বিষন্নতার ভয়াবহ ছোবল কেড়ে নিল টরন্টোর সম্ভাবনাময় দুুই তরুণের প্রাণ
সতর্ক হওয়ার পরামর্শ প্রবাসী অভিভাবকদের প্রতি
মে ১৪, ২০১৭
খুরশিদ আলম : বিষন্নতা একটি গুরুতর মানসিক ব্যাধি। প্রাণঘাতি এই ব্যাধি মানুষকে কুড়ে কুড়ে খায়। নীরব ঘাতকের মত মানুষের সব আনন্দ, সব সুখ, সব ভাললাগাকে ক্রমশ গ্রাস করে নেয় এই বিষন্নতা। সম্প্রতি টরন্টোতে দুই বাংলাদেশী তরুণ আত্মহননে পথ বেছে নেয় এই বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়েই। তাদের এই আত্মহননের খবরে বিষাদের ছয়া নেমে আসে টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে। অনেকের মনেই প্রশ্ন উদিত হয়, কেন এই দুই তরুণ আত্মহননের মত এরকম কঠিন এক পথ বেছে নিল? কি ছিল তাদের সমস্যা?
টরন্টোতে আগেও আরো কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে। তবে সেগুলো তেমনভাবে আলোচনায় আসেনি যেমনটা এসেছে এবারের দুই তরুণের আত্মহত্যার ঘটনায়। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এভাবে দুই উদীয়মান তরুণের চলে যাওয়াটাকে কেউই যেন মেনে নিতে পারছেন না।
প্রথমে সাবিত খন্দকার নামে ২৭ বছরের এক তরুণ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তার বাবার নাম সেলিম খন্দকার। মা শিল্পী খন্দকার। তার কয়েক সপ্তাহ পরেই খবর আসে ফাহমি আরিফ রহমান নামের আরেক তরুণ আত্মহত্যা করেছে। ফাহমির বাবা আরিফ রহমান ও মা সাবিনা রহমান।
সাবিত লেখাপড়া করছিল আইন বিষয়ে। স্বপ্ন ছিল ব্যরিস্টার হবে। এ জন্য সে পাড়ি জমিয়েছিল বৃটেনে। বৃটেনে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করাটা ব্যয়বহুল হবে জেনেও সাবিতের বাবা পিছ পা হননি ছেলের স্বপ্ন পূরণে। কিন্তু সেই স্বপ্নে কখন যে গুনে ধরেছে তা টের পাননি সাবিত। টের পাননি তার বাবা সেলিম খন্দকারও। দুই বছর সেখানে লেখাপড়া করার পর একদিন সাবিত তার বাবাকে ফেনে জানালো, ‘বাবা আমি আর পেরে উঠছি না। খুব কঠিন লাগছে আমার এই লেখাপড়া। আমি ফিরে আসতে চাই। তুমি কিছু মনে করো না।
মাঝ পথে এই ফিরে আসাটা সাবিত বা তার পরিবারের কারোই কাম্য ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা তাকে ফিরিয়ে এনেছে লন্ডন থেকে টরন্টোতে। ফিরে আসার কিছুদিন পর সাবিত কেমন যেন বদলে যায়। অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল, স্বতঃস্ফূর্ত ও মিশুক প্রকৃতির সাবিত আশ্রয় নেয় বাড়ির বেইজমেন্টে। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই। নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে সবকিছু থেকেই। সারাদিন বেইজমেন্টে কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে। খাবার সময় হলে উপরে উঠে আসে। কিন্তু খাবার নিয়ে আবার সেই বেইজমেন্টে চলে যায়। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে, আমি ভাল আছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
উল্লেখ্য যে, অন্টারিওতে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন এখন একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। সিবিসি নিউজের এক খবরে বলা হয়, বিভিন্ন কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে মেন্টাল হেলথ কাউন্সিলরদেরকে এখন অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে বিষন্নতার শিকার শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে। কাউন্সিলরগণ শিক্ষার্থীদের এই ভিড়কে সুনামীর সঙ্গে তুলনা করেন।
অন্টারিওতে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর উপর জরীপ চালিয়ে দেখা গেছে তাদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষন্নতা এবং আত্মহত্যার প্রবনতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্টারিও ইউনিভার্সিটি এন্ড কলেজ হেলথ এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট মেগ হোটন বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি ভীতি ছড়াতে চাই না। তবে বাস্তবতা হলো, বিষন্নতায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের জীবনে ঝুঁকি বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হবার সময় এসেছে।
