কানাডার শ্রমবাজারে দক্ষ অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্য

এদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছেন এবং স্থানীয়দের চেয়ে মজুরিও কম পাচ্ছেন

অগাস্ট ৪, ২০১৮

ফিলিপ ওরেওপোলাস : কানাডার শ্রমবাজারে কাজ পাওয়ার জন্য সংগ্রামরত দক্ষ অভিবাসীদের উল্লেখযোগ্য অংশ বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছেন এবং স্থানীয়দের চেয়ে মজুরিও কম পাচ্ছেন। গবেষকরা দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাই করা হাজার হাজার জীবনবৃত্তান্ত ঘেঁটে দেখেছেন যে, বিদেশি দক্ষ ব্যক্তি যাদের নামের মধ্যে বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় স্পষ্ট চাকরিদাতারা তাদেরকে খুব কমই সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকেন। বিদেশি নামের চেয়ে ইংরেজি নামের লোকদেরকে বেশি করে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতার কারণে বিদেশিদের নিয়োগের জন্য ডেকে নেওয়ার পরিমাণ বাড়লেও তা ইংরেজি নামবিশিষ্ট লোকদের চেয়ে কম।

দক্ষ অভিবাসীদের উল্লেখযোগ্য অংশ বেকারত্বের অভিশাপে ভুগছেন। জবফেয়ারে ঘুড়েও চাকরী মিলেনা অধিকাংশের। ছবি : রিহহরঢ়বম.ররনধ.ড়ৎম । প্রচ্ছদে ব্যবহৃত মডেল ছবি অনলাইন থেকে নেয়া

নীতিগত বিষয়

জাতীয়তা এবং জাতিগত পরিচয় সারা বিশ্বেই চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে। নিয়োগদাতা যখন কোনও একটি পদের জন্য প্রার্থীদের ইন্টারভিউতে ডাকার সিদ্ধান্ত নেন তখন আবেদনকারীর জীবনবৃত্তান্তের দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলোও অজানা তথ্যের ইঙ্গিতবহ হতে পারে। যেমন, আবেদনকারী কোন্ দেশে শিক্ষা গ্রহণ করেছে সেই তথ্য থেকে অথবা তার নাম থেকেও নিয়োগদাতা তার ভাষাগত দক্ষতা, কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনুমানভিত্তিক ধারণা তৈরি করে নিতে পারেন। বিশেষ কোনও দেশের বা জাতিগত পরিচয়ের কোনও কর্মচারী সম্পর্কে আগের অভিজ্ঞতা থেকে বা নেহায়েত সংস্কারের কারণেও নিয়োগদাতারা সচেতন বা অসচেতনভাবে চাকরিপ্রার্থীর প্রতি বৈষম্য করতে পারেন। আগের এক জরিপে জে-পল-এর সঙ্গে জড়িত (J-PAL affiliated) অধ্যাপকরা দেখতে পান যে, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ও শিকাগোতে শ্বেতাঙ্গ ধাঁচের নামধারীরা কৃষ্ণাঙ্গ ধাঁচের নামধারী চাকরি প্রার্থীদের চেয়ে শতকরা ৫০ ভাগ বেশি ইন্টারভিউর ডাক পেয়েছেন। কানাডায় দক্ষ অভিবাসীরাও চাকরির জন্য রীতিমত সংগ্রাম করছেন। এ ক্ষেত্রে অভিবাসীরা কতটা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে এবং ভিন্নতর কাজের অভিজ্ঞতা বা ভাষাগত দক্ষতা সেই বৈষম্যের পরিমাণ কিছুটা লাঘব করতে পারে কিনা সে সম্পর্কিত কোনও প্রমাণ অবশ্য নেই।

