কানাডায় বাংলাদেশী নারীগণ সুখী : কেউ কেউ শতভাগের চেয়েও বেশী

নিজের সম্মান, আত্মমর্যাদা ও সম্ভ্রম নিয়ে নারীদের বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ সুযোগই রয়েছে কানাডায়

মার্চ ১১, ২০১৭

খুরশিদ আলম : ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয় দিবসটি। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকার  কতটুকু বিদ্যমান?

আমরা জানি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও সমাজে নারী স্বাধীনতা যুগ যুগ ধরেই নিষ্পেষিত, অবদমিত, নিপীড়িত ও নিগৃহীত হয়ে এসেছে। আজো হচ্ছে বহু দেশ ও সমাজে। বিশেষত অনুন্নত, গরীব ও স্বল্পশিক্ষিত দেশ ও সামাজে নারী স্বাধীনতা বেশী মাত্রায় নিপীড়িত হয়। তবে গরীব দেশ হলেই যে নারী স্বাধীনতা পদে পদে লঙ্ঘিত হয় তা কিন্তু নয়। সৌদী আরবের কথাই ধরা যাক। দেশটি গরীব নয়। পেট্রো ডলারের বদৌলতে দেশটি ধনী দেশের কাতারে পৌঁছে গেছে আরো কয়েক দশক আগেই। দেশটির অবকাঠামোর উন্নতিও ঘটেছে অভাবনীয় রকমের। আকাশচুম্বী সব দালানকোঠা। কিন্তু দেশটিতে নারী স্বাধীনতা কতটুকু?

সৌদী আরবে নারীদেরকে এখনো কঠিন পর্দার আড়ালে থাকতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। রাস্তায় গাড়ি চালানোর অনুমতি নেই তাদের। অনুমতি নেই তাদের আরো অনেক কিছুতেই। পদে পদে তাদের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। মানুষ হিসাবে তাদের মূল্যায়ন নেই। নেই সম্মান ও মর্যাদা।

অন্যদিকে স্বল্প শিক্ষিতের দেশ, সমাজ বা সম্প্রদায় হলেই যে নারী স্বাধীনতা পদদলিত হয় তাও কিন্তু নয়। আমরা জানