবে যে, শব্দ দিয়ে মাত্র সাত শতাংশ মনের ভাব প্রকাশ করা সম্ভব, বাকীটা করতে হয় মুখের অভিব্যক্তি, কণ্ঠস্বর এবং সার্বিক দেহভঙ্গি দিয়ে।

ধ্বণিবিহীন ভাব বিনিময়ের সময় অভিবাসী শিশু, তাদের সহপাঠী বা বন্ধু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অনেক সময় ভাষাগত সংশয় দেখা দেয়। আর এই সংশয় একটি শিশুর জন্য কখনও গুরুতর হয়ে ওঠে যখন তাকে “ভিন্ন” মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার সময় এটি “ভ্রান্ত” বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহারের নমুনা হিসাবে কখনও মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, কারণ এটিকে অশ্রদ্ধার প্রকাশ হিসাবে ধরে নেওয়া হতে পারে। যেমন, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়া থেকে আসা অনেক শিশু কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না, কিন্তু কানাডায় এই একই বিষয়টিকে দেখা হয় অমনোযোগিতা এবং বিদ্রোহী মনোভাবের প্রকাশ হিসাবে।

বাবা-মায়েদেরকে পাশ্চাত্যের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ শেখা এবং অন্যান্য পরিবার ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ভাব বিনিময়ের কায়দা দেখার জন্য কিছু সময় ব্যয় করতে হবে। এরপর তাদের সন্তানদেরকে শেখাতে হবে কীভাবে তাদের নিজের প্রকাশভঙ্গি সংশোধন করতে হবে যাতে করে তাদের দৈহিক ও মৌখিক বার্তার মধ্যে সমন্বয় ঘটানো যায় এবং তা অন্যদের কাছে বোধগম্য হয়ে ওঠে।

শিশুর বেড়ে ওঠার চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করা এবং একটি নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কাজটি একই সঙ্গে চালিয়ে যাওয়া কখনই সহজ নয়। বাবা-মার সহায়তায় অনেক অভিবাসী শিশু “উভয় জগতের সেরা” অভিজ্ঞতা নিয়েই বেড়ে ওঠে। বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত সমাজ সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে হাজার বছর ধরে, সুতরাং এই প্রক্রিয়ার সবশেষ ফলাফল প্রায়শই বিপুলভাবে ইতিবাচক।

সব শেষে বলতে হয়, একটি বিষয় স্মরণ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, উপরে উল্ল্লেখিত কৌশলগুলো প্রয়োগ করার পরও যদি আপনার শিশুর জন্য সমন্বয় করতে সমস্যা হয় তাহলেও আপনি সহায়তা পেতে পারেন কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে। আপনি ও আপনার পরিবার কখনই নিঃসঙ্গ নন।