সাবিতের মা বাবাও চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন তাকে নিয়ে। মা প্রত্যেক ওয়াক্তে নামাজ আদায়ের পর দোয়া করতেন ছেলের জন্য। দু হাত তুলে আল্লাহর দরবারে আর্জি জানাতেন এই বলে যে, ‘আল্লাহ, আমার ছেলের সেই প্রাণ চঞ্চলতা ফিরিয়ে দাও’।
ছেলেকে কোথাও যেতে বললেও সে যেত না। সাবিতের এক কাজিনের বিয়ে হয় কিছু দিন আগে। সেখানেও সে যায় নি। সে যে ডিপ্রেশনের ভুগছিল এই বিষয়টি বাড়ির কেউ টের পায়নি। সাবিতের বাবা সেলিম খন্দকার এই প্রতিবেদক জানান, ডিপ্রেশন বিষয়টা কি তা আমার জানা ছিল না। সে কারণে আমি বুঝতেও পারিনি আসলে তার কি হয়েছিল।
সাবিতের বাবা আরো জানান, আমরা বিভ্রান্ত ছিলাম আরো এই কারণে যে, সে ঘরে আবার সবার সঙ্গেই কথা বলতো। মাকে জিজ্ঞেস করতো ঘরের কাছে তার কোন সাহায্য লাগবে কি না। আমাকেও জিজ্ঞেস করতো কোন সাহায্য লাগবে কি না যেটা সে আগে কখনো বলেনি।
কি কারণ থাকতে পারে সাবিতের ডিপ্রেসড হওয়ার পিছনে? লেখাপড়ায় ব্যর্থতা না কি অন্য কিছু? এর কোন সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। সে নিজে থেকেও কখনো কিছু বলেনি কি তার সমস্যা কি। তবে অনুমান করা যেতে পারে যে, তার ব্যর্থতাগুলোই তাকে বিষন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সে ব্যরিস্টার হতে চেয়েছিল, হতে পারেনি। টরন্টোতে তার বেশ কয়েকজন কাজিন রয়েছে যাদের মধ্যে কেউ ডাক্তার কেউ ইঞ্জিনিয়ার। তাদের সাফল্য দেখেও হয়তো সে নিজের ব্যর্থতাগুলোকে বড় করে দেখেছিল। তার বড় বোনের কাছে একবার সে স্বীকার করেছিল এই বলে যে, তার ব্যর্থতাগুলো নিয়ে সে নিজেই গিলটি ফিল করে।
সাবিতের বাবা বলেন, তার কাজিনরা ভাল ভাল পজিশনে আছে কিন্তু সে কিছু করতে পারেনি। সময়ে সময়ে এ বিষয়গুলো তাকে বলা হতো।
হয়তো এ সকল কারণেই সাবিতের মধ্যে এক পর্যায়ে বিষন্নতা জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু সময়মত তার চিকিৎসা হয়নি। কারণ, বিষন্নতার বিষয়টি কেউ অনুধাবন করতে পারেনি বলে। পরিণতিতে সে মৃত্যুকে সে বেছে নেয় সব কিছু থেকে মুক্তি পাবার জন্য।
গত বছর অন্টারিও ইউনিভার্সিটি এন্ড কলেজ হেলথ এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর উপর পরিচালিত জরীপে দেখা গেছে এখানকার অনেক শিক্ষার্থী ২০১৩ সালের তুলনায় অধিকমাত্রায় উদ্বেগ ও বিষন্নতায় ভুগছে। কারো কারো মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বা চেষ্টার মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
জরীপে যে তথ্যগুলো বেড়িয়ে এসেছে তা হলো :
শতকরা ৬৫ ভাগ শিক্ষার্থী জানিয়েছে ২০১৬ সালে তারা অপ্রতিরোধ্য উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। ২০১৩ সালে এ রকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৭ ভাগ।
শতকরা ৪৬ ভাগ শিক্ষার্থী জানিয়েছে ২০১৬ সালে তারা এতটাই ডিপ্রেসড বা বিষন্ন ছিল যে, ঠিকমত পড়াশুনা করাটা সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছিল। ২০১৩ সালে এ রকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল শতকরা ৪০ ভাগ।
২০১৬ সালে শতকরা ১৩ ভাগ শিক্ষার্থী গুরুতরভাবে চিন্তা করেছিল আত্মহত্যা করার জন্য। ২০১৩ সালে এরকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল শতকরা ১০ ভাগ।
২০১৬ সালে আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল শতকরা ২.২ ভাগ শিক্ষার্থী। ২০১৩ সালে এ রকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল শতকরা ১.৫ ভাগ।
