টরন্টোতে বাংলাদেশী দুই তরুনের আত্মহত্যা

দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুন : সেলিম খন্দকার

মে ১৪, ২০১৭

খুরশিদ আলম : টরন্টোর এক টগবগে প্রাণোচ্ছল যুবক সাবিত খন্দকার হঠাৎ করেই প্রাণচঞ্চলতা হারিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় সব কিছু থেকে। যৌবনদীপ্ত হাসিখুশি স্বভাবের সাবিত ঘর থেকে কোথাও বের হত না। যার চোখে স্বপ্ন ছিল একদিন স্বনাম ধন্য আইনজীবী হবে সে কেন এমন মনমরা হয়ে নিজের চারদিকে বিচ্ছিন্নতার একটি দেয়াল তুলে দিয়েছিল? বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে সে কেন নিজের জীবনটাকে এভাবে ধ্বংস করে দিল?

সাবিতের এভাবে চলে যাওয়াকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না বাবা সেলিম খন্দকার ও মা শিল্পী খন্দকার। গভীর শোকে মুহ্যমান পড়েছিলেন তারা। কমিউনিটিতেও নেমে এসেছিল গভীর শোকের ছায়া।

এ বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছি সাবিতের বাবা সেলিম খন্দকারের সঙ্গে। সদ্য ছেলে হারানোর বেদনায় তীব্রভাবে কাতর থাকলেও তিনি কথা বলেছেন আমাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাবিতের মৃত্যু আমাদের কমিউনিটির জন্য একটি ওয়েকআপ কল। এ বিষয়ে কমিউনিটিতে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই মনে প্রচন্ড কষ্ট নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। দিয়েছেন কিছু পরামর্শ। নিচে তা তুলে ধরা হলো:-

পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে সাবিত খন্দকার (বাঁয়ে)। পাশে তার বাবা সেলিম খন্দকার ও মা শিল্পী খন্দকার (ডান থেকে)

সাবিত খুবই মিশুক প্রকৃতির ছিল। ছিল প্রাণোচ্ছল। লেখাপড়ায় মনোযোগ ছিল আবার ছিলও না। তার ইচ্ছা ছিল সে ল’ইয়ার হবে। সে বৃটেনে গিয়েছিল এ বিষয়ে পড়তে। আমি লাইন অব ক্রেডিট থেকে লোন নিয়ে তাকে পড়তে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু দুই বছর পড়ার পর সে একদিন আমাকে ফোনে জানালো, বাবা আমি আর পেরে উঠছি না। খুব কঠিন সাবজেক্ট। কিছু মনে করো না, আমি ফিরে আসতে চাই।

তখন সে কোর্স শেষ না করেই দুই বছর পরে ফিরে আসলো।

সাবিতের জন্ম কানাডাতেই ১৯৯০ সালের জানুয়ারীতে। তার এক বোন আছে। সে ফেঞ্চ ভাষার শিক্ষক। আমরা কানাডায় আসি ১৯৮৮ সালে।

ডিপ্রেশন বিষয়টা আসলে কি সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। আস্তে আস্তে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে এ বিষয়ে।

গত প্রায় তিন মাস ধরে সাবিত খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। কোথাও যেত না। বললেও যেত না। আমাদের সঙ্গেও যেতে চাইত না। সাবিতের এক কাজিনের বিয়ে হলো, সেখানেও সে যায়নি। চার ভাই এক বোনের ছেলে-মেয়েরা মিলে টরন্টোতে আমাদের অনেক বড় ফ্যামিলি। প্রায় প্রতিদিনই কারো না কারো বাসায় দাওয়াত বা কিছু একটা উপলক্ষে গেদারিং লেগেই থাকে আমাদের।

ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে সাবিত বাসায় নিজেকে বন্দি করে রাখলেও বাসার কাজে মাকে সাহায্য করতো। মাকে জিজ্ঞেস করতো মা তোমার কোন সাহায্য লাগলে আমাকে বলবে। নিচে বেইজমেন্টে গিয়ে সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতো। খাবারের সময়ও খাবারটা নিয়ে চলে যেত নিচে। ডিপ্রেসড হলে মানুষের বিহেভিয়ার চেঞ্জ হয়ে যায়। কেউ এগ্রেসিভ হয়ে পড়ে, কেউ খুব চুপচাপ হয়ে পড়ে। অন্ধকারে থাকতে ভালবাসে। সাবিতের আচরণও বদলে গিয়েছিল। সে খুবই চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। মাকে হেলপ করার পাশাপাশি মাঝে মধ্যে আমাকেও বলতো, বাবা তোমার কোন হেলপ লাগবে? এ কাজটি সে আগে কখনো করেনি। আমাকে সে কোন দিন বলেনি বাবা তোমার হেলপ লাগলে আমাকে বল।

সাবিতের চুপচাপ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তার মা একটু উদ্বিগ্ন ছিল। তিনি দোয়া করতেন ছেলের জন্য। বলতেন আল্লাহ, তুমি আমার ছেলের চঞ্চলতাকে ফিরিয়ে দাও।

আমরা সবসময় তাকে পড়াশোনার বিষয়ে একটু চাপ দিতাম। কানাডায় আমাদের পরিবারটা বেশ বড়। আমার চার ভাই ও এক বোন এখানে থাকেন। তাদের ছেলে মেয়ে মিলিয়ে এখানে একটা বড় ফ্যামিলির মত আমরা। আমার ভাগ্নে-ভাগ্নি এরা অনেকেই লেখা পড়া শেষ করে প্রফেশনাল ডাক্তারসহ ভাল ভাল পজিশনে চাকরী করছে। কিন্তু সে কিছু করতে পারেনি, এই চাপটা তার উপর ছিল। সে দেখছিল সবাই ভাল কিছু করছে কিন্তু সে কিছু করতে পারছে না। এ সময়ে সে একাকিত্বও অনুভব করতে লাগলো। এটি শুরু হয় লন্ডন থেকে ফেরার পর। এবং দিন দিন এটি বাড়তে থাকে।

অন্যের সঙ্গে তুলনার একটি বিষয় ছিল। কারণ তার কাজিনরা ভাল ভাল পজিশনে

আছে কিন্তু সে কিছু করতে পারেনি। সময়ে সময়ে এ বিষয়গুলো তাকে বলা হতো। কিন্তু সে বলতো, না বাবা, আমি ডাক্তারী পড়তে পারবো না। ১৮/২০ ঘণ্টা লেখাপড়া করা আমার দ্বারা হবে না।

এই তুলনাটা আসলে ঠিক ছিল না।

তবে তাকে আমি বলতাম, বাবা তুমি কোন একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়ে যাও। সবাই কি আর ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে? আর আমি তোমার ল’ইয়ার হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছি।

ডাক্তারের কাছে সে নিজে থেকে একবার গিয়েছিল। কিন্তু হাসপাতাল থেকে যে ঔষধ দিয়েছিল সেগুলো খেলে নাকি তার ঘুম আসতো। তাই সে ঔষধগুলো ফেলে দিয়েছিল। আমরা তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বলতাম। কিন্তু সে যেতে চাইত না। ২৭ বছরের একটি ছেলেকে তো আর জোর করে ডাক্তারের কাছে নেয়া যায় না। পরে তার বোনের সঙ্গে সে একবার বসেছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা দুই ভাই-বোনে বসে কথা বলে। বোনের অনুরোধে সে ডাক্তারের কাছে আবারো যেতে রাজী হয়েছিল। সে তখন শর্ত দিয়েছিল কেউ যাতে তাকে পড়াশুনার ব্যাপারে চাপ না দেয়। তার যে ব্যর্থতা সেগুলোর ব্যাপারে কেউ যাতে কোনরকম কথা না বলে। সে বলেছিল সে নিজেই গিল্টি ফিল করে তার ব্যর্থতাগুলো নিয়ে।

পরের দিন সে ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে যাবে বলে আমার কাছ থেকে মেট্রো পাস নিয়েছিল। ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছ থেকে রেফারেল নিয়ে স্পেশালিস্ট এর কাছে তার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে ডাক্তারের কাছে আর যায়নি।

আমাদের পরিবারে আর কারো ডিপ্রেশন সমস্যা নেই। সাবিতই প্রথম যে এই সমস্যায় ভুগছিল।

মার সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল তার। আমার সঙ্গে একটু দুরত্ব নিয়ে চলতো। বোনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল। মাঝে মাঝে বোনের বাসায় গিয়ে থাকতো সে।

বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু গত তিনমাস ধরে সেই যোগাযোগটা আর ছিল না। সাবিতের মৃত্যুর পর তার বন্ধুরা যখন এসেছিল তখন তারাও বলেছে, সাবিত কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতো না। অথচ সে এরকম ছিল না। খুবই হাঁসি-খুশী থাকতো। মিশুক ছিল। বন্ধুদের বাড়িতে গেলে কিচেনে ঢুকে ফ্রিজ খুলে নিজেই খাবার খুঁজতো।

