বাঙ্গালী কমিউনিটির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের একজোট হওয়া প্রয়োজন : সৈয়দ সামছুল আলম

আমার বিশ্বাস কোন নির্বাচনে যদি কমিউনিটি থেকে একজন প্রার্থী হয় তবে ঐ নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে বাঙ্গালী কমিউনিটি এই শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে

আগস্ট ৪, ২০১৮

প্রবাসী কণ্ঠ : সৈয়দ সামছুল আলম একজন সমাজকর্মী, একজন সংগঠক, একজন সফল ব্যবসায়ী। টরন্টোর বাঙ্গালী কমিউনিটিতে তিনি একজন অতি পরিচিত মুখ যাকে সবাই আলম ভাই নামেই চিনেন। প্রতি বছর ড্যানফোর্থে একুশ উদযাপনের যে অনুষ্ঠান হয়, বৈশাখী মেলা ও র‌্যালির যে আয়োজন হয় তার অন্যতম একজন সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক এই আলম ভাই। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ১৯৮১ সালে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন তিনি। ১৯৮৭ সালে চলে আসেন নরওয়েতে স্টুডেন্ট ভিসায়। সেখানে পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট এর উপর ডিপ্লোমা করেন। ডিপ্লোমা করেন বিজনেস বিষয়ের উপরও। এরপর ১৯৯৫ সালে চলে আসেন কানাডায়।

তিনি এবার আসন্ন টরন্টো সিটি নির্বাচনে ৩৯ ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রচার প্রচারণা শুরু করার আগেই হঠাৎ সরে দাড়ান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে।

হঠাৎ কেন তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে সরে দাড়ালেন? এ বিষয়ে জানার জন্য আমরা কথা বলেছি তার সঙ্গে। আরো জানতে চেয়েছি তিনি কিসের টানে বা কিসের তাগিদে কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। আসুন শুনি তার নিজের মুখ থেকেই।

প্রশ্ন : ড্যানফোর্থে নিজ ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি আপনি কমিউনিটি সেবায় একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি। আমরা জানি গত প্রায় দুই দশক ধরে ড্যানফোর্থে ভাষা শহীদ দিবস পালন হয়ে আসছে অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপন করে। ইদানিং পহেলা বৈশাখে ড্যানফোর্থে বর্ণাঢ্য র‌্যালীরও আয়োজন করা হয়ে আসছে। আর আপনি এগুলোর একজন অন্যতম সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক। আপনি এ সকল কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়ালেন কি ভাবে? শুরুর ইতিহাসটা একটু বলবেন কি? এবং কিসের টানে বা তাগিদে আপনি এগুলো করছেন?

উত্তর : বিদেশে আসলে যা হয়। মাতৃভূমির প্রতি একটা আলাদা টান জন্মে তখন। আর বাংলাদেশে থাকা অবস্থায়ও আমি নানান সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম এবং সবসময় চেষ্টা করেছি মানুষের জন্য কাজ করতে। তবে কখনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না সরাসরি। পড়াশুনা শেষে টঙ্গিতে যখন আমি আমার চাচার স্বনামধন্য ন্যাশনাল ইলেকট্রিক কোম্পানীর (NEC) ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম তখন আমি ঐ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের জন্য যে সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছিলাম তা ঐ এলাকার আর কোন ফ্যাক্টরীতে ছিল না। এ কারণে আজো অনেকে সেই সব দিনের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

আমি প্রবাসে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছি। কিন্তু এখনো বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার সাধ্যমত কিছু সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমার স্ত্রীও করেন। সময় সময় আমি আমার ছেলেদের কাছ থেকেও আর্থিক সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশের সেবাকার্যক্রগুলো চালাই।