আর শতকরা ৯ ভাগ শিক্ষার্থী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে (শুধু গত বছর নয়) আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।
অন্টারিও ইউনিভার্সিটি এন্ড কলেজ হেলথ এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট মেগ হোটন বলেন, আমরা গুরুতর সংকটের মধ্যে রয়েছি।
ফাহমির আত্মহননের বিষয়টিও ছিল বিষন্নতার কারণেই। তবে তার পরিস্থিতি ছিল একটু ভিন্ন। ২০১৫ সালে সে এক মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে সে অক্ষত অবস্থায় বেচেঁ যায় সেদিনের ঐ দুর্ঘটনা থেকে। কিন্তু তার পর থেকেই তার মধ্যে এক ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল যা ক্রমান্বয়ে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতায় রূপ নেয়।
লক্ষ্য করা গেছে যে, কানাডায় গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হওয়া তরুণদের (যাদের বয়স ১০ থেকে ২৪) মৃত্যুর প্রধান কারণ আত্মহত্যা। কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটির এক রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়। ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, গাড়ি দুর্ঘটনার পর বিষন্নতায় আক্রান্ত তরুণেরা নিজেদেরকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নেয়। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন কারো সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না। একা থাকতে পছন্দ করে। কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। ফাহমির ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল। গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার পরই সে ধীরে ধীরে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়। তবে মাদকাসক্ত হয়নি সে।
বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার আগে ফাহমির জীবনে কোন ব্যর্থতা ছিল না। সে ছিল অত্যন্ত মেধাবী। টরন্টো ইউনিভার্সিটির সেন্ট জর্জ ক্যাম্পাসে লাইফ সায়েন্সে পড়তো সে। ছিল খুবই মিশুক। বন্ধুদের পার্টিতে সে থাকতো ‘ম্যান অব দ্যা পার্টি’ হিসাবে। সবাইকে নাচিয়ে রাখতো সে। পরিবারের পরিবেশটিও ছিল তার খুবই অনুকুলে। আর্থিক সমস্যাও ছিল না পরিবারে। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার ছিল খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বাবাকে সে বলতো “বেস্ট ড্যাড ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড”। আর মা সম্পর্কে বলতো, “বেস্ট ফ্রেন্ড ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড”।
ফাহমির মা এই প্রতিবেদকে বলেন, আমরা কখনো আমাদের ছেলে-মেয়েকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করতাম না। বলতাম না যে, দেখ ওমুকে এই করেছে, তোমাদেরকেও তাই করতে হবে। ডাক্তার হতে হবে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এরকম কোন চাপ কখনো আমরা তাদেরকে দেইনি। তবে ফাহমি যেহেতু অত্যন্ত মেধাবী ছিল তাই তাকে এনকারেজ করতাম যাতে তার সেই মেধার অপচয় না হয়।
এরকম একটি ছেলে কেন বিষন্নতায় আক্রান্ত হবে? ফাহমির বাবা-মা এর কোন উত্তর খুঁজে পাননি। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলে অনেক সময় ছেলে-মেয়েরা হঠাৎ নতুন পরিবেশ, নতুন মুখ, পড়ালেখার বর্ধিত চাপ এর মুখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। দেখা যায় কেউ কেউ ভাল রেজাল্টও করতে পারে না নতুন অবস্থায়। কিন্তু ফাহমির বেলায় তা ঘটেনি। সে আগেও যেমন মেধার পরিচয় দিয়েছে, ইউনিভার্সিটিতে গিয়েও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ কারণে প্রথম বছরেই দু দুটো স্কলারশীপ পেয়েছে। তাহলে কেন সে বিষন্নতায় আক্রান্ত হলো?
