মুসলিম নারীদের ঘিরে বিদ্যমান ভ্রান্তি ভেঙ্গে দিল ফটোগ্রাফারের লেন্স
নভেম্বর ৪, ২০১৮
গাজালা মালিক : ফটোগ্রাফার আলিয়া ইউসেফ মুসলিম নারীদের সম্পর্কে অনেক কানাডীয়র দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন।
একজন তরুণ বালিকা হলেও – বয়স মাত্র ২৩- ইউসেফ বলেন, কানাডায় বেড়ে ওঠার সময় একজন মুসলিম হিসাবে তার সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
ইউসেফের বয়স যখন আট বছর তখন তার পরিবার মিসর থেকে অভিবাসী হিসাবে কানাডায় আসে এবং ভ্যাঙ্কুভারের উপকণ্ঠে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। ইউসেফ বলেন, সেখানে তিনি খব দ্রুতই শিখে নেন যে তিনি যে মুসলিম সেটা গোপন রাখতে হবে।
নিজের মুসলিম পরিচয়, অতীতের পটভূমি এবং ধর্ম সম্পর্কিত এক ধরণের লজ্জাবোধ নিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন। এর সবই ঘটেছে একজন মুসলিম নারী হওয়ায় তাদের নিয়ে সমাজে বিদ্যমান সংজ্ঞার্থের কারণে।
ইউসেফ বলেন, “মিসরে থাকার সময় আমি আমার ধর্ম, আমার বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে যেমন গর্বিত ও উদ্দীপ্ত বোধ করতাম সেই অবস্থা থেকে আমাকে আমার অনুভূতি মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করা থেকে নিবৃত্ত থাকা এবং আরও বেশি বাকসংযমের দিকে যেতে হয়েছে- কারণ এখানে আসার পর পরই এমন কিছু মন্তব্যের মুখোমুখি হয়েছি যে সেগুলো আমার মধ্যে এমন অনুভূতির সৃষ্টি করেছে যে, আমার পটভূমি যথার্থ নয়, কারণ আমাকে আপনাআপনিই বিচার করা হচ্ছিলো। সুতরাং আমি বেড়ে উঠেছি এমন অনুভূতি নিয়ে যে, ওটা হচ্ছে আমার নিজের সম্পর্কে এমন কোনও বিষয় যা আমাকে গোপন রাখতে হবে।”
টরন্টোতে ফটোগ্রাফির একজন তরুণ শিক্ষার্থী হিসাবে ইউসেফ অতি সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নেন যে, মুসলিম নারীদের নিয়ে যেসব নেতিবাচক কথাবার্তা প্রচলিত রয়েছে তার মোকাবিলায় কিছু করার দায়িত্ব এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা তার রয়েছে।
তার ভাষায়, “মুসলিম নারীদের ওপর অব্যাহতভাবে একটি একপেশে চিত্রই ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে যে, প্রতিটি মুসলিম নারীই নিপীড়নের শিকার, সে প্রায়শ নির্বাক, নিজ জীবনের ওপর তার প্রায়শ কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই এবং সে হচ্ছে তাদের পুরুষ সঙ্গীর ইচ্ছার অধীন।”
ইউসেফ অনুভব করেন যে, মুসলিম নারীদেরকে যে সংকীর্ণ লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখা হচ্ছে তাতে মুসলিম নারীদের বা তার পরিবারের নারীদের এবং তার চারপাশের আরও অসংখ্য মুসলিম নারীর বাস্তব জীবনের চিত্র ফুটে উঠছে না।
ইউসেফ বলেন, “মুসলিম নারীদেরকে একটি মাত্র তুলির আঁচড়ে এঁকে ফেলা যায় এমন ধারণাকে আমি চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছি তাদেরকে মানবিক গুণসম্পন্ন হিসাবে তুলে ধরা এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাহিনীর বৈচিত্র্য প্রদর্শন ও সমসাময়িক কানাডীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ মুসলিম নারীদের জীবনের ওপর আলোক প্রক্ষেপণের মাধ্যমে।”
