নেকাব ইহুদীদের পোষাক!
নেকাব নিয়ে কানাডার রাজনীতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে
কোরআনে বলা হয়নি মুসলিম নারীদেরকে মুখ ঢেকে রাখতে হবে : হজের সময়ও নেকাব অনুমোদিত নয়
খুরশিদ আলম : নেকাব নিয়ে কানাডার রাজনীতি আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। জমে উঠেছে বিতর্ক। বৃদ্ধি পেয়েছে অভিযোগ ও অসন্তোষ প্রকাশের মাত্রা। নেকাব ইস্যুতে পক্ষে বিপক্ষে নানা মত ও তথ্য দিয়ে বিষয়টিকে ক্রমেই জটিল করে তোলা হচ্ছে। ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছেন কানাডার সাধারণ মানুষ।
পাশ্চ্যত্যের সমাজ ব্যবস্থায় মুসলিম জনগোষ্ঠি এমনিতেই বিব্রতকর অবস্থায় আছেন নানান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের যন্ত্রণায়। কানাডায় অবস্থানকারী মুসলিম জনগোষ্ঠিও এর বাইরে নয়। এর মাঝে আবার এই নেকাব ইস্যু নিয়ে হৈচৈ শুরু হওয়াতে বিব্রত হওয়ার মাত্রাটি যেন আরেকটু বৃদ্ধি পেল।
ঘটনার শুরু গত ১৮ অক্টোবর যখন কুইবেক প্রভিন্সের পার্লামেন্টে রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি বিল (বিল ৬২) পাশ হয়। বিলের কোথাও অবশ্য নেকাব বা বোরখার কাথা বলা হয়নি স্পষ্ট করে। বলা হয়নি যে মুসলিম মহিলাগণ রাস্তায় বোরখা পরে এবং নেকাব দিয়ে মুখ ঢেকে বেড় হতে পারবেন না। যে কথা বলা হয় সেটি হলো, বাসে বা ট্রেনে উঠতে হলে কিংবা কোন সরকারী অফিসে গিয়ে সেবা পেতে হলে কিংবা সরকারী অফিসে কাজ করতে হলে মুখ ঢেকে রাখা যাবে না। অর্থাৎ নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে। পর্দার আড়ালে থেকে সেবা নেওয়া যাবে না এবং সেবা দেওয়া যাবে না।
কিন্তু এই বিলের মূল টার্গেট যে মুসলিম মহিলাগণ সে কথা সবাই জানেন। অবশ্য কুইবেকের বিচার মন্ত্রী স্টিফেনী ভ্যালি বার বার বলে আসছেন এই বিলের লক্ষ্য মুসলিম সম্প্রদায় নয়।
রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি বিল এ আরো যা বলা হয় তা হলো:
– মুখ ঢাকা অবস্থায় যে কেউ সরকারী লাইব্রেরীতে প্রবেশ করতে পারবেন। কিন্তু লাইব্রেরী থেকে কোন বই ধার করতে পারবেন না।
– মুখ ঢাকা আবস্থায় যে কেউ হাসপাতালের ওয়েটিং রূমে বসতে পারবেন বা অপেক্ষা করতে পারবেন। কিন্তু হাসপাতালের কোন ডাক্তার বা স্টাফের সঙ্গে যোগাযোগ বা বাক্য বিনিময় করতে পারবেন না।
– মুখ ঢাকা অবস্থায় যে কেউ ডে কেয়ার সেন্টারে বাচ্চা রেখে যেতে পারবেন। কিন্তু সেই বাচ্চাকে যখন নিতে আসবেন তখন মুখ ঢাকা থাকলে তার কাছে বাচ্চাকে দেয়া হবে না।
এরকম আরো কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি বিলে। বিলটি পাশ হওয়ার পর পরই কানাডা জুড়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। বিতর্কের পাশাপাশি নিন্দার ঝড়ও উঠে কানাডাব্যাপী। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, মহিলারা কোন পোষাক পরবেন আর কোনটি পরবেন না সেটি নির্ধারণ করার দায়িত্ব কোন সরকারের নয়। অন্টারিওর প্রিমিয়ার ক্যাথেলিন ওয়েন এবং আলবার্টার প্রিমিয়ার রিচেল নটলি এই বিল ৬২ এর নিন্দা জানান। নিন্দা জানান মন্ট্রিয়লের মেয়র ডেনিস কোডার।
মন্ট্রিয়লের একটি মেট্রো স্টেশনে কয়েকজন নেকাব পরিহিতা মহিলা রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য একত্রিত হন। ছবি : সিবিসি
চারদিক থেকে নিন্দা যখন তুঙ্গে উঠে তখন কুইবেকের বিচার মন্ত্রী স্টিফেনী ভ্যালি কিছুটা নমনীয় হন এবং রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি আইনে কিছুটা ছাড় দেয়ার ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, নেকাব পরা মহিলাদেরকে বাসে বা সাবওয়েতে উঠার সময় তাদের মুখ প্রদর্শন করতে হবে না। তবে তাদের হ্রাসকৃত ভাড়া বা মেট্রো পাস সংক্রান্ত কারণে ফটো আইডি’র প্রয়োজন পড়লে তা যাচাই বা প্রমাণ করার জন্য মুখ প্রদর্শন করতে হবে। মুখ প্রদর্শন করার পর ড্রাইভার তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হলে উক্ত মহিলা যাত্রী পুনরায় মুখ ঢেকে বাসে বা সাবওয়েতে যাত্রা করতে পারবেন।
বিচার মন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা আসে বিতর্ক ও নিন্দা শুরুর বেশ কয়েকদিন পর। তিনি বলেন, এ বিষয়ে যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল সে জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।