সাবিতের একজন বান্ধবী ছিল। সে টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভার্সিটিতে পড়তো। একদিন সে আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। সেটা অনেকদিন আগের কথা। সাবিত তখন লন্ডনে। তখন আমি সাবিতকে বলি, বাবা তুমিতো কিছু কর না। তো মেয়েটি কতদিন তোমার জন্য অপেক্ষা করবে। তারচেয়ে ভাল, মিচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দাও সে যাতে তোমার জন্য আর অপেক্ষা না করে। পরে সাবিত তার মাকে বলেছিল সে মেয়েকে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছে। আর মেয়েটিও নাকি একটি ভাল ছেলে পেয়েছে। সুতরাং সাবিতও হ্যাপী। আসলে মেয়েটির সঙ্গে সাবিতের তেমন সিরিয়াস কোন সম্পর্ক ছিল না।

সাবিতের হবি ছিল বই পড়া। নানারকম বই কিনতো সে। মুভি দেখার শখও ছিল তার। মাঝে মাঝে টেবিল টেনিস খেলতো।

তার ভবিষ্যত স্বপ্ন ছিল ল’ইয়ার হবে। একটা বড় বাড়ি কিনবে। আমার যে লোন আছে বাড়ির পিছনে সেগুলো শোধ করে দিবে। আমি তাকে বলেছিলাম, বাবা আমার লোন তোমাকে শোধ করতে হবে না। তুমি আগে মানুষ হও, নিজের পায়ে নিজে দাড়াও। ল’ইয়ার হতে চেয়েছো সেটা হও। সেটাই হবে আমার বড় পাওয়া।

ছেলেকে নিয়ে মায়ের স্বপ্ন ছিল, ছেলের বিয়ে হবে। ঘরে বউ আসবে। নাতি নাতনীর মুখ দেখবে। আমার স্বপ্ন ছিল সে নিজের পায়ে দাড়াক এইটুকুই। সেলিম খন্দকারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ছেলেকে হারিয়ে এখন তাদের মনে অবস্থা কি?

এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মনের অবস্থাটা যে কি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এটা যে কতটা বেদানাদায়ক, কতটা কষ্টদায়ক তা কেবল ভুক্তভোগীই অনুধাবন করতে পারবে। এটি বলে বুঝানো যাবে না।

সাবিতের মা সাবিতকে নাম ধরে কখনো ডেকেছে কি না তা আমার মনে নেই। সবসময়ই বাবা বলে ডাকতো। আমরা যখন সাবিতের কবর জিয়ারত করতে যাই, তখন সাবিতের মা যে ভাবে কান্নাকাটি করে দোয়া করে তখন আমার মনে হয় সাবিত মারা যায়নি, সে জীবিত আছে। সে আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলে, আল্লাহ সাবিত এখন তোমার কাছে। তাকে তুমি দেখে রেখ। এই দৃশ্য অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও অসহনীয়। ঘরেও সাবিতের মা খুব কান্নাকাটি করে।

সেলিম খন্দকার বলেন, আমাদের আসলে ডিপ্রেশন সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা উচিত ছিল। এ বিষয়ে আমাদের কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। আর একটা কথা আমি বলবো, কোন সময়ই ছেলে-মেয়েদেরকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়। বিশেষ করে অন্যের সাফল্যকে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করে নিজের ছেলে-মেয়ের উপর কখনোই চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়। অমুকে ডাক্তার হয়েছে, অমুকে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে – তুমি কেন পারবে না বা পারলে না এই জাতীয় কথা ছেলে-মেয়েদের উপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

প্রবাসে বাংলাদেশী বাবা-মায়েদের প্রতি আমার পরামর্শ বা অনুরোধ হলো, অন্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিজের ছেলে-মেয়ের তুলনা কখনোই করবেন না। তাদের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন যাতে করে তারা আপনাদের উপর নির্ভর করতে পারে। কোন সমস্যা হলে যাতে বিনা সংকোচে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। তারা কোন সমস্যার কথা বললে সেটা হালকাভাবে নেয়া চেষ্টা করবেন না বা ফান করে তা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টাও করবেন না। ভাববেন না যে তারা পড়াশুনা ফাঁকি দেয়ার জন্য এরকম করছে।

ছেলে-মেয়েরা যদি একবার মনে করে যে তাদের কথাটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি এবং সেটা যদি তাদের মনে কোন দুঃখবোধ জন্ম দেয় তবে তার পরিণতি ভাল হয় না। মনে রাখতে হবে আমাদের সময় আর আমাদের ছেলে-মেয়েদের সময় এক না। আমরা যে ভাবে বড় হয়েছি, আমাদেরকে যে ভাবে শাসন করা হতো সেই শাসন আজকের দিনের ছেলে-মেয়েদের করা যাবে না। আর এই প্রবাসে তো নয়ই।

আমি বলবো, জীবনটা শুধু বাড়ি, গাড়ি, মর্টগেজ, চাকরী আর লাইন অব ক্রেডিট নয়। আরো অনেক কিছু আছে। প্রবাসে আমাদেরকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। পরিবারে বাবা অথবা মা যে কোন একজনকে সময় বের করতে হবে ছেলে-মেয়েদের পিছনে ব্যয় করার জন্য যাতে করে তাদের সঙ্গে একটা ভাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়। তাদের মনে যাতে কখনো এইরকম মনোভাব সৃষ্টি না হয় যে তারা নিঃসঙ্গ। তাদেরকে ভাবতে শিখাতে হবে- তাদের যে কোন সমস্যায় নির্ভর করার মত তাদের পাশে তাদের বাবা – মা রয়েছে। গুরুত্বসহকারে তাদের বাবা-মা তাদের কথা শুনবে।

আমি আরো বলবো, কোন দুর্ঘটনা ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না। তার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। কাজে কর্মে যতই ব্যস্ত থাকুন ছেলে-মেয়েদের সময় দিন। তারা কি করছে, কি করতে ভালবাসে এগুলো জানতে চেষ্টা করুন। বাবা-মা হিসাবে আপনারা যে তাদের জন্য ফিল করেন, তাদের যতœ নিচ্ছেন, তাদেরকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এটা তাদের বুঝতে দিন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেকে আছি যারা ছেলে-মেয়েদের জন্য ফিল করি কিন্তু তা প্রকাশ করি না। এটাও ঠিক নয়। আপনাকে প্রকাশ করতে হবে। না হলে ছেলে-মেয়েরা বুঝবে কি করে?

আমি আমাকে দিয়েই উদাহরণ দিতে পারি। ছেলের জন্য আমার মায়া ছিল। সে যখন লন্ডনে গিয়ে ল পড়তে চাইল তখন আমি কষ্ট করে লোন করে তাকে পড়তে পাঠিছি। কিন্তু আমার ভালবাসার প্রকাশটা সে ভাবে হয়তো হয়নি। আমারও নিশ্চই কোন ব্যর্থতা ছিল। আমিতো হিউম্যান বিং।

বিষন্নতা সম্পর্কে জানতে হবে সন্তান হারানোর আগে, পরে নয় : আরিফ রহমান ও সাবিনা রহমান

বাবা আরিফ রহমান ও মা সাবিনা রহমানের সঙ্গে ফাহমি রহমান

ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সেন্ট জর্জ ক্যাম্পাসে লাইফ সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল ফাহমি রহমান। কানাডায় জন্ম নেয়া এই তরুণ ছিল অত্যন্ত মেধাবী। এখানে যাকে গিফটেড স্টুডেন্ট বলে সে তাই ছিল। টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে সে দুই বার স্কলাশীপ পায় খুব ভাল মার্ক পাওয়ার জন্য। গত ১৮ ফেব্রুয়ারী ডাউন টাউনে যাওয়া কথা বলে সে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু তারপর থেকেই সে নিখোঁজ ছিল। যাওয়ার আগে বাড়িতে রেখে গিয়েছিল সুইসাইডের একটি নোট।

উল্লেখ্য যে, ফাহমি ২০১৫ সালে মারাত্মক এক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে ভাগ্যক্রমে অক্ষত অবস্থায় বেচেঁ যায়। কিন্তু এর পর থেকেই তার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় যা ক্রমে ডিপ্রেশনে রূপ নেয়।

সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর অনেক খোঁজাখুজি করেও তার কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে গত ৩০ মার্চ টরন্টোর সুগার বিচের কাছে অন্টারিও লেক থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃতদেহ উদ্ধারের খবরে চরমভাবে ভেঙ্গে পরেন ফাহমির বাবা আরিফ রহমান ও মা সাবিনা রহমান। তার মৃত্যু সংবাদে টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিতেও নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া।

আমরা প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে কথা বলেছি ফাহমির বাবা ও মায়ের সঙ্গে। যদিও তারা সন্তান হারানোর বেদনায় ছিলেন চরম বিপর্যস্ত, তবু কথা বলেছেন আমাদের সঙ্গে। কথা বলেছেন আমাদের কমিউনিটিতে এ বিষয়ে এওয়্যারনেস তৈরীর লক্ষ্যে। এখানে তাদের বক্তব্য তুলে ধরা হলো:-

