কানাডীয় ডাক্তারদের মহান মানবিকতায় বাংলাদেশের পপি রানী দাস সুস্থ হয়ে উঠলেন দীর্ঘ আট বছরের অভিশপ্ত জীবন থেকে
রানীর যৌতুক লোভী স্বামী তাকে হত্যা করার জন্য এসিড পান করিয়েছিল পানির নাম করে
জানুয়ারী ৬, ২০১৮
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বরের একটি ঘটনা। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার কামালপুর গ্রামের অসুস্থ গৃহবধূ পপি রানী দাস বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না বলে তার স্বামী প্রদীপ বণিকের কাছে এক মগ পানি চান। কিন্তু তৃষ্ণার্ত পপিকে পানির বদলে দেয়া হয় এসিড ভর্তি একটি মগ। পপি কখনো চিন্তাই করেননি স্বামী এমনটা করতে পারে। মগে চুমুক দিয়েই চিৎকার করে ওঠেন পপি। বাড়ির অন্যরা এসে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু এসিডে কণ্ঠনালি পুড়ে যাওয়ায় পরবর্তী ১০ মাস ধরে কথা বলতে পারেননি পপি। পরে চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে পপি বর্ণনা করলেন সেই নির্মম ঘটনা। যৌতুকের কারণে স্বামীর বর্বরতা শিকার পপি ঘটনা বর্ণনা করার পর তাঁর মা অজন্তা রানী দাস বাজিতপুর থানায় একটি মামলা করেন। খবরটি ছাপা হয়েছিল কালের কণ্ঠ পত্রিকায়।
কিন্তু পুলিশ প্রদীপকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশ জানিয়েছে সে পালাতক।
এসিড পানের পর পপির খাদ্যনালী, শ্বাসনালী, পাকস্থলীসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাকে ভর্তি করানো হয়েছিল এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। চিকিৎসায় সামান্য সেরে উঠলেও পপি সরাসরি খাবার খেতে পারতো না। কারণ কয়েকটি অপারেশন এর পরও চিকিৎসকরা তার খাদ্যনালীর তেমন কোন সংস্কার করতে পারেননি। তাদের পক্ষে তেমন কিছু করার সুযোগও ছিলনা।
পপিকে খেতে হতো খাবার মেশিনে গুড়ো করে। বাড়িতে তার ইলেক্ট্রিসিটিও ছিল না যে খাবার গুড়ো করার মেশিন চালাবেন। ফলে তিনি ঐ হাসপাতালেই থেকে যান এবং দীর্ঘ প্রায় সাত বছরের এক অভিশপ্ত কষ্টের জীবন পার করেন।
বাংলাদেশের ডাক্তারগণ আশা ছেড়ে দিলেও পপি রানী আশা ছাড়েননি। তার কাছে মনে হতো কিছু একটা সুযোগ আসবে নিশ্চই। হোক
সেটা মিরাকল। আবার তিনি আগের জীবন ফিরে পাবেন।
পরি রানীর সেই আশা আজ সত্যি সত্যি বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তিনি সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। আর এটি সম্ভব হয়েছে কানাডার এক ডাক্তার টনি ঝং এর মানবিকতার কারণে। টরন্টো স্টার পত্রিকায় সম্প্রতি ছাপা হয় পপি রানীকে নিয়ে সেই মানবিক প্রতিবেদনটি।
টনি ঝং কানাডার একজন plastic surgeon। ২০১৬ সালের ফেব্র“য়ারীতে তিনি বাংলাদেশ সফরে যান একটি মেডিকেল টিমের সঙ্গে। অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসা সহায়তা দানের জন্য ঐ টিমটি বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিল। ঐ সফরের সময়ই টনি ঝং ঘটনাক্রমে পপি রানীর সাক্ষাৎ পান। ঢাকার এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন হাসপাতাল পরিদর্শন কালে তিনি পপিকে দেখতে পান জানালার পাশে বসে পাইপ দিয়ে খাবার খাওয়ার চেষ্টা করছেন। টনি ঝং এর ঐ সফরে পপি রানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার কোন পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি ছিল না। হাসপাতালের ডাক্তারগণও পপির বিষয়টি টনি ঝং এর কাছে উপস্থাপন করেননি। টনি নিজেই কৌতুহল বশত রানীর কেসটি জানাতে চান।