বিচার মন্ত্রী স্টিফেনী ভ্যালি আরো বলেন, হাসপাতালে সেবা পেতে হলে মুখের পর্দা বা আচ্ছাদন অবশ্যই সরাতে হবে যখন কোন ব্যক্তি হাসপাতালের কোন কর্মীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। এর পরবর্তী পর্যায়ে অর্থাৎ পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর সেই ব্যক্তি যখন ওয়েটিং রূমে ফিরে যাবেন তখন তিনি আবার মুখের পর্দা বা আচ্ছাদন ব্যবহার করতে পারবেন। তবে অবশ্যই এমার্জেন্সী বা জরুরী চিকিৎসা প্রত্যাখান করা যাবে না।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তাদের মুখের পর্দা বা আচ্ছাদন সরাতে হবে যখন তারা শ্রেণী কক্ষে অবস্থান করে। এই আইন সকল সরকারী স্কুল কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে কার্যকর হবে। একই আইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে।
আদলতে গিয়ে কোন ব্যক্তি কোর্টের কোন ফাইল ওপেন করতে চাইলে তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য কোর্ট কর্মকর্তার সামনে মুখের পর্দা সরাতে হবে। শপথ গ্রহণের সময়ও মুখের পর্দা সরাতে হবে।
স্টিফেনী ভ্যালি বলেন, রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি আইন কুইবেক প্রভিন্সের সর্বত্রই কার্যকর হবে। তিনি আরো দাবী করেন এই আইন কোন নির্দিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে করা হয়নি। আর কুইবেকের অধিকাংশ অধিবাসী এই আইনের পক্ষে।
একই দাবী করেন কুইবেক এর প্রিমিয়ার ফিলিপ কুইয়ার্ড-ও। তিনি বলেন শুধু কুইবেক এর বাসিন্দারা নন, কানাডার সিংহভাগ নাগরিকই এই আইনের পক্ষে। তিনি আরো বলেন, আমরা কেবল বলছি যোগাযোগ, পরিচয় নিশ্চিতকরণ এবং নিরাপত্তার খাতিরে সরকারী সেবা গ্রহণ করতে হলে মুখের পর্দা সরাতে হবে। আমরা একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বাস করি। যখন কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে, তখন তার মুখ আমার দেখতে পারা উচিৎ। তেমনি ভাবে আমি যার সঙ্গে কথা বলবো সেই ব্যক্তিরও অধিকার আছে আমাকে দেখতে পারার।
নেকাব নিষিদ্ধের পক্ষে সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে, কুইবেকের বিচার মন্ত্রী স্টিফেনী ভ্যালি ও প্রিমিয়ার ফিলিপ কুইয়ার্ড এর এমন দাবীর পিছনে অবশ্য প্রমাণ রয়েছে। কুইবেকের পার্লামেন্টে বিল ৬২ পাশ হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে Angus Reid Institute কর্তৃক পরিচালিত এক জরীপে দেখা যায় কুইবেকের অভিভূতকারী সংখ্যক অধিবাসী এই আইন প্রবর্তনের পক্ষে ছিলেন। জরীপে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে শতকরা ৮৭ জনই চাননি মুখের উপর পর্দা থাকুক। আর প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জন এই পর্দা প্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন। আইনটি পার্লামেন্টে পাশ হওয়ার পরও নিশ্চই তাদের মতামত পরিবর্তন হয়নি।
এমনকি মুসলিম মহিলাদের মধ্যেও এই আইনের প্রতি সমর্থন লক্ষ্য করা গেছে। এমনি একজন মহিলা হলেন ইনসাফ হায়দার। সংবাদ সংস্থা কানাডিয়ান প্রেস এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি যখন সৌদী আরবে ছিলাম তখন আমাকে নেকাব পরতে হতো। কারণ, ঐ দেশে মহিলাদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক। আমি মনে করি নেকাব এমন একটি প্রথা যা মহিলাদেরকে সমাজ থেকে দূরে রাখে এবং তাদেরকে অন্ধকারে রাখে। যারা নেকাব প্রথায় বিশ্বাস করেন, কুইবেকে বা কানাডায় তাদের কোন স্থান নেই। যেখানে নেকাব সেখানে মহিলারা অস্তিত্ব¡হীন। নেকাব পরা মহিলাকে ভূত বা প্রেতাত্মার মত লাগে।”
ইনসাফ হায়দার মন্ট্রিয়লের শেরব্র“কে থাকেন তিন সন্তান নিয়ে। তার স্বামী রাইফ বাদাউই সৌদীতে আলেমদের সমালোচানা করায় সেখানে দশ বছরের জেল খাটছেন।
ইনসাফ হায়দার আরো বলেন, “আমি বিশ্বাস করি না নেকাব পরা মহিলাদের জন্য একটি পছন্দনীয় কাজ হতে পারে। আর আমি আশা করছি একদিন এই নেকাব কালচার কানাডা থেকে মুছে যাবে। আমরা এই দেশে এসেছি মুক্তির জন্য। এই দেশে আমরা অনেক কিছুই করতে পারি যা আমরা আমাদের মাতৃভূমিতে করতে পারতাম না। আমি এখন এই কানাডায়, আমি এখানে মুক্ত, আমার নিজস্ব পরিচয় রয়েছে এখানে এবং আমি এখানে আমি।”