প্রথমে কথা বলেছেন ফাহমির মা সাবিনা রহমান। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে ফাহমি টরন্টোতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ঐ দুর্ঘটনায় তার গাড়ি দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সে অক্ষত অবস্থায় বেচেঁ যায়। দুর্ঘটনায় তার কোন ফল্ট ছিল না। যে গাড়ি তাকে হিট করে সেই গাড়ির চালক বেচেঁ আছে। ফাহমির আইনজীবী তাকে বলেছিল ঐ চালকের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য। কিন্তু সে করেনি। তার ভাষ্য ছিল, বৃদ্ধা ঐ মহিলা চালক এমনিতেই অনেক সাফার করেছে। আমি তাকে আর বাড়তি পীড়া দিতে চাই না। তার এই কথায় আমরা খুবই গৌরব অনুভব করেছিলাম। মনে হচ্ছিল আমরা পৃথিবীতে সবচেয়ে গৌরবান্বিত পিতা-মাতা।

ঐ সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকেই ফাহমি কেমন যেন বদলে যায়। ঘর থেকে বের হতো না। বেশিরভাগ ক্লাশই অনলাইনে করতো। কিন্তু আমরা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি। কিছুটা খুশিও ছিলাম যে সে ঘরেই থাকছে। আমাদের সময় দিচ্ছে। তবে এত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটায় আমরাও একটা ঝাঁকুনি খেয়েছিলাম।

দুর্ঘটনার পর তাকে আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম তার কোন সাহায্য লাগবে কিনা বিশেষ করে কাউন্সিলিং। কিন্তু সে বলেছিল, না আম্মু আমার কোন কিছু লাগবে না। আমি ঠিক আছি।

সেখানেই আমাদের একটু ভুল ছিল সম্ভবত। ছেলেরা তো সহজে কিছু স্বীকার করতে চায় না। একটু ম্যাচুরিটি দেখানোর প্রবণতা থাকে। মেয়েরা যেমন সমস্যাগুলো বলে ছেলেরা তেমন ভাবে বলে না। বাইরে যাওয়া বন্ধ করার পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও বন্ধ করে দিয়েছিল ফাহমি। কোন পার্টিতে যেত না। কিন্তু সে এরকম ছিল না। খুবই মিশুক প্রকৃতির ছিল। বন্ধুদের মধ্যে সে ছিল মধ্যমনি। সবসময় হাঁসি-খুশী থাকতো, কৌতুক প্রিয় ছিল।

কিন্তু বাইরে যাওয়া বন্ধ করলেও ঘরে আমাদের সঙ্গে ছিল একেবারে স্বাভাবিক। বাসায় কোন মেহমান আসলে তাদের সঙ্গেও স্বাভাবিক আচরণই করতো। তারাও টের পেত না সে যে ভিতরে ভিতরে সমস্যায় ভুগছিল। বাসায় পার্টির আয়োজন করা হলে সে খুব খুশী হতো। ঘরদোর পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই সাহায্য করতো সে।

কিন্তু এভাবে দিন যত কাটছিল ততই সে যেন আরো চুপচাপ হয়ে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে স্বাস্থ্যহানিও ঘটতে লাগলো। আমরা ভেবেছিলাম সে হয়তো ডায়েট করছে। সেও তাই বলতো। আসলে তা ছিল না, তার খাওয়ার ইচ্ছাটাও ক্রমে কমে এসেছিল। এভাবে আরো কিছুদিন যাওয়ার পর সে একসময় বিছানা নিল। সে তার রূমেই থাকতো বেশীরভাগ সময়। এখানে টিন এজ ছেলে-মেয়েরা বিশেষ করে ছেলেরা একটু প্রাইভেসী চায়। তাই আমরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কখন তাকে একা থাকতে দিব বা কখন তার কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলবো। 

তখন আমি আবার কর্মস্থলে লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম। তারা কেউই ডাক্তার না হলেও মেডিক্যাল ফিল্ডে কর্মরত। দেখলাম এ বিষয়ে তাদের মোটামুটি ধারণা আছে। তারা আমাকে জানালো, এটি ডিপ্রেশনের লক্ষণ। ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে হবে।

তখন আমি ছেলে সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম এই বিষয়ে। জানতে চাইলাম সে বাইরে যায় না কেন। কিন্তু সে তখনও বলছে সে ভাল আছে। সে নায়েগ্রা ফলস এ যেতে খুব ভালবাসতো। আমরা তাকে সেখানে নিয়ে যেতে চালাম। সে বললো, না আম্মু তোমরা যাও।

তখন একদিন ফাহমিই আমাকে ডেকে নিয়ে বললো, আম্মু তোমার সাথে কথা আছে। আমি বললাম কি কথা? সে তখন দরজা বন্ধ করে আমার পাশে বসলো। এবং তখনই সে বললো, গত প্রায় এক বছর ধরেই সে ডিপ্রেশনে ভুগছে। একথাটি সে যখন আমাকে জানালো তখন সে একেবারে বিছানায় শোয়া। কিছু খেতে পারে না। ক্ষুধার কোন টেন্ডেন্সীই নেই তার। সে আমাকে আরো শর্ত দিল যে, তার এই ডিপ্রেশনের বিষয়টি যাতে কাউকে না জানাই। আমি জানতে চাইলাম কেন বাবা? তারা জানলে সমস্যা কোথায়? সে বললো কেউ বুঝবে না বিষয়টি। আমি তাকে তখন বলেছিলাম, আমি তো তোমার সঙ্গে অন্য মায়েদের মত আচরণ করিনি। তবে তুমি আমাকে কেন শুরুতেই জানালে না?

ফাহমি এমনিতে খুব যতœশীল ছিল অন্যদের প্রতি। আমাদের ব্যাপারে ছিল তার বিশেষ রকমের যতœ। আমরা কষ্ট পাই এটা সে কখনোই চাইত না। ফলে শত কষ্টের মধ্যেও আমাদেরকে ভাল থাকার ভান করতে হয়েছে যাতে তার ডিপ্রেশনের মাত্রা আরো বেড়ে না যায়।

তখন তাকে বললাম ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য। কিন্তু সে রাজী হলো না এবং বললো, কেউ তাকে আর সাহায্য করতে পারবে না। তারপর অনেক বলাবলির পর সে একদিন রাজী হলো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য। ডাক্তার তাকে দেখলো।

ডাক্তারের ভাষ্য ছিল, এই বয়েসের ছেলেদের বেলায় এরকমটা হতে পারে। বিশেষ করে তারা যখন ইউনিভার্সিটিতে যায়, হঠাৎ করে লেখাপড়ার চাপ বেড়ে যায়। আর সাবজেক্ট যদি কঠিন হয় যেমন লাইফ সাইন্স, তখন চাপটা বেশীই হয়। তাছাড়া শরীরের হরমন চেঞ্জের বয়স এটি। এই সব মিলিয়ে এংজাইটি অথবা ডিপ্রেশন এর ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।

ডাক্তার ঔষধ দিলেন। সে সপ্তাহ তিনেক ঔষধ খেলে। প্রথম দিকে মনে হলো, ঔষধে কাজ হচেছ। একটু যেন চাঙ্গা হয়ে উঠছে সে। কিন্তু তার দিনকয়েক পরেই সে ঔষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিল। সে জানালো, এই ঔষুধে নাকি খালি ঘুম পায়। দুর্বল লাগে। এরকম হলে সে ক্লাসে যাবে কি করে।

তার এই ঔষধ বন্ধ করাটা বোধ হয় খুবই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ, মাস না পেরুতেই আবার তার সিম্পটমগুলো দেখা দিল। আবার সেই বিষন্নতা। স্যাডনেস। কিন্তু ঘরে আমাদের সঙ্গে সে কথা বলতো। ওর বাবা ছিল ওর ভাষায় – “বেস্ট ড্যাড ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড”। আর মা সম্পর্কে বলতো, “বেস্ট ফ্রেন্ড ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড”। ফাহমি আমার খুব ভাল বন্ধু ছিল যে আমার সাথে সবকিছুই শেয়ার করতো এবং আলোচনা করতো। আমার জীবনের যা কিছু অর্জন তার পিছনে রয়েছে এই ফাহমির অনুপ্রেরণা।

আমরা কখনো আমাদের ছেলে-মেয়েকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করতাম না। বলতাম না যে, দেখ ওমুকে এই করেছে, তোমাদেরকেও তাই করতে হবে। ডাক্তার হতে হবে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এরকম কোন চাপ কখনো আমরা তাদেরকে দেইনি। তবে ফাহমি যেহেতু অত্যন্ত মেধাবী ছিল তাই তাকে এনকারেজ করতাম যাতে তার সেই মেধার অপচয় না হয়। ফাহমির বড় বোন টুসিয়া একজন ল’ইয়ার। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে পাশ করে বের হয়েছে সে।