এর উত্তর সম্ভবত কুইন্স ইউনিভার্সিটির ঐ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যই বলে দেয়। গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হওয়াটাই ছিল হয়তো ছিল ফাহমির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য।
ফাহমি নিজেও কি বুঝতে পেরেছিল যে সে বিষন্নতায় ভুগছে? সম্ভবত না। আর বুঝে থাকলেও সে তা গোপন করে গেছে। সড়ক দুর্ঘটনার পর তার বাবা মা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কোন কাউন্সিলিং লাগবে কি না। উত্তরে সে জানিয়েছিল তার কাউন্সিলিং এর প্রয়োজন নেই। সে ভাল আছে।
কিন্তু ফাহমি ভাল ছিল না। তার মা বলেন, ক্রমশই সে সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বন্ধুবান্ধব কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতো না। সবসময় হাসি-খুশী থাকতো যে ছেলেটি, বন্ধুবৎসলতা ছিল যার চরিত্রের বৈশিষ্ট সেই ক্রমশ বদলে গেল।
কিন্তু আবার বাসায় কোন পার্টি হলে বা মেহমান আসলে তাদের সঙ্গে বেশ স্বাভাবিক আচরণ করতো সে। ঘরে আমাদের সঙ্গেও স্বাভাবিক আচরণই করতো সে।
কানাডায় একটি ইমিগ্রেন্ট পরিবারের সন্তান হিসাবে ফাহমি যে সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছিল তাতে করে ডিপ্রেসড হওয়ার কোন কারণ তার ছিল না। এখানকার ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায়ও বলা হয়, ইমিগ্রেন্ট পরিবারের সন্তানদের মধ্যে মেন্টাল হেলথ ইস্যু কানাডার মূলধারার সমবয়সী ছেলে-মেয়েদের চেয়ে কম।
কানাডায় ‘হেলদী ইমিগ্রেন্ট ইফেক্ট’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। বিষয়টি এরকম যে, কানাডায় ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসার আগে সবাইকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হয়। ঐ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ্য লোকেরাই সাধারণত ইমিগ্রেশন পেয়ে থাকেন। ফলে কানাডায় আসার পর তারা তুলনামুলকভাবে কানাডায় জন্ম নেয়া অধিবাসীদের চেয়ে সুস্থ্যই থাকেন।
ম্যাক মাস্টার ইউনিভার্সিটির গবেষণায় আরো বলা হয়, কানাডায় আসার পর ইমিগ্রেন্ট পরিবারগুলো সাধারণভাবে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করে। কিন্তু তারপরও দেখা গেছে তাদের পরিবারের সন্তানদের মধ্যে বিহেভিরিয়াল বা ইমোশনাল সমস্যা কানাডিয়ান ছেলে-মেয়েদের তুলনায় কম। এর কারণ হতে পারে ইমিগ্রেন্ট পরিবারের সন্তানেরা ভাল গাইডেন্সের মধ্যে থাকে, তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধনটা শক্তিশালী। ফাহমির ক্ষেত্রে এই সুবিধাগুলো ছিল এবং বাড়তি আরো যে সুবিধা ছিল তা হলো তাকে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। কিন্তু তার দুর্ভাগ্যই তাকে টেনে নিয়ে গেছে ডিপ্রেশনের দিকে। শুরু থেকে তার চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। প্রথমত সে নিজে থেকে সমস্যাটি
গোপন রাখার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে ডিপ্রেশনের লক্ষণ সম্পর্কে বাবা-মা অবহিত ছিলেন না বলে তারাও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেন নি।
ফাহমি অবশ্য এক পর্যায়ে এসে তার মায়ের কাছে বলেছে যে সে ডিপ্রেশনে ভুগছে। কিন্তু ইতিমধ্যে এক বছর পার করে ফেলেছে সে। এর পর ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেছিল। ঔষধ খাওয়াও শুরু করেছিল। কিন্তু কয়েকদিন পর সে ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। ঐ ঔষধ খেলে নাকি দুর্বল লাগতো এবং খুব ঘুম পেতো।
ফাহমির বিষন্নতা যখন অনেকদূর এগিয়েছে তখন সে নিজেকে দোষারোপ করতে আরম্ভ করলো। মাঝে মাঝে বলতো – “আম্মু হোয়াট হেভ আই ডান টু মাই লাইফ”। সে আরো বলতো, “আমার বন্ধুরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, কেউ থার্ড ইয়ারে কেউ ফোর্থ ইয়ারে। আর আমি স্ট্রাগল করছি নিজেকে নিয়ে। আমাকে কেন ঔষধ খেতে হবে।”
ফাহমির মা বলেন, ছেলের সেল্ফ কনফিডেন্সটা হারিয়ে গিয়েছিল। নিজেকে দোষারোপ করার পাশাপাশি সে আরো মনে করতো সে হ্যান্ডসাম নয়। গুড লুকিং নয়। সে ব্রিলিয়ান্ট নয়। সে অকৃতকার্য।