রানীর দ্বিতীয় জীবন শুরু সেদিন থেকেই। তার সেই স্বপ্ন দেখা, একদিন কেউ আসবেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বা কোন এক অলৌকিক ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি আবার সুস্থ্য হয়ে উঠবেন।
রানীর ঘটনা শুনে টনি ঝং সিদ্ধান্ত নেন একে যে করেই হোক সাহায্য করতে হবে। তিনি রানীকে প্রতিশ্র“তি দেন তাকে কানাডায় নিয়ে এসে চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করা হবে।
plastic surgeon হিসাবে টনি জানতেন টরন্টো জেনারেল হাসপাতালে রানীর সমস্যাটির চিকিৎসা করানো যেতে পারে। এই চিকিৎসা করানোর সুযোগ পৃথিবীর খুব কম হাসপাতালেই আছে। হাতে গোনা যে কয়েকটি হাসপাতালে এই চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে, টরন্টো জেনারেল হাসপাতাল তার মধ্যে একটি।
তারপর একটি বছর সময় লেগেছে টনি ঝং এর রানীকে কানাডায় নিয়ে আসতে। তার আগে রানীর জন্য ফান্ড কালেক্ট করতে হয়েছে, টরন্টোর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে।
পপি রানী কানাডায় আসেন ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারী। এর পর চলতে থাকে তার চিকিৎসা। লম্বা সময়ের চিকিৎসা। এই সময় তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন টরন্টো প্রবাসী মানব-হিতৈষী কয়েকজন বাংলাদেশীও। টরন্টোতে বাংলাদেশ মাইনরিটি রাইটস এ্যালায়েন্স নামের একটি সংগঠনও এগিয়ে আসে পপি রানীকে সহায়তা করার জন্য। এই সংগঠনের কর্মকর্তা অরুন দত্ত তার ফেসবুকের টাইমলাইনে লিখেন পপি রানীকে সাহায্য করার জন্য টরন্টোতে যারা এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে আছেন বিশ্বরূপ, মৌমিতা দে ও ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্ত।
গত ১৪ ডিসেম্বর টরন্টো জেনারেল হাসপাতালে পপি রানী মিলিত হন তার মেডিকেল টিমের সঙ্গে। এই সময় তার মা অজন্তা রানী দাসও উপস্থিত ছিলেন। উদ্দেশ্য, তার সুস্থ হয়ে উঠার বিষয়টি চিকিৎসকদের সঙ্গে সেলিব্রেট করা এবং তাদেরকে গুডবাই বলা।
টরন্টোতে প্রায় দশ মাস সময় লেগেছে পপির চিকিৎসায়। এখন সে সুস্থ এবং খুব খুশী এবং সে তার প্রিয় খাবার আইস ক্রিম, বিস্কিট খেতে পারবে কোন কৃত্রিম সহায়তা ছাড়াই। শীঘ্রই সে দেশে ফিরে যাবে। টরন্টো স্টারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে পপি রানী বলেন, দেশে ফিরে গিয়ে আমি সবসময়ই মনে রাখবো এই কানাডার কথা যেখানে আমার দ্বিতীয় জীবন শুরু হয়।
তবে পপি রানীর চিকিৎসা খুব সহজ ছিল না। মেডিক্যাল চ্যালেঞ্জ তো ছিলই, তার সাথে ছিল পর্যাপ্ত ফান্ড পাওয়া যাবে কি না। আরো আশংকা ছিল অসুস্থ অবস্থায় এত দূরের পথ পারি দিয়ে সে কানাডায় আসতে পারবে কিনা। এরকম জটিল একটি চিকিৎসায় কতটুকু সাফল্য আসবে সে বিষয়েও সন্দেহ ছিল। টরন্টো স্টারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে চিকিৎসক টনি ঝং বলেন, পপি রানীর অবস্থা আমাকে ও আমার সঙ্গের অন্যান্য চিকিৎসকদের ইন্ধন ও অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসে টনি ঝং এর প্রথম কাজ ছিল পপি রানীর জন্য ফান্ড যোগার করা। কারণ অন্টারিওর মেডিকেল সিস্টেম এই চিকিৎসার খরচ বহন করবে না। তাছাড়া বিমান ভাড়া, টরন্টোতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্যও অর্থের প্রয়োজন হবে। কিন্তু টনি ঝং খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন দেশের বাইরের কোন প্রাপ্তবয়স্ক রোগীকে কানাডায় এনে চিকিৎসা কারানোর জন্য কোন ফান্ডের ব্যবস্থা নেই। গরীব দেশের কোন জটিল রোগে ভোগা শিশুর জন্য একটি ব্যবস্থা আছে যা The Herbie Fund এর মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে।