ফাহমি খুব বেশী সময় ধরে পড়তো না। অল্প সময় পড়েই সে ভাল রেজাল্ট করতো। তাই বলতাম, দেখ তুমি যদি আরেকটু সময় নিয়ে লেখাপড়া কর তবে চিন্তা কর তুমি কোথা গিয়ে দাড়াতে পারবে।

ঔষধ বন্ধ করার পর তার অবস্থার যখন আবারো অবনতি ঘটতে থাকলো তখন আমরাও চিন্তিত হয়ে পরলাম। তাকে বলতাম তুমি বাইরে যাও। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাও। তুমি ক্লাশেও যাচ্ছ না। এভাবে ঘরে বসে থাকলে তো তুমি আরো বেশী অসুস্থ হয়ে পড়বে।

এর মধ্যে সামার এসে গেল। আমাদের বাড়িটি অন্টারিও লেকের পাশে। ফাহমি আমাকে নিয়ে লেকের ধারে হাটতে যেত প্রায়ই। কোন কোন দিন কয়েক ঘন্টা ধরে সে আমার সঙ্গে আমার হাত ধরে হাটতো। তখন মাঝে মাঝে বলতো – “আম্মু হোয়াট হেভ আই ডান টু মাই লাইফ”। সে আরো বলতো, “আমার বন্ধুরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, কেউ থার্ড ইয়ারে কেউ ফোর্থ ইয়ারে। আর আমি স্ট্রাগল করছি নিজেকে নিয়ে। আমাকে কেন ঔষধ খেতে হবে।” সে নিজেকে দোষারোপ করতে আরম্ভ করলো। আমি তখন তাকে বুঝাতে চেষ্টা করতাম। বলতাম, না ফাহমি, তোমার কোন দোষ নেই।

ফাহমির সেল্ফ কনফিডেন্সটা হারিয়ে গিয়েছিল। নিজেকে দোষারোপ করার পাশাপাশি সে আরো মনে করতো সে হ্যান্ডসাম নয়। গুড লুকিং নয়। সে ব্রিলিয়ান্ট নয়। সে অকৃতকার্য। কিন্তু তার এই চিন্তাগুলো সঠিক ছিল না। সে ছিল অত্যন্ত মেধাবী। ৬ ফুটেরও বেশী লম্বা এক তরুণ- আমার চোখে সে ছিল মোস্ট হ্যান্ডসাম এন্ড গর্জিয়াস ইয়ং বয় অন আর্থ।

গত ডিসেম্বরে ওর ফ্রেন্ডদের একটি গেট-টুগেদার হলো। আমরা তাকে উৎসাহ দিলাম ওখানে যাওায়ার জন্য। সে যেতে চায়নি। বললাম – যাও, দেখবে ভাল লাগবে। একপর্যায়ে সে রাজী হলো।

অসুস্থ হওয়ার আগে সে এগুলোতে নিয়মিত যেত। সে ছিল হার্ট অব দ্যা পার্টি। সবাইকে নাচিয়ে রাখতো সে। কিন্তু এবার অনেক বলে কয়ে তাকে পাঠানোর পর সে বেশীক্ষণ সেখানে থাকতে পারেনি। প্রথমে গিয়েছিল হাঁসি মুখেই। কিন্তু গেট-টুগেদার পার্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে আমাকে ফোন দিয়ে বলল, মা তুমি কি আমাকে পিক-আপ করতে পারবে এখন? আমার ভাল লাগছে না। আমি বললাম কেন কি হয়েছে? তুমি কি অসুস্থ ফিল করছ? সে বললো- না আম্মু, এখানে এসে দেখি আমার বন্ধুরা সবাই প্রায় ডান। এরা কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউ ডাক্তার হয়ে যাবে আর কিছু দিনের মধ্যেই। আমি কি করলাম? আবারো তার সেই একই কথা- হোয়াট হেভ আই ডান টু মাই লাইফ।

তার অবস্থা যখন আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল তখন অনেক বলে কয়ে তাকে আবারো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। সেটা গত জানুয়ারী মাসের ঘটনা। ডাক্তার তাকে দেখে শুনে একটি ঔষধ দিল। সেও রাজী হলো ঔষধ খেতে। বাড়িতে এসে সে ঔষধ খাওয়া শুরু করলো। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে দেখলাম ভালর দিকেই যাচ্ছে। সে নিজে থেকেই বলছে ইউনিভার্সিটিতে আবার এপ্লাই করবে। আমরাও খুব খুশী তার উন্নতি দেখে। কি কি সবজেক্ট নিবে তা নিয়ে আলোচনাও হলো। আমরা তাকে বললাম সাবজেক্ট একটু কমিয়ে নাও এবং কঠিন কোন সাবজেক্ট এই মুহুর্তে নিও না। এতে করে প্রেসার কম থাকবে। সেও সেই ভাবেই সব করলো।

এই সময় তার ইমপ্রুভমেন্ট কি হচ্ছে তা জানার জন্য আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার জানতে চাইল এখন সে কিরকম ফিল করছে। সে বললো, আগের মতই, কোন পরিবর্তন দেখছি না। তখন ডাক্তার ঔষধের মাত্রা দিল ডাবল করে। সম্ভবত সেটাই ছিল একটা বড় রকমের ভুল। ডিপ্রেশনের ঔষধ সাথে সাথে কাজ করে না। চার থেকে ছয় সপ্তাহ লাগে কাজ শুরু করতে। কিন্তু ডাক্তার তিন সপ্তাহের মাথায় ঔষধের মাত্রা কেন ডাবল করে দিল আমরা জানিনা। পরে শুনেছি, এই ঔষধ খেলে সুইসাইডাল টেন্ডেসী আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। এ জন্য রোগীকে সবসময় ওয়াচের মধ্যে রাখতে হয়। কিন্তু ডাক্তার আমাকে বা ফাহমিকে কিছুই বলেনি এ সম্পর্কে। ফাহমি তো লাইফ সাইন্সের ছাত্র ছিল, তাকেও তো ডাক্তার এ বিষয়টি খুলে বলতে পারতো।

একটি বিষয় আমরা বুঝতে পারতারম যে, ফাহমি অসুস্থ হলেও সে সবসময় চেষ্টা করতো আমাদেরকে হ্যাপী রাখতে। আমাদেরকে বুঝতে দিতে চাইত না তার কষ্টের বিষয়গুলো। বন্ধুদের সঙ্গেও সে তার অসুস্থতার বিষয়টি নিয়ে কখনো কোন কথা বলেনি। পরে যখন তারা বিষয়টি জানতে পারে তখন তারাও হতবাক হয়ে যায়।

গত ১৪ ফেব্রুয়ারী ভেলেন্টাইন ডে – তে সে আমাদের সঙ্গে নায়েগ্রা গিয়েছিল বেড়াতে। আমরা দুদিন ছিলাম সেখানে। এই দুইদিন সে খুব উৎফুল্ল ছিল এবং বেড়ানোটা বেশ উপভোগ করেছে। ফাহমির এই আচরণ দেখে আমার কিছুতেই তার ডিপ্রেশনের রহস্যটা কোথায় সেই সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমরাও খুব খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, ঔষধ কাজে দিচ্ছে। ঐ নায়েগ্রা যাওয়াটাই ছিল তার সাথে আমাদের শেষ ফ্যামিলি ট্রিপ।

কিন্তু নায়েগ্রা থেকে ফিরে যা লক্ষ্য করলাম তা হলো, ডাবল ডোজের ঔষধ শুরু হওয়ার পর তার অবস্থার কোন উন্নতি প্রকৃত পক্ষে হয়নি। এরই মধ্যে একদিন সে আমাকে জানালো, সে ডাউন টউনে যাবে ঘুরতে। আমিতো খুব খুশী। সে বাইরে যেতে চাইছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কিছু লাগবে কি না। কিছু টাকাও দিতে চাইলাম। সে বললো-না মা, টাকা আমার কাছে আছে। আমি বললাম যাও, কিন্তু আমাকে কিছুক্ষণ পর পর ফোন দিবে। কোথায় আছ কেমন আছ আমাকে জানাবে।

এই সময় আমার কেন জানি মনে একটা সন্দেহ দেখা দিল। যে ছেলে ঘর থেকেই বের হচ্ছে না আজ প্রায় এক বছর, সে কেন হঠাৎ ডাউন টাউনে যেতে চাইছে একা একা? আমি তাকে জিজ্ঞেসও করলাম। কিন্তু সে বললো- না মা, এমনিতেই। অনেকদিন যাই না। কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করবো।

সেই দিনটি ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারী। সকালে ডাউন টাউনে যাওয়ার আগে ফাহমি আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে চুমু খেল। বাবাকেও হাগ দিল। সে বের হয়ে গেল। আমরা বারান্দায় দাড়িয়ে তাকে হাত তুলে বিদায় জানালাম। সেও পিছন ফিরে হাত তুলে বিদায় নিল। বিদায় নেওয়ার সময় সে খুবই স্বাভাবিক আচরণ করেছিল যেমনটি আগেও করতো।