তিনি কানাডীয় মুসলিম নারীদের ওপর তোলা ফটো সিরিজ সিস্টার প্রজেক্ট তৈরি করেছেন যার লক্ষ্য হলো, মুসলিম নারী এবং কানাডার সমাজে তাদের ভূমিকা সম্পর্কিত একদেশদর্শী ধারণা ভেঙ্গে দেওয়া।
এই সিরিজের অংশ হিসাবে ইউসেফ সারা কানাডা ভ্রমণ করে প্রায় ২০০ মুসলিম নারীর ছবি তুলেছেন যারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজ করছেন, বাজার করা থেকে শুরু করে ঘরের বাইরে কাজ করছেন, বাগান করছেন,এমনকি মোটর সাইকেল চালাচ্ছেন।
এই সিরিজের ছবিগুলো একটি সামাজিক মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। সেখানে ফটোগ্রাফের পাশাপাশি টেক্সট এবং ভিডিওচিত্র যুক্ত করে প্রতি সপ্তাহে কানাডীয় মুসলিম নারীদের কাহিনী শেয়ার করা।
বর্তমানে টরন্টোর রিয়ারসন ইমেজ সেন্টারে ইউসেফের কাজ নিয়ে আয়োজিত প্রথম প্রদর্শনীতে সিস্টার্স প্রজেক্টের ছবিগুলি প্রদর্শিত হচ্ছে। তিনি আশা করছেন যে, এই কাজের মধ্য দিয়ে তিনি কানাডাজুড়ে মুসলিম নারীদের বর্ণালী জীবনের ওপর নির্দিষ্ট আলো ফেলতে পারবেন এবং কোনও না কোনওভাবে মুসলিম নারী ও সার্বিকভাবে মুসলমানদের নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের কুসংস্কার ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হবেন।
ইউসেফের তোলা সিস্টারর্স প্রজেক্টের কিছু ছবি এখানে তুলে ধরা হলো। এতে প্রতিটি ছবির সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত নারীর চিন্তা-ভাবনাও যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে:
আইয়ান
“আমার জীবনের কঠিনতম অভিজ্ঞতা ছিলো এটা উপলব্ধি করা যে, একজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নারী হিসাবে আমার জাতি ও ধর্মকে অন্যরা যেভাবে দেখে তার কারণে আমাকে এই বিশ্বে অনাবশ্যক কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।
“যখন অপেক্ষাকৃত তরুণ ছিলাম তখন আমি ভাবনি যে সমাজে আমি কতটা জায়গা নিচ্ছি এবং এটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে শিখলাম যে আমার সঙ্গে যোগাযোগের সময় কিভাবে লোকেরা তাদের মনোভাব পাল্টে ফেলে।”
আয়েশা
“আমি সৌভাগ্যবান যে, জীবনের অনেক আনন্দদায়ক উপহার আমি পেয়েছি এবং এসব অগণিত উপহারের সবটাই আমার নিজের অর্জন নয়- নিছক ভাগ্যগুণে পাওয়া। তবে এসব উপহারের বেশ বড় অংশ আমার নিরলস প্রচেষ্টা ও কঠোর শ্রমে অর্জিত।
“কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসাবে আমাদেরকে নিজের কাজের অবমূল্যায়নই শেখানো হয়েছে, কিন্তু আমরা কঠোর পরিশ্রম করি। আমার দেখা সবচেয়ে কঠোর পরিশ্রমী নারীদের মধ্যে অনেকেই কৃষ্ণাঙ্গ।”
দাইহিয়া
“আমার হিজাব আমার ধর্ম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয় এবং লোকেরা প্রায়শ আমাকে “স্বাগত” জানায়, তারা মনে করে আমি হয়তো সিরীয় উদ্বাস্তু বা তেমন কেউ।
“একপেশে ধারণা ভেঙ্গে দেওয়ার বিষয়টি আমি পছন্দ করি, সুতরাং লোকেরা আমার সম্পর্কে কী ভাবে এবং কিভাবে দেখে সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা যাই ভাবুক না কেন আমি এটাকে আমার অনুকূলে ব্যবহার করবো।”