মূল্যায়নের অনুষঙ্গ

কানাডার অভিবাসন নীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি জোরদার করার লক্ষ্যে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের আকৃষ্ট করার প্রয়াস হিসাবে শ্রমঘন শিল্পে উচ্চতর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অভিবাসীদের অনুকূলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কানাডায় আসা অভিবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি এসেছেন পয়েন্ট-বণ্টন পদ্ধতির আওতায়। এই পদ্ধতিতে আবেদনকারীর শিক্ষা, বয়স, কাজের অভিজ্ঞতা এবং ভাষাগত দক্ষতার মত বিষয়ের ভিত্তিতে তার মূল্যায়ন করা হয়। এসব অভিবাসীর বেশিরভাগই এসেছেন চীন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে। এই পয়েন্ট-বণ্টন পদ্ধতির আওতায় আসা অভিবাসীদের বেশিরভাগেরই অন্ততপক্ষে আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি রয়েছে। তার পরও সম্প্রতি আসা অভিবাসীরা কানাডায় জন্মগ্রহণকারীদের তাদের সমবয়সী চাকরিপ্রার্থীদের চেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যায় বেকারত্বের শিকার হচ্ছেন। একই মানের ডিগ্রি নিয়েও অভিবাসীরা একই বয়সের স্থানীয়দের চেয়ে ৪৮ শতাংশ কম বেতন পাচ্ছেন। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে, নিয়োগদাতারা কানাডার শিক্ষা ও কাজের অভিজ্ঞতাকে বিদেশের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার চেয়ে বেশি মূল্য দেন। নিয়োগদাতারা হয়তো এমনও আশঙ্কা করেন যে, নবাগত অভিবাসীদের ভাষার ওপর তেমন দক্ষতা নেই। তারা হয়তো সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত প্রার্থক্যের বিষয়টিও মাথায় রাখেন এবং সেজন্যই অভিবাসী চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি সচেতন বা অসচেতনভাবে বৈষম্য করেন।

অনুসন্ধানের বিস্তারিত

কানাডার শ্রমবাজারে দক্ষ অভিবাসীদেরকে যে কারণে চাকরির জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে তার ব্যাখ্যা হিসাবে নিয়োগদাতাদের বৈষম্য সৃষ্টির বিষয়টির কতটা ভূমিকা আছে গবেষকরা সেটি পরীক্ষা করেছেন। তারা টরন্টো ও মন্ট্রিয়েলে তিন থেকে সাত বছরের অভিজ্ঞতা এবং অন্তত একটি আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রিসম্পন্ন চারকিপ্রার্থীদের মধ্য থেকে নিয়োগ পাওয়া হাজার হাজার আবেদনপত্র দৈবচয়নের ভিত্তিতে বাছাই করে সেগুলো পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ আবেদনকারীর নাম ছিলো ইংরেজি ধাঁচের (যেমন এমিলি উইলসন বা জন মার্টিন), আর বাকীগুলো ছিলো চীনা, ভারতীয়, পাকিস্তানী ও গ্রিক নামধারীদের। শিক্ষা ও কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে চাকরিদাতাদের ধারণা কেমন তা পরীক্ষা করার জন্য গবেষকরা বিদেশি নাম এবং কানাডা বা বিদেশের গ্রাজুয়েট ডিগ্রি অথবা কানাডা বা বিদেশের কর্মঅভিজ্ঞতা রয়েছে এমন কতগুলি জীবন-বৃত্তান্ত বাছাই করে পরীক্ষা করেন। দৈবচয়নের ভিত্তিত আরও কিছু জীবন-বৃত্তান্ত বেছে নেওয়া হয় অন্যান্য তথ্য যেমন ভাষার দক্ষতা, কোনও মর্যাদাবান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রি, কোনও সম্মানজনক বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজের অভিজ্ঞতা অথবা গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারী প্রার্থীদের অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য। প্রার্থীর জাতিগত পরিচয় এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো চাকরিদাতাদেরকে ইন্টারভিউ কার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে কতটা প্রভাবিত করেছে সেই বিষয়টি অনুধাবনের জন্য গবেষকরা কোন্ ধরণের জীবনবৃত্তান্তের প্রার্থীদেরকে কতটা ইন্টারভিউ কার্ড পাঠানো হয়েছে সেটাও তুলনামূলক বিচার করে দেখেছেন। পরে তারা একইরকম দৈবচয়নের ভিত্তিতে কিছু নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জাতিগত পরিচয় স্পষ্ট এমন নামধারী প্রার্থীদের প্রতি বৈষম্যের সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধানের জন্য গবেষকরা এই পদক্ষেপ নেন।