দুই ছেলে সৈয়দ জাকী আলম ও সৈয়দ রাফী আলম এর সঙ্গে সৈয়দ সামছুল আলম ও মাহমুদা খান

মূলত মাতৃভূমির প্রতি টান ও ভালবাসা থেকেই এগুলো করা। বাংলাদেশ তো আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। সুতরাং সেই দেশের প্রতি তো আমার একটি দায়িত্ব রয়েছে। আমি দেশের সাথে বেঈমানী করতে পারবো না। প্রবাসেও আমি এমন কিছু করবো না যাতে করে বাংলাদেশের কোন বদনাম হয়। আমি অন্যদেরও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি।

আর বিদেশে বাংলাদেশের লোকদেরকে একতাবদ্ধ করারও একটি তাগিদ অনুভব করতাম আমি শুরু থেকেই। আর এটি করতে হলে আমি চিন্তা করে দেখলাম, বাংলাদেশের এমন কিছু বিষয় আছে যার কথা বললে দলমত নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে আসবেন। এর মধ্যে আছে অমর একুশে, বৈশাখী মেলা, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ আরো কিছু বিষয়। বিষয়গুলো আমার চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এর মধ্যে একদিন আমাদের কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় একজন পরিচিত মুখ আবু জুবায়ের দারা এসে বললেন, আলম ভাই আমরা ড্যানফোর্থে শহীদ দিবস পালন করার জন্য একটি অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মান করতে চাই। আপনি যদি আপনার রেস্টুরেন্ট এর পার্কিং লট-টি ব্যবহার করতে দেন তবে খুব ভাল হয়। সেটি ১৯৯৮ সালের কথা। আমি তখন কানাডায় নতুন এসেছি। আমি বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গেলাম। সেই থেকে শুরু। এরপর বিরামহীনভাবে প্রতি বছরই এখানে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হচ্ছে এবং টরন্টোর বাঙ্গালী ভাই-বোনেরা একুশের প্রথম প্রহরে এসে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। মূলধারার রাজনীতিকরা আসেন ভাষা শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে। এখন এই উদ্যোগের সঙ্গে আরো অনেকেই জড়িত। সবার সাহায্য সহযোগিতা নিয়েই আমরা প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানটি করছি।

এ বছর একুশের প্রথম প্রহরে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ড্যানফোর্থে এসেছিলেন সিটি অব টরন্টোর মেয়র জন টরি। আরো এসেছিলেন অত্র এলাকার এমপি নেথানিয়েল আরস্কিন স্মিথ (লিবারেল পার্টি), তৎকালীন এমপিপি আর্থার পট্স (লিবারেল পার্টি) এবং সিটি কাউন্সিলর জেনেট ডেভিস। পার্শ্ববর্তী রাইডিং স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট এর এমপি (বর্তমানে মন্ত্রী)  বিল ব্লেয়ার-ও (লিবারেল পার্টি) এসেছিলেন ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এসেছিলেন সাবেক এমপি ও মন্ত্রী মারিয়া মিন্না। তারা সকলেই পুষ্পার্ঘ অর্পণের আগে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।

স্ত্রী মাহমুদা খান এর সঙ্গে সৈয়দ সামছুল আলম

আমরা গত কয়েক বছর ধরে ড্যানফোর্থে বৈশাখী মেলা এবং র‌্যালীও করে আসছি। বিপুল লোকের সমাগম হয় মেলা ও র‌্যালীতে। বৈশাখী-কে উপলক্ষ করে ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট প্রাঙ্গণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়।

আমাদের ইচ্ছা আছে ‘কানাডা ডে’ এর প্যারেডে নিয়মিত অংশ নেয়ার। অনেক আগে একবার আমরা কয়েকজন অংশ নিয়েছিলাম ঢাক-ঢোল হাতে নিয়ে। কিন্তু তখন তো টরন্টোতে বাংলাদেশীদের সংখ্যা ছিল খুব কম। এখন আমরা অনেক লোক। ইচ্ছে করলে পাঁচ শ বা হাজার লোকও আমরা প্যারেডে অংশ নিতে পারি। তাহলে মূলধারায় জানান দেয়া হবে যে আমরাও এখানে আছি। আর বাংলাদেশের নাম যেহেতু এ্যালফাবেটিক্যালী প্রথম দিকে রয়েছে তাই শুরুর দিকেই আমাদের নাম উচ্চারিত হবে।

