কানাডা আগামী তিন বছরে দশ লাখ ইমিগ্রেন্টকে স্বাগত জানাবে
সরকারের দাবী নতুন পরিকল্পনা কানাডার অর্থনীতি বিকাশে সাহায্য করবে, সাহায্য করবে শরণার্থীদেরও।
সমালোচকরা বলছেন বিশ্বব্যাপী অভিবাসন সংকট এবং কানাডা জুড়ে শ্রম ঘাটতির বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে
নভেম্বর ৭, ২০১৭
প্রবাসী কণ্ঠ ডেস্ক : কেন্দ্রীয় লিবারেল সরকার তার ২০১৮ সালের অভিবাসন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছে। বিশ্বব্যাপী অভিবাসন সংকট, অবৈধ সীমান্ত অতিক্রম এবং সারাদেশে অব্যাহত শ্রম ঘাটতির মুখে সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখার লক্ষ্যে নতুন এই অভিবাসন পরিকল্পনা তৈরী করা হয়েছে। আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কানাডা আগামী তিন বছর পর্যায়ক্রমে প্রায় ১০ লাখ ইমিগ্রেন্টকে স্বাগত জানাবে। গত ১ নভেম্বর সংসদে এই পরিকল্পনা পেশ করেন ইমিগ্রেশন মন্ত্রী আহমদ হোসেন। নতুন এই ইমিগ্রেন্টদের স্বাগত জানানো হবে ইকনমিক মাইগ্রেন্ট, ফ্যামিলি রিইউনিফিকেশন ও রিফিউজি ক্যাটাগরীতে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছর স্বাগত জানানো হবে ৩ লাখ ১০ হাজার ইমিগ্রেন্টকে। ২০১৯ সালে স্বাগত জানানো হবে ৩ লাখ ৩০ হাজার ইমিগ্রেন্টকে এবং ২০২০ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাড়াবে ৩ লাখ ৪০ হাজারে। খবার সিবিসি নিউজ এর।
ইমিগ্রেশন মন্ত্রী আহমদ হোসনে বলেন, কানাডার সরকার বিশ্বাস করে নতুন ইমিগ্রেন্টরা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন আগামী ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ কানাডিয়ান অবসর জীবনে চলে যাবেন। কিন্তু আমাদের পর্যাপ্ত সংখ্যাক কর্মী থাকবে না এই সিনিয়র সিটিজেনদের সেবা প্রদানের জন্য।
নতুন ইমিগ্রেন্ট নেয়ার এই তিন বছর মেয়াদী পরিকল্পনাকে সরকার সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্খী পরিকল্পনা বলে আখ্যায়িত করে।
ইতিপূর্বে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নতুন পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্যের মধ্যে আছে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাজারে শীর্ষ প্রতিভাধরদেরকে আকৃষ্ট করা, পরিবার পুন:সংযুক্ত করা এবং দুর্যোগ ও সংঘর্ষের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য আশ্রয়ের প্রস্তাব করা। ইমিগ্রেশন মন্ত্রী আহমদ হোসনে বলেন কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থা সমবেদনা, দক্ষতা এবং সবার জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ এই বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে চলতে থাকবে এবং পাশাপশি কানাডিয়ানদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সকল ব্যবস্থা থাকবে।
প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির এমপি এবং অভিবাসন সংক্রান্ত দলীয় সমালোচক মিশেল রেমপেল সংসদে এই পরিকল্পনা পেশ করার আগেই বলেছিলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন দল অভিবাসন বিষয়ে একটি সুষম পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে কম জনবহুল এলাকায় লোকসংখ্যার ঘাটতি পূরণ করা যাচ্ছে না এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রমঘাটতিও পূরণ করা যাচ্ছে না। মিশেল আরো বলেন, বর্তমান বিশ্বে অভিবাসন সংকট ও শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে ২০১৮ সালের আভিবাসন পরিকল্পনা আরো ঢেলে সাজাতে হবে। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যেন শারণার্থীরা যথাযথভাবে কানাডায় অংশভুক্ত হয় এবং কর্মক্ষেত্রে ফলদায়ক সদস্য হয়ে উঠে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের অভিবাসন পরিকল্পনায় ৩ লাখ অভিবাসী নেয়ার যে টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছিল তাতে অন্তভুক্ত ছিল দক্ষ কর্মী, ব্যবসায়ী, শুশ্র“ষাকারী, স্বামী বা স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা, দাদা-দাদী ও নানা-নানী।
