অন্টারিওর নির্বাচন : কে আসছেন ক্ষমতায়?
জরীপ বলছে পিসি পার্টির সম্ভাবনা অনেক বেশী : কিন্তু অতীত রেকর্ড বলছে জরীপ ফলাফল সবসময় ঠিক হয় না : শেষ মূহুর্তে পরিস্থিতি বদলেও যেতে পারে
মে ৫, ২০১৮
খুরশিদ আলম : অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৭ জুন। সময়ের হিসাবে আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকী। কিন্তু এই নির্বাচনে কে জয়ী হবে আর কে পরাজিত হবে তা নিয়ে জোর জল্পনা কল্পনা শুরু হয়েছে আরো বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই। পাশাপাশি পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন জরীপ প্রতিষ্ঠানের জরীপ কার্যক্রম। আর ঐ সব জরীপ ফলাফলে যা দেখা যাচ্ছে তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে অন্টারিওতে বর্তমান ক্ষমতাসীন লিবারেল দলের ভরাডুবি হবে।
উল্ল্লেখ্য যে, লিবারেল পার্টি অন্টারিওতে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সরকার পরিচালনা করে আসছে। গত নির্বাচনেও এই দলটি ক্যাথলিন উইন এর নেতৃত্বে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু গত চার বছরে এমন কি ঘটে গেলে যে এই দলটির জনপ্রিয়তা এখন এমন তলানিতে এসে ঠেকেছে?
এই প্রতিবেদন তৈরী করার সময় (এপ্রিল ৩০) সর্বশেষ যে নির্বাচনী জরীপ আমরা দেখতে পাই তাতে বলা হচ্ছে প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা এখন ৪৩%। অন্যদিকে লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তা নামতে নামতে ২৬.৬% এ চলে এসেছে। এনডিপি’র জনপ্রিয়তা লিবারেল থেকে সামান্য কম – ২৩.৩%।
উপরের হিসাবটি কোন একক জরীপ প্রতিষ্ঠানের নয়। বিভিন্ন জরীপ প্রতিষ্ঠানের করা জরীপের গড় হিসাব এটি, যা তৈরী করেছে সিবিসি নিউজ এর পুল ট্রাকার। আর এতে স্পষ্টই প্রতিয়মান হচ্ছে যে আসন্ন নির্বাচনে ড্যগ ফোর্ড এর নেতৃত্বাধিন প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে।
অবশ্য প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টিকে একটি বড় ধরণের সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে কিছুদিন আগে যখন যৌন হয়রানীর অভিযোগে এই দলটির সাবেক নেতা প্যাট্রিক ব্রাউনকে পদত্যাগ করতে হয়। শুধু দলের নেতা নয়, এই দলের প্রেসিডেন্ট রিক ডাইকস্ট্রা-কেও পদত্যাগ করতে হয় একই অভিযোগে। রিক ডাইকস্ট্রা অন্টারিও প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন ২০১৬ সাল থেকে। তার আগে তিনি সেইন্ট ক্যাথেরিন থেকে নির্বাচিত এমপি ছিলেন ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত।
অন্যদিকে প্যাট্রিক ব্রাউন ছিলেন অন্টারিও প্রভিন্সের প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও সংসদে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা। ইতিপূর্বে তিনি ফেডারেল পার্লামেন্টেরও এমপি ছিলেন। ঐ সময়টাতেই নাকি তিনি যৌন নির্যাতন এর ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। দুই নারী এই অভিযোগ তুলেন। সিটিভি নিউজের এক খবরে এই তথ্য প্রকাশিত হয়।
অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার আগে অন্টারওি প্রভিন্সের আসন্ন নির্বাচনে তার তার জয়ী হওয়ার সম্ভানাই ছিল বেশী। অর্থাৎ তিনিই সম্ভবত হতে যাচ্ছিলেন অন্টারিওর পরবর্তী প্রিমিয়ার।
