সবার কাছে দোয়া চাচ্ছি যাতে সঠিক ভাবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারি : ডলি
রাজনীতিতে জড়াবো সেটা কখনো আমার চিন্তায় ছিল না
জুলাই ৬, ২০১৮
খুরশিদ আলম : ডলি বেগম যখন খুব ছোট তখন তার নানা প্রায়ই বলতেন, আমার নাতনী বড় হয়ে একদিন বিরাট কিছু হবে। নানার সেই ভবিষ্যতবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায় গত ৭ জুন অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর। সেদিনের সেই ছোট শিশুটি অন্টারিওর সাধারণ নির্বাচনে স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট রাইডিং থেকে এমপিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন বিপুল ভোট পেয়ে।
আর এর মধ্য দিয়ে পূরণ হলো কানাডা প্রবাসী সকল বাংলাদেশীদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নও। স্বপ্নটি ছিল কানাডার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের গর্বিত উপস্থিতি।
অন্টারিও পার্লামেন্টের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ডলি বেগম মূলত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এক ইতিহাস। ইতিপূর্বে অন্টারিওসহ কানাডার অন্য কোন প্রভিন্সে কোন বাংলাদেশী কানাডিয়ান এরকম মর্যাদায় ভুষিত হননি। এমপিপি বা এমপি কোন পদেই কোন বাংলাদেশী পাশ করতে পারেননি। নির্বাচনে বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের অংশগ্রহণও ছিল বলতে গেলে প্রায় শূন্যের কোঠায়।
অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) থেকে মনোনয়ন পেয়ে ডলি বেগম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন স্কারবরো সাউথওয়েস্ট রাইডিং থেকে। তিনি ১৯ হাজার ৭ শত ৫১ ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করেছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির গ্রে এলিস পেয়েছেন ১৩ হাজার ৫ শত ৯২ ভোট। অত্র রাইডিং এ গত চার মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় ছিলেন লিবারেল পার্টির লরেঞ্জো বেরারডিনেটি। তিনি এবার ভোট পেয়েছেন ৮ হাজার ২ শত ১৫টি।
৭ জুনের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছে ড্যাগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধিক প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি। এই দল জয়ী হয়েছে মোট ৭৬টি আসনে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে অন্টারিও এনডিপি। তারা জয়ী হয়েছে ৪০টি আসনে। আর অন্টারিও লিবারেল পার্টি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। তারা আসন পেয়েছে মাত্র ৭টি। শোচনীয় এই পরাজয়ের পর অন্টারিও লিবারেল পার্টির প্রধান ক্যাথলিন উইন পার্টি প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। আর এর মধ্য দিয়ে অন্টারিওতে অবসান হয় লিবারেল পার্টির ১৫ বছরের ক্ষমতা।
ডলি বেগম নির্বাচিত হওয়ার পর টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। একই সাথে কানাডার অন্যান্য প্রভিন্সের বাঙ্গালীদের মধ্যেও। ডলি বেগম যে রাইডিং থেকে জয়ী হন সেই রাইডিং এ প্রচুর সংখ্যাক বাংলাদেশী বাস করেন। সেখানে বাংলাদেশী কানাডিয়ান ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজারের মত।
উল্লেখ্য যে, গত ৭ জুনের নির্বাচনের পরের দিনই কানাডা এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর আমন্ত্রণে তিনি জি সেভেন সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য এসেছিলেন তিনি। কানাডা অবস্থানকালে শেখ হাসিনা বাঙ্গালীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সেখানে ডলি বেগমের নির্বাচিত হওয়ার খবর পেয়ে তিনিও আনন্দিত হন।
নির্বাচনের আগে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনে ডলি বেগমের উপর একটি প্রচ্ছদ কাহিনী ছাপা হয়েছিল। ঐ প্রচ্ছদ কাহিনীতে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিল এই বলে যে, ‘প্রবাসী বাংলাদেশীদের স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে ডলি বেগম’।
বাংলাদেশীদের স্বপ্ন পূরণ করেছেন ডলি বেগম। কানাডায় প্রথম প্রজন্মের বাঙ্গালীদের অধরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন দ্বিতীয় প্রজন্মের এই তরুনী। কমিউনিটিতে তিনি এখন এক সেলিব্রিটি। সেলিব্রিটিদের ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে জানার কৌতুহল থাকে অনেকেরই।
আমরা কথা বলেছি ডলি বেগম এর সঙ্গে। কথা হয়েছে তার মা, বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গেও। জানতে চেয়েছি আমাদের এই নতুন সেলিব্রিটির অতীত ও বর্তমানের কাহিনী। জানতে চেয়েছি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও।
আজ কানাডায় সবার মুখে মুখে যার নাম সেই ডলির পরিবারকে একটা ইস্পাত কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে পার হতে হয়েছে কানাডায় আসার কিছুদিন পর থেকেই। আর এই সময়টা এক বছর নয়, দুই বছর নয় সুদীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় ধরে!