বিরোধী দল এনডিপি’র এমপি এবং অভিবাসন সংক্রান্ত দলীয় সমালোচক জেনি কাওন বলেন, ২০১৮ সালের অভিবাসন পরিকল্পনা আরো উচ্চাভিলাষী হতে হবে। তিনি বলেন গুরুত্বপূর্ণ শ্রমঘাটতি পূরণ করতে এবং বয়োবৃদ্ধদের সংখ্যা বৃদ্ধি মোকাবেলা করার জন্য অভিবাসন একটি উত্তম উপায়। জেনি আরো বলেন, উচ্চ-দক্ষতাসম্পন্ন অভিবাসীর উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত না করে সুষম এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিবাসী আনার উপর গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। যে সকল কাজের জন্য কম দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক প্রয়োজন সে সকল কাজের জন্য অস্থায়ী বিদেশী শ্রমিকের উপর নির্ভরতা কমানোর উপরও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর রিফিউজিস এর নির্বাহী পরিচালক জেনেট ডেঞ্চ বলেন, কানাডা প্রতি বছর আরো ২০ হাজার শরণার্থী আনতে পারে। কিন্তু ২০১৭ সালে টার্গেট ছিল মাত্র ৭,৫০০। এই সংখ্যা খুবই কম। জাতিসংঘের রিফিউজি এজেন্সী এর হিসাবে বর্তমানে প্রায় ১০ লক্ষেরও বেশী শরণার্থী রয়েছে যাদের পুনর্বাসন প্রয়োজন। সেই তুলনায় ২০১৭ সালে কানাডার যে টার্গেট ছিল মোটেও পর্যাপ্ত নয়। তিনি ২০১৬ সালে যে সংখ্যক সিরিয়ান শরণার্থী আনা হয়েছিল তার উল্লেখ করে বলেন, আমরা জানি আমাদের সামর্থ্য রয়েছে।
কানাডার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সরকারী পরামর্শ পরিষদ সুপারিশ করেছে ২০২১ সালের মধ্যে অভিবাসী গ্রহণের সংখ্যা ৪ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত করা প্রয়োজন যাতে করে দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে উদ্দীপিত করা যায়। পরিষদ আরো বলে, একদিকে বয়স্ক লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি অন্যদিকে নিম্ম জন্মহারের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। এই সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে কানাডাকে।
কানাডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক (স্কিল এ্যান্ড ইমিগ্রেশন) প্যাট্রিক øাইডার বলেন, উচ্চ অভিবাসন মাত্রা ব্যবসার জন্য সম্ভাবনা বয়ে আনে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু এটি নির্ভর করে সঠিক এপ্রোচের উপর। তিনি বলেন, সরকারের উচিত যে সকল পেশার চাহিদা বেশী সে সকল পেশার জন্য এমন সব অভিবাসী আনা যাদের রয়েছে সঠিক দক্ষতা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বর্তমান র্যাংকিং সিস্টেমে ডিগ্রি কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বেশী। আমরা জানি এমন অনেক কর্মী আছেন যারা তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘসময় কাজ করে উচ্চ দক্ষতা অর্জন করেছেন এবং এই দক্ষ কর্মীদের চাহিদাই বেশী কানাডায়। তাদের হয়তো উচ্চ ডিগ্রী নেই, কিন্তু উচ্চ দক্ষতা আছে। কানাডিয়ান কোম্পানীগুলো এই দক্ষ কর্মীবাহিনীই চায়। উদাহরণ হিসাবে প্যাট্রিক øাইডার বলেন, অনেকে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গিয়েও নিজে নিজে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জন করেছেন বিভিন্ন পেশায়। যেমন হাই টেক, প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদি পেশার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
কনফারেন্স বোর্ড অব কানাডার এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে বলা হয়, অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলে অর্থনীতিতে সুফল আসবে। কিন্তু সেটা নির্ভর করে যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নতুন আসার অভিবাসীদেরকে একীভূত করা যায়। তবে কনফারেন্স বোর্ড সতর্ক করে দেয় এই বলে যে, এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ বিচার না করে বেহিসাবীর মত অভিবাসীদের আনা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অর্থনীতির উপর বাড়তি চাপ পড়তে পারে এবং অভিবাসনের প্রতি সাধারণ কানাডিয়ানদের সমর্থন হ্রাস পেতে পারে।