কিন্তু রাতারাতি সে সম্ভাবনার চিত্র পাল্টে যায়। প্রথমে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ অস্বীকার করেন। ঐ সময় প্রায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল তার। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেই সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নের জাবব না দিয়েই। কিন্তু এর ঘন্টাখানেক পরই তিনি দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে তিনি তার এমপিপি (মেম্বার অব প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্ট) পদ থেকে সড়ে দাড়াননি।
প্যাট্রিক অবশ্য সিটিভি নিউজের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছেন ইতিমধ্যে। তবে যৌন হয়রানী বা নির্যাতন যেটাই হয়ে থাকুক বা না হয়ে থাকুক সেটা প্রমাণিত হতে সময় লাগবে। কিন্তু প্যাট্রিক ব্রাউনের সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে।
একটি দলের দুই শীর্ষ নেতাকেই যখন নির্বাচনের মাত্র কয়েকমাস আগে যৌন হয়রানী করার চরম শরমের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হয় তখন দলের ভবিষ্যত নিয়েও চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। এবং হয়েছিলও তাই। অনেকেই তখন ভেবেছিলেন প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টি কর্তৃক ক্ষমতায় আসার সকল পথ বন্ধ করে দিয়ে বিদায় হয়েছেন দলের দুই শীর্ষ নেতা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, দলটির জনপ্রিয়তা একবিন্দুও কমেনি, বরং নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, তাদের জনপ্রিয়তাও যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্তত জরীপ তথ্যে সেরকমই প্রতীয়মান হচ্ছে। এমনকি আরেক বিতর্কিত ব্যক্তি ড্যগ ফোর্ড দলের প্রধান নেতা নির্বাচিত হওয়ার পরও।
ড্যগ ফোর্ডের বিরুদ্ধে অবশ্য তেমন গুরুতর কোন যৌন নির্যাতন বা যৌন হয়রানির অভিযোগ নেই। কিন্তু তিনি বিতর্কিত তার অশোভন আচরণের জন্য, বিতর্কিত মাস্তানী করার জন্য এবং বেহিসাবী কথাবার্তা বলার জন্য। তিনি একসময় টরন্টোতে অবৈধ মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন অভিযোগও রয়েছে! টরন্টোর প্রথম সারির দৈনিক Globe and Mail একবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ড্যগ ফোর্ডকে নিয়ে যেখানে উল্ল্লেখ করা হয়েছিল যে তিনি ৮০’র দশকে বেশ কয়েক বছর ধরে অবৈধ ড্রাগ বা মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্প্রক্ত ছিলেন। শুধু তিনিই নন, তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও অবৈধ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয় ড্যগ ফোর্ডের ভাই র্যান্ডি, বোন ক্যাথি অতীতে ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ড্যগ ফোর্ড আশির দশকে টরন্টোর ইটবিকোক এলাকায় গাঁজা বিক্রি করতেন। র্যান্ডি একবার ড্রাগ রিলেটেড এক কিডন্যাপ ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। বোন ক্যাথি ড্রাগ রিলেটেড গান ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছিলেন। ড্যগ ফোর্ড ঐ প্রতিবেদনের বিষয়ে কোন প্রতিবাদ করেননি বা কোন আইনগত ব্যবস্থা নেননি। তিনি যা বলেছেন তা হলো, অযথা সময় নষ্ট হবে এর বিরুদ্ধে লড়তে গেলে।
