বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের চত্বরে দ্বিতীয়বারের মত উত্তলন করা হলো লালসবুজ পতাকা
মার্চ ৩০, ২০১৭
প্রবাসী কণ্ঠ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবন চত্বরে দ্বিতীয়বারের মত উত্তলন করা হলো বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত লালসবুজ পতাকা। গত ২৭ মার্চ বিকেলে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশীদের উপস্থিতিতে পার্লামেন্ট ভবনের সামনের চত্বরে পতাকা উত্তলনের সময় অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ হলেও ঐ দিন অন্টারিওতে সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় ২৭ মার্চকে পতাকা উত্তলনের দিন হিসাবে বেছে নেয়া হয়।
অন্টারিও প্রভিন্সের বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্যের উপস্থিতিতে এবছর বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করেন কানাডার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অধ্যাপক ড. অমিত চাকমা। অমিত চাকমা লন্ডন অন্টারিওতে অবস্থিত স্বনামধন্য ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ও ভাইস চ্যান্সেলর।
ঐ দিন টরন্টোতে তুষার বা বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল না কিন্তু আকাশ ছিল মেঘলা। মেঘলা আকাশ আর মৃদু শৈত্য প্রবাহ এবং কর্মদিবস সত্বেও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশী পতাকা উত্তলনের এই মহতী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। টরন্টোর ‘বাংলাদেশ সেন্টার ও কমিউনিটি সার্ভিসেস’ এবং অন্টারিও পার্লামেন্ট এর সহযোগিতায় টরন্টোর ডাউন টাউনে অবস্থিত পার্লামেন্ট ভবনের দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নিদর্শন এর পটভূমিতে যখন বাংলাদেশের পতাকাটি উত্তলন করা হচ্ছিল তখন প্রবাসী বাংলাদেশীগণ একযোগে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে উঠেন।
পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশ সেন্টার ও কমিউনিটি সার্ভিসেস এর পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সেন্টারের প্রেসিডেন্ট হাসিনা কাদের। এরপর বক্তব্য রাখেন অন্টারিও পার্লামেন্ট এর স্পীকার ডেভ ল্যাভাক। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানে আসার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকেই বলছি, আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, ‘আই এ্যাম ইউ এন্ড ইউ আর আই’। এ সময় অনুষ্ঠানে আগত বাংলাদেশীরা তার এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে করতালি দেন।
ডেভ ল্যাভাক বলেন, বিশ্বের অনেক দেশই কানাডার মাল্টিাকালচারালইজমের এক্সপিরিমেন্টে এর কথা বলে থাকেন। আমি বলি, কানাডায় মাল্টিকালচারালইজম আর এক্সিপিরিমেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন একটি সাকসেস স্টোরী। তিনি আরো বলেন, কানাডায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর ২ লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশী ইমিগ্রেন্ট এসে থাকেন। আর এদের মধ্য থেকে গড়ে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজারই আসেন অন্টারিওতে। অন্টারিওর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে এই ইমিগ্রেন্টদের প্রয়োজন রয়েছে। বসবাসের জন্য অন্টারিওকে একটি উত্তম স্থান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য এই ইমিগ্রেন্টদেরকে চাই আমরা। আর এই ইমিগ্রেন্টরা সেই কাজটিই করছেন এখানে আসার পর থেকে।
ডেভ ল্যাভাক বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সকলের প্রতি শুভেচ্ছা জানান।
পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশী অধ্যুষিত বিচেস ইস্ট ইয়র্ক এলাকা থেকে নির্বাচিত এমপিপি আর্থার পটস অন্টারিওর প্রিমিয়ার ক্যাথলিন উইন এর একটি বাণী পড়ে শুনান। প্রদত্ত ঐ বাণীতে ক্যাথলিন উইন বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অন্টারিও সরকারের পক্ষ থেকে আমি আমার উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি প্রবাসী বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের প্রতি।
মাল্টিকালচারাল সোসাইটির সাফল্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে অগ্রসরমান ও শক্তিশালী প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটি আগামীতেও অন্টরিওকে আরো শক্তিশালী করে তুলবে। আন্টারিওর আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেক টেকসই অবদানের জন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আজকের এই অর্থপূর্ণ ও স্বরণীয় দিনে আপনারা আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।”
