কানাডায় শিশুদের আত্মহত্যা, নির্যাতন ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্তদের মধ্যে যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে তাদের সংখ্যাও বাড়ছে
অক্টোবর ১১, ২০১৮
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ : শিশুদের লালন-পালনের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর স্থান হিসাবে বিশ্বজুড়ে কানাডার যে খ্যাতি তা ভুল প্রতিপন্ন হয়েছে। গত মঙ্গলবার নতুন এক রিপোর্টে দেশটিতে শিশুদের আত্মহত্যা, শিশু নির্যাতন এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জটিলতায় ভোগার যে বিস্ময়কর রকমের উচ্চ হারের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে তাতেই এই সত্য প্রকাশ পায়।
চিলড্রেন ফার্স্ট কানাডা এবং ও’ব্রেইন ইনস্টিটিউট ফর পাবলিক হেলথ-এর সংকলিত ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, শিশু মৃত্যু থেকে শুরু করে স্থূলতা এবং দারিদ্র্যের হার পর্যন্ত সব স্বাস্থ্যগত সূচকেই কানাডায় শিশুর কল্যাণের এক উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। খবর কানাডিয়ান প্রেস এর।
নতুন সমীক্ষায় স্ট্যাটিস্টিকস কানাডা এবং কানাডিয়ান ইন্সটিটিউট অব হেলথ ইনফরমেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে বলা হয়েছে যে, দেশের সার্বিক সম্পদ ও সমৃদ্ধির সুফল শিশুরা পাচ্ছে এটা নিশ্চিত করতে সরকারের সব প্রতিষ্ঠানকে আরও অনেক কিছু করতে হবে।
চিলড্রেন ফার্স্ট-এর প্রধান পরিচালক সারা অস্টিন বলেন, “আমরা শিশু মৃত্যুর হার, বা দুর্ঘটনা বা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে বিষয় নিয়েই কথা বলি না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিসংখ্যানগুলো গভীরভাবে উদ্বেগজনক।” তিনি বলেন, “কানাডা বিশ্বের পঞ্চম সমৃদ্ধিশালী দেশ কিন্তু যখন শিশুদের কল্যাণের প্রসঙ্গ আসে তখন আমরা অনেক পেছনে পড়ে যাই। আমাদের শিশুদের কল্যাণ এবং জাতির কল্যাণের মধ্যে একটা যোগাযোগহীনতা রয়ে গেছে।”
অস্টিন জানান, এই যোগাযোগহীনতার বিষয়টি কিছু আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও স্বীকৃত। তিনি শিশু কল্যাণের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইউনিসেফের তালিকায় কানাডার ৪১ তম এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ২৫ তম অবস্থানের বিষয়টি উল্লেখ করেন।
অস্টিন বলেন, সর্বশেষ রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে অনেক উদ্বেগজনক সূচক তুলে ধরেছে যার মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি। এটি ক্রমবর্ধমান জরুরী পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।
রিপোর্টে বলা হয়, মানসিক স্বাস্থ্যগত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পাঁচ থেকে ২৪ বছর বয়সী শিশুদের সংখ্যা গত এক দশকে ৬৬ শতাংশ বেড়েছে, যখন একই কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সব বয়সের মানুষের সংখ্যা ওই একই সময়ে বেড়েছে ৫৫ শতাংশ।
অস্টিন বলেন, ১৮ বা তার চেয়ে কম বয়সীদের নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের অভাব রয়েছে। আর এই বিষয়টিকে তিনি কানাডায় শিশুস্বাস্থ্যের ওপর নজরদারির প্রয়াসে বিরাজমান অনেক সীমাবদ্ধতার অন্যতম বিষয় হিসাবে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছেন।
‘অনুপাতের বাইরে’
রিপোর্টে বলা হয়, মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সর্বোচ্চ সংখ্যক রুগীকে জরুরীভাবে পর্যবেক্ষণ ও হাসপাতালে ভর্তি করার মেধ্য দিয়ে রেকর্ড গড়েছে অন্টারিও। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, শুধু ২০১৬ সালেই অন্টারিওতে মানসিক স্বাস্থ্যগত কারণে ১৬ হাজার ২৯১ টি শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় যা এক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কুইবেকের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। মাদকাসক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সিক কিডস হসপিটাল এবং টরন্টো হাসপাতালের মধ্যে শিশু ও মানসিক স্বাস্থ্য সহযোগিতার কর্মসূচির প্রধান ডা. পিটার সাতমারির (Peter Szatmari) মতে, ওই সংখ্যাটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রবণতার প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি বলেন, অনেক আগে সেই ১৯৮৭ সাল থেকে শিশুদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার বিদ্যমানতা সম্পর্কে নথিপত্র সংরক্ষণ করা হলেও কানাডা সমস্যার মূলে যাওয়ার জন্য তুলনামূলকভাবে সামান্যই পদক্ষেপ নিয়েছে।