কানাডায় আসার বছরখানেক পর একদিন ডলির বাবা রাজা মিয়া বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হচ্ছিলেন বাসায় ফিরবেন বলে। এমন সময় একটি দ্রুতগতির গাড়ি হঠাৎ করে তাকে ধাক্কা মারে। তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে পরপর আরো দুটি গাড়ি তাকে আঘাত করে। সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মকভাবে আহত হন রাজা মিয়া। সেখান থেকে হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। এরপর রিহ্যাবে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ বছরের পরিবার বিচ্ছিন্ন জীবন!
এই সময়টা শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরেন ডলির মা জবা বেগম। একটি সম্পূর্ণ নতুন দেশে নতুন পরিবেশে গ্রাম থেকে আসা জবা বেগম একদিকে হাল ধরেছেন সংসারের, অন্যদিকে দৌড়াদৌড়ি করেছেন হাসপাতাল আর রিহ্যাবে। আর এর পাশাপাশি দেখাশুনা করেছেন ছেলে-মেয়েদের। জবা বেগম বলেন, আমার স্বামী দুর্ঘটনা মারাত্মকভাবে আহত হন। ঐ সময় তাকে দেখভাল করবো না বাচ্চাদের দিকে নজর দিব? এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছি আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা। এবং এটা এক বছর বা দুই বছর সময়ের জন্য নয়। সুদীর্ঘ এক যুগ বা তারো বেশী সময় ধরে একটা চরম সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা অবর্ণনীয় দুঃসময় পাড় করেছি।
ডলির বাবা বলেন, আমার এক্সিডেন্টের পর আমার পরিবার একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কষ্ট ভোগ করছিল নানাভাবে। আমি অর্থাভাবে আমার ছেলে-মেয়েদেরকে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়াতে পারিনি। কিন্তু তারপরও তারা ভাল রেজাল্ট করছিল। ডলি স্কুল থেকে পুরষ্কার পেত। আমার কাছে মনে হতো স্কুল কর্তৃপক্ষ ভুল করে তাকে পুরস্কার দিচ্ছে।
রাজা মিয়া আর জবা বেগম এর কন্যা সেই ডলি বেগম জীবনের কঠিন রূপটি দেখেছেন শৈশবেই। কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেননি। বরং মায়ের মতই শক্ত হাতে নিজের জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। স্কুল, ইউনিভার্সিটিতে অত্যন্ত ভাল রেজাল্ট করে নিজের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো বিশ্বসেরা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি। সেখান থেকে পলিটিক্যাল সাইন্সে ডিগ্রি নিয়ে Development Administration and Planning এর উপর মাস্টার্স শেষ করেন বৃটেন থেকে। এই মেয়েকে থামিয়ে রাখে এমন সাধ্য কার আছে?
ডলি বেগম ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার জন্য গত ২৫ জুন হাজির হয়েছিলাম তার বাড়িতে। সাথে ক্যামেরায় ছিলেন বিদ্যুৎ সরকার। স্কারবরোর ওয়ার্ডেন সাবওয়ের পাশে জর্জিনা গেট এ তাদের সেমি ডিটাচ বাড়িটি। প্রথমেই দেখা ডলির বাবা রাজা মিয়ার সঙ্গে। এ সময় বাড়ির ভিতর থেকে এগিয়ে আসেন ডলির ভাই মহসীন মিয়া। কথাবার্তায় ও আচরণে চৌকষ এই তরুণ আমাদেরকে নিয়ে বসালেন বৈঠকখানায়। ডলি তখনো বাসায় এসে পৌঁছায় নি। পার্টির একটি মিটিং শেষ করে বাসায় ফেরার পথে ৪০১ এর জ্যামে পড়েছেন। যথাসময়ে বাড়িতে পৌঁছাতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে ডলির ভাই টিভিতে ওয়ার্ল্ডকাপ ফুটবলের খেলা ছেড়ে দিয়েছেন অপেক্ষার সময়টুকু কাটানোর জন্য। ডলির মাও ব্যস্ত হয়ে উঠেন আপ্যান করার জন্য। তবে বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয়নি আমাদেরকে। ডলি এসে উপস্থিত হন বাড়িতে। এসেই বসে যান আমাদের সঙ্গে।
আসুন শুনি ডলি বেগম নিজের জীবন সম্পর্কে নিজেই কি বলেছেন।
প্রশ্ন : আপনার একেবারে শৈশব থেকেই শুরু করি। সেই সময় আপনি কি স্বপ্ন দেখতেন? অর্থাৎ বড় হয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার অথবা জজ-ব্যারিস্টার কিংবা নভোচারী এরকম কিছু হওয়ার বাসনা কি ছিল মনে মনে?