বিল ৬২ কুইবেকের পার্লামেন্টে পাশ হওয়ার পর যারা বোরখা এবং সেই সাথে নেকাব পরেন তারা এখন অনিশ্চয়তা ও আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এমনকি যারা হিজাব পরেন তারাও। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে এখন তারা আর রাস্তায় বের হচ্ছেন না। বের হওয়ার আগে একাধিকবার চিন্তা করছেন বের হবেন কি হবেন না। অনেকে ইতিমধ্যে বাইরে বের হওয়ার মাত্রা কমিয়ে দিয়েছেন। এদেরই একজন হলেন ৩৪ বছর বয়সী ওয়ার্দা নেইলী। ধর্মান্তরিত মুসলিম তিনি। গত প্রায় ৬ বছর ধরে বোরখা ব্যবহার করে আসছেন এবং তার সাথে বেশ লম্বাকৃতির নেকাব। ২১ বয়সী আরেক মহিলা ফাতেমা আহমদ, তিনিও বোরখা এবং নেকাব পরেন। তারা বার্তা সংস্থা কানাডিয়ান প্রেস-কে বলেন কেউ তাদেরকে এই পোষাক পরার জন্য চাপ দেয়নি। নিজে থেকেই তারা এটি পরছেন। কিন্তু কুইবেকে নতুন আইন হওয়াতে তারা দুজনেই খুব উদ্বিগ্ন। ফাতেমা বলেন, “এই আইন আমার নিয়মিত ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া আসায় ব্যাঘাত ঘটাবে। অবশ্য তিনি আশাবাদী এই ভেবে যে, এরকম পরিস্থিতির হয়তো উদ্ভব ঘটবে না কারণ তার শিক্ষকগণ নাকি তাকে বলেছেন তারা তাকে সমর্থন এবং সহায়তা করবেন। তবে তিনি অনুমান করছেন, ভবিষ্যতে হয়তো তাকে ঘরেই সময় কাটাতে হবে। অপরদিকে ওয়ার্দা নেইলী বলেন তিনি ইতিমধ্যই বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। কারণ, তার আশংকা, নেকাব পরে বাইরে গেলে তিনি বৈষম্যের শিকার হতে পারেন। তবে তাকে হাসপাতালে যেতে হচ্ছে নিয়মিত তার স্বাস্থ্যগত কারণে।
উল্লেখ্য যে, এই নেকাব নিষিদ্ধ করার বিষয়টি ইতিপূর্বে আরো কয়েকটি দেশে ঘটেছে। এর মধ্যে আছে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও অস্ট্রেলিয়া। জার্মানী এখনো নেকাব নিষিদ্ধ করেনি সম্পূর্ণভাবে। তবে গাড়ি চালানোর সময় কেউ এমন কোন পর্দা বা বস্ত্রখন্ড ব্যবহার করতে পারবেন না যা তাদের মুখাবয়ব সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখে। জার্মানীর পার্লামেন্ট সম্প্রতি এই আইন পাশ করেছে। দেশটির নেত্রী চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল সম্প্রতি বলেন, জার্মানীতে নেকাব নিষিদ্ধ করা উচিৎ যদি আইনগতভাবে তা করা যায়।
অস্ট্রেলিয়ায় মুসলিম মহিলাদের প্রকাশ্য স্থানে পুরো মুখ-ঢাকা নেকাব বা বোরকা পরা নিষিদ্ধ করে যে আইন হয়েছে সম্প্রতি – তা কার্যকর হয়েছে গত ১ অক্টোবর থেকে। বিবিসি জানায়, অস্ট্রেলিয়ার সরকার বলছে, এই আইনে মাথার চুল থেকে চিবুক পর্যন্ত মুখ দৃশ্যমান থাকতে হবে, এবং অস্ট্রেলিয়ার মূল্যবোধ রক্ষার জন্যই এটা করা হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ৭ লক্ষ মুসলিম বাস করেন, কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ১৫০ জনের মতো মহিলা পুরো মুখ-ঢাকা বোরকা বা নেকাব পরেন বলে অনুমান করা হয়।
ফ্রান্স আরো অনেক আগেই নেকাব নিষিদ্ধের আইন পাশ করে। ২০১০ সালে পার্লামেন্টে পাশ কারা ঐ আইনে অবশ্য কোন ধর্মের কথা উল্ল্লেখ করা হয়নি। তবে স্পষ্টতই তা ছিল মুসলিম নারীদের নেকাব। ফ্রান্সে জনসমক্ষে কেউ নেকাব পরতে পারে না। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস্ও ২০১৪ সালে এই আইনকে সমর্থন জানায়।
বেলজিয়াম জনসমক্ষে নেকাব পরা নিষিদ্ধ করে ২০১১ সালে। ঐ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে দুই মুসলিম নারী ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস এর নিকট অভিযোগ করেন। তাদের অভিযোগ ছিল এই আইনের মাধ্যমে তাদের ধর্ম পালনের অধিকারকে অবমাননা করা হয়েছে, যে অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটস। কিন্তু ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস বেলজিয়াম সরকারের করা আইনকেই সমর্থন জানায়।
বৃটেনে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেকাব বা বোরকার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি এখনো। বৃটেনে অবশ্য বোরখা ও নেকাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য কেউ কেউ দাবী উঠাচ্ছেন।
বুলগেরিয়াতে নেকাব নিষিদ্ধ করা হয় গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে। সুইজারল্যান্ডের দক্ষিনাঞ্চলীয় প্রদেশ টিসিনো-তে নেকাব নিষিদ্ধ করা হয় ২০১৬ সালে। ইটালীর অভিজাত এলাকা লম্বর্ডে-তে নেকাব নিষিদ্ধ করা হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে।
মুসলিম অধ্যুষিত দেশ চাদ এ-ও নেকাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নেকাব নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে আরেক মুসলিম দেশ মিশরও। মিশরের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদগণ বলেন, নেকাব ইসলামী পোষক নয়, কোরআনেও কোথাও বলা হয়নি নেকাব পরতে হবে। শুধু তাই নয়, এমনো বলা হচ্ছে যে, নেকাব মূলত ইহুদীদের পোষাক!