ড্যগ ফোর্ডের প্রয়াত ভাই রব ফোর্ড ছিলেন টরন্টোর মেয়র। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি ড্রাগ সেবন করতেন। টরন্টোর বিভিন্ন পাবলিক গ্যাদারিং এ একাধিকবার মদ্যপানের পর মাতলামী করে নিউজের শিরোনাম হয়েছেন তিনি। কানাডার সেনাবাহিনীর একটি অনুষ্ঠান থেকে একবার তাকে চলে যেতে বলা হয়েছিল। কারণ তিনি অতিরিক্ত মদ্যপান করে বেসামাল হয়ে পড়েছিলেন। তার এই অতিরিক্ত মদ্যপানের স্বভাবের জন্য সেই সময় টরন্টোর বিভিন্ন পত্রিকাগুলোও তাকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন এবং বলেন, টরন্টোর জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছেন। তাই তিনি এই পদে থাকবেন।
যৌন কেলেংকারীতে জড়িয়ে প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির সাবেক নেতা প্যাট্রিক ব্রাউন পদত্যাগ করার পর ঐ পার্টির নেতার পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য লড়াই করার সময়ও ড্যগ ফোর্ড বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। টরন্টো সিটি কাউন্সিলর হিসাবে একবার দায়িত্ব পালনকারী এবং মেয়র পদে ফেল করা প্রার্থী ড্যগ ফোর্ড পর্দার অন্তরালে কলকাঠি নেড়ে দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন এমন অভিযোগ রয়েছে।
ড্যগ ফোর্ড একবার এক অটিস্টিক শিশুর বাবাকে একটি বাড়ি নিয়ে প্রকাশ্য সভায় তীব্র বাক্যবর্ষণ করেছিলেন এবং নরকে যেতে বলেছিলেন।
এক সময় তিনি টরন্টো স্টারের এক নারী রিপোর্টারকে “কুত্তি” এবং Globe and Mail এর নারী রিপোর্টারকে অসভ্য ভাষায় গালি দিয়েছিলেন।
কানাডার প্রাইভেট সেক্টরের সর্ববৃহত ট্রেড ইউনিয়ন টহরভড়ৎ এর ন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট জেরী ডায়াস বলেন, “ড্যগ ফোর্ড সব সময়ই পশ্চাৎমুখি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। গর্ভপাতের অধিকার, যৌন শিক্ষা, ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি বাতিল
করা, কার্বন নিঃসরণের জন্য করারোপের চেষ্টা বন্ধ করার মতো বিষয়গুলিতে তিনি ঘড়ির কাটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি এবং তিনি কর কমানোর অঙ্গীকার করেন যা আসলে সামাজিক সেবা হ্রাস করতে পারে।”
জেরী আরো বলেন, “ফোর্ড হবেন একজন বিপজ্জনক এবং বিপর্যয়কর প্রিমিয়ার। সবার জন্য একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে অনেক কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে কিন্তু ফোর্ড ও তার দলের হাতে কুইন্স পার্কের নেতৃত্বের চাবি তুলে দেওয়া হলে সেটা হবে অন্টারিও এবং কানাডাজুড়ে ঘড়ির কাটা উল্টো দিকে ফিরিয়ে দেওয়া। এটা এমন একটি বিষয় যা আমরা হতে দিতে পারি না।”
ফোর্ড কর্তৃক পাগলের মত কথাবার্তা বলার একটি উদাহরণ হলো, তিনি কিছুদিন আগে বলেছিলেন নির্বাচিত হলে তিনি হাইড্রো ওয়ানের প্রধান কর্মকর্তাকে ফায়ার করবেন কারণ এই ব্যক্তি অনেক বেশী বেতন পান। অথচ এটি করার কোন অথরিটি নেই একজন প্রিমিয়ারের।
কিন্তু ড্যগ ফোর্ডের এই সকল পাগলামী, অশোভন আচরণ এবং মাস্তানী এর কোনটাই তার সমর্থকদের মধ্যে কোন রিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। অতীতে তিনি ড্রাগ ডিলার ছিলেন এটিও তার সমর্থকদেরকে বিচলিত করেনি। বরং তারা ফোর্ডকে আরো বেশী করে সমর্থন দিচ্ছেন। এ কথা বলেন টরন্টো স্টারের কলামিস্ট বব হেপবার্ন। তিনি আরো বলেন, ড্যগ ফোর্ডের সমর্থকদের মধ্যে তার প্রতি যে অনুগত্য দেখা যাচ্ছে তার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনকালীন পরিস্থিতির মিল পাওয়া যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তখন তার সমর্থকরা তার অতীতের অপকর্ম জেনেও তাকে জোর সমর্থন দিয়ে আসছিলেন।