ফাহমী তার বাবা-মায়ের সঙ্গে গত ১৪ ফেব্রুয়ারী নায়েগ্রা বেড়াতে গিয়েছিল। ফাহমির মা বলেন, এই সময়টা সে বেশ হাসি-খুশী ছিল। সে যে বিষন্নতায় ভুগছে এটি তখন তাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছিল না।
কিন্তু তার দিন কয়েক পরেই সে ডাউন টাউনে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেড় হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারী। যাওয়ার আগে সে একটি সুইসাইডাল নোট রেখে গিয়েছিল বাড়িতে। সেই দিন থেকেই সে নিখোঁজ ছিল। পরে প্রায় ৪০ দিন পর লেক অন্টারিও থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
বিষন্নতা একটি গুরুতর মানসিক রোগ। সময়মত এর চিকিৎসা না করাতে পারলে এর পরিণতি যে কতটা ভয়াবহ হয় সাবিত আর ফাহমি আত্মহননের মধ্য দিয়ে সেই কথা আমাদের কমিউনিটিকে জানিয়ে গেল।
আমরা কমিউনিটির প্রায় সবাই হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ আরো বেশ কিছু রোগ সম্পর্কে মোটামুটি অবহিত। আড্ডায় বসলে আমরা একে অন্যকে উপদেশ দেই। প্রয়োজনে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করার উপদেশ দেই। কিন্তু ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা নিয়ে কোন আড্ডায় বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে কাউকে কোন কথা বলতে শুনা যায় না। এর মূখ্য কারণ, এ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের অভাব। আরেকটা কারণ হতে পারে আমাদের সংস্কৃতি। কানাডায় আমরা সাউথ এশিয়ান ইমিগ্রেন্টরা এমন একটা সংস্কৃতি বহন করি যেখানে ডিপ্রেশনটাকে রোগ হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। অন্যদিকে যারা ডিপ্রেশনে বা মানসিক রোগে ভুগেন তাদেরকে ‘পাগল’ এর খাতায় ফেলা হয়। ফলে ডিপ্রেশনে কেউ ভুগলেও স্বীকার করতে ভয় পান। লজ্জায় চুপ থাকেন। আর পুরুষদের মধ্যে একটি প্রবণতা হলো, সহজে ডাক্তারের কাছে যেতে না চাওয়া।
ইউনিভারসিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে ক্রস কালচারাল সাইকোলজিতে পিএইচ ডি করা মনোবিজ্ঞানী সুনাইনা আসানান্দ তার এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, এখানে সমস্যা হলো, ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে যারা মানসিক সমস্যায় ভুগেন তাদের অনেকেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে চান না। বিষয়টির সঙ্গে দেশজ সংস্কৃতি সম্পর্কিত। মানসিক সমস্যা হলে অনেকেই লজ্জায় ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। তারা মনে করেন, আত্মীয় – বন্ধুরা যদি জেনে যায় তবে লজ্জার ব্যাপার হয়ে দাড়াবে।
মনোবিজ্ঞানী সুনাইনা আরো উল্লেখ করেন, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মূলধারার কানাডিয়ানদের চেয়ে ইমিগ্রেন্টদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বেশী দেখা দেয়। অথচ এরাই সবচেয়ে কম যান ডাক্তারের কাছে সাহায্য নিতে। পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয় – বন্ধু এদের কাছে লজ্জা পেতে হবে বা একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে এই ভয়েই তারা ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। ফলে সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তা বড় রকমের সমস্যা হয়ে দাড়ায়।
মনোবিজ্ঞানী সুনাইনার মতে, ইমিগ্রেন্টদের অনেকেরই ধারণা- এখানকার ডাক্তাররা ইমিগ্রেন্টদের মানসিক সমস্যাটা সঠিকভাবে ধরতে পারবেন না। কালচারাল গ্যাপের কারণে এরকম হতে পারে বলে তারা মনে করেন। বৈষম্যমূলক আচরণ
পেতে পারেন এই ভয়েও মূলধারার ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় পান অনেকে। এ বিষয়ে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন কমিউনিটিতে বেশ কিছু ডাক্তার যোগ হয়েছেন যারা নিজেরাও ঐ কমিউনিটিরই সদস্য বা একই কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা। সুতরাং তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে কোনরকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই।
