কানাডায় শিশু পরিস্থিতির ‘উদ্বেগজনক’ চিত্র উঠে এলো নতুন রিপোর্টে
ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৯
কানাডার শিশুকল্যাণ বিষয়ে নতুন এক রিপোর্টে শিশু মৃত্যুর উচ্চ হারসহ শিশু নির্যাতনের নিদারুণ চিত্র ফুটে উঠেছে যা অস্বস্তিকর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
ক্যালগেরি ইউনিভার্সিটির গবেষকবৃন্দ এবং ও’ব্রিয়েন ইন্সটিটিউট ফর পাবলিক হেল্থ-এর সহযোগিতায় চিলড্রেন ফার্স্ট কানাডা এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
রিপোর্টে কানাডায় শিশু মৃত্যুর হার, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং যেসব সামাজিক উপাদান তাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে যেমন দারিদ্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং নির্যাতন ইত্যাদি বিষয় পরীক্ষা করা হয়। রিপোর্ট প্রণয়নের জন্য স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা, ইন্সটিটিউট ফর হেল্থ ইনফরমেশন এবং হেল্থ কানাডাসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে।
চিলড্রেন ফার্স্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজ. ট্রিশ মঙ্গেয়ন বলেন, তাদের এই অলাভজনক সংস্থা একই ধরণের তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দু’বছর আগে যে আলাদা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলো তারপর পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
মঙ্গলবার সিটিভির ইওর মর্নিং অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “কানাডায় শিশু পরিস্থিতি সম্পর্কিত পরিসংখ্যান এখনও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কানাডীয়রা ভাবে যে, এটি হলো শিশুদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে সেরা জায়গা, কিন্তু পরিসংখ্যান আমাদের ভিন্ন চিত্রই দেখাচ্ছে।”
শিশু মৃত্যু
রিপোর্টে দেখা যায়, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ঙঊঈউ) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে যেসব দেশে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি কানাডা সেগুলোর অন্যতম।
কানাডায় বছরে জন্মগ্রহণকারী প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ৪.৭ জন একবছর বয়সের মধ্যে মারা যায়। এর ফলে ওইসিডিভুক্ত ৩৬টি দেশের মধ্যে কানাডার অবস্থান ৩০ নম্বরে। শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম আইসল্যান্ডে প্রতি হাজারে ০.৭ জন এবং সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৭.৯ জন।
কানাডার ভেতরে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ৩.৪ এবং সবচেয়ে বেশি নুনাভুট-এ ১৭.৭ যা অন্য যে কোনও প্রদেশের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। তবে গত এক দশকে গড়ে সবচেয়ে বেশি শিশু মৃত্যুর হার ছিলো ম্যানিটোবা ও সাসকাচুনে।
কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সার্বিকভাবে বাড়লেও রিপোর্টে সতর্ক করা হয়েছে যে, প্রাপ্ত বয়স্ক ও শিশুদের সংখ্যার অনুপাত ক্রমশ কমে যাচ্ছে এবং ২০৩৬ সাল পর্যন্ত কমতেই থাকবে। উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, এরই মধ্যে জনসংখ্যার বৃহদংশ দখলকারী ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা আগামী বছরগুলোতে বাড়তেই থাকবে। চিলড্রেস ফার্স্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা সারা অস্টিন শিশু মৃত্যুর হারের দিক থেকে কানাডার এই পিছিয়ে থাকার বিষয়টিকে “গভীরভাবে যন্ত্রণাদায়ক” বলে অভিহিত করেছেন। সিটিভি নিউজ চ্যানেলকে তিনি বলেন,“স্বাস্থ্যসম্মত গর্ভধারণ ও প্রসব নিশ্চিত করার জন্য যে পর্যাপ্ত পুষ্টি ও প্রসূতি সেবার প্রয়োজন সেটা অনেক গর্ভবতী মা-ই পাচ্ছে না।”
মানসিক স্বাস্থ্য
২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় এক থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হলো আত্মহত্যা। ২০১৫ সালে কানাডাকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু আত্মহত্যার দেশগুলোর অন্যতম হিসাবে দেখানো হয়।
এতে উল্লেখ করা হয় যে, প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে তরুণদের আত্মহত্যার হার আদিবাসী নয় এমন জনগোষ্ঠীর তুলনায় পাঁচ থেকে সাতগুণ বেশি।
কানাডার স্বাস্থ্য তথ্য ইনস্টিটিউটের তথ্যের ভিত্তিতে রিপোর্টে বলা হয় যে, কানাডীয় শিশুদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশেরই জীবনের কোন এক পর্যায়ে মানসিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে।
হেল্থ কানাডা জানায়, মানসিক অসুস্থতায় ভোগা শিশু ও তরুণদের সংখ্যা ১২ লাখের মতো এবং তাদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ প্রয়োজনীয় যথাযথ চিকিৎসা লাভ করে।
এছাড়াও রিপোর্টে কানাডার শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে ক্রমবর্ধমান হারে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। গত ১০ বছরে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যার কারণে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি হওয়া তরুণের সংখ্যা বেড়েছে ৬৬ শতাংশ।