উত্তর : ছোট বেলায় আমি শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখতাম। কারণ তখন আমার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র ছিলেন শিক্ষকগণ। কারণ তাদের কাছে অনেক হেলপ পেতাম। তবে সত্যি কথা কি, আমার নির্দিষ্ট কোন ক্যারিয়ার পরিকল্পনা ছিল না।
প্রশ্ন : রাজনীতিক হওয়ার কথা কি কখনো ভেবেছিলেন?
উত্তর : আমার চিন্তায় আসলে রাজনীতির বিষয়টি ছিল না। তবে মানুষকে হেলপ করার একটা স্বপ্ন আমার শৈশব থেকেই ছিল। আর সেটা থেকেই ক্রমশ রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠি এবং এর সাথে সম্পৃক্ত হই।
প্রশ্ন : কারো উৎসাহ বা অনুপ্রেরণা ছিল কি রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে?
উত্তর : রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে আমি অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তবে এ ক্ষেত্রে আমি আমার মা’র কথাই আগে বলবো। কারণ, উনার ইচ্ছাশক্তি খুবই প্রবল এবং খুবই শক্তিশালী। আমাদের পুরো পরিবারটিকে উনিই টেক কেয়ার করেন। সে কারণে স্পষ্টতই উনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখার আছে। আমি এখানে মূলধারার কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গেও কাজ করেছি। যেমন বিচেস ইস্ট ইয়র্ক এলাকার ওয়ার্ড ৩১ এর সিটি কাউন্সিলর জেনেট ডেভিস। এরকম আরো কয়েকজন এর সঙ্গে কাজ করেছি। আর তাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়েও রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি এবং আগ্রহী হয়ে উঠেছি।
প্রশ্ন : কানাডায় বা বাংলাদেশে আপনার নিজ পরিবারের কেউ কি আছেন যারা রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত?
উত্তর : না, সেরকম ভাবে কেউ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তবে আমার নানা ছিলেন নিজ গ্রামে একজন সক্রিয় সমাজসেবী। আমার দাদাও ছিলেন ঐ রকম। উনারা অবশ্য কেউই এখন আর জীবীত নন।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। যেমন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিরোধী দলীয় নেত্রী, স্পীকার সবাই নারী। এই বিষয়টি কি একজন নারী হিসাবে আপনার মনে কোন প্রভাব ফেলেছে রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠার পিছনে?
উত্তর : বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে আমি আসলে ততটা অবহিত নই। তবে নারী নেত্রী পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর বাংলাদেশে যারা নতুন প্রজন্ম
আছেন বিশেষ করে মেয়েরা, আমি আশা করবো তারা এই বিষয়টি দেখে অনুপ্রাণিত হবেন এবং নেতৃত্বদানে এগিয়ে আসবেন।
প্রশ্ন : কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশীদের বেশির ভাগই লিবারেল সমর্থক। তারা ভোটও দিয়ে থাকেন লিবারেল পার্টির মনোনিত ব্যক্তিকে। আপনি এনডিপি’র দিকে ঝুকলেন কি কারণে? আর একটা ঝুঁকি কি ছিল না যে, লিবারেল সমর্থক বাংলাদেশীরা আপনাকে ভোট নাও দিতে পারেন?
উত্তর : আমি আসলে কখনোই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না আগে। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে মানুষকে হেলপ করতে পারবো, কমিউনিটিকে হেলপ করতে পারবো। আমার যে বিশ্বাস বা দর্শন ছিল – সেটা শিক্ষা হোক বা হেলথ কেয়ারই হোক, আমি দেখতাম তার সঙ্গে এনডিপি’র যে নীতি ও আদর্শ তার সঙ্গে অনেক মিল আছে। এমনকি লিবারেল পার্টির চেয়েও অনেক ভাল এনডিপি’র নীতি ও আদর্শগুলো। ইমিগ্রেশন বিষয়েও এনডিপি’র যে নীতি রয়েছে সেটা লিবারেল পার্টির চেয়ে অনেক ভাল এবং ইমিগ্রেন্টবান্ধব। এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষন করে আমি দেখলাম এনডিপি’র সঙ্গে আমার নিজের নীতি ও আদর্শগুলো বেশী খাপ খায়। এ কারণেই মূলত আমি এনডিপি’র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাই।
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয়, আপনার রাইডিং এ বসবাসকারী বাংলাদেশীরা প্রায় সবাই আপনাকে ভোট দিয়েছেন?
উত্তর : আমি বাঙ্গালী যারা আছেন এখানে তাদের সবার সমর্থনই পেয়েছি একচেটিয়াভাবে। এ জন্য আমি তাদের সকলের কাছেই কৃতজ্ঞ। অন্যদিকে আমার রাইডিং থেকে আমি দশ হাজারেরও বেশী লিবারেল সমর্থকদের ভোট পেয়েছি।
প্রশ্ন : নির্বাচনে জয়ী হবার পর প্রথম অনুভূতিটা কি ছিল আপনার? কার মুখটা ভেসে উঠেছিল প্রথম আপনার মানসপটে?