ফাহমি চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর একটা টেক্সট ম্যাসেজ পেলাম তার ফোন থেকে।

ঐ ম্যাসেজে সে আমাকে তার ঘরের টেবিলের ড্রয়ারটি চেক করতে বললো। আমি সাথে সাথে তার ঘরে গিয়ে ড্রয়ারটি খুললাম। সেখানে দেখি একটি চিঠি।

চিঠিটি হাতে নিয়েই আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। এটি ছিল একটি সুইসাইডাল নোট। কিছুক্ষণ আগে সে আসলে চিরতরে বিদায় নিয়ে চলে গেছে আমাদের কাছ থেকে। আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি তখন।

চিঠিতে সে বিস্তারিত লিখে গিয়েছিল। তার ব্যাংক একাউন্ট ক্লোজ করার তথ্য, লেপটপ কাকে দিতে হবে ইত্যাদি সব লিখে রেখে গিয়েছিল চিঠিতে। আর লিখেছিল সেই ভয়াবহ মর্মঘাতী বাক্যটি “আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারণ ডিপ্রেশন, পেইন এবং এর ভোগান্তি আমার পক্ষে সহ্য করা অসহনীয় হয়ে উঠেছে।” সবশেষে লিখেছিল, “আমি তোমাদেরকে অনেক অনেক ভালবাসি।”

পরে তাকে আমরা অনেক জায়গায় খুঁজেছি। পুলিশে খবর দিয়েছি। কমিউনিটির লোকদের সহযোগিতা নিয়েছি। দল বেধে আমরা একেক দিন একেক জায়গায় খুঁজেছি। সে যেসকল জায়গায় যেতে পছন্দ করতো সেসব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ দিয়েছি। ছবি দিয়েছি। যদি কেউ কোন সংবাদ দিতে পারে। কোন প্রচেষ্টাই আমরা বাদ রাখিনি।

অবশেষে নিখোঁজ হওয়ার ৪০ দিন পর গত ৩০ মার্চ তার সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু জীবিত ফাহমির নয়, মৃত ফাহমির সন্ধান। মা-বাবার কাছে এর চেয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ আর কি হতে পারে আমাদের জানা নেই।

কমিউনিটির প্রতি পরামর্শ :

সাবিনা রহমান বলেন, কমিউনিটিতে আমাদের সবাইকে এই ডিপ্রেশন সম্পর্কে জানতে হবে। আমি এখনো শতভাগ জানিনা এই অসুখটা কেন হয়, এর লক্ষণগুলো কি। শুধু বাচ্চারা যে ডিপ্রেশনে ভুগছে তা নয় বয়স্করাও এই সমস্যায় ভুগছে। বাচ্চাদের মধ্যে বেশী হচ্ছে। বয়স্করা কোন সমস্যা হলে শেয়ার করে। কিন্তু বাচ্চারা সহজে শেয়ার করে না। তারা মনে করে এটি একটি লজ্জার বিষয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে কোন অসুখের মত এই ডিপ্রেশন বা বিষন্নতাও একটি রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে এর চিকিৎসা সহজ। আমরা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক জানি। কিন্তু ডিপ্রেশন সম্পর্কে খুব কম জানি। এই যে আমাদের ফাহমি এভাবে চলে গেল, আমার তো মনে হয় এখনো বহু লোক জানে না ডিপ্রেশন বা মেন্টাল ইলনেস কি। আমরা যখন এই রোগটি সম্পর্কে ভাল করে ওয়াকিবহাল হব তখনই সক্ষম হব নিজেকে এবং অন্যকে সাহায্য করতে। আমরা যখন লক্ষণগুলো কি তা জানতে পারবো তখন পরিবারের কেউ মেন্টাল সমস্যায় ভুগলে বা বন্ধুমহলে কেউ মেন্টাল সমস্যায় ভুগলে দ্রুত সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে অসতে পারবো। তাই আমি মনে করি সবার আগে আমাদের যা দরকার তা  হলো এডুকেশন। এটি খুবই জরুরী। এর পর এওয়ারনেস বা সতর্কতা। আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। এর পাশাপাশি কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থাও করতে হবে। আমার একটি বিষয় খুব খারপ লেগেছে যে, আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার বা মনরোগ চিকিৎসক কেউ একবারও বলেনি যে ফাহমির জন্য কাউন্সিলিং এর প্রয়োজন রয়েছে। আমার পরামর্শ হলো, এই বিষয়গুলো আমাদের কমিউনিটির প্রতিটি বাবা-মাকে জানতে হবে, শিখতে হবে। এবং এটি শিখতে হবে সন্তান হারানোর আগে, পরে নয়। আর ডাক্তার যদি কাউন্সিলিং এর কথা নাও বলে তবে নিজে থেকেই এর ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার ইউলিয়াম ওয়াটসন বলেছিলেন, “Tha system failed him”. কথাটি ফাহমির বেলায় খুবই সত্য ছিল। সেন্ট মাইকেল হাসপাতালের এই চিকিৎসকের তত্বাবধানেই একদিন জন্ম হয়েছিল ফাহমির। ফাহমির ডিপ্রেশনের চিকিৎসার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন।

ফাহমিকে আর আমরা ফিরে পাব না। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার নামে একটি অরগানাইজেশন গড়ে তুলবো যার নাম হবে “ফাহমি রহমান ফাউন্ডেশন ফর মেন্টাল হেলথ”। এই অরগানাইজেশনের মূল উদ্দেশ্য হবে লোকজনকে সাহায্য করা বিশেষ করে ফাহমির মত যে ছেলেরা মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করছে তাদেরকে সহায়তা প্রদান করা। আমরা চাই আর কোন বাবা-মাকে যেন এরকম জীবন যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে না হয়।

এই পর্যায়ে ফাহমির বাবা আরিফ রহমান বলেন, এখানে আমি একটি বিষয় যোগ করতে চাই। এডুকেশনের পাশাপাশি এই রোগ সম্পর্কে একসেপ্টেন্সী খুব দরকার। কানাডায় আমাদের সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতে মেন্টাল হেলথ এর সমস্যাটিকে একসেপ্ট করে নিতে হবে। আমরা এখনো এই সমস্যাটিকে অন্যভাবে দেখি। এটা অন্য যে কোন রোগের মতই একটি রোগ। এ সত্যটি মেনে নিতে হবে। আমি যে অফিসে কাজ করি সেখানে আমি ছাড়া সবাই শ্বেতাঙ্গ। ফাহমির ঘটনাটি তাদেরকে অবহিত করার পর দেখলাম তারা প্রত্যেকেই রোগটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। শুধু আমরা সাউথ এশিয়ানরাই এখনো এই রোগ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানিনা।

আরিফ রহমান  আরো বলেন, ফাহমি নিখোঁজ হওয়ার পর আমাদের পারিবারিক বন্ধুরা এবং কমিউনিটির লোকেরা যে ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার জন্য আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ। কমিউনিটির প্রতিটি পরিবারে ফহমির জন্য দোয়া করেছে। ফাহমিকে খুঁজে বের করার জন্য ঝড় বৃষ্টি ও তুষারপাতের মধ্যেও যে যখন সুযোগ পেয়েছে তখনই টরন্টোর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। ইন্টারনেটে সার্চ করেছে। সবারই কনসার্ন ছিল, ফাহমিকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। এই বিষয়টি আমার কাছে এত ভাল লেগেছে যে, আমি কমিউনিটির লোকদের কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো।

বিষন্নতা রোধ করতে হলে ছেলে-মেয়েদের আচরণগত কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তার উপর নজর রাখতে হবে

মাহবুব রেজা

মাহবুব রেজা :  সহ-সভাপতি, বিসিসিএস

প্রশ্ন :  বিষন্নতার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেন্টার এন্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস এর পক্ষ থেকে গত ৯ এপ্রিল আপনারা একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন। ঐ আলোচনা সভায় বক্তারা কোন কেন বিষয়ের উপর জোর দেন?