ফাতিমা
“আমার মোটর সাইকেল চালনার সবচেয়ে সেরা অংশ হলো যখন আমি হেলমেট খুলে নিই এবং লোকেরা আমার মাথায় হিজাব দেখে বিস্মিত হয়।
“এতে আমার হাসি পায়, কারণ কেউই একজন হিজাব পরা নারীর কাছে এধরণের কিছু আশা করে না। সেজন্যে আমি চাই হিজাবি মেয়েদের ব্যাপারে মানুষের ধারণার পরিবর্তন ঘটুক।”
ফাইয়ে
“আমি অন্যদের প্রত্যাশার বাইরে পা রেখেছি।
“দীর্ঘ সময় ধরেই আমি সেরকমই ছিলাম এবং আমি জানি এটা দেখা আমার পরিবারের জন্য ছিলো একটা চ্যালেঞ্জ। আমি কখনই প্রত্যাশার সীমা ছাড়িয়ে যাইনি তবে আমি আমার কোন প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থও হইনি। আমার মনে হয়, আমি আগেভাগেই শিখে নিয়েছিলাম প্রত্যাশাগুলোকে পাশে সরিয়ে রাখতে এবং আমার প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে।”
র্যান্ডা
“মুসলিম নারীদের নিয়ে সবচেয়ে বড় বদ্ধমূল ধারণা হলো তারা ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার, যেটা আসলে সবচেয়ে বড় কৌতুকও বটে।
“আম যতবার এটা শুনি ততবারই হাসি, তাদের অজ্ঞতা দেখে আমার হাসি পায়। আমি তাদের কথার প্রতিবাদ করতে যাই না কারণ আমি যদি তাদের বলি যে, আমরা কতটা অসাধারণ, তারা এটা কখনই কোনওভাবেই বিশ্বাস করবে না।
“কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখি, সেটাই যথেষ্ট। আমরা কী, আর কী নই সেটা অন্য কেউ এসে বলে দেবে তার কোনও দরকার নেই।”
জয়নাব
“অন্যদের কাছে আমি অনুভব করি যে, আমি যেন এমন কেউ যে তার পটভূমিতেই ঝরে পড়ে। কিন্তু বাস্তবে আমি হলাম এমন একজন যার জন্মই হয়েছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য।
“আমি চাই আমাকে দেখা হোক একজন যোদ্ধা হিসাবে। এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে যে শক্তিমান এবং স্বপ্ন জয় করতে আর আমি যা বিশ্বাস করি তার পক্ষে দাঁড়াতে যে ভীত নয়।”
আলীয়া
“আমি চাই আমাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসাবে দেখা হোক, সমাজ ও তার নিয়মকানুনের মধ্যে অস্তিত্বশীল ব্যক্তিদের সহায়তার মাধ্যমে যার চিন্তা, বাক্য ও কর্মে ইসলামের নীতির প্রতিফলন ঘটে।”
সাবা
“যদি কোন কিছুর পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয় তাহলে সেটা হোক অন্যদের মধ্যে এই সচেতনতা সৃষ্টি যে আমরা স্বাধীন।
“আমরা যে সিদ্ধান্ত নিই সেটা আমাদের নিজস্ব, আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের পরিবার আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে যেমন তোমাদের ধর্ম, তোমাদের সংস্কৃতি এবং তোমাদের পরিবার তোমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
“যদিও শেষ পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্ত আমরাই নিই, যেমনটা তোমরা নাও।”
ইদিল
“আমি একজন কানাডীয়, আর আমি এটা দাবি করি কোনওরকম ফাঁকফোকড় বা ক্ষমাপ্রার্থনা ছাড়াই।
“আমার সফর আমাকে যেখানেই নিয়ে যাক না কেন সে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে একজন কানাডীয় হিসাবে যে এদেশের অতীতের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী।” -সিবিসি। ফটো : আলিয়া ইউসেফ