উত্তর : নির্বাচনে জয়ী হবার খবর পেয়ে প্রথমেই আমি আল্ল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই, তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। এরপর আমি আমার মা ও বাবাকে ফোন দেই। আমার ভাই তখন আমার পাশেই ছিল। এছাড়াও যারা আমার টিমে ছিলেন তাদের কথাও আমি কৃতজ্ঞতা সহকারে মনে করি। কারণ, তারা অনেক প্ররিশ্রম করেছেন আমার নির্বাচনী প্রচারনায়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টরন্টোতে বাঙ্গালীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসে নাকি আপনার খোঁজও করেছিলেন এবং খুব খুশীও হয়েছেন আপনার জয়ী হবার খবর পেয়ে। ঐ অনুষ্ঠানে আপনি যান নি কেন? পরে কি দেখা হয়েছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে? কিংবা টেলিফোনে যোগাযোগ? হয়ে থাকলে তিনি কি বলেছিলেন আপনাকে?
উত্তর : ঐ অনুষ্ঠানে আমি যাইনি। কারণ, আমিতো তখনো শপথ নেইনি। সেই অর্থে আমি তখনো ‘এমপিপি ইলেক্ট’। অর্থাৎ এমপিপি হিসাবে তখনও ফাইনাল ডিক্লারেশন হয়নি।
না, পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি বা ফোনেও কথা হয়নি। তবে শুনেছি তিনি নাকি খুশি হয়েছেন আমার বিজয়ের সংবাদ শুনে। এটি আমার জন্য খুবই উৎসাহদায়ক একটি খবর।
প্রশ্ন : বৃটেনের বাংলাদেশী কমিউনিটি থেকে প্রথম এপি নির্বাচিত হন রুশনারা আলী। তার সঙ্গে কি এর মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে?
উত্তর : আমি মাস্টার্স করার জন্য বৃটেনে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন রুশনারা আলীর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি বা পরিচয়ও হয়নি। লন্ডনে আমি তখন আমার লেখাপড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। আবার রিসার্সের জন্য ইথিওপিয়াতে থাকতে হয়েছে আমাকে।
আমার জয়ের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর উনার দিক থেকে কোন অভিনন্দন পাইনি এখনো। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে উনার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। অবশ্য আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয়নি। আমার ক্যাম্পেইন ম্যানেজারের সঙ্গে উনার কথা হয়েছে। আমরা পরিকল্পনা করছি কখন তার সঙ্গে দেখা করা যায় বা কথা বলা যায়। আমি খুবই উদ্দীপ্ত হয়ে আছি এ ব্যাপারে।
প্রশ্ন : কানাডায় বাংলাদেশী কানাডিয়ান হিসাবে প্রথম এমপিপি নির্বাচিত হয়ে আপনি একটি ইতিহাস গড়েছেন। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কি?
উত্তর : আলহামদুলিল্লাহ। আমি এ ব্যাপারে খুবই উদ্দীপ্ত। তবে একই সাথে আমি মনে করি আমার জন্য এটি একটি বড় দায়িত্বও। আমি সবার কাছে দোয়া চাচ্ছি যাতে আমি আমার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে পারি।
আমি ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি অনেক মানুষের অনেক সাহায্য দরকার। অনেক ইমেইল আসছে, ম্যাসেজ আসছে যাদের সাহায্য দরকার তাদের কাছ থেকে। তাছাড়া আমি যদি আমার কমিউনিটি থেকে সহযোগিতা পাই তবে আমাদের যুবসম্প্রদায়ের জন্য আমি কিছু একটা করতে পারবো। তাদের কাছ থেকেও আমি অনেক বার্তা পাচ্ছি।
প্রশ্ন : কানাডায় আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতা বা আগ্রহ কম। কারণটা কি বলে মনে হয় আপনার কাছে? আপনার কি মনে হয় না তাদের এগিয়ে আসা উচিৎ? এই তরুণদের প্রতি আপনার বার্তা বা পরামর্শ কি?
উত্তর : আমি আমার নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে দেখতে পেয়েছি তরুণ সম্প্রদায়ের অনেকেই এগিয়ে এসেছেন আমাকে সাহায্য করার জন্য। নির্বাচনের দিন আমাদের ৩ শ’রও বেশী স্বেচ্ছাসেবী ছিল যারা বয়সে তরুন। অবশ্য সবাই বাংলাদেশী ছিলেন তা নয়। তবে তরুণ সম্প্রদায়ের এই যে অংশগ্রহণ, আমি মনে করি এটি একটি খুবই ভাল দিক। আমি আশা করছি আগামীতে এই তরুণ সম্প্রদায়কে আমি রাজনীতিতে আরো বেশী সম্পৃক্ত করতে পারবো।
প্রশ্ন : টরন্টো ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টু এসোসিয়েশন এর সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা কি ছিল? কি দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানে?