বৃটেনের এক্সপ্রেস পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের (http://www.express.co.uk)) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মিশরের পার্লামেন্টের সদস্য ও সেদেশের সুপ্রিম কাউন্সিল ফর ইসলামিক এ্যাফেয়ার্স এর সদস্য ড.অমনা নসের বলেন, “নেকাব ইহুদী ঐতিহ্যের পোষাক। এটি মুসলিম নারীদের পরা কর্তব্য নয়। ইহুদী ধর্মালম্বীদের পোষাকের অংশ এটি।” তিনি আরো বলেন, “নেকাব ইসলাম আবির্ভূত হওয়ার আগেই কোন কোন আরব উপজাতিদের প্রচলিত ছিল। কোরআনের বক্তব্যের সঙ্গে নেকাবের কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। কোরআনে মুসলিম নারীদেরকে শালীন পোষাক পরার জন্য বলা হয়েছে এবং মাথার চুল ঢেকে রাখার কথাও বলা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়নি মুসলিম নারীদেরকে মুখ ঢেকে রাখতে হবে।”
মিশরের প্রধান ও বিখ্যাত কায়রো ইউনিভার্সিটি ক্লাসরূমে শিক্ষকদের নেকাব পরা নিষেধ করেছে যা দেশটির আদালতও সমর্থন করেছে।
উল্ল্লেখ্য যে, কানাডার ক্যালগারী মাউন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাহফুজ ইতিপূর্বে বলেন, “কোরআনের কোথাও লেখা নেই যে মহিলাদেরকে হিজাব পরতেই হবে। বোরখা, হিজাব নেকাব ইত্যাদি সৌদি আরবের আদিকালের সংস্কৃতি। ইসলামের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।”
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কুইবেকে নেকাব নিষিদ্ধ করা নিয়ে কেন এত হৈ-চৈ হচ্ছে? নেকাব যদি ইসলামী পোষাক না হয়ে থাকে, এটি যদি ইহুদীদের ঐতিহ্য হয়ে থাকে এবং কোরআনের কোথাও যদি মুসলিম মহিলাদের মুখ ঢাকার নির্দেশ না থাকে তবে নেকাব নিষিদ্ধ করায় কুইবেকের নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছেন কেন কানাডার মূলধারার রাজনীতিকগণও!
কানাডায় নেকাব নিয়ে বিতর্ক বা আইনী লড়াই আসলে এই প্রথম নয়। স্মরণ করা যেতে পারে
যে, ভোট রাজনীতির অংশ হিসেবে সাবেক কনজারভেটিভ সরকার মুসলিম নারীদের নেকাব পরার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল। তাদের দাবী ছিল মুখ ঢেকে রাখা কানাডার সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই আইন করেছিল নাগরিকত্ব লাভ করতে হলে শপথ গ্রহনের সময় মুখ ঢেকে রাখা চলবে না।
কনজারভেটিভ পার্টির পরিকল্পনা সব ঠিকঠাকমতই চলছিল। কিন্তু বাধ সাধে জুনেরা ইসহাক নামের এক পাকিস্তানী মহিলা। তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠেন সাবেক সরকারের ঐ সিদ্ধান্তে। মামলাও করে বসেন। জুনেরার দাবী ছিল, সরকারের ঐ সিদ্ধান্ত তার ধর্মীয় স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে।
মামলায় সরকার পরাজিত হয়। কিন্তু সরকার তখন থেমে থাকেনি। আদালতের ঐ রায়ের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে আপীল করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সরকারের। ঐ আপীলেও হেরে যায় তারা। এদিকে তখন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণাও দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। হাতে সময়ও ছিলনা। পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে দেখে কানাডার সর্বোচ্চ অদালত সুপ্রীম কোর্টে আপীল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সাবেক কনজারভেটিভ পার্টি।
কিন্তু ইতিমধ্যে জুনেরা ইসহাক ফেডারেল কোর্ট অব আপীলের রায় তার পক্ষে যাওয়ায় নেকাব পরেই তিনি শপথ গ্রহণ করেন এবং গত নির্বাচনে ভোটও দেন।
ঐ নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির পরাজয় ঘটে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে লিবারেল পার্টি। আর সরকার গঠনের একমাস পার হওয়ার আগেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সাবেক সরকারের আপীল করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসার।
ঐ সময়ে প্রকশিত কানাডিয়ান প্রেস এর এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, লিবারেল সরকারের জাস্টিস মিনিস্টার জডি ওইলসন ব্যক্তিগত ভাবে জুনেরা ইসহাককে ফোন করেন এবং তাদের সরকার যে নেকাবের বিষয়টি নিয়ে সুপ্রীম কোর্টে যাচ্ছেন না তা তাকে নিশ্চিত করেন।
জাস্টিস মিনিস্টার বলেন, কানাডার ইমিগ্রেশন আইনে এমন কোন ধারা নেই যাতে লেখা আছে যে শপথ গ্রহনের সময় মুখ দেখাতে হবে। উল্ল্লেখ্য যে, নেকাব নিষিদ্ধের আইন বাতিল হলেও শপথ গ্রহন শুরু হওয়ার আগে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কাছে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মুখের পর্দা সরাতে হবে। পরে যখন সবাই মিলে জাজ এর সামনে হাত তুলে শপথ গ্রহণ করবেন তখন মুখের পর্দা না সরালেও চলবে।