টরন্টোর বাংলাদেশী-কানাডিয়ান ডাক্তার আবু আরিফ ইতিপূর্বে প্রবাসী কণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার কাছে মানসিক চাপ, দুঃচিন্তা, হতাশা বা ডিপ্রেশনের মতো সমস্যা নিয়ে অনেক রোগী আসে। ডাক্তার আবু আরিফের মতে টরন্টোতে গড়ে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বাংলাদেশী কোন না কোনভাবে মানসিক সমস্যায় ভোগে। এটি চিত্রটি প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের।
এতদিন আমাদের ধারণা ছিল আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম এই সমস্যার বাইরে। সাবিত আর ফাহমি আমাদের সেই ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়ে গেল তাদের মূল্যবান জীবনের বিনিময়ে। সাবিতের বাবা এবং ফাহমির বাবা-মা তাদের সাক্ষাৎকারে কমিউনিটির লোকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন আমাদেরকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। সাবিতের বাবা সেলিম খন্দকার বলেন, আমাদের আসলে ডিপ্রেশন সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকা উচিত ছিল। আমি আরো বলবো, কোন দুর্ঘটনা ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না। তার আগেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। সাবিত আর ফাহমির চলে যাওয়া আমাদের কমিউনিটির জন্য একটি ওয়েকআপ কল।
ফাহমির মা সাবিনা রহমান বলেন, কমিউনিটিতে আমাদের সবাইকে এই ডিপ্রেশন সম্পর্কে জানতে হবে। আমি এখনো শতভাগ জানিনা এই অসুখটা কেন হয়, এর লক্ষণগুলো কি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে কোন অসুখের মত এই ডিপ্রেশন বা বিষন্নতাও একটি রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে এর চিকিৎসা সহজ। আমরা যখন লক্ষণগুলো কি তা জানতে পারবো তখন পরিবারের কেউ মেন্টাল সমস্যায় ভুগলে বা বন্ধুমহলে কেউ মেন্টাল সমস্যায় ভুগলে দ্রুত সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে অসতে পারবো। তাই আমি মনে করি সবার আগে আমাদের যা দরকার তা হলো এডুকেশন। এটি খুবই জরুরী। এর পর এওয়ারনেস বা সতর্কতা। আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। এর পাশাপাশি কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থাও করতে হবে।
ফাহমির বাবা আরিফ রহমান বলেন, এডুকেশনের পাশাপাশি এই রোগ সম্পর্কে একসেপ্টেন্সী খুব দরকার। কানাডায় আমাদের সাউথ এশিয়ান কমিউনিটিতে মেন্টাল হেলথ এর সমস্যাটিকে একসেপ্ট করে নিতে হবে। আমরা এখনো এই সমস্যাটিকে অন্যভাবে দেখি। এটা অন্য যে কোন রোগের মতই একটি রোগ। এ সত্যটি মেনে নিতে হবে।
সানিব্রুক হেলথ সাইন্স সেন্টারে কর্মরত মনরোগ বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর এসিস্টেন্ট প্রফেসর ড. মার্ক সেনিয়র হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলেন, স্কুলে আমরা হৃদরোগ, মস্তিস্কে রক্ত ক্ষরণ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পড়াই। এটা খুবই জরুরী। কিন্তু আমাদেরকে একই সঙ্গে এটাও বিবেচনা করতে হবে যে, মানসিক রোগ সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীদেকে জ্ঞানদান করাটাও সমানভাবে জরুরী।
তিনি বলেন, অনেক মানুষ আছেন যারা এই রোগের ঝুঁকিতে থাকা সত্বেও এর লক্ষণসমূহ ঠিকমত বুঝতে পারেন না। তারা এটাও জানেন না যে, শুরুতেই এটি প্রতিরোধ করা যায় উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে। কারণ, কেউ তাদেরকে ডিপ্রেশন এর কারণসমূহ কি এবং কি ভাবে তা প্রতিহত করা যায় সে বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব নিচ্ছেন না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুল থেকেই মানসিক রোগের লক্ষন, করনীয় ইত্যাদি সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষিত করে তোলা গেলে সম্ভাবনাময় অনেক মূল্যবান জীবনই রক্ষা করা যেতে পারে।