প্রশ্ন : আপনারা প্রতি বছর ড্যানফোর্থে একটা অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মান করে একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করেন। কিন্তু একটা স্থায়ী শহীদ মিনার নেই টরন্টোতে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

উত্তর : টরন্টোতে আমাদের একটা স্থায়ী শহীদ মিনার আসলেই ভীষন দরকার। পৃথিবীর কয়েকটি দেশে ইতিমধ্যেই স্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে। উল্ল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে আছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও বৃটেন। আমাদের এখানেও এটা দরকার। চেষ্টা চলছে। হয়তো অচিরেই হয়ে যাবে।

প্রশ্ন : আপনিতো ড্যানফোর্থে সবচেয়ে পুরাতন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। গত প্রায় ২৩ বছর ধরে এই এলাকায় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত সফলভাবে চালিয়ে আসছেন। এই সাফল্য লাভের পিছনে রহস্য কি?

উত্তর : সবচেয়ে বড় কথা হলো ধৈর্য। প্রচন্ড ধৈর্য। যে কোন কাজে সাফল্য পেতে হলে এই ধৈর্য থাকতে হবে। আর যার সাহায্য সহযোগিতা না পেলে আমি কিছুই করতে পারতাম না তিনি হলেন আমার স্ত্রী। তার চিন্তা-ভাবনাই এর পিছনে মূলত কাজ করছে। শুধু এই ব্যবসায়ই নয়, তিনি বাংলাদেশে থাকা অবস্থায়ও আমাকে নানান ভাবে সাহায্য সহযোগিতা ও উৎসাহ যুগিয়েছেন।

প্রশ্ন : আপনি আসন্ন সিটি নির্বাচনে ৩৯ ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু

হঠাৎ আবার থেমে গেলেন। কারণটা কি? আর শুরুই যখন করেছিলেন, আরো আগে কেন তা করেননি?

উত্তর : কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে আরো আগে চিন্তা ভাবনা করিনি কারণ, এ দেশে আসার পর প্রথমে তো নিজের পায়ে দাড়াতে হবে। তখন ছেলেরা ছোট ছিল। সংসার গুছানোর ব্যাপার ছিল। এরপর ব্যবসায় নামলাম। প্রচুর সময় ব্যয় করতে হতো ব্যবসার পিছনে। তারপর ধীরে ধীরে এর উন্নতী ঘটলো। মোটামুটি একটা স্টেবল পজিশনে চলে আসলাম আমি ও আমার স্ত্রী। কমিউনিটিতে এর পরিচিতি ঘটলো।

ইতিমধ্যে দেখলাম ছেলেরাও বড় হয়েছে। তখনই ভাবলাম এবার কমিউনিটিতে আরো বেশী সময় দেয়া যাবে। তখনই কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টি চিন্তায় আসে। আর মূলত বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে আমি আগে থেকেই জড়িত ছিলাম।

তাছাড়া আগেতো এখানে বাংলাদেশী কমিউনিটিও ছিল ছোট। লোকজন তেমন ছিল না। এখন তো অনকে লোকজন হয়েছে কমিউনিটিতে। ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে বাঙ্গালী ভোটারের সংখ্যাও এখন অনেক। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। এ কারণেই একটা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম।

প্রশ্ন : এমপিপি বা এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে কাউন্সিলর পদে কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? এমপি বা এমপিপি পদে জয় লাভ করাতো কাউন্সিলর পদ থেকে অনেক সহজ।

উত্তর : হ্যা এটি সত্যি যে কাউন্সিলর পদ থেকে এমপি বা এমপিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তুলনামুলকভাবে অনেক সহজ। কারণ, তখন দলীয় সমর্থন থাকে। দলীয় সমর্থন থাকায় দলের ভোটগুলো পাওয়া যায়। কিন্তু কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় সম্পূর্ণ নিজের পরিচয়ে। নিজের যোগ্যতায়।