শারীরিক স্বাস্থ্য
রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এক থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ দুর্ঘটনাজনিত আঘাত। দুর্ঘটনাজনিত আঘাতে মৃত্যুর তিনটি প্রধান কারণ হলো মোটর গাড়ির দুর্ঘটনা, পানিতে ডুবে মৃত্যু এবং শ্বাসজনিত ঝুঁকি।
রিপোর্টে কানাডীয় শিশুদের শারীরিক কর্মকান্ড ও তাদের ওজনের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়।
পার্টিসিপেশনের ২০১৮ সালের সর্বশেষ রিপোর্ড কার্ডের তথ্য অনুযায়ী, তিন থেকে চার বছর বয়সী ৬২ শতাংশ শিশু শারীরিক কর্মকান্ড সম্পর্কিত প্রাত্যহিক সুপারিশমালা পূরণ করে, অথচ পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে সেটা নেমে আসে মাত্র ৩৫ শতাংশে।
গত এক দশকে শিশুদের অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতার হার স্থিতিশীল হয়ে এলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, শিশু জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশই স্থ’ূলকায় থেকে যাচ্ছে। শিশুদের স্থূলতার হার সবচেয়ে কম ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় শতকরা ২১.৪ এবং সবচেয়ে বেশি নিউ ফাউন্ডল্যান্ডে ৩৬.৪ শতাংশ।
চিলড্রেন ফার্স্ট সতর্ক করেছে যে, দেশের বর্তমান অবকাঠামো ও কর্মসূচি শিশুদের যথেষ্ট পরিমাণে শারীরিক কর্মকান্ডে উৎসাহিত করার মতো নয়।
অস্টিন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুরা “অহেতুক” মারা যাচ্ছে কারণ বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের নিরাপদ রাখার জন্য তাদের গাড়িতে প্রয়োজনীয় সঠিক বুস্টার সিট ব্যবহার করছেন না। “আর বাচ্চারা হেলমেট ব্যবহার না করায় সাইকেল চালাতে গিয়ে মারা যাচ্ছে।”
সামাজিক উপাদানসমূহ
রিপোর্টে অন্যান্য উপাদান যেমন দারিদ্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং নির্যাতন কীভাবে শিশুদের সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে সেই বিষয়গুলিও পরীক্ষা করা হয়।
স্ট্যাটিটিকস কানাডার হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশের ১২ লাখ শিশু বসবাস করেছে স্বল্প আয়ের পরিবারে। সেজন্যে তারা অধিকতর নাজুক অবস্থার মুখোমুখি থেকেছে। শৈশবের দারিদ্র্যের হার বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন। এই হার সবচেয়ে বেশি ম্যারিটাইম ও ম্যানিটোবায় আর সবচেয়ে কম আলবার্টা ও কুইবেকে।
দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে। বিশেষ করে সংরক্ষিত এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে।
শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে গবেষকরা দেখেছেন যে, প্রতি তিনজন কানাডীয় শিশুর মধ্যে একজন ১৬ বছর বয়সে পৌঁছার আগে কোন না কোনও ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ২৬ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, ১০ শতাংশ যৌন নির্যাতন এবং আট শতাংশ বাবা-মায়ের হাতে নিপীড়নের শিকার হয়।
চিলড্রেন ফার্স্ট এমন উসংহারে পৌঁছেছে যে, শৈশবে নির্যাতন শিশুদের জন্য সারা জীবনের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ হতে পারে।
অস্টিন বলেন, আদিবাসী ও আদিবাসী নয় এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যকার অসাম্য দূর করার জন্য জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
তিনি বলেন,“আমাদের দেশের শিশু পরিস্থিতি নিয়ে সব কানাডীয়রই মর্মাহত হওয়া উচিৎ বিশেষ করে আদিবাসী সমাজের অবস্থা নিয়ে।”
সুপারিশমালা
শিশু পরিস্থিতি নিয়ে যেসব উদ্বেগের বিষয় রিপোর্টে উঠে এসেছে তার সমাধানের লক্ষ্যে চিলড্রেন ফার্স্ট-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ট্রিশ মঙ্গেয়ন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি তিনটি সুপারিশ রেখেছেন।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “কমিশনারকে শিশুদের পক্ষে কথা বলতে হবে, শিশুদের জন্য সর্বোত্তম কাজ করতে হবে, তাদের নিয়ে গবেষণা করতে হবে এবং তাকে শিশুদের কণ্ঠস্বর হতে হবে।”
দ্বিতীয়ত, মঙ্গেয়ন বলেন, চিলড্রেন ফার্স্ট চায় কেন্দ্রীয় সরকার শিশুদের জন্য একটি বাজেট ঘোষণা করুক যাতে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের ওপর নজরদারি এবং সরকারের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকবে।
সংগঠনটি সরকারের প্রতি শিশু সনদের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ারও আহবান জানায়। সারা দেশের তরুণদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে সংগঠনটি ওই সনদ প্রণয়ন করেছে।
মঙ্গেয়ন বলেন, “এটি হলো সরকারের সব স্তরের জন্য কী করতে হবে তারই একটি পথনির্দেশনা। এটি হলো শিশুদের দিয়ে শিশুদের জন্য প্রণীত। এটি শিশুদের অধিকার সম্পর্কিত। এতে শিশু অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ সনদকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং শিশুদের জন্য সত্যিকারের প্রয়োজনগুলো তুলে ধরা হয়েছে।”