উত্তর : সেদিনকার আয়োজনটা ছিল অত্যন্ত অর্থবোধক এবং সময়োপযোগী। আমি নিজেও ভাবিনি যে, আলোচনাটি এরকম ফলপ্রসু হবে। সেদিনকার আলোচনা সভা থেকে বেশ কয়েকটা বিষয় আমদের কাছে মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :-

Ñ যে কোন মূল্যে ছেলে-মেয়ে এবং পিতা-মাতার মধ্যে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখা, যাতে করে ছেলে-মেয়েরা তাঁদের মনের কথা খুলে বলতে পারে।

Ñ যদি দেখা যায় কারও ছেলে বা মেয়ে মেন্টাল হেলথ ইস্যুতে ভুগছে তবে তা লুকিয়ে না রেখে অত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব এদের সঙ্গে অবশ্যই শেয়ার করা।

Ñ পিতা-মাতা হিসেবে কোন অবস্থাতেই নিজেদের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে অন্য ছেলে-মেয়েদের তুলনা না করা।

আরেকটি মূল্যবান কথা সেদিন অনেকেই বলেছেন-সেটা হল, ছেলে-মেয়েদের কোন বিহেভিরিয়াল চেঞ্জ বা আচরণগত কোন পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তার উপর নজর রাখা।

প্রশ্ন : এতদিন আমরা জেনে এসেছি যে, বিষন্নতা শুধু প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদেরই সমস্যা। কিন্তু এখন দেখছি, আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যেও বিষন্নতা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

উত্তর : হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন, এদেশে এসে অনেকেই ভেঙ্গে পরেন। তার প্রথম কারণ হল প্রফেশনাল জব না পাওয়া। তবে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব এবং ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টরা অনেক অভিযোগ করার পরও হাল ছেড়ে দেয়না। দ্বিতীয় প্রজন্ম ভাল করবে এই আশাতেই বুকবেধে পরিশ্রম করে যেতে থাকে।

কিন্তু দ্বিতীয় প্রজন্মের বিষন্নতার কারণগুলো ভিন্ন। এটা স্কুল এর সার্বিক পরিবেশ থেকে আসতে পারে – যেমন নতুন ভাষা, এডুকেশনাল সিস্টেম, পড়ার চাপ, ব্যুলিং ইত্যাদি। তার উপর যদি ঘরে বাবা-মার কলহ বিরাজ করে, তবে সেটাও ছেলে-মেয়েদের বিষন্নতার একটা কারণ হতে পারে। এছাড়াও টেস্ট রেজাল্ট, প্রেম ঘটিত ব্যাপারও বিষন্নতার কারণ হতে পারে।

আরো যে বিষয়গুলো আমি উল্লেখ করতে চাই তা হলো, মা বাবার সাথে ছেলেমেয়েদের সম্পর্কের দূরত্ব। তার মানে, যে মধুর সম্পর্ক থাকা দরকার তা আমরা অনেকসময়ই মেনটেইন করতে পারিনা। এর কারণ সময়ের অভাব। আবার সময় থাকলেও না থাকার অজুহাত দেখানো (যেমন, ফেইস বুক, সেলফোন ইত্যাদি নিয়ে মাত্রাধিক্য ব্যস্ত থাকা), আর্থিক অনটন, পারিবারিক কলহ অনেক কিছুই হতে পারে। শুধু যদি আমরা ছেলে-মেয়েদের বিহেভিরিয়াল চেঞ্জটাকেও ফলো করতে পারি তাহলেও অনেক অঘটন থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

তাই আমি সবাইকে অনুরোধ করবো ছেলেমেয়েদের সাথে মধুর সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য সচেষ্ট হতে। শুধু সুসম্পর্কই যে সবকিছুর সমাধান দিবে সেটারও কোন গ্যারান্টি নেই। কারণ যখন বাচ্চারা টিন-এজ পর্যায়-এর মধ্য দিয়ে পার হয় তখন তাঁদের হরমোনাল চেঞ্জও হয়। তাঁদের ব্যাবহারে দেখা যায় অনেক পরিবর্তন। তাঁদেরও যে দরকার তাঁদের নিজস্ব স্পেস, আমরা কি তাঁদের এই বিষয়টা চিন্তা করি? আমদের উচিত তাঁদের জন্য হ্যাং-এরাউন্ড স্পেস তৈরি করা। যেমন স্পোর্টস ক্লাব সহ অন্যান্য ক্লাবের ব্যবস্থা করা-যেখানে গেলে তারা তাঁদের সমবয়সী ছেলে-মেদের সাথে মিশতে পারবে, বন্ধ্ত্বু করতে পারবে। তখন তাদের মনও প্রফুল্ল থাকবে।

প্রশ্ন :  তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিষন্নতা রোধের বিষয়ে অভিভাবকদের ভূমিকা কি হওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : বিষন্নতা কিন্তু একদিনে আসেনা। এটা একটা পূঞ্জিভূত বিষয়। আস্তে আস্তে সৃষ্টি হয়। একটা সময়ে এসে এক অসহনীয় ব্যাথায় রূপ নেয় এই বিষন্নতা। কাজেই শুরু থেকে বিষন্নতার পিক স্টেজ পর্যন্ত অনেক সময় পাওয়া যায়। অভিভাবকরা যদি

ছেলে-মেয়েদের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখে তাহলে বিষন্নতা রোধ করা খুবই সহজ। আগেও বলেছি ছেলে-মেয়ের বিহেভিরিয়াল চেঞ্জ এর প্রতি সতর্ক দৃষ্টিও এনে দিতে পারে সুফল। স্টিগমা থেকে বেরিয়ে এসে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরামর্শ নেওয়াটাও জরুরী। আরেকটা কথা না বললেই নয়, তা হল, ডিপ্রেশন / মেন্টাল হেলথ সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

প্রশ্ন : বিসিসিএস এর পক্ষ থেকে আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি এ বিষয়ে?

উত্তর : সুন্দর প্রশ্ন। ধন্যবাদ। আমরা এযাবৎ এল্ডার এবিউজ, সিনিয়র এবং তরুণদের মাঝে সম্পর্কের গ্যাপ কমানো, সিনিয়রদের টেকনোলজিক্যাল নলেজ বৃদ্ধি-বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমগুলোর ব্যাবহার, বাচচাদের আর্ট এবং একাকিতত্বে ভুগছে এমন সিনিয়রদেরকে নিয়েই কাজ করে আসছি। তবে ইদানিংকার পরপর দুটো মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের বাঙ্গালী সমাজকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে, ঠিক তেমনি ভাবে বিসিসিএস কেও নাড়া দিয়েছে। একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব এড়াতে পারিনি।

গত ৯ এপ্রিল টরন্টোতে আমরা একটা মত বিনিময় সভা দিয়ে শুরু করেছি। আমাদের সাথে এক্সপার্ট টিম আছে, তাদেরকে নিয়ে একটা সঠিক ওয়ার্ক প্লান নিয়েই আমরা অগ্রসর হচ্ছি। আমাদের প্রথম কাজ হলো আমাদের কাজ কর্মের ধরণ সম্পর্কে কমিউনিটিকে অবহিত করা। তারপর কমিউনিটির লোকদেরকে মেন্টাল হেলথ/বিষন্নতা সম্পর্কে সজাগ করে তোলা, বিষন্নতার কারণ, সিম্পটম, অভিভাবকদের কি করণীয়, এদেশে কি কি প্রফেশনাল সার্ভিস আছে, আমরা কি কি করতে পারি এগুলোর একটা সম্যক চিত্র তাঁদের কাছে তুলে ধরা। আমাদের মনে রাখতে হবে যে  মেন্টাল হেলথ/বিষন্নতা এখন আর ফাহমি বা সাবিত-এর পরিবারের সমস্যা নয়-এটা আমদের সবার সমস্যা। সে কারণে আমরা ‘বাংলাদেশ সেন্টার এন্ড কমিউনিটি সার্ভিসেস’ এবং ‘লাইট’ (ডিপ্রেশন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সাহায্য প্রদানের একটি সংগঠন ) চাই যে  কমিউনিটির সবাই খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসুক।

আর এসব কারণেই আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে বাবা-মা যারা আছেন তাদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ- আপনারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে দ্বিধাবোধ করবেন না। আমাদের সাথে রয়েছে নতুন প্রজন্মের এক ঝাক উদ্যোমী তরুণ-তরুণী যারা দারুন সংবেদনশীল এ প্রসঙ্গটি নিয়ে। এদের সংস্পর্শে এসে আপনার ছেলে-মেয়েরা সহজ-স্বাভাবিক হতে পারবে এবং স্বাচ্ছন্দ অনুভব করবে।

বিষন্নতা গোপন রাখবেন না, ‘শেয়ারিং পেইন ডিক্রিজেজ পেইন’

প্রয়োজনে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন : সানজানা হোসেইন

সানজানা হোসেইন

সানজানা হোসেইন বাংলাদেশী কমিউনিটিতে একজন নিবেদিত প্রাণ সামাজকর্মী। যারা মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী তাদেরকে নিয়ে তার কাজ। সে আন্ডারগ্রাজুয়েট করেছে সাইকোলজীতে। রিহেবিলিটিং কাউন্সিলিং এ পোস্টগ্রাজুয়েট এবং মাস্টার্স রিহেবিলিটিং সাইন্সে। বর্তমানে সে ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ডিজএবিলিটি কেস ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত।

সম্প্রতি টরন্টোতে দুজন বাংলাদেশী তরুণের আত্মহত্যার ঘটনা তাকেও নাড়া দিয়ে গেছে। একজন মেন্টাল হেলথ প্রফেশনাল হিসাবে তার কাছে মনে হয়েছে এ বিষয়ে কমিউনিটিতে কিছু করা জরুরী। ডিপ্রেশনের ব্যাপারে এ্যাওয়ারনেস তৈরী করা সহ আরো কিভাবে লোকজনদেরকে সহায়তা প্রদান করা যায় সে বিষয়ে কাজ করার জন্য সে ও আরো কয়েকজন উদ্যোগী তরুন মিলে গঠন করে লাইট (LIGHT) নামের একটি অনলাইন সংগঠন। এর মাধ্যমে সানজানা ও তার সহযোগিরা কমিউনিটিতে যারা ডিপ্রেশন বা মেন্টাল হেলথ ইস্যু নিয়ে সমস্যায় ভুগছে তাদেরকে সহায়তা প্রদান করবে। লাইট এর সঙ্গে যোগাযোগ ঠিকানা : lightawareness@outlook.com

সানজানা হোসেইন এর কাছে আমরা প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে জানতে চেয়েছিলাম প্রবাসে আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ডিপ্রেশন কেন দেখা দিচ্ছে, এর লক্ষণগুলো কি কি এবং কেউ ডিপ্রেসড হলে কি কি করনীয় তা নিয়ে। এ বিষয়ে তিনি যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তা এখানে তুলে ধরা হলো।

প্রশ্ন : ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো কি কি?