আমার চিন্তাটা ছিল, আগে তো নিজের একটা ভিত তৈরী করতে হবে। আমাদের একটা স্বভাব হলো, আমরা মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাই না। আমি কানাডায় আসার পর থেকেই লিবারেল পার্টির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমি দেখলাম, বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকায় যে সকল এমপি বা এমপিপি আছেন তারা কেউ কেউ বহু বছর ধরেই ঐ পদ দখল করে আছেন, অথবা যথেষ্ট প্রভাবশালী তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায়। ওখানে তাদেরকে বিট করে নমিনেশন পাওয়াটাই কঠিন। যেমনটা আমরা বাংলাদেশেও দেখি। বড় দলের নমিনেশন পাওয়াটা কঠিন সেখানেও। সে কারণেই আমি নিচে থেকে শুরু করার পরিকল্পনা নেই। তাছাড়া এখন বয়সও হয়ে গেছে। কানাডায় যখন আমি আসি তখনই আমি চল্ল্লিশোর্ধ। ইতিমধ্যে প্রায় কোয়ার্টার সেঞ্চুরী পার করে ফেলেছি কানাডায়। আরো কম বয়সে আসলে হয়তো এমপি বা এমপিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চিন্তাভাবনা করা যেত।

আরেকটা বিষয় হলো, কমিউনিটির বিভিন্ন কাজের বিষয়ে আমাদেরকে সবসময় কাউন্সিলদের কাছেই যেতে হয়। বাড়ীঘর, ব্যবসা থেকে শুরু করে কমিউনিটি ইভেন্ট ইত্যাদি সব বিষয়েই আমরা কাউন্সিলর নির্ভর। কাউন্সিলর এর অনুমতি ছাড়া অনেক কিছুই আমরা করতে পারি না। রাস্তার অনুমতি, খোলা জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুমতি, মাঠের অনুমতি এগুলো সবকিছুতেই কাউন্সিলর এর কাছে যেতে হয়। কিন্তু টরন্টোতে আমাদের কমিউনিটি থেকে নির্বাচিত কোন কাউন্সিলর নেই। আমি যে এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো ভেবেছিলাম সেই এলাকার কাউন্সিলর মিশেল হলান্ড, যিনি গত ৮ বছর ধরেই ঐ এলাকা দায়িত্বে আছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কাছ থেকে আমরা কোন সহযোগিতাই পাইনি। গত আট বছরে তাকে অনেকবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি,কোন অনুষ্ঠানেই আসেন নি। এমনকি আসবেন না এ কথা জানানোরও প্রয়োজনবোধ করেন নি।

এ সমস্ত কারণেই ভেবেছিলাম কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো।

আর অভূতপূর্ব সাড়াও পেয়েছিলাম বাংলাদেশী কমিউনিটি থেকে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়ার আগে আমি কমিউটির যারা নেতৃবৃন্দ আছেন, যারা মিডিয়ার সঙ্গে আছেন এবং ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ যারা আছেন তাদের সঙ্গে বসেছি। তাদের পরামর্শ নিয়েছি। তারা সবাই আমাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। আর সবচেয়ে বড় যে সমর্থন অর্থাৎ ঘরের সমর্থন, সেটিও আমি পেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী এবং সন্তানদেরও সমর্থন ছিল।

আমি মূলধারার রাজনীতির সাথে দীর্ঘ দিন ধরে জড়িত। বিচেস-ইষ্টইয়র্ক ফেডারেল লিবারেল এসোসিয়েশনের একজন ডাইরেক্টর হিসাবে বিগত কয়েক বৎসর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছি। প্রতি বছর একুশে উদযাপন থেকে শুরু করে, বাংলা নববর্ষ পালন সহ কমিউনিটির বৃহত্তর স্বার্থে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত থাকি। যতটুকু সম্ভব, আমি আমার কমিউনিটির জন্য কাজ করেছি, এখনো করছি এবং ভবিষ্যতেও করতে চেষ্টা করবো।

এই সামাজিক কর্মকান্ড সহ বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত থাকার জন্যই, অনেকের অনুরোধে আমি এবার কাউন্সিলার পদের জন্য প্রার্থী হয়েছিলাম। যাদের উৎসাহে ও অনুরোধে আমি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তাঁদের সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা।