উত্তর : আমি ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর এসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমি সেখানে কাজ করি পলিসি কোঅর্ডিনেটর হিসাবে। ইউএফটি’র যে পলিসি আছে সেগুলো নিয়ে কাজ করেছি। যেমন টিউশন ফি, স্টুডেন্টদের মেন্টাল ইস্যু, ফুড সিকিউরিটি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেছি। টিউশন ফি কিভাবে আরো কমানো যায় তা নিয়ে কাজ করেছি যাতে লেখাপড়া আরো সামর্থ্যরে মধ্যে আনা যায়।
প্রশ্ন : ইউনিভার্সিটিতে দেখা যায় অনেকেই ডিপ্রেশন বা এংজাইটিতে ভোগে। এ নিয়ে আপনি কাজ করেছেন কি?
উত্তর : হ্যা, আমি এ নিয়ে কাজ করেছি। স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন থেকে আমরা মেন্টাল হেলথ নিয়ে অনেক কাজ করেছি। স্টুডেন্টরা যখন ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করেন তখন তাদের উপর অনেক চাপ পড়ে। আর আমি মনে করি যখন ইমিগ্রেন্ট স্টুডেন্টরা ইউনিভার্সিটিতে প্রবেশ করে তখন তাদের উপর চাপটা অন্যসব কানাডিয়ান স্টুডেন্টদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশী পড়ে। কারণ, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আমাদের ইমিগ্রেন্ট পরিবারগুলোর এক্সপেক্টেশন থাকে খুবই হাই। আমাদের বাবা-মা-রা এদেশে আসেন প্রধানত ছেলে-মেয়েদের ভাল লেখাপড়া ও উজ্জল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। এক্সপেক্টেশনটা এ কারণেই হাই হয়। তারা আশা করেন তাদের ছেলে-মেয়েরা সব বিষয়ে অ+ পাবে। এ কারণে ছেলে-মেয়েদের উপর অনেক চাপ পড়ে। বিশেষ করে যখন ছেলে-মেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে বা কলেজে পড়তে যায়। ফলে আমি দেখেছি অনেক ছেলে-মেয়েই আমার কাছে আসতো এই চাপের কারনে সৃষ্ট মেন্টাল হেলথ সমস্যা নিয়ে। আমি আমাদের ইমিগ্রেন্ট বাবা-মা-দেরকে এই বিষয়ে বলতে চাই, আপনারা আপনাদের ছেলে-মেয়েদের উপর এরকম চাপ সৃষ্টি করবেন না। আর অন্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কখনো তুলনাও করবেন না। এতে করে ছেলে-মেয়েদের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটা ছেলে-মেয়েই স্বতন্ত্র। একজন হয়তো সায়েন্সে ভাল, অন্যজন হয়তো আর্টস এ ভাল। কে কোনটাতে ভাল তা যাচাই করে দেখতে হবে। সব ছেলে-মেয়েই যে সবকিছুতে ভাল হবে তা ভাবার কোন যুক্তি নেই।
প্রশ্ন : আপনার জীবনের আদর্শ পুরুষ বা নারী কে? যেমন কারো জীবনের আদর্শ মাদার তেরেসা, কারো জীবনের আদর্শ মহাত্মা গান্ধি।
উত্তর : আমার আদর্শ পুরুষ বা নারী বলতে অনেকেই আছেন। তবে আমি আমার মা-র কথাই প্রথমে বলবো। আমার মাই আমার সবচেয়ে বড় আদর্শ। আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাদেরকে বড় করেছেন। একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে বা একজন আদর্শ নারী হিসাবে কিভাবে জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করতে হয়, কিভাবে একটা পরিবারকে ধরে রাখা যায় সেটা দেখিয়েছেন আমার মা। কারণ আমার বাবা কানাডা আসার পর এক বছরের মাথায়ই এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে প্রায় এক যুগেরও বেশী সময় ধরে শারীরিকভাবে কষ্ট করছেন। উনি বাস থেকে নেমে বাসায় ফিরার জন্য রস্তা পার হচ্ছিলেন। ঐ সময় একটি দ্রুতগতির গাড়ি এসে উনাকে হিট করে। পর পর আরো দুটি গাড়ি উনাকে হিট করে রাস্তার উপর। এটি ২০০১ সালের ঘটনা।
এখন আলহামদুলিল্ল্লাহ উনি ভাল আছেন। কিন্তু প্রায় ১৮ বছর পার হয়ে গেলেও নিয়মিত উনাকে পেইন কিলার খেতে হয়। উনি প্রায় বার বছর হাসপাতাল আর রিহাবে কাটিয়েছেন। এই পরিস্থিতিগুলো আমার মা একাই অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে সামলিয়েছেন এবং আমাদের মানুষ করেছেন।
প্রশ্ন : আপনার কোন হবি আছে কি? যেমন বই পড়া, ভ্রমণে যাওয়া বা বাগান করা?