এর পর বক্তব্য রাখেন এনডিপি এমপিপি তেরেসা আর্মস্ট্রং। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ করে বলেন, আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তলন করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। আজ সেই পতাকাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দ্বিতীয়বারের মত উত্তলন করা করা হলো অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের চত্বরে। বাংলাদেশের বিশেষ এই দিনে লালসবুজ পতাকা উত্তলন করতে পেরে আমরা গর্বিত।
তেরেসা আর্মস্ট্রং বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনেরও প্রশংসা করেন। বাংলাদেশীদের প্রগতিশীল মূল্যবোধেরও প্রশংসা করেন তিনি। তিনি কানাডার বিশেষ করে অন্টারিও প্রভিন্সের অগ্রগতিতে বাংলাদেশী কানাডিয়ানদের অবদানের কথাও উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, অন্টারিওতে মার্চ মাসকে বাংলাদেশ হেরিটেজ মাস ঘোষণা দেয়া ও তা উদযাপন করার মধ্য দিয়ে প্রমানিত হয় যে আমরা মাল্টিকালচারাল মোজাইক এ বিশ্বাসী।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের সিংহভাগ মানুষ মুসলিম একথা উল্লেখ করে তেরেসা আর্মস্ট্রং বলেন, কানাডায় ইসলামোফোবিয়া যে ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটি মোকাবেলা করার জন্য আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, গত বছর অক্টোবর মাসে অন্টারিওতে অক্টোবর মাসকে ইসলামিক হেরিটজ মাস হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। পার্লামেন্টে এই প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন তেরেসা আর্মস্ট্রং।
তেরেসা আর্মস্ট্রং তার বক্তব্য শেষ করার আগে বাংলাদেশের জাতীয় কবী কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুলি-মজুর’ কবিতা থেকে একটি উদ্বৃতি পড়ে শুনান যেখানে বলা আছে ,
“ একজনে দিলে ব্যথা-
সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।
একের অসম্মান
নিখিল মানব-জাতির লজ্জা- সকলের অপমান!”
তিনি বলেন, কাজী নজরুল ইসলাম যদিও বহু বছর আগে এই বার্তাটি দিয়ে গেছেন, কিন্তু সেই বার্তা আজো মানব জাতির জন্য জরুরী। আন্টারিওতে আমরা সেই বার্তাকেই বাস্তবে দেখতে চাই।
পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন কনজারভেটিভ পার্টির এমপিপি রিক নিকলস। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অন্টারিও পার্লামেন্ট ভবনের সামনে পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠান করার উদ্যোগ গ্রহণ করায় বাংলাদেশ সেন্টার এন্ড কমিউনিটি সার্ভিসেসকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বাংলাদেশের গৌরবদীপ্ত লালসবুজ পতাকার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন বাঙ্গালী জাতি তাদের স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য যে আত্মত্যাগ করেছেন তারই চিত্র ফুটে উঠেছে সবুজের মধ্যে লাল চিহ্নিত বৃত্তের মধ্য দিয়ে।
অন্টারিওর আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষা উন্নয়নে বাংলাদেশীদের অবদানের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সমাবেশে উপস্থিত লন্ডন অন্টারির ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট ও ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. অমিত চকমার নাম উল্লেখ করেন। তিনি বলেন অমিত চাকমা এমন একটি ইউনিভার্সিটির ভিসি যেটি কানাডায় সেরা কয়েকটি ইউনিভার্সিটির একটি।
তিনি আরো বলেন, কানাডার মাল্টিকালচারাল সোসাইটিকে সমৃদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশীদের কালচারও অনেক অবদান রাখছে।
সবার শেষে বক্তব্য রাখার জন্য মঞ্চে আহ্বান করা হয় অধ্যাপক ড. আমিত চাকমাকে। তিনি মঞ্চে দাড়িয়ে প্রথমেই অভিনন্দন জানান অন্টারিও পার্লামেন্ট এর স্পীকারসহ অন্যান্য এমপিপিদেরকে বাংলাদেশের এই মহতী দিনে পতাকা উত্তলন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য। তিনি উপস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের অভিনন্দন জানাই কমিউনিটির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে কুইন্স পার্কে বাংলাদেশের সুনাম প্রচার করার জন্য। এরপর তিনি উপস্থিত এমপিপিসহ অন্যান্যদেরকে আহ্বান জানান পতাকা উত্তলনে অংশ নেয়ার জন্য।
পতাকা উত্তলন শেষে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ সেন্টার ও কমিউনিটি সার্ভিসেস এর প্রেসিডেন্ট হাসিনা কাদের।