টনি ঝিং-ও দমার পাত্রী নন। তিনি অবশেষ নিজেই একটি উদ্যোগ নিলেন ফান্ড সংগ্রহের জন্য এবং এর নাম দিলেন পপি ফান্ড। তিনি কয়েটি সম্ভাব্য জায়গায় নক করে পপির স্টোরীট বললেন। এতে ভালই কাজ হলো। প্রথম অবস্থায় তিনিটি পরিবার সাড়া দেয়। এভাবে কয়েক মাসের মধ্যেই ৭ লাখ ডলারের ফান্ড যোগার হয়ে যায়। এর পাশাপাশি কয়েকজন চিকিৎসকও রাজী হয়ে যান বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করার জন্য।
পপি রানীর উপর যে অত্যাচার হয়েছে এর পর তার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। তার স্বামী প্রদীপ বণিক তার উপর অনবরত চাপ সৃষ্টি করে আসছিল আরো যৌতুক পাবার জন্য। কিন্তু সফল হতে না পেরে পপি রানীকে খুন করার জন্যই কৌশলে এসিড পান করিয়ে দেন। পপি রানীর মৃত্যু হলে প্রদীপ আবার বিয়ে করতে পারবে এবং আবারো যৌতুক পাবে। এমনটাই ছিল প্রদীপের পরিকল্পনা।
পপি রানীর মা অজন্তা রানী দাস প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করলেও পুলিশ তার বিরুদ্ধে অপরাধের কোন চার্জ গঠন করেনি। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রদীপ নাকি পালাতক। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে এসিড ক্রাইমের বিচার হওয়ার নজীর খুব কম। দেশে এসিড হামলার যত ঘটনা ঘটে তার মাত্র ১০% ঘটনার বিচার হয়। একথা জানিয়েছে বাংলাদেশের এসিড সার্ভাইভারস ফাউন্ডেশন।
পপি রানী তার চিকিৎসক টনি ঝং-কে বলেন, আমি দেশে ফিরে গিয়ে এসিড ভিক্টিমদের জন্য কাজ করতে চাই। টনি ঝং বলেন, আমরা কখনো পপিকে এর জন্য উৎসাহ দেইনি। তিনি নিজে থেকেই এসিড ভিক্টিমদের জন্য কাজ করার কথা বলেছেন। কারণ, তিনি দেখেছেন তার জন্য কত লোক কাজ করেছেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই তিনিও উদ্দীপনা পেয়েছেন এই স্বেচ্ছাশ্রম দেখে।
পপি রানী তার চিকিৎসক রালফ গিলবার্ট কে নিজেই একটা নাম দিয়েছেন। তিনি তাকে ম্যাজিক ডাক্তার বলে ডাকেন। পপি বলেন, গিলবার্ট আমার জন্য যা করেছেন তা যাদু ছাড়া আর কিছু নয়। হাসপাতালে আরো যারা তাকে সাহায্য করেছেন তাদের মধ্যে আছেন স্পিস প্যাথলজিস্ট এলানা আজিজা, সমাজকর্মী সোভা সা ও দোভাষী তানাজ্জুম কায়সার। সোভা সম্পর্কে পপি বলেন, তার সেবা ঔষধের মত কাজ করেছ। পপির মেডিকেল টিমে ২০ জনের মত কাজ করেছেন। এদের সবার প্রতিই তিনি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
পপি রানী বলেন, আমি আমার মা আমার জন্য অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন। তার øেহ ভালবাসা ও প্রার্থনা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
চিকিৎসক টনি ঝং পপি রানীর জন্য যে ফান্ড ক্রিয়েট করেছিলেন সেটি এখন থেকে টরন্টোর ইউনিভার্সিটি হেলথ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে চালু থাকবে। এটি ২০১৮ সাল থেকে অন্য দেশের জটিল রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাবে। ইচ্ছুক দাতাগণ uhnhelps.ca এই ওয়েবসাইটে গিয়ে অনুদান দিতে পারেন।