জুনেরা ইসহাক যে পাকিস্থান থেকে কানাডায় এসে নেকাব নিয়ে হুলস্থুল কান্ড বাধিয়েছেন সেই পাকিস্তানেও আদালতে নেকাব পরা যায় না। ২০০৪ সালে পেশোয়ার হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি তারিক পারভেজ খান একজন মহিলা আইনজীবীকে আদালতে অবস্থানকালে নেকাব পরা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছিলেন।
জুনেরা ইসহাককে স্পন্সর করে পাকিস্তান থেকে কানাডায় নিয়ে এসেছেন তার স্বামী ২০০৮ সালে। ২০১৩ সালে ইসহাক সিটিজেনশীপ পরীক্ষা পাশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি যখন নেকাব নিষিদ্ধ করার বিষয়টি জানতে পারেন তখন তিনি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ফেডারেল সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে বসেন। কিন্তু কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হলো, তিনি তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেয়ার জন্য কানাডায় আসার পর মুখমন্ডল উন্মোচন করেছিলেন। তখন তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগেনি এবং পরপুরুষের সামনে মুখমন্ডল উন্মেচিত করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে লাইসেন্স নিতে অস্বীকৃতি জানাননি। তিনি যখন পাকিস্তান থেকে কানাডা আসছিলেন তখন বিভিন্ন বিমান বন্দরে এবং কানাডার ইমিগ্রেশন দরজা পার হতে নিশ্চই তাকে একাধিকবার মুখের পর্দা সরাতে হয়েছিল। তখনও তিনি কানাডায় আসার ব্যাপারে আপত্তি জানাননি। জানালে নিশ্চই তিনি কানাডায় আসতে পারতেন না।
জুনেরা ইসহাক নেকাব পড়তে শুরু করেন ১৫ বছর বয়স থেকে। পরবর্তীতে তিনি আইডিয়েন্টিফিকেশনের জন্য বিভিন্ন সময় মুখমন্ডল উন্মোচন করেছেন। কিন্তু সিটিজেনশীপ পাওয়ার জন্য যখন তিনি মুখমন্ডল উন্মোচন করে শপথ নিতে অস্বীকৃতি জানান তখন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাকে শপথ গ্রহনের সময় একেবারে সামনের সিটে অথবা একেবারে পিছনের সিটে বসার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাতে তিনি রাজী হননি। তার যুক্তি ছিল- ইমিগ্রেশন জাজ বা অন্যান্য কর্মকর্তারা নারী না হয়ে পুরুষ হতে পারেন। তাছাড়া লোকজন সেখানে ছবিও তুলতে পারেন।
উপরে বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, নেকাব বা বোরখা পরাতো দূরের কথা, হিজাব নিয়েও ইসলামে তেমন বাড়াবাড়ির কথা নেই। কিন্তু দেখা গেছে, ২০০৭ সালে মিসিসাগায় আকসা পারভেজ নামের এর তরুনীকে হিজাব না পরার কারণে তার বাবা ও ভাই মিলে তাকে হত্যা করে। ঐ সময় কানাডিয়ান কাউন্সিল অব ইমাম এর সহ-সভাপতি ও ইসলামী চিন্তাবিদ ড. মোহাম্মদ আলনাডুই বলেছিলেন, ইসলাম এটি সমর্থন করে না। হিজাব পরার জন্য আমরা আমাদের মেয়েদের বাধ্য করতে পারি না। যদি মেয়েরা নিজ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে হিজাব পরে সেটিই ভাল। একই সময় মিসিসাগায় অবস্থিত ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার ইমাম শেখ আলা ই. সাঈয়েদ বলেছিলেন, হিজাব পরলে মহিলারা ইসলামে উচ্চতর আসনে আসীন হন সত্যি তবে এটি পরা না পরা সম্পূর্ণ মহিলাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে।
লক্ষ্যনীয় যে, অধিকাংশ মুসলিম দেশেই নেকাব পরার বাধ্যবাধকতা নেই। বোরখার এই ঘোমটা বা নেকাব শরীয়া আইনেরই বাধ্যবাধকতা। আজকে বাংলাদেশসহ আরো অনেক মুসলিম দেশ শরীয়া আইন ছাড়াই যদি শাসন ব্যবস্থা সচল রাখতে পারে তবে সে ক্ষেত্রে কানাডাসহ পাশ্চাত্যের গুটি কতক দেশে বোরখা বা নেকাব পরা নিয়ে নিয়ে একশ্রেণীর গোড়াঁ পন্থী মুসলমানদের এই বাড়াবাড়ির কোন যুক্তি আছে বলে মনে করেন না অনেকেই। পাশাপাশি কানাডার মূলধারার রাজনীতিকদের মধ্যেও নেকাব এর পক্ষ নিয়ে বাড়াবাড়ির কোন যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে করেন না অনেকে।
মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেস এর মতে নেকাব ও বোরকা হলো যারা মুসলমানদেরকে একটি ধর্মীয় গন্ডির মধ্যে আলাদা করে রাখতে এবং তাঁদেরকে সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চান সেইসব ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক হাতিয়ার। এই কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা তারেক ফাত্তা ইতিপূর্বে এক বক্তব্যে বলেন, কতক মুলমান আছেন যারা কানাডায় আসেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এ উদ্দেশ্য হলো এখানকার সৌহার্দপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া। তিনি এদেরকে মুসলমান না বলে ‘ইসলামিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