অন্টারিও লিবারেল পার্টির প্রধান প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন উইন-ও ড্যগ ফোর্ডকে ডোনাল ট্রাম্প এর সঙ্গে তুলনা করেন। সম্প্রতি ড্যগ ফোর্ডের একটি মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি এই প্রতিক্রিয়া জানান। ড্যগ ফোর্ড বলেছিলেন লিবারেল পার্টির কিছু নেতা কারাবন্দি হতে পারেন। ক্যাথেলিন বলেন “Doug Ford sounds like Donald Trump and that’s because he is like Donald Trump,” । তিনি আরো বলেন ড্যগ ফোর্ড কুৎসিত ও জঘন্য প্রকৃতির রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তিনি যে কোন সময় যে কারো বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। কারণ তিনি ট্রাম্প এর মত।
ক্যাথলিন অবশ্য এও বলেন যে, ড্যগ ফোর্ড ডোনাল্ড ট্রাম্প এর মত হতে পারেন তবে আমি হিলারী ক্লিন্টন নই এবং অন্টারিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্টারিওর রাজনীতিতে নির্বাচন উপলক্ষ্যে যে বাক-বিতন্ডতা শুরু হয়েছে তা হয়তো আরো কুৎসিত আকার ধারণ করতে পারে।
উল্লেখ্য যে, অন্টারিওতে ক্যাথলিন ইউন-ই প্রথম মহিলা প্রিমিয়ার এবং প্রথম এলজিবিটি (LGBT) প্রিমিয়ার। ডনভ্যালি ওয়েস্ট থেকে তিনি এমপিপি পদে নির্বাচন করে জয়ী হন ২০০৩ সালে। ইতিপূর্বে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীও ছিলেন।
২০১৪ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করলেও নির্বাচনের মাস খানের আগে কিন্তু ক্যাথলিন উইনের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নেমেছিল। ঐ সময় নির্বাচনী জরীপে তিনি জনপ্রিয়তার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছিলেন। কেউ আশা করেননি তিনি জয়ী হবেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল জুন মাসের ১২ তারিখে। আর মে মাসের ১২ তারিখে অর্থাৎ মাত্র এক মাস আগে তার দলের জনপ্রিয়তা ছিল ৩০%। অন্যদিকে প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা ছিল ৩৯%। এটি ছিল Ipsos Research এর জরীপ ফলাফল।
কিন্তু এবারের চিত্রটি অনেটা ভিন্ন। সর্বশেষ প্রাপ্ত জরীপসমূহের গড় হিসাবে দেখা যাচ্ছে ক্যাথলিন উইন এর অবস্থান গতবার নির্বাচানের এক মাস আগে যা ছিল তার চেয়ে আরো পিছনে। এবং প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির অবস্থান আরো সামনের দিকে। অর্থাৎ প্রগ্রেসিভ কনর্জাভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা ৪৩% এবং লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তা ২৬.৬%। ব্যবধানটা গতবারের চেয়ে অনেক বেশী। এই ব্যবধান কি কমিয়ে আনতে পারবেন ক্যাথলিন উইন?
উল্ল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাথলিন উইনের সরকার অন্টারিওর সাধারণ মানুষের কল্যানে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যা ইতিমধ্যেই প্রশংসিত হয়েছে। যেমন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির আইন করেছেন। সিংহভাগ অন্টারিওবাসীর সমর্থন রয়েছে এ বছরের শুরু থেকে অন্টারিওর ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির উদ্যোগের প্রতি। কিন্তু অর্থনীতির উপর এর প্রভাব কি হবে সে নিয়ে রয়েছে মতভেদ।
ফোরাম রিসার্স এর জরীপে দেখা গেছে, ৬২% অন্টারিওবাসী বলেছেন তারা সরকার কর্তৃক ন্যূনতম মজুরী ঘন্টায় ১৪ ডলার করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। গত ১লা জানুয়ারী থেকে ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে।