কিন্তু পরে সমস্যা দেখা দিল যখন দেখলাম একই ওয়ার্ড থেকে পাঁচজন বাংলাদেশী ক্যান্ডিডেট হয়ে গেলেন। মোট ক্যান্ডিডেট হলেন নয় জন। তার মধ্যে পাঁচজনই বাংলাদেশী। পরে বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ বিষয়টি নিয়ে সব ক্যান্ডিডেটের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি। আমার বিশ্বাস ও আশা ছিল, সবাই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আমাদের বাঙ্গালী কমিউনিটি থেকে একজন প্রার্থীই কাউন্সিলর পদের জন্য নির্বাচন করবেন এবং সবার সহযোগিতা নিয়ে জয় লাভ করতে পারবেন। কিন্তু সেটি আর হয়ে উঠেনি।

আসলে আমাদের প্রয়োজন বাঙ্গালী কমিউনিটির বৃহত্তর স্বার্থে সবাই মিলে একজোট হওয়া, কমিউনিটি থেকে একজন নির্বাচন করা এবং মনে রাখতে হবে – এই সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার কোন বিকল্প নেই।

বিভিন্নদিক বিবেচনা ও পর্যালোচনা করেই আমি পরে আমার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছি।

আমার প্রত্যাশা একটাই- বাঙ্গালী কমিউনিটি থেকে একজন প্রার্থী হোক, যার জন্য আমরা সবাই মিলে কাজ করবো। যদি একজন প্রার্থী হয়, আমার বিশ্বাস সকল নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে বাঙ্গালী কমিউনিটি এই শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। যেমনটা হয়েছে এবারের প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনে ডলি বেগম এর ক্ষেত্রে।

প্রশ্ন : এবার একটু আপনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। কানাডা এসে দেশটি সম্পর্কে সর্বপ্রথম অনুভূতি কি হয়েছিল আপনার?

উত্তর : আমি সরাসরি বাংলাদেশ থেকে কানাডায় আসিনি। মাঝখানে প্রায় ৫ বছর নরওয়েতে ছিলাম স্টুডেন্ট হিসাবে। সেখানে সবকিছুই ভাল লেগেছিল। শুধু ভাষাটা ছিল ভিন্ন। আর যখন কোন জনসমক্ষে যেতাম বা বাসে চড়তাম তখন নিজেকে কেমন একা মনে হতো। কারণ আমার চারপাশেই দেখতাম সব শ্বেত বর্ণের মানুষ। কেবল আমিই বাদামী। আমার সহপাঠীরাও আমাকে মাঝে মধ্যে জিজ্ঞেস করতো কবে দেশে ফিরে যাব। কিন্তু কানাডায় আসার পর দেখলাম ভিন্ন এক চিত্র। এখানে আসার পর কখনো মনে হয়নি যে আমি বিচ্ছিন্ন কেউ। মনে হতো আমি নিজের দেশেই আছি। সমস্ত দেশটাই মনে হতো আমার। এখানে সবারই সমান অধিকার। সেই ভাল লাগার অনুভূতি আমার এখনো আছে।

প্রশ্ন : কানাডায় কখনো বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলন কি?

উত্তর : আমি ব্যক্তিগত ভাবে কখনো এরকম পরিস্থিতির শিকার হইনি।

হ্যা, বর্ণবাদ বা বৈষম্য কিছুটা আছে এই দেশটিতে। কিন্তু সেটা নেই কোথায়? আমরা বাঙ্গালীরাও কি কম বর্ণবাদী? আমরা এক জেলার লোক আরেক জেলার লোকদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করি সুযোগ পেলেই।

এ সব বিবেচনা করলে আমি বলবো কানাডায় ওভারঅল আমরা অনেক ভাল আছি। কানাডা ইজ দ্যা বেস্ট কান্ট্রি ইন ওয়াল্ড টু লিভ ইন।

প্রশ্ন : টরন্টো এসে প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা কি হয়েছিল?