উত্তর : অনেক কিছুই আছে যা করতে ভাল লাগে আমার। এর মধ্যে কবিতা একটি বিষয়। আমি বাংলা ইংরেজী দুই ভাষার কবিতাই পড়ি। গান শুনতেও আমার খুব ভাল লাগে। বিশেষ করে বাংলা গান। আমি লালন এর গান খুব পছন্দ করি।
আমি মনে করি লালন যে বিষয়গুলো নিয়ে গান লিখেছেন সেগুলো ফর দ্যা পিপল, মানুষের জন্য। উনি মানুষের যে অধিকারগুলো নিয়ে গান লিখেছেন যে অনুভূতিগুলো নিয়ে গান লিখেছেন সেগুলো আজ অনেক লেখকই লিখছেন। কিন্তু একথাগুলো তিনি আরো বহু যুগ আগেই লিখে গেছেন।
প্রশ্ন : আপনাদের কেন্দ্রীয় নেতা জাগমিত সিং সম্প্রতি ফ্যাশন ডিজাইনার গুলকিরান এর সাথে ঘর বেঁধেছেন। আপনারও কি সেরকম ঘর বাঁধার কোন পরিকল্পনা আছে অদূর ভবিষ্যতে?
উত্তর : ইনশালল্াহ। আমি বিষয়টি আমার বাবা মা’র হাতে ছেড়ে দিয়েছি। উনারা যে ভাবে সিদ্ধান্ত নিবেন আমি সেভাবেই এগুবো।
প্রশ্ন : কানাডার সাবেক এক প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর উপদেষ্টা ভিক্টর চোই তার এক লেখায় বলেন, আমরা রাজনীতির নতুন এক যুগে প্রবেশ করছি এবং সেখানে মাল্টিকালচারাল কমিউনিটি নতুন এক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ফলে কানাডার সব রাজনৈতিক দলই এখন এই মাল্টিকালচারাল কমিউিনিটিকে খাতির করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য বা পর্যবেক্ষন কি?
উত্তর : এটা এখন এক বাস্তবতা কানাডার রাজনীতিতে। কানাডায় মাল্টিকালচারাল কমিউনিটি যে শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে মূলধারার রাজনীতি তাকে অবজ্ঞা করতে পারবে না। কারণ, কানাডা একটি মাল্টিকালচারাল দেশ। এর অবয়ব একটি সাতরঙা রংধনুর মত। এই দেশে মাল্টিাকালচারকে গুরুত্ব দিতেই হবে। কোন পার্টি যদি নির্দিষ্ট একটি গ্র“পকে নিয়ে এগুতে চায় তবে তা সম্ভব নয়। সবাইকে গুরুত্ব দিতে হবে।
আমি আমার নিজ দল এনডিপি প্রসঙ্গে বলতে পারি, এই দলের যে নীতি ও আদর্শ আছে তা নিয়ে আমি খুব গর্বিত। কারণ এটি মাল্টিকালচারাল আদর্শ নিয়ে গঠিত। এই দল কানাডার ইমিগ্রেন্টস পরিবারগুলোর চাহিদা ও দাবী নিয়ে কথা বলে।
প্রশ্ন : ইমিগ্রেন্ট পরিবারের ছেলে-মেয়েরা ঘরে এক সংস্কৃতি এবং বাইরে আরেক সংস্কৃতির মুখমুখি হয়। এই দুই সংস্কৃতির দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে তাদের মধ্যে এক ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। আপনার ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্ব বা বিভ্রান্তি কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং সেটি কি ভাবে কাটিয়ে উঠে আজ একজন সফল ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন?
উত্তর : এটা সব ইমিগ্রেন্ট পরিবারের ছেলে-মেয়েদেরকেই মোকাবেলা করতে হয়। আমাকেও করতে হয়েছে। আমি মনে করি আমরা যখন স্কুলে যাব তখন এখানকার যে কানাডীয় কালচার সেটার উপর বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ আমাদেরকে এই দেশে থাকতে হবে। আর থাকতে হলে এই দেশের কালচারের সঙ্গে স¤পৃক্ত হতে হবে। আমাদেরকে নিশ্চিত হতে হবে যে, আমাদের যে এজগ্র“প আছে আমরা সেটার অন্তর্গত।
আর বাসায় আমরা অবশ্য একটি বিষয় খুব দৃঢ় অবস্থানে ছিলাম যে, ঘরে বাংলা বলতে হবে। আমার বাবা সবসময় বলতেন, বাংলা নিয়মিত পড়তে হবে। না পড়লে এই ভাষা ভুলে যাবে।
আর বিশেষ করে কানাডীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি আমাদের যে নিজের একটা সংস্কৃতি আছে, যে সংস্কৃতি আমরা দেশ থেকে নিয়ে এসেছি সেটা যেন ভুল না যাই তাও দেখতে হবে। কারণ এটা আমাদের শিকড়। এটা অবশ্য ছেলে-মেয়েদের জন্য এটা কিছুটা কঠিন হয়ে দাড়ায় দুই সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। কিন্তু তবু করতে হবে। পাশাপাশি বাবা-মাকে সহযোগিতা করতে হবে এবং উৎসাহ দিতে হবে যাতে ছেলে-মেয়েরা বাইরের সংস্কৃতির সঙ্গেও তাল মিলিয়ে চলতে পারে। কারণ, স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে ঐ বাইরের সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, চলতে হবে জীবন ও জীবিকার তাগিদে।
প্রশ্ন : আপনার আজকের এই সাফল্যের পিছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশী বলে আপনি মনে করছেন?