উত্তর : ডিপ্রেশনের অনেক লক্ষণ থাকতে পারে। প্রথম যে বিষয়টি উল্লেখ করা যায় সেটি হলো বিহেভিরিয়াল চেঞ্জ বা আচরণগত পরিবর্তন। যদি দেখা যায় কোন চুপচাপ মানুষ হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাচ্ছে তখন ধরে নিতে হবে এটি তার আচরণগত পরিবর্তন। আবার যদি দেখা যায় কোন কৌতুকপ্রিয় এবং বহির্মূখী স্বভাবের ব্যক্তি হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে এবং একা একা থাকতে ভালবাসে তবে ধরে নিতে হবে সেটিও তার আচরণগত পরিবর্তন।

আচরণগত পরিবর্তনের কিছু শারীরিক লক্ষণও আছে। যেমন অবসাদ, ক্লান্তি, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা, কোন কাজে একাগ্রতার অভাব ইত্যাদি।

আচরণগত পরিবর্তনের মধ্যে আরো যে সকল লক্ষণ থাকতে পারে তা হলো, আক্রমনাত্বক বা মারমুখি হওয়া, বিমর্ষ বা বিষন্ন থাকা, নিজেকে অপদার্থ মনে করা, খিটখিটে মেজাজের হওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা ইত্যাদি।

প্রশ্ন : আমরা জানি প্রবাসে প্রথম প্রজন্মের অনেক বাবা-মা’ই কম বেশী ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন। এতে করে কি ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও ডিপ্রেশন ছড়ানোর  সম্ভাবনা থাকে?

উত্তর : ডিপ্রেশনের জেনেটিক রিলেশন কিছু কিছু পাওয়া গেছে। আর বাবা মা যদি নতুন দেশে এসে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে বা কাজে কর্মে সুবিধা না করতে পরে ডিপ্রেসড হন বা বিষন্নতায় ভোগেন, ছেলে-মেয়েদেরকে সময় দিত না পারেন, সবসময় বিমর্ষ থাকেন তবে তা থেকে পরিবারে যে একটা অসুখী এনভাইরনমেন্ট বা পরিবেশ তৈরী হয় তার প্রভাব কিছুটা ছেলে-মেয়েদের উপর পড়তেই পারে। তবে পড়বেই এমন কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না।

প্রশ্ন : পরিবারিক সহিংসতা ও শাসনের নামে ছেলে-মেয়েদেরকে মারধর করা থেকে কি ডিপ্রেশন জন্ম নিতে পারে?

শাসনের নামে ছেলে-মেয়েদেরকে মারধর করা বাংলাদেশে হয়তো স্বাভাবিক। বা আমরা তা দেখেও না দেখার ভান করি। কিন্তু কানাডায় যখন ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যায়, অন্য কালচারের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করে তখন তারা জানতে পারে যে এ ধরণের নির্যাতন মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং তা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে পুলিশ কল করতে হয়।

এটা আসলে একটি বড় ধরনের সমস্যা। এবং সেভাবেই এটা আমাদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু আমরা যখন বাড়িতে আসি তখন দেখি পরিস্থিতিটা কেমন যেন বদলে যায়। শাসনের নামে মারধর করার বিষয়টি যেন সবাই কেমন স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়। কিছু কিছু বাবা-মা আছে যারা ছেলে-মেয়েদেরকে মারধর করছে, বকাবকি করছে, অভদ্র আচরণ করছে, অপমান করছে। বাংলাদেশী কমিউনিটিতে এগুলো আমরা দেখেও না দেখার ভাব করছি।

আমরা তখন একটি বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাই। আমরা ভাবতে থাকি শাসনের নামে এই ফিজিক্যাল অথবা মেন্টাল এবিউজ কি ঠিক আছে না এটি সত্যিই বড় ধরনের কোন সমস্যা। শুধু যে ছেলে-মেয়েরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা নয়। অনেক সময় দেখা যায় স্বামী স্ত্রীকে মারধর করছে। এই যে বিষয়গুলো, এ সমস্তের কারণেও অনেক সময় পরিবারের ছেলে-মেয়েরা উদ্বিগ্ন অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে পারে অথবা ডিপ্রেশনের বা বিষন্নতার শিকার হতে পারে। বিশেষ করে ছেলে-মেয়েরা যখন এর কোন উত্তর খুঁজে না পায় যে, কেন এমন হচ্ছে।

প্রশ্ন : ব্যুলিং (bullying) এর শিকার হলেও কি ডিপ্রেসড হতে পারে ছেলে-মেয়েরা? এরকমটা কি হচ্ছে এখানে বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে?

উত্তর : ব্যুলিং যেটা হয় স্কুলে, অনলাইনে বা অন্যত্র সেটাও ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ডিপ্রেশন বা মেন্টাল হেলথ এর কন্ডিশন তৈরী করতে পারে। আর যে ব্যুলিং করে সে নিজেও কোন না কোন ভাবে মানসিক সমস্যার মধ্যে থাকে বলেই এগুলো করে বেড়ায়। যারা ব্যুলিং এর শিকার হয় এবং ক্রমাগত শিকার হতে থাকে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পায়, তারা যদি নিরাপদ অনুভব না করে তবে একটি পর্যায়ে এসে তারাও ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে। এদের কেউ কেউ আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়। এ কারণে, যারা ব্যুলিং করে এবং যারা ব্যুলিং এর শিকার হয় তাদের উভয়ের জন্যই মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।

প্রশ্ন : এখানে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পর ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার চাপ হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে যায়। এই চাপের সঙ্গে ডিপ্রেশনের কোন সম্পর্ক আছে কি?

উত্তর : এটা অনেকটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ একটা বড় পরিবর্তনের কারণে লেখাপড়ার চাপ বৃদ্ধি পেলে যে কেউ নিজেকে অসহায় ভাবতে পারে বা নিরাশ হয়ে পড়েতে পারে একটা পর্যায়ে। এর জন্য ভয় পাবার কিছু নেই বা লজ্জিত হবারও কিছু নেই। আমি আমার নিজের সহপাঠীদের অনেককেই দেখেছি এরকম সমস্যায় ভুগেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সাপোর্ট সিস্টেম। এই সাপোর্ট আসতে পারে সহপাঠীদের কাছ থেকে অথবা কোন বন্ধুর কাছ থেকে বিশেষ করে যারা নিজেরাও হয়তো একই সমস্যায় ভুগছে। যখন একজন ভুক্তভুগি দেখে সে একা নয়, আরো ভুক্তভুগি আছে তখন তারা অনেকটাই সহজ হয়ে আসতে পারে। এটা একটা বড় সহযোগিতা। কিন্তু এই সহযোগিতাটি প্রবাসে আমরা বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েরা সাধারণত অনেক বাবা-মায়ের কাছ থেকে যথাযথভাবে পাই না। আমরা বাবা-মায়ের কাছে সহজভাবে বলতে পারি না যে, প্রতি সেমিস্টারে ৪টা কি ৫টা সাবজেক্ট নিলে খুব কঠিন হয়ে যাবে পাশ করা বা ভাল রেজাল্ট করা। অনেক বাবা-মায়েরাও এ বিষয়ে ছেলে-মেয়েদের সমস্যাটি বুঝতে চান না। তাদের এক কথা, চার বছরের কোর্স চার বছরেই শেষ করতে হবে। কোর্স শেষ করতে গিয়ে সময় বেশী নিলে আমাদের বদনাম হবে, নাক কাটা যাবে। এরকম একটি মনোভাব আমাদের কিছু কিছু বাংলাদেশী বাবা-মায়েদের মধ্যে বিরজমান। এরকম পরিস্থিতিতে ছেলে-মেয়েরা ভীত হয়ে পড়ে, অসহায় হয়ে পড়ে এবং নিরাশ হয়ে পড়ে।

আমার সাজেশন হলো, এরকম অবস্থায় পতিত হলে ছেলে-মেয়েরা স্কুলের কাউন্সিলিং সার্ভিসের বা স্টুডেন্ট এ্যাভাইজরী কমিটির স্মরণাপন্ন হতে পারে সাহায্যের জন্য। বাবা-মাকে খুশী করার জন্য নিজের জীবনকে কঠিন করে তোলার কোন প্রয়োজন নেই। আগে নিজের কথা ভাবতে হবে। চার বছরের কোর্স যদি পাঁচ বছরে শেষ করা যায় সফল ভাবে তবে সেটা সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। ছেলে-মেয়েদের জন্যও বাবা-মায়েদের জন্যও। কোন কোন বাবা-মা হয়েতো বাইরে থেকে খুব কঠিন মনোভাব দেখায়। কিন্তু দেরীতে হলেও যখন ছেলে-মেয়েদের সাফল্য দেখে তখন তরা খুশীই হয়।

প্রশ্ন : বাবা-মা অনেক সময় ভাল রেজাল্ট করার জন্য ছেলে-মেয়েদের উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকেন। অন্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তুলনা করে বলেন তারা ভাল করছে তুমি কেন পারছ না। ডিপ্রেসড হওয়ার পিছনে এগুলো কোন ভূমিকা থাকে কি?