উত্তর : তিক্ত অভিজ্ঞতা একটা হয়েছিল। আমি যখন নরওয়েতে ছিলাম তখন দেখেছি সেখানে যখন তখন হায়ারিং ফায়ারিং এর বিষয়টি ছিল না। এমনকি পার্টটাইম জবেও না। আমি সেখানে স্টুডেন্ট অবস্থায় পার্টটাইম জব করেছি। জবে হায়ারিং হলে সেটা পার্মানেন্টই হতো। কিন্তু কানাডায় এসে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। এখানে কাজ থেকে যখন তখন ফায়ার করে দেয়ার রীতি চালু আছে। আর আমি

যখন কানাডায় আসি তখন এখানে একটা রিসেশন চলছিল। চাকরী পাওয়াও খুব কঠিন ছিল। তার মধ্যে আবার যখন তখন ফায়ার। বিষয়টি আমার কাছে ভাল লাগেনি। এটা একটা তিক্ত অভিজ্ঞতাই ছিল আমার জন্য।

এই যখন তখন ফায়ারিং এর অমর্যাদাকর যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকতে তখন ব্যবসা করার কথা ভাবতে লাগলাম। সুযোগও আসলো একটা। ঐ সময় ড্যানফোর্থে আনারকলি নামে একটি ভিডিও স্টোর ছিল এক পাকিস্তানির। সেটা বিক্রি করে দেয়ার জন্য ক্রেতার সন্ধানে ছিল সেই ব্যক্তি। খবর পেয়ে আমি তার সঙ্গে কথা বললাম এবং সেটি কিনে নিলাম। আজকে ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট যে ভবনটিতে আছে সেখানেই ছিল ঐ ভিডিও স্টোরটি। পরবর্তীতে আমি এর নাম দিয়েছিলাম প্রিয়াঙ্গণ। এখনো অনেকে ঐ প্রিয়াঙ্গণ নামটিই উচ্চারণ করেন। বাঙ্গালীদের প্রিয় প্রধান আড্ডার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল প্রিয়াঙ্গণ এর প্রাঙ্গণটি সেই ২০/২২ বছর আগেই। আর আজো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ড্যানফোর্থের সেদিনের প্রিয়াঙ্গণ আর আজকের ঘরোয়া এখনো টরন্টো প্রবাসী বাঙ্গালীদের আড্ডার প্রধান কেন্দ্র। বৈশাখী র‌্যালি, একুশের প্রথম প্রহরে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসহ আরো অনেক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু এখন ঘরোয়া প্রাঙ্গণ।

প্রশ্ন : পরিচয় সংকট (আইডিয়েন্টি ক্রাইসিস) নিয়ে কোন সমস্যায় পড়তে হয়েছিল কি?

উত্তর : না, পরিচয় সংকটে আমি কখনো ভুগিনি কানাডায় এসে। আর আমি যখনই যে সমাজে চলেছি, সেই সমাজের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করি। আমি সবসময় চেষ্টা করি মূলধারার লোকদের সঙ্গে কথা বলতে। অন্য কমিউনিটির কাছে আমাদের কমিউনিটির ভাল জিনিষগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমার অনেক বন্ধু আছে ইটালিয়ান ও গ্রীক কমিউনিটিতে।

প্রশ্ন : যে আশা নিয়ে কানাডায় এসেছিলেন বাস্তবতার সঙ্গে তার কোন মিল খুঁজে পেয়েছিলেন কি?

উত্তর : আমার উচ্চাকাংখা বলে কিছু নেই। অর্থনৈতিকভাবেও না বা অন্য কোন ভাবেও না। সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক রেখে জীবন চালানোই আমার ব্রত। কমিউনিটির সবার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক আছে এটা আমার একটা সুখের বিষয়। আর আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে খুব সুখে আছি। এটাই আমার জীবনে বড় পাওয়া। আমি যে কোন পরিস্থিতির সঙ্গে এ্যাডজাস্ট করে চলতে পারি। এ জন্য আমার কোন অভিযোগও নেই কোন কিছুর ব্যাপারে।

প্রশ্ন : আপনার স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলুন। কানাডায় আপনার সাফল্যের পিছনে আপনার স্ত্রীর অবদান কি?