জরীপে দেখা গেছে যাদের বয়স ৬৫+ তাদের মধ্যে এই ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধির প্রতি সমর্থনের হার শতকরা ৭৩ ভাগ। মহিলাদের মধ্যে সমর্থনের হার শতকরা ৭০ ভাগ, যারা টরন্টোতে বাস করেন তাদের মধ্যে এই সমর্থনের হার ৭৭ ভাগ এবং যারা লিবারেল দলের সমর্থক তাদের মধ্যে এই সমর্থনের হার শতকরা ৯১ ভাগ।
যাদের বাৎসরিক আয় ২০ হাজার ডলার থেকে ৪০ হাজার ডলার তাদের মধ্যে ন্যুনতম মজুরী বৃদ্ধির হারের প্রতি সমর্থন রয়েছে শতকরা ৭৪ ভাগের। এদের মধ্যে শতকরা ৬৫ জন মনে করেন ন্যূনতম এই মজুরী বৃদ্ধি অর্থনীতির উপর পজিটিভ বা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফোরাম রিসার্সের প্রেসিডেন্ট র্লন বজিনফ বলেন, অন্টারিওবাসীদের মধ্যে নূন্যতম মজুরী বৃদ্ধির প্রতি সমর্থ ব্যপক।
অবশ্য কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থকদের ভাষ্য এর বিপরীত। তারা বলছেন ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি অন্টারিওর অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলাচ্ছেন যাদের আয় বছরে ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলারের মধ্যে।
ক্যাথলিন উইন অন্টারিওতে স্বল্প আয়ের পরিবারের ছেলে-মেয়েদের জন্য টিউশন ফি মওকুফ করার আইন করেছেন। অন্টারিও প্রভিন্সের কলেজ ও ইউনিভারসিটির শিক্ষার্থীরা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর সেশন থেকে বিনা টিউশন ফি-তেই লেখাপড়া করতে পারছেন।
এমনকি ম্যাচুর স্টুডেন্টরাও এই সুবিধা পাচ্ছেন। ম্যাচুর স্টুডেন্টদের মধ্যে যারা যোগ্য বিবেচিত হবেন তারাও বাস্তব অর্থে বিনা টিউশন ফি-তেই লেখাপড়া করতে পারবেন।
উল্ল্লেখ্য যে, নিন্ম আয়ের পরিবারের সন্তানদের কলেজ ও ইউনির্ভাসিতে পড়ার জন্যে নির্ভর করতে হয় ওসাপ (ওন্টারিও স্টুডেন্টস এসিট্যান্স প্রোগ্রাম) লোনের ওপর। ইউনির্ভাসিটির থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী নেয়ার পর একেক ছাত্র/ছাত্রীর উপর গড়ে ৩৭ হাজার ডলারের ঋণের বোঝা কাঁধে চেপে বসে থাকে। চাকরি পাওয়ার পর এই ঋণ শোধ করার ব্যাপারে কঠোর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
অন্টারিও লিবারেল সরকারের অর্থ মন্ত্রী চার্লস সওজার মতে, এই নতুন আইন একটি অর্থবহ অবদান রাখবে। আগের ঋণের পদ্ধতিটা ছিল বেশ জটিল। বর্তমান পদ্ধতিতে স্বল্প আয়ের সন্তানেরাও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহনের ব্যাপারে সমান সুযোগ পাবেন।
অন্টারিও লিবারেল সরকার আরো উদ্যোগ নিয়েছে ২৫ বছরের কম বয়সী ছেলে মেয়ের জন্য বিনা মূল্যে ওষুধ প্রদানের জন্য।
অন্যদিকে ক্যাথলিন উইনের সরকার সম্প্রতি ‘বেসিক ইনকাম’ নামের একটি পাইলট প্রজেক্ট শুরু করেছে। যাদের আয় কম বা যারা
বেকার কিংবা যারা শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে কাজ করতে অপরাগ, তাদেরকে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বছরে সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ডলার প্রদান করা হচ্ছে মাথা পিছু। এই পাইলট প্রকল্পটি তিন বছর মেয়াদী। তিন বছর পর পর্যালোচনা
করে দেখা হবে এর সুূফল কি হয়েছে। কিংবা আদৌ কোন উপকার হয়েছে কি না তাদের যারা এই প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করেছেন।
এই পাইলট প্রজেক্টে ৪ হাজার স্বল্প আয়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। টরন্টোর নিকটবর্তী হ্যামিলটন-ব্রেন্টফোর্ড এলাকা, থান্ডার বে এবং লিন্ডসে এলকায় বসবাসকারী স্বল্প আয়ের
