কানাডার বহুসংস্কৃতিবাদ কেন কার্যকর

বিলঙ্গিং: দ্য প্যারাডক্স অব সিটিজেনশিপ, ২০১৪ সিবিসি ম্যাসি লেকচারে মিজ ক্লার্কসন

ডিসেম্বর ১, ২০১৪

অক্টোবরের শেষদিকে অটোয়ায় গুলিবর্ষণের ঘটনায় করপোরাল নাথান সিরিলোর মৃত্যু এই জাতিকে চরম আঘাত দিয়েছে।

ওই ঘটনার দু’দিন পর আটলান্টার কোল্ড লেকে একটি মসজিদের অবমাননা করা হয়েছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোল্ড লেকের অধিবাসীরা মসজিদটি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সাহায্য করেছেন।

একটি জাতীয় ট্রাজেডির পর স্থানীয় পর্যায়ে একটি চমৎকার কাজÑ উপর্যুপরি এসব ঘটনা আমাদেরকে নিজেদের সম্পর্কে কী ধারণা দেয়?

প্রাক্তন গভর্নর জেনারেল ও সিবিসি টেলিভিশনের দীর্ঘদিনের অনুষ্ঠান সঞ্চালক এড্রিয়েন ক্লার্কসনের এ বিষয়ে একটি তত্ত্ব রয়েছে যাতে ব্যাখ্যা রয়েছে যে, কোল্ড লেক টাউনের লোকেরা যে কাজটি করলো তা তারা কেন করলো।

এটি সহনশীলতা বা দয়া দেখানোর কোন বিষয় নয়। এটি ছিলো আমাদের আত্মপরিচয়ের ব্যাপার যে আত্মপরিচয় নির্ধারিত হয় অন্যদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তিতে।

বিলঙ্গিং: দ্য প্যারাডক্স অব সিটিজেনশিপ, ২০১৪ সিবিসি ম্যাসি লেকচারে মিজ ক্লার্কসন বলেন, ‘‘ব্যক্তিবিশেষ পরস্পরের থেকে স্বাধীন নয়। আমাদের ব্যক্তিগত অধিকার রয়েছে, কিন্তু অন্যদের প্রতি আমাদের দায়িত্বও রয়েছে।’’ তার এই লেকচারটি বর্তমানে বই আকারেও পাওয়া যায়।

বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘‘নিজেদের প্রতি এবং সমাজের প্রতি আমাদের একাত্মতার ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে পরিপূর্ণ জীবন উপভোগের বৃহত্তর সম্ভাবনা যা সমগ্র মানব জাতির সঙ্গে সম্পর্কিত।’’

ক্লার্কসন যুক্তি দেন যে, আমরা কারা এই বিষয়ে আমাদের ঐকান্তিক অনুভব নির্ভর করে কোন গ্রুপ, একটি জনসমষ্টি, একটি দেশের প্রতি একাত্মতা বোধের ওপরÑ আর এই অনুভূতি সামনে চলে আসে কোন জাতীয় সংকটকালে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়া

তিনি অবশ্য এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন যে, একাত্মতার অর্থ হলো অন্যদের বাইরে রেখে দেয়া।

ক্লার্কসনের এই বক্তব্য পরীক্ষার মুখে পড়ে যখন তিনি প্রথম মন্ট্রিয়লে ম্যাসি লেকচার দেন। শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন উল্লেখ করেন যে, অন্যদেরকে বাইরে রাখার অর্থ হলো সঠিক অর্থে রাজনৈতিক নেতারা যে গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করার কথা বলেন তাদের মধ্যে কতজন সেই গ্রুপের আত্মপরিচয়কে সংজ্ঞায়িত করেন।

ওই শ্রোতা কুইবেক সনদের ওপর বিতর্ককালে প্রকাশ করা কিছু চরম অভিমত এবং প্রকাশ্যে মুসলিম ও অভিবাসীদের নিন্দা জানিয়ে ইউরোপের দক্ষিণপন্থী নেতারা কীভাবে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করেনতার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেন।

এর প্রেক্ষিতে ক্লার্কসনের জবাব ছিলো, ‘‘এগুলো মূলত বর্ণবাদী কর্মকান্ড। আমি শঙ্কিত যে ফ্রান্সে এখনও এমন কিছু শোনা যায় যা আমরা কানাডায় ৪০ বছর আগে ছোটবেলায় শুনেছি ইহুদি বা অন্যদের সম্পর্কে।

‘‘আমার মনে হয় ভীতি, অজ্ঞতা এবং ধর্মান্ধতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সবসময়ই সামনাসামনি জবাব দিতে হবে।’’

অজ্ঞতা ও ধর্মান্ধতার মোকাবিলার এই নীতির কারণে ক্লার্কসন তার লেকচারে কিছু ভয়ংকর তথ্য তুলে ধরতে বাধ্য হন।

‘‘মার্গারেট থেচারের বিখ্যাত উক্তি ছিলো, ‘সমাজ – এর মতো কোন কিছু আদৌ নেই।’ তার মুখ থেকে এধরণের বক্তব্য প্রথম শোনার পর থেকেই আমি এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে এসেছি। তিনি একজন রাজনীতিবিদ যার সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি এবং ব্যক্তিগতভাবে তাকে আবেদনহীন দেখতে পেয়েছি।’’

ক্লার্কসনের কাছে, ব্যক্তিবিশেষ এবং সমাজের পরস্পর সম্পর্কিত জীবন কেবল একটি আকর্ষণীয় আদর্শই নয়Ñ এটি একটি বাস্তবতা। সঙ্গীতের স্বরলিপি যেমন একটি ঐক্যতান সৃষ্টি করে