উত্তর : আমি মনে করি আমার আজকের এই সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার ভাইয়ের। আমরা পিঠাপিঠি ভাই বোন। যদিও সে আমার ছোট কিন্তু অনেকটা যমজ ভাই বোনের মত আমরা। সে আমার সবকিছুতেই উৎসাহ যোগায়। আমার সব ব্যাপারেই সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এমনটা আমি আর কারো কাছ থেকে পাইনি।
প্রশ্ন : আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
উত্তর : নির্বাচনে জয়ী হবার পর আমার মাথার উপর খুব বড় একটা দায়িত্ব এসে পড়েছে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো যাতে আগামী কয়েক বছর সে দায়িত্বটা আমি যথাযথভাবে পালন করতে পারি। আমার এলাকার মানুষকে সাহায্য করা, তাদের দাবি দাওয়া কুইন্সপার্কে তুলে ধরা, আমার পার্টি লিডারের কাছে তুলে ধরাই হবে আমার এখন মূল লক্ষ্য।
প্রশ্ন : টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিকে নিয়ে বিশেষ কোন পরিকল্পনা আছে কি আপনার?
উত্তর : আমি মনে করি আমাদের অনেক কিছুরই দরকার আছে। আমার শপথ হয়ে যাওয়ার পর আমি আমার কমিউনিটিকে নিয়ে বসবো। তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো কি কি করা দরকার এবং কোন জিনিষটা আগে করা দরকার।
ডলি বেগম সম্পর্কে তার পরিবারের
সদস্যরা কে কি বলেন-
প্রশ্ন : ডলি বিজয়ী হয়েছে এই খবর যখন পেলেন ৭ জুন রাতে তখন আপনাদের মনের অনুভূতিটা কি ছিল?
বাবা – খুব ভাল লেগেছিল। এত ভাল লাগছিল যে এক পর্যায়ে আমি আবেগ সামলাতে না পেরে কাঁদছিলাম।
মা: খুবই ভাল লাগছিল। আল্ল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছি সেই রাতে। মেয়েকেও বলেছি আল্ল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর।
ভাই : খুবই খুশী লাগছিল।
প্রশ্ন : আপনারা কি স্বপ্নেও কখনো ভেবেছিলেন আপনাদের মেয়ে একদিন অন্টারিও পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হবে?
বাবা – আমরা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি আমাদের মেয়ে একদিন এই পর্যায়ে আসবে। আমার এক্সিডেন্টের পর আমার পরিবার একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। কষ্ট ভোগ করছিল নানাভাবে। আমি অর্থাভাবে আমার ছেলে-মেয়েদেরকে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়াতে পারিনি। কিন্তু তারপরও তারা ভাল রেজাল্ট করছিল। ডলি স্কুল থেকে পুরষ্কার পেত। আমার কাছে মনে হতো স্কুল কর্তৃপক্ষ ভুল করে তাকে পুরস্কার দিচ্ছে। কারণ তাকে তো আমরা ঠিক মত লেখা পড়া করাতে পারিনি। এরপর ছিল আমাকে দেখাশুনা করা। এগুলোই করবে না লেখাপড়া করবে? কিন্তু আল্ল্লাহর অশেষ রহমত, এত সংকট আর কষ্টের মধ্য দিয়ে পার হয়েও ডলি আজ এমপিপি নির্বাচিত হয়েছে। সব তার নিজের চেষ্টায় করেছে। আল্ল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।
প্রশ্ন : ডলি যখন ছোট ছিল তখন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনাদের কি পরিকল্পনা ছিল? আপনারাও কি চেয়েছিলেন ডলি বড় হয়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে যেমনটা প্রায় সব বাবা মাই চান?