বাসিন্দাগণ এই সুযোগ পাচ্ছেন। গত সামারের পর থেকেই শুরু হয়েছে এই প্রকল্প। অন্টারিওর প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন উইন গত বছর এপ্রিলে হ্যামিলটনে এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, অন্টারিওতে অরক্ষিত কর্মজীবী ও বেকারদের সহায়তা প্রদান এবং স্বল্প আয়ের লোকদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উন্নয়নের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে এই পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেছিলেন, এই অর্থ অত্যধিক এ কথা কোনভাবেই বলা যাবে না। মাথাপিছু বছরে মাত্র ১৭ হাজার ডলার বা তারও নীচে। কিন্তু তবু এই পরিমাণ অর্থ স্বল্প আয়ের মানুষদের জীবন মান উন্নয়নে যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো ছাড়াও সম্প্রতি ঘোষিত অন্টারিও বাজেটেও আরো কিছু উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে ভোটারদের মন জয় করার জন্য। এসব মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনে ক্যাথলিন উইন কতটা সাফল্য অর্জন করতে পারবেন তা নির্বাচনের দিনই চূড়ান্তভাবে জানা যাবে।
এদিকে জনপ্রিয়তার বিচারে এন্ড্রিয়া হোরয়াথ এর নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির অবস্থান তৃতীয় হলেও এখনি বলা যাচ্ছে না আগামী সপ্তাহগুলোতে তাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাড়াবে। হয়তো তারা এগিয়ে যাবে অথবা বর্তমান অবস্থানেই থাকবে।
মূলত স্বাস্থ্য সেবা, অর্থনীতি আর কর্মসংস্থান, কর হ্রাস এবং বিদ্যুৎ এর খরচ এই বিষয়গুলো এবারের অন্টারিও নির্বাচনে প্রধান ইস্যু হয়ে দেখা দিয়েছে। Global News এর পক্ষে Ipsos poll এর এক জরীপ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। এই বিষয়গুলো নিয়ে যারা বেশী বেশী প্রতিশ্র“তি দিতে পারবেন তারাই হয়তো নির্বাচনী খেলায় জিতে যাবেন। প্রতিশ্র“তি কতটা বাস্তবায়ন হবে সে পরের কথা। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতা দখল। এর পর অন্য কাজ।
আর নির্বাচনের আগে জরীপে যে সকল ভবিষ্যৎ বাণী করা হয় বা হচ্ছে সেগুলো অন্ধভাবে বিশ্বাস করাটা নিরাপদ নয়। কারণ অতীতে দেখা গেছে নির্বাচনের আগে করা অনেক জরীপ রিপোর্টই পরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার ঘটনা আছে অনেক। কানাডার গত জাতীয় নির্বাচনই তার অতি সাম্প্রতিক প্রমাণ। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মাসখানেক আগে দেখা গিয়েছিল টম মূলকেয়ারের নেতৃত্বাধীন নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় আসছে। তখন জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন লিবারেল পার্টির অবস্থান ছিল তৃতীয়। কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টাতে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন দেখা গেল জাস্টিন ট্রুডো তার দল নিয়ে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছে। অন্টারিওর গত সাধারণ নির্বাচনেও প্রায় একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। প্রথম দিকে পিছিয়ে ছিল ক্যাথলিন উইনের দল। পরে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করে তার দল।
বিশিষ্ট সাংবাদিক লেখক ও TVOntario (TVO) এর কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স এর হোস্ট স্টিভ পাইকিন সম্প্রতি এক লেখায় বলেন, জরীপ কোন ভবিষ্যত বানী নয়। কথাটি তিনি দ্বিতীয়বারও জোর দিয়ে বলেন, জরীপ কোন ভবিষ্যত বাণী নয়। জরীপ কখনো এ কথা বলতে পারেনা আজ থেকে দুই বা