উত্তর : আমার স্ত্রী মাহমুদা খান ঢাকার একটি খুব খানদানী পরিবারের মেয়ে। এক নামেই পুরানো ঢাকার লোকেরা চিনেন এই পরিবারকে। তারা ৬ ভাই এক বোন। পুরানো ঢাকার রায় সাহেব বাজারের খান ম্যানশন এ তাদের বাড়ি। আমার শ্বশুর গত হয়েছেন অনেক আগেই। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আমার বিদেশে আসা হতো না। কারণ, আমার স্ত্রী তার একমাত্র মেয়ে। তার কাছে খুব আদরের ছিলেন তিনি।

কিন্তু আমার স্ত্রী ধনির দুলালী হলেও খুব পরিশ্রমী নারী। এখানে এসেও তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে চাইল্ড কেয়ারের উপর ডিপ্লোমা করেছেন। চাকরীও করেছেন ঐ লাইনে প্রায় ১৩ বছর। পাশাপাশি ছেলেদের টেককেয়ার করেছেন, চাকরীর পর আমাদের ব্যবসায়ও সময় দিয়েছেন। এখন অবশ্য ফুলটাইম ব্যবসায়তেই সময় দিচ্ছেন। যদিও প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, আমাদের এখন পর্যাপ্ত স্টাফ রয়েছে রেস্টুরেন্টে।

আমি বলবো এই ব্যবসা দাড় করানোর পিছনে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তার।

প্রশ্ন : আপনার ছেলেরা কে কি করছেন বর্তমানে?

উত্তর : আমাদের দুই ছেলে। বড়জন সৈয়দ জাকী আলম। বর্তমানে পিএইচডি করছে ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং এ। পাশাপাশি এনব্রিজ এ রিক্স কনসালটেন্ট হিসাবে জবও করছে। ছোটজন সৈয়দ রাফী আলম। টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেস এ পাস করে বেরিয়েছে। বর্তমানে একটি পার্টটাইম জব করছে।

প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় মনে আপনি বাংলাদেশের তুলনায় কানাডায়ই ভাল আছেন? কেন মনে হয় এ কথা?

উত্তর : বাংলাদেশের তুলনা ভাল তো অবশ্যই আছি। এর পিছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন এখানে যারা মূলধারার লোক তারা অন্তত মিথ্যা বলেনা। যেমনটা বলে না এখানে আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও। এখানে আমরা বিনা পয়সায় ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে পারি, প্রয়োজনে লোন নিয়ে লেখাপড়া শিখাতে পারি। আমি কাজ না করতে পারলে আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে সরকার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে সরকার, দুষণমুক্ত পরিবেশ পাচ্ছি, দুষণমুক্ত পানি পাচ্ছি। এই সব বিবেচনায় আনলে বাংলাদেশের তুলনায় অবশ্যই ভাল আছি কানাডায়। তবে আমি বাংলাদেশকে দোষ দিচ্ছি না। দেশ তো দেশই। দেশ আমাকে অনক কিছু দিয়েছে। আমি দেশের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু সেখানে মানুষ বেশী হয়ে গেছে। সেখানকার সিস্টমটা কলুষিত হয়ে আছে। কেউ আইন মানে না।

অনেকে হয়তো আমাকে স্বার্থপর ভাবতে পারেন। কারণ আমি ভাল থাকার জন্য বিদেশে চলে এসেছি। সেই অর্থে আমি স্বার্থপরই বলতে পারেন। আমি আমার মা (বাবা গত হয়েছেন অনেক আগেই) এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের দিকে তাকাইনি। নিজের এবং ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চলে এসেছি। এ কারণে আমার মধ্য একটা অপরাধবোধ কাজ করে এখনো।

সবশেষে বলবো- কানাডায় ভাল আছি এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য, মনটা সবসময় পড়ে থাকে বাংলাদেশে।