ডা. সাতমারি বলেন, হাসপাতালে রুগীদের পর্যবেক্ষণের সংখ্যাটাও বৈশ্বিক মানদন্ডে অনুপাতের বাইরেই রয়ে গেছে।
এটিকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কালিমা মোচনের লক্ষণ হিসাবে দেখার সুযোগ থাকলেও তিনি এটাও মনে করেন যে, স্কুল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি মোকাবিলার ক্ষেত্রে যেসব ঘাটতি রয়েছে তার জন্য এটি একটি বিপদসঙ্কেত।
তিনি বলেন, “শিশুরা যখন ছোট থাকে তখনই তাদেরকে এধরণের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার উপায়টা আমরা বাতলে দিচ্ছি না। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সমস্যা-ভারাক্রান্ত, আমরা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনুসরণ করছি না।”
ডা. অস্টিন বলেন, মানসিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠার মত কোনও উপায় নিজের সমাজ থেকে না পাওয়ার কারণে শিশুরা ক্রমবর্ধমান হারে হাসপাতালের শরণাপন্ন হচ্ছে।
কিন্তু পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রন্তদের মধ্যে যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে তাদের সংখ্যাও বাড়ছে। অস্টিনের বক্তব্য অনুযায়ী, শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হলো আত্মহত্যা। তিনি আরও জানান, শিশুদের আত্মহত্যার হারের দিক থেকে কানাডা বিশ্বে পঞ্চম শীর্ষস্থানে রয়েছে।
সাতমারি বলেন, জি-৭ গ্র“পভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কানাডাই একমাত্র দেশ যেখানে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্পর্কিত কোনও জাতীয় কৌশল নেই। তবে যেখানে এধরণের কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন কুইবেক, সেখানে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে।
অস্টিন বলেন, “এসব বিষয় পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। এগুলোর সবই কোন না কোনওভাবে দারিদ্র্য, নির্যাতন এবং স্বাস্থ্য খাত ও আমাদের শিশুদের কল্যাণে পদ্ধতিগতভাবে স্বল্প বিনিয়োগের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত।”
তিনি বলেন, শিশু নির্যাতনের যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেল নির্দিষ্ট করে সেটি মর্মান্তিক Ñ প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন কানাডীয় ১৬ বছর বয়সে পা রাখার আগেই কোনও না কোনও ধরণের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানানÑ এটা জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা।
শিশু মৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক বলে মনে করেন অস্টিন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে কানাডার সাফল্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
তিনি বলেন, হাজারে দশটি শিশুর মৃত্যুর জাতীয় গড় নিয়ে ওইসিডিভুক্ত ৪৪টি দেশের মধ্যে কানাডা রয়েছে ৩০ তম অবস্থানে। এই হার আবার দেশের সর্বত্র সমভাবে বিরাজ করছে না। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় যেখানে এই হার হলো হাজারে ৩ দশমিক ৫ ভাগ সেখানে নুনাভুট-এ হাজারে মারা যায় ১৭ দশমিক ৭ ভাগ শিশু।
অস্টিন বলেন, রিপোর্টে স্বাস্থ্য খাতের ঘাটতিগুলোর মোকাবিলায় তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। এগুলি হলো: শিশুদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন, শিশু-সম্পর্কিত সব ব্যয় জনসমক্ষে প্রকাশ করা এবং একটি শিশু অধিকার সনদ গ্রহণ করা।