www.sachalayatan.com এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় -নেকাব যে বাধ্যতামূলক নয় তার আরেকটি প্রমাণ পাওয়া যায় এই হাদিসে :- “আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত, একদা রসুল উটের পিঠে চড়ে যাচ্ছিলেন, আব্দুল্লাহর ভাই আল-ফজলও ওনার পেছনে বসা ছিল। একটি সুন্দরী রমণী নবীজীর কাছে এল তার বাবার হজের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন করতে। আল-ফজল মেয়েটির সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে বারবার তার দিকে তাকাতে লাগল। নবীজী এটি লক্ষ করেছিলেন। মেয়েটি যখন তার সঙ্গীদের নিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন তিনি আল-ফজলের মুখ হাত দিয়ে ধরে মেয়েটির দিক থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেন। আল আব্বাস নবীজীর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি উত্তর করলেন, “আমি লক্ষ করলাম ছেলেটি এবং মেয়েটি উভয়েই তরুণ; এবং আমি ভয় পাচ্ছিলাম শয়তান এখানে নাক গলাতে পারে।” (তিরমিযী এবং বুখারী)
গবেষকরা যুক্তি দেখান,
নবীজী যুবক আল-ফজলের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, কিন্তু ওই নারীর মুখমণ্ডল উন্মুক্ত থাকার বিষয়ে কিছু বলেননি। নিয়ম অনুযায়ী, নবীজী যেসব বিষয়ে নীরব থেকেছেন তা তাঁর সমর্থনেরই বহিঃপ্রকাশ। এই হাদিসটিকে তাই একটি শক্ত প্রমাণ হিসেবে মনে করা হয় নেকাব যে বাধ্যতামূলক নয় তা বোঝাতে।”
মুসলিম নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন ‘কানাডিয়ান থিংকার্স ফোরাম’ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাহির গোরা বলেন, নেকাব ইসলামের বাধ্যতামূলক কোন পরিধেয় বস্ত্র নয় এবং সিংহভাগ কানাডিয়ান মুসলিম নারীরা এটি পরেন না। কানাডার প্রায় অর্ধলক্ষ মুসলিম নারীর মধ্যে মাত্র কয়েকশত মহিলা হয়তো এটি পরিধান করে থাকেন। তাহলে কেন কানাডার রাজনীতিবিদগণ এবং মিডিয়াগুলো এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম ইস্যু হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন? তাহির গোরা আরো বলেন, নেকাব হজের সময়ও অনুমোদিত নয়। হজ হলো মুসলমানদের পাঁচটি মৌলিক আদর্শের একটি। তাছাড়া নেকাব একটি ড্রেসও নয়। এটি এক ধরণের মাস্ক বা মুখোশ। কানাডার গুটি কয়েক মুসলিম মহিলা এটি পরে থাকলেও বাকি সকল মুসলিম মহিলা এটি ছাড়াই ধর্ম পালন করে আসছেন। তাহির গোরা আরো বলেন, কোন মহিলা যদি নেকাব পরেন তবে তার পরিচয় নিশ্চিত করার অধিকারও সমাজ ও রাষ্ট্রকে দিতে হবে তাকে। গুটি কয়েক মুসলিম মহিলা নেকাব পরে অযথা একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করছেন।
“কাউন্সিল ফর মুসলিমস ফেসিং টুমোরো” এর প্রেসিডেন্ট এবং লেখিকা রাহেল রেজা বলেন, নেকাব বা বোরখা কোনটার সঙ্গেই ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এটি মুসলিম ব্রাদাহুড, ইসলামিক স্টেট, তালেবান, আল-কায়দা ও সৌদী আরবের রাজনৈতিক পতাকা।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কুইবেকের অভিভূতকারী সংখ্যক অধিবাসী বিল ৬২ প্রবর্তনের পক্ষে ছিলেন। জরীপে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে শতকরা ৮৭ জনই চাননি মুখের উপর পর্দা বা নেকাব থাকুক। এর সাথে অতীতের আরেকটি জরীপ তথ্য এখানে যোগ করা যেতে পারে যেটি পরিচালনা করেছিল Vox Pop Labs নামের একটি সংস্থা। ঐ জরীপে দেখা গেছে ৭২% কানাডিয়ান নিকাবের বিরুদ্ধে। মাত্র ১৯% কানাডিয়ান বলেছে নিকাবের ব্যাপারে তাদের সমস্যা নেই। এটি সাধারণ জনগণের মতামত। আর রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে এই চিত্র অন্যরকম।bloc quebecois এবং কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য/সমর্থকরা নেকাবের ঘোরতর বিরোধী। তাদের বিরোধীতার মাত্রা যথাক্রমে ৯৬% ও ৯২%। কিন্তু এনডিপি লিবারেল ও গ্রীন পার্টির সদস্য/সমর্থকদের মধ্যে নিকাবের বিরোধীতাকারীর সংখ্যা কম। এদের মাত্রা যথাক্রমে ৬২%, ৫৭% ও ৫১%।
অর্থাৎ, আঞ্চলিকভাবে কুইবেক এবং সার্বিকভাবে কানাডার সিংহভাগ মানুষই এই নেকাবের বিপক্ষে। অথবা বলা চলে তারা এর ঘোরতর বিরোধী। অন্যদিকে ইসলামী বিশেষজ্ঞগণও বলছেন নেকাব ইসলামী পোশাকের অংশ বা ঐতিহ্য নয়। ইতিহাসও সেই সাক্ষ্য দেয়। তাহলে ইসলামের দোহাই দিয়ে এবং এর পাশাপাশি কানাডার চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম এ ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্বসহকারে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এসব কথা বলে কেন এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে সেই প্রশ্নই এখন জোরালো হয়ে উঠছে।
লক্ষ্যনীয় যে, কুইবেকে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘনিয়ে এসেছে। আর মাত্র ১১ মাস বাকী। আগামী বছর অক্টোবর মাসের ১ তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ঠিক এমন সময় নেকাব ইস্যুকে চাঙ্গা করার পিছনে কি কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে যেমনটা করেছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির স্টিফেন হারপার গত জাতীয় নির্বাচনের আগে?
সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার চেয়েছিলেন নেকাব ইস্যুকে উস্কে দিয়ে কানাডায় বিদ্যমান ইসলামোফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে ভোট বেশী পেতে। কিন্তু হারপারের সেই পরিকল্পনা ঠিক মত কাজ করেনি। সে সময় লিবারেল পার্টি নেকাব এর পক্ষ নেয়। জাস্টিন ট্রুডো নেকাব পরার পক্ষ নিয়ে কনজারভেটিভ পার্টির সমালোচনা করেছিলেন সেদিন। আর আজ তারই দলের প্রভিন্সিয়াল (কুইবেক) গ্র“পের সদস্যরা সেই নেকাব পরা বন্ধ করার জন্য পার্লামেন্টে আইন পাশ করলো।
জাস্টিন ট্রুডো অবশ্য এখনো নেকাবের পক্ষেই রয়ে গেছেন। কুইবেক পার্লামেন্টে আইনটি পাস হওয়ার পর প্রথম দিকে তিনি কি করবেন তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কারণ কুইবেকে তার দলের লোকেরাই আইনটি পাস করিয়েছেন। কিন্তু পরে তিনি এই আইনের বিরুদ্ধে ক্রমশ সোচ্চার হতে থাকেন। প্রথম দিকে তিনি বলেছিলেন প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টে পাস করা আইনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার দায়িত্ব জনগনের, ফেডারেল সরকারের নয়। এখন বলছেন ফেডারেল সরকার পথ অন্বেষণ করছে কি করে নেকাব পরা মহিলাদের অধিকার রক্ষা করা যায়। তিনি আরো বলেন, আমি সবসময়ই ব্যক্তির অধিকার রক্ষায় সোচ্চার এবং সবসময়ই সোচ্চার থাকবো কানাডার চার্টার অব রাইটস এ্যান্ড ফ্রিডম এ বর্ণিত অধিকারসমূহকে রক্ষা করার জন্য।
জাস্টিন ট্রুডো গত জাতীয় নির্বাচনের আগে আরো বলেছিলেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করার সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। সরকার বা অন্য যে কোন নেতা যখন সংখ্যালঘুদের কোন অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত বা সীমিত করতে চাইবে তখন তার পিছনে জোড়ালো কারণ বা যৌক্তিকতা থাকতে হবে।
এনডিপি’র নবনির্বাচিত দলীয় প্রধান জাগমিত সিং বলেছেন তিনি কুইবেকের এই বিল ৬২ এর সম্পূর্ণ বিরোধী। তিনি মনে করেন এই আইন মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। মৌলিকভাবে আমরা রাষ্ট্রিয়ভাবে কাউকে বলতে পারি না সে কি পোষাক পরবে বা পরবে না।
এনডিপি’র সাবেক দলীয় প্রধান টম মুলকেয়ার-ও নেকাব এর পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন গত জাতীয় নির্বাচনের আগে।
অন্যদিকে অন্টারিও প্রভিন্সে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আগামী বছর জুন মাসের ৭ তারিখে। অর্থাৎ আর ৬ মাসের মতো সময় আছে হাতে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রিমিয়ার ক্যাথলিন ওয়েন’ও বিল ৬২ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন এই আইনের ফলে নেকাব পরা মহিলাগণ আরো বেশী মাত্রায় সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।
কুইবেকের লিবারেল পার্টি নেকাব বিরোধী আইন করেছে সেখানকার জনগনের ভোট পাবার জন্য। আর অন্টারিও লিবারেল পার্টি সেই আইনটিরই বিরোধীতা করছে সেই একই কারণে, অর্থাৎ জগনের ভোট পাবার জন্য। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়টি বিভ্রান্তকর মনে হতে পারে। কিন্তু একটু ব্যাখ্যা করলে তা আর বিভ্রান্তকর ঠেকবে না কারো কাছেই।
অতীতের বিভিন্ন গবেষণা আর জরীপ থেকে দেখা গেছে কুইবেকের জনগণ এই নেকাব আর হিজাবের ঘোর বিরোধী। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে কুইবেকের অভিভূতকারী সংখ্যক অধিবাসী বিল ৬২ প্রবর্তনের পক্ষে ছিলেন। জরীপে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের মধ্যে শতকরা ৮৭ জনই চাননি মুখের উপর পর্দা বা নেকাব থাকুক। ফলে এই ভোটারদের মন জয় করার জন্য এরকম একটি আইন করাটা কুইবেকের বর্তমান লিবারেল সরকার লাভজনক বলেই মনে করেছে।
অন্যদিকে অন্টারিওর লিবারেল সরকার মনে করছে তাদের নিজ প্রভিন্সে মুসলিম ভোটার সংখ্যা আগামী নির্বাচনের জন্য একটি ফ্যাক্টর। সুতরাং তাদেরকে খুশী রাখতে হবে। গত জাতীয় নির্বাচনে দেখা গেছে এই মুসলিমদের প্রায় সবাই ভোট দিয়েছেন লিবারেল দলকে। সুতরাং প্রভিন্সিয়াল নির্বাচনেও তারা লিবারেল সরকারকেই ভোট দিবে এমনটা হয়তো আশা করা যায়। আর এই আশা থেকেই নেকাবের পক্ষ নেয়া ক্যাথিলিন ওয়েন এর, এমনটা ভাবাই যায়।