তিন মাস পর লোকজন কি সিদ্ধান্ত নিবে। বড়জোর সপ্তাহ দুই আগে লোকজন কি ভাবছিল তা বলতে পারে জরীপ। স্টিভ অতীতের নির্বাচনী জরীপ বিষয়ে তিনি কতগুলো উদাহরণ টেনে দেখান এগুলোর উপর নির্ভর করা যে কতটা অদূরদর্শীতার কাজ।
যেমন, ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির নবনির্বাচিত প্রধান ফ্রেঙ্ক মিলার বেশ আয়েশী মুডেই ছিলেন। কারণ তিনি
দেখছিলেন তার দল নির্বাচনী জরীপে বেশ এগিয়ে আছে। তাছাড়া তার দল বিগত ৪২ বছর ধরে বিরতিহীনভাবে অন্টারিও শাসন করে আসছে। সুতরাং এই দলকে ঠেকায় কে? এই ভাবনা থেকে তিনি প্রচার কার্যে মন দেননি। বা নির্বাচনকে তেমন গুরুত্ব সহকারে মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। নির্বাচনের দিন দেখা গেল তার দলের ৪২ বছরের বিরামহীন রাজত্ব ধুলায় মিশে গেছে। ক্ষমতা চলে যায় লিবারেল পার্টির হাতে।
আরো ৫ বছর পরের ঘটনা। নির্বাচনের ৩ মাস আগে লিবারেল পার্টি দেখলো জরীপ রিপোর্ট তার পক্ষেই যাচ্ছে। তারা মনে মনে প্রস্তুতিও নিয়ে ফেললো পরবর্তী সরকার গঠনের। কিন্তু বিপর্যয় ঘটলো নির্বাচনের রাতে। বব রে -র নেতৃত্বে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতা দখল করলো।
আরো ৫ বছরের পরের ঘটনা। নির্বাচনের আগে জরীপ রিপোর্ট বলছে লিবারেল ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু না। জরীপ রিপোর্ট ভুল প্রমাণ করে ক্ষমতায় আসলেন মাইক হ্যারিস। একেবারে তৃতীয় স্থান থেকে প্রথম স্থানে।
এরকম আরো কিছু উদাহরণ আছে অন্টারিও এবং কানাডার নির্বাচনী জরীপ নিয়ে। সুতরাং আসন্ন নির্বাচনে কে আসবে ক্ষমতায়- ড্যগ ফোর্ড না ক্যাথলিন উইন নাকি এন্ড্রিয়া হোরয়াথ তা শতভাগ নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারে না। কোন জরীপই না। নির্বাচনে কোন দল জিতবে তা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর। আর নির্বাচনের আগে দ্রুতই বদলাতে থাকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট। প্রগ্রেসিভ কনজার্ভেটিভ পার্টির সাবেক নেতা প্যাট্রিক ব্রাউন কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন তার প্রিমিয়ার হওয়ার স্বপ্ন ‘মি-টু’ আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যাবে নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে? কবে কোন মেয়ের সঙ্গে কি আচরণ করেছিলেন বা করেননি তার অভিযোগের ভিত্তিতে ভরাডুবি ঘটবে তার রাজনৈতিক জীবনের উচ্চাকাংখা?
সুতরাং সময় এখন অপেক্ষার। ৭ জুন কি ঘটবে, কার হাতে ক্ষমতা যাবে তা নিয়ে জরীপ প্রতিষ্ঠানসমূহের জরীপ ফলাফল নিয়ে কোন দলের হতোদ্যম হওয়া ঠিক নয়। আবার কোন দলের পুলকিত হওয়ারও কোন যুক্তি নেই।
বি.দ্র. এই প্রতিবেদনটি তৈরী করার সময় আমরা বাঙ্গালী অধ্যুষিত বিচেস ইস্ট ইয়র্ক ও স্কারবরো সাউথ ওয়েস্ট থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিভিন্ন ক্যান্ডিডেট এর সাক্ষাৎকার নেয়ার চেষ্টা করেছি। এই উদ্দেশ্যে সাবার সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সাক্ষাৎকার পেয়েছি শুধু আর্থার পটস এবং স্যারা মেলো’র। এই দুজনের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে ১০ ও ১১ পাতায়। বাকিরা সাক্ষাৎকার প্রদানের ব্যাপারে সম্মতি বা আগ্রহ প্রকাশ করলেও সময়মত তা দিতে পারেননি।