উত্তর : এর প্রভাবটা ছেলে-মেয়েরদের উপর বেশ নেগিটিভ ভাবেই পড়ে। তারা ডিপ্রেশনেরও শিকার হতে পারে। কারণ, অন্যের সঙ্গে তুলনা করা হলে সেটি একজন ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসকে তলানিতে নামিয়ে দেয়। কারো আত্মবিশ্বাসকে যখন খর্ব করা হয় তখন তার প্রভাবটা নানাভাবে হতে পারে। মানসিক ভাবে বিষন্ন হওয়া ছাড়াও একজন ব্যক্তির মনে উদ্বিগ্নতার জন্ম দিতে পারে। সুতরাং অন্যের সঙ্গে তুলনা করার আগে খুবই সতর্ক থাকতে হবে শব্দ চয়নের বেলায়। আমরা সবাই চাই সেরাটা হতে। বাস্তবতা হলো সেটি সবার বেলায় সম্ভব হয় না। সে কারণে আমাদেরকে প্রতিটি শিশুর ব্যক্তিগত শক্তিমত্তাকে আলাদাভাবে বিচার করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি শিশুরই কোন না কোন বিষয়ে মেধা বা গুণ আছে। অন্যের সঙ্গে তুলনা না করে শিশুটির যে বিষয়ে গুণ আছে সেটির উপর জোর দিন, সেই গুণটিকে উৎসাহিত করুন নানান রকম ইতিবাচক কথা বলে।

প্রশ্ন : প্রবাসে বাঙ্গালী ছেলে-মেয়েরা ঘরে এক সংস্কৃতি এবং বাইরে আরেক সংস্কৃতির মধ্যে বড় হয়। এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তার প্রভাবটা কিরকম হয় এবং এর কারণেও কি ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে?

উত্তর : ছেলে-মেয়েরা ঘরে দেখে এক সংস্কৃতি আর বাইরে গিয়ে মুখমুখি হয় আরে সংস্কৃতির। এটি অবশ্যই তাদের মনে একধরণের বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে এবং আইডিয়েন্টি ক্রাইসিস তৈরী করে। আমি কি বাঙ্গালী, আমি কি কানাডিয়ান, না আমি বাঙ্গালী কানাডিয়ান। কোনটা আমি? এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠে।

যখন অন্য সংস্কৃতির কারো সঙ্গে কোন বিষয়ে কথা হয় একজন বাংলাদেশীর তখন হয়তো দেখা যায় তার অভিমতের সঙ্গে বাংলাদেশী তরুনের অভিমত মিলেনা। ফলে এরকম পরিস্থিতিতে ঐ তরুনের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি পারে বিভিন্ন পর্যায়ে। এটি একধরণের মানসিক সংকট বা মেন্টাল ক্রাইসিস। আর এই ক্রাইসিস থেকে মেন্টাল এংজাইটি বা ডিপ্রেশন এর সৃষ্টি হতে  পারে।

প্রশ্ন : কোন কোন পরিবারে ছেলে-মেয়েদেরকে হিজাব বা বোরখা পরতে বাধ্য করা হয়। এর কারণেও কি ডিপ্রেশন সৃষ্টি হতে পারে?

উত্তর : হিজাব বা বোরখা পরতে বাধ্য করাটা এক ধরণের মানসিক চাপ অবশ্যই। আর যে কোন ধরণের মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হলে একজনের মনে এংজাইটি বা ডিপ্রেশনের সৃষ্টি হতে পারে। এটি বাচ্চাদের উপর এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা। যে সকল বাবা-মা এই ধরনের আচরণ করেন তাদেরকে আমি বলতে চাই, ধর্মকে ভাল করে জানুন। ধর্মে কোন কিছু জোর করে আরোপ করার কথা বলেনি। ইসলাম ধর্ম এই বিষয়ে সুষ্পষ্ট। ধর্ম প্রচার করুন কিন্তু বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। পোশাকে শালীনতা বজায় রেখে শরীর ঢাকা থাকলেই হয়।

প্রশ্ন : যদি কোন বাবা-মা বুঝতে পারেন যে তাদের ছেলে বা মেয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছে তবে প্রাথমিক পদক্ষেপ কি হওয়া উচিৎ?

উত্তর : প্রথমেই ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদেরকে জানাতে হবে যে, আমরা কিছু একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বিষয়টি নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমরা এ বিষয়ে তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আমরা তোমাকে অভিযুক্ত করছি না কোন বিষয়ে। শুধু জানতে চাচ্ছি কি হয়েছে তোমার।

এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, প্রথম প্রচেষ্টাতেই হয়তো সফল হওয়া যাবে না। ছেলে-মেয়েরা হয়তো এ বিষয়ে কথা বলতে চাইবে না। বা কোন কিছু ঘটেছে এই কথা স্বীকারও করতে চাইবে না। তাই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দুই থেকে তিনবার চেষ্টা করুণ তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য। প্রথম সপ্তাহে সফল না হলে দ্বিতীয় সপ্তাহে চেষ্টা অব্যাহত রাখুন, প্রয়োজনে তৃতীয় সপ্তাহেও। হয়তো তখন সে তার মুখ খুলবে। চতুর্থ সপ্তাহে হয়তো সে আরো বিস্তারিতভাবে মনের সমস্যাগুলো আপনাদের কাছে তুলে ধরবে। এটা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

যদি মনে করেন আপনার সন্তানের যে অবস্থা তাতে চূড়ান্ত কিছু ঘটে যেতে পারে তবে সাথে সাথে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে আপনাকে।

আর বিষয়টি না লুকিয়ে আপনার পরিবারের সবাইকে জানান, আপনার প্রতিবেশী, আপনার বন্ধু-বান্ধব সবাইকে জানিয়ে রাখুন যাতে তারাও এই ব্যাপারে সহায়ক হন যখন তার সঙ্গে দেখা হয় বা কথা হয়। এটা খুবই জরুরী।

যারাই বিষন্নতায় ভুগছে তাদের প্রতি আমার পরামর্শ – আপনারা এগিয়ে আসুন, কথা বলুন পরিবারের সদস্যদের সাথে, বন্ধুদের সাথে। যার উপর নির্ভর করতে পারেন বা যাকেই বিশ্বাস করুন তার সাথেই কথা বলুন। প্রয়োজনে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন। সমস্যাটি গোপন রাখবেন না, বা জিইয়ে রাখবেন না। মনে রাখবেন, ‘শেয়ারিং পেইন ডিক্রিজেজ পেইন’।

আপনি যদি জানতে পারেন আপনার পরিচিত কেউ মেন্টাল ইলনেস এ ভুগছে তবে তাকে সহায়তা দানের জন্য এ বিষয়টির উপর একটু লেখাপড়া করুন। অনলাইনে সার্চ করুন, ভিডিও দেখুন। শিখুন আপনার ভূমিকা কি হওয়া উচিৎ, শিখুন এই পরিস্থিতিতে আপনি কি অবদান রাখতে পারেন। আপনার কমিউনিটিতে ডিপ্রেশন মোকাবেলায় কি কি সুযোগ রয়েছে সেটাও জেনে রাখুন। ডিপ্রেশন এর কারণে যখনই কারো সহযোগিতা দরকার, স্বপ্রনোদিত হয়ে এগিয়ে আসুন।

বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্যদের প্রতি আমার সবিনয় আহ্বান, এ বিষয়ে এ্যওয়ারনেস বা সচেতনতা গড়ে তুলুন যাতে করে আমাদের আগামী জেনারেশন ডিপ্রেশন বলুন, বিষন্নতা বলুন বা মানসিক রোগ বলুন এগুলোতে না ভুগে যেভাবে আজকের জেনারেশন ভুগছে।