তেমনইভাবে ব্যক্তিবিশেষ একটি বৃহত্তর সমষ্টি গড়ে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবকিছু হারানো হংকংয়ের অভিবাসীর সন্তান হিসাবে ক্লার্কসন নিজের অভিজ্ঞতায় জানেন যে, এটি হলো এমন এক সময়ে বেঁচে থাকা যে সময়টি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণঅভিবাসন দিয়ে চিহ্নিত হয়ে আছে।‘‘আমি আমার জীবনের আগ্রহের বিষয়গুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ি। আমি আমার দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া পরিবারের সন্তান ছিলাম এবং আছি। আমি এমন একজন, কিছু সময়ের জন্য যার কোনও দেশ ছিলো না। আর আমি সব সময়ই এমন একজন হিসাবেই থাকবো যে বুঝতে পারবে কোনও দেশ না থাকার চিরস্থায়ী যন্ত্রণা কেমন।

শুধুই কানাডায়

তার জন্য এটা অনেকটা বিস্ময়কর ছিলো যে, ১৯৪০এর দশকে তিনি যে কানাডায় পৌঁছলেন সেই দেশটি তাকে সমাজের একজন করে নিলো। তখন কানাডার সর্বত্রই ছিলো শ্বেতাঙ্গদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই দেশটির গ্রহণ করে নেয়ার তত্ত্ব তাকে বারবার বিস্মিত করেছে। তিনি স্মরণ করেন সে সময়ের টরন্টোর কিছু সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড পত্রিকার কথা যাতে তরুণ-তরুণীদের ডেটিংয়ের জীবন নিয়ে লেখা ছাপা হতো।

‘‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার যেটি ছিলো তা হলো এই বিশেষ জুটিগুলির সবই যে সবসময় কেবল সমবর্ণের ছিলো তা নয়, তাদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ, বাদামী-কৃষ্ণাঙ্গ, হলুদ-শ্বেতাঙ্গ সব ধরণের জুটিই ছিলো। তারপরও বর্ণ বা জাতিগোষ্ঠীর কোনও প্রশ্ন কোনও দলের পক্ষ থেকে তোলা হয়নি। এটি কানাডা ছাড়া আর কোনও দেশে সম্ভব নয়।’’

এর পরও তিনি কিন্তু পতাকা-দোলানোদের দলে নন।

তিনি কানাডায় আয়-বৈষম্য ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন যে, শীর্ষস্থানীয় ১০০ জন সিইও সাধারণ গড় আয়ের লোকদের তুলনায় বার্ষিক ১৭০ গুণ বেশি রোজগার করেন এবং তিনি আক্ষেপ করেন এজন্য যে, প্রথম দেশের জনগণের সঙ্গে ইতিহাসের পুরো সময়জুড়ে কীভাবে অসঙ্গত আচরণ করা হয়ে আসছে।

ক্লার্কসন জোর দিয়ে বলেন, নতুন কানাডীয়দেরকে এ দেশের অতীত, এর বাড়তি স্ফীতি এবং অন্য সবকিছুর ভার বয়ে নেয়ার কাজে শরিক হতে হবে।

তিনি বলেন, ‘‘তাদেরকে সবকিছু গ্রহণ করতে হবে।’’ যার অর্থ দাঁড়ায় একটি দেশ হিসাবে কেবল আমাদের অতীতের পাপই নয় বরং অন্য কানাডীয়দের প্রতি আমাদের বর্তমান দায়িত্বও গ্রহণ করতে হবে।

তিনি তার গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালনকালে সাহসিকতার জন্য পুরস্কার দেয়ার বিষয়টি স্মরণ করেন। পুরস্কার গ্রহণকারীদের মধ্যে সাসকাটচেবনের এমন একজন ছিলেন যিনি একটি মারাত্মক ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ অচেনা এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন। তিনি ট্যাঙ্কারের জ্বলন্ত জানালা ভেঙ্গে এর চালককে উদ্ধার করেছিলেন।

ক্লার্কসন বলেন, ‘‘আমি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, তিনি যখন এই কাজটি করেন তখন তার চিন্তাটি কী ছিলো। তিনি জবাব দেন, ‘আমি জ্বলন্ত ট্যাঙ্কারের ভেতরে লোকটির দিকে তাকাই, আমার মনে হয় যেন ওই লোকটি আমিই’।’’

এটিই হলো একজন বা অন্যদের সম্পর্কে চিন্তা করার সঠিক উপায়– সেটা সাসকাটচেবনের হাইওয়েতে অচেনা কাউকে সাহায্য করাই হোক বা আটলান্টার কোল্ড লেকে মসজিদ সংস্কারের কাজই হোক– এভাবেই একাত্মতাবোধের শক্তি সম্পর্কে ক্লার্কসনের বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে।

তাঁর ভাষায়, ‘‘আমাদের বেশিরভাগই পরিপূর্ণ মানুষ, বেশিরভাগই সত্যিকারভাবে আমরা নিজেরা, সবচেয়ে নিশ্চিতভাবে ব্যক্তিবিশেষ, যখন আমরা সমাজের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমাদের সড়ক, আমাদের মহল্লা, শহর এবং দেশ যা কিছুই আমরা নিজেদের জন্য দেখতে পাই– সেটা হলো সমাজের আয়নায় দেখা।’’- সিবিসি