মা – বড় হয়ে ডাক্তার হতে হবে বা ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এই ধরনের কোন চাপ আমরা কখনোই বাচ্চাদের উপর সৃষ্টি করিনি। আমার বক্তব্য ছিল ওরা যেটা পছন্দ করে সেটাই করুক। কারণ, বাচ্চাদের মন মত কিছু না হলে ওরাতো সে বিষয়ে ভাল করতে পারবে না, সামনে এগুতে পারবে না। আর আমার ছেলে-মেয়েরা একটু বড় হওয়ার পরই আমাদের পরিবারে নেমে আসে এক চরম সংকট। আমার স্বামী দুর্ঘটনা মারাত্মকভাবে আহত হন। ঐ সময় তাকে দেখভাল করবো না বাচ্চাদের দিকে নজর দিব? এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেছি আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা। এবং এটা এক বছর বা দুই বছর সময়ের জন্য নয়। সুদীর্ঘ এক যুগ বা তারো বেশী সময় ধরে একটা চরম সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা সময় অতিক্রান্ত করেছি। আমি আমার সন্তানদের কিছুই দিতে পারিনি। শুধু যেটুকু দিতে পেরেছি তা হলো অফুরন্ত ভালবাসা। (এ সময় একটা আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয় বৈঠকখানায়। চোখ ছল ছল হয়ে উঠে সবার। পাশে বসা ছেলে মহসীন উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষনের জন্য সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে যান।)
পরিস্থিতি সামলে উঠে ডলির মা বলেন, আমি আমার বাচ্চাদেরকে বলতাম, তোমরা যেটা ভাল মনে কর সেটাই কর। কিন্তু যখন বাইরে যাবে তখন বিসমিল্ল্লাহ বলে বের হবে আর মায়ের কথা স্মরণ রাখবে। আর ভাই বোন একজন আরেকজনের হাত ধরে চলবে। একজন ভুল করলে আরেকজন সেটা দেখবে।
প্রশ্ন : ডলি সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হোক, রাজনীতিতে জড়িত হোক এগুলোকি আপনারা চাইতেন? নাকি পছন্দ করতেন না।
মা – আমি পছন্দ করতাম আমার ছেলে-মেয়েরা সামাজিক কর্মকান্ডে জড়িত হোক। আর একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি যে, ছোট বেলা থেকেই ওরা দুই ভাই বোনই লোকজনের সাহায্য এগিয়ে আসতো। হয়তো ওরা দেখতো রাস্তায় কোন বয়স্ক ব্যক্তি হাতে ভাড়ি কিছু বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তখন ওরা এগিয়ে যেত তাকে সাহায্য করার জন্য।
বাবা – ডলি একবার আমাকে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। সেখানে এক অপরিচিত বয়স্ক দম্পতির সঙ্গে দেখা। তারা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন অনেক্ষণ ধরে। ভদ্রলোকের চোখে অপারেশন করা হয়েছিল। ডলি তখন আমাকে হাসপাতালে রেখে ঐ বয়স্ক দম্পতিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে।
মা – আমি যখন ওদের নিয়ে হাসপাতালে যেতাম ওদের বাবাকে দেখার জন্য তখন ওরা আসপাশের অন্যান্য রোগীদের কাছে যেত কারো কোন হেলপ লাগবে কিনা দেখার জন্য। এগুলো করতো তারা নিজেদের ইচ্ছায়ই। আমরা কখনো তাদেরকে বলিনি এরকম করতে।
প্রশ্ন : ডলির শৈশব নিয়ে কিছু বলুন। ও কি খুব দুষ্টুমী করতো? খুব চঞ্চল ছিল? নাকি খুব শান্ত প্রকৃতির ছিল?
মা – ডলি দুষ্টুমি করতো না। খুব শান্ত প্রকৃতির ছিল সে। কিন্তু তার ভাইটি ছিল চঞ্চল। খুব দুষ্টুমি করতো। ডলি একেবারে গ্রেড ওয়ান থেকেই খুব ভাল রেজাল্ট করতো স্কুলে। তখন সে গ্রামের (সিলেটে) এক স্কুলে পড়তো। তার রিজাল্ট দেখে শিক্ষকরা তাকে উপরের ক্লাশে দিয়ে দিতেন। স্কুলে সে বরাবরই পুরষ্কার পেত। কানাডায় এসে সে যখন গ্রেড সিক্স এর ছাত্রী তখন একবার স্কুলে সে ‘স্টুডেন্ট অব দ্যা মান্থ’ পুরস্কার পায়। সেই পুরস্কার বাসায় নিয়ে এসে সে খুব কাঁদছিল। কারণ তার বাবা তখন হাসপাতালে। সে বলছিল, আমি পুরষ্কার পেলাম কিন্তু বাবা দেখতে পারবে না। আমি হাসপাতাল থেকে বাসায় এসে তখন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম এই বলে যে, মা – কেঁদোনা, তোমার বাবা একদিন ভাল হয়ে যাবে। আবার বাসায় আসবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে আবার।
প্রশ্ন : তার মধ্যে নেতৃত্বের কোন গুন বা লক্ষণ কি ছোটবেলায়ই দেখতে পেয়েছিলেন?
মা – হ্যা, ওর যারা খেলার সাথী ছিল ছোটবেলায় তারা তাকে সবসময় লীডার মানতো। আমার বাবাও বলতেন, ডলিকে নিয়ে চিন্তা করো না। দেখবে সে একদিন অনেক বড় কেউ হবে।
ছোটবেলা থেকেই সবাই ওকে খুব পছন্দ করতো।
প্রশ্ন : বাবা মা’র প্রতি ডলি কতটা কর্তব্যপরায়ন?
বাবা – মেয়ে হিসাবে ডলি বাবা-মায়ের প্রতি খুবই যতœবান। সবসময়ই সে আমাদের খোঁজ খবর নেয়।