ফলাফল এবং নীতিগত শিক্ষা

গবেষকরা বিদেশি নামধারী চাকরিপ্রার্থীদের প্রতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৈষম্যের প্রমাণ পেয়েছেন। কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অভিবাসী প্রার্থীদের ইন্টারভিউ কার্ড পাঠানোর পরিমাণ বেড়েছে বলেও তারা দেখতে পেয়েছেন।

কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতার কারণে বিদেশে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ইন্টারভিউ কার্ড পাঠানোর পরিমাণও বেড়েছে। ভারত, পাকিস্তান বা চীনা নামধারী এবং বিদেশে শিক্ষা গ্রহণকারী যেসব চাকরিপ্রার্থীর কানাডায় কাজের অভিজ্ঞতা আছে তাদের ক্ষেত্রেও ইন্টারভিউতে ডাকার পরিমাণ ৫.১ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে। কানাডায় শিক্ষাগ্রহণের কারণে আবেদনকারীকে ইন্টারভিউতে ডাকা হবে এমন সম্ভাবনার ক্ষেত্রে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।

এমনকি কানাডায় আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং এদেশেই কাজের অভিজ্ঞতা আছে এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও শুধু নামের কারণে নিয়োগদাতারা ব্যাপকভাবে বৈষম্য করেছেন। কোনও জীবন-বৃত্তান্ত থেকে কেবল ইংরেজি ধাঁচের নাম পাল্টে ভারতীয়, পাকিস্তানী বা চীনা নাম বসিয়ে দিলেই চাকরির ইন্টারভিউতে ডাকার সম্ভাবনা ৪.৪ শতাংশ পয়েন্ট বা ২৮ শতাংশ কমে যেতে পারে। কানাডায় শিক্ষালাভ এবং কাজের অভিজ্ঞতা থাকার পরও বিদেশি নামধারী চাকরিপ্রার্থীরা যদি একাধিক ভাষায় অনর্গল কথা বলতে সক্ষম হন, কোনও ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে থাকেন বা মাস্টার্স ডিগ্রি করে থাকেন তবুও তাদের চাকরির ইন্টারভিউতে ডাকার হার বাড়ে না।

একটি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের ফলো-আপ জরিপে অংশ নিয়ে নিয়োগদাতারা অভিমত দিয়েছেন যে, ভাষাগত দক্ষতা নিয়ে শঙ্কার কারণেই ইন্টারভিউতে ডাকার হার কম হয়ে থাকতে পারে। অবশ্য সার্বিক মূল্যায়নে দেখা গেছে যে, ওটা ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার দিকেই ইঙ্গিত করে কারণ একাধিক ভাষায়

অনর্গল কথা বলতে পারার মত দক্ষতা থাকলেও বিদেশি নামধারী প্রার্থীদের চাকরির ইন্টারভিউতে ডাকার হার বাড়ে না। চাকরিদাতারা প্রার্থীদের জীবন-বৃত্তান্তে উল্লেখিত আরও যেসব বৈশিষ্ট্য ভাষাগত দক্ষতার বিষয়টিকে গৌন করে দিতে পারে সেগুলোর প্রতি মনোযোগ না দিয়ে কেবল ভাষার ওপর দক্ষতার বিষয়ে তাদের উদ্বেগকেই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছেন।

এ ধরণের বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য নিয়োগদাতারা কিছু সহজ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। আবেদনপত্রে উল্লেখিত প্রার্থীর নামটি উহ্য রাখলেই কর্মচারীদের জন্য পক্ষপাতহীনভাবে ইন্টারভিউ কার্ড পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতে পারে। চাকরিদাতারা এটাও ভেবে দেখতে পারেন যে, কোনও প্রার্থীর ভাষাগত দক্ষতা জানার জন্য সামান্য খরচ করে তাকে একটি ফোন কল দেওয়াই যথেষ্ট। – সূত্র : www.povertyactionlab.org