এভাবেই আসলে নেকাব ইস্যুকে জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে বার বার টেনে আনা হচ্ছে। এখানে ধর্ম রক্ষা করা, ধর্ম পালনকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা, নেকাব ব্যবহারকারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা বা ধর্ম পালনে ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষা করা এর কোনটাই মূখ্য বিবেচনার বিষয় নয়। কারণ, মেইন স্ট্রিমের রাজনীতিকরা নিশ্চই অতটা বিচারবুদ্ধিহীন নন যে, নেকাব বিষয়টি সম্পর্কে তারা অবগত নন। তারা রাজনীতি করবেন বিভিন্ন এথনিক গ্র“প নিয়ে আর সেই গ্র“পসমূহের সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাসের আলো অন্ধকারের দিক সম্পর্কে অবহিত থাকবেন না তা হয় না।
আর নাগরিকদের ধর্ম বিশ্বাস বা ধর্ম পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কানাডার রাজনীতিকগণ কতটা আন্তরিক বা স্বচ্ছ তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় যখন দেখা যায়- বিল ৬২ বা রিলিজিয়াস নিউট্রালিটি বিল এমন এক পার্লামেন্টে পাস করানো হয়েছে যেখানে স্পীকারের মাথার উপর টানানো রয়েছে যিশু খৃষ্টের ক্রশবিদ্ধ বিশাল আকৃতির এক দেয়াল মূর্তি! মানুষের ধর্ম বিশ্বাস বিষয়ে পার্লামেন্টের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য এই মূর্তিটি সরানো হবে কিনা এরকম প্রশ্নের জবাবে কুইবেকের লিবারেল সরকার না সূচক উত্তর দিয়েছে!
স্মরণ করা যেতে পারে যে ইতিপূর্বে কুইবেকে ‘চার্টার অব ভ্যালুস’ প্রবর্তন করতে চেয়েছিল ‘পার্টি কুইবেকো’ যাতে বলা হয়েছিল- সরকারী অফিস আদালতে কেউ ধর্মীয় পোষাক, প্রতীক বা চিহ্ন পরিধান করতে পারবে না। এটি স্পষ্টতই মুসলমান সম্প্রদায়কে টার্গেট করে করা হয়েছিল। বিষয়টি তখন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। ঐ সময়ও এই যিশু খৃষ্টের ক্রশবিদ্ধ বিশাল আকৃতির দেয়াল মূর্তিটি অপসারণের দাবী উঠেছিল পার্লামেন্টের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য। কিন্তু মূর্তিটি অপসারণের ব্যাপারে পার্টি কুইবেকো তখন অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আরো কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো এই পার্টি কুইবেকো সরকারী অফিস আদালতে ধর্মীয় পোষাক পরিধানের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারীর চেষ্টা করলেও এবার তারাই আবার নেকাব নিষিদ্ধের বিরোধিতা করেছে! পার্লামেন্টে ভোট দিয়েছে এই বিল ৬২ যাতে পাস না হয়!
অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের নেতৃত্বে কনজার্ভেটিভ পার্টি নেকাবের বিরোধীতা করে যখন একে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল তখন বর্তমান অন্টারিও কনজার্ভেটিভ পার্টির নেতা প্যাট্রিক ব্রাউন তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই প্যাট্রিক ব্রাউনই এখন আবার কুইবেকে নেকাব নিষিদ্ধের বিরোধীতা করছেন!
কানাডা একটি স্বচ্ছ উদার গণতান্ত্রিক দেশ, স্বাধীন মত প্রকাশের দেশ, স্বাধীনভাবে চিন্তা করার দেশ এবং শিষ্টাচারের দেশ। এদেশে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনে কোন বাধা নেই। আর এ কারণেই অভিবাসীদের পছন্দের তালিকায় কানাডা বরাবরই শীর্ষে অবস্থান করে আসছে।
কিন্তু এ দেশে এসেও যদি অভিবাসীরা দেখেন এখানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি হয়, ধর্মের নামে মানুষ মুখোস পরে অবগুণ্ঠিত হয়, নিজের পরিচয় গোপন করে, সমাজ বিচ্ছিন্নতার পথ বেছে নেয় এবং ধর্মের নামে অনার কিলিং এর মত মধ্যযুগীয় বর্বরতার পথ বেছে নেয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে আসলে সমস্যাটা কোথায়?
যারা সমাজ বিজ্ঞানী, যারা মনোবিজ্ঞানী তারা হয়তো গবেষণা করে এর কারণসমূহ বের করতে পারবেন। কিন্তু কানাডায় যারা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তারা চান সহজভাবে জীবনযাপন করতে এবং গোড়াঁমী-ধর্মান্ধতা বাদ দিয়ে সহজ-স্বচ্ছভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে। তারা পছন্দ করেন স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ রাজনীতি। তারা চান না সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ম নিয়ে কোন বিভেদ সৃষ্টি হোক, সৃষ্টি হোক ভুল বোঝাবুঝির। বহু সংস্কৃতি ও বহু ধর্মের এই সামাজ থেকে বিভেদ সৃষ্টিকারী এই নীতি-অভ্যাস ও চর্চাগুলো অবিলম্বে দূর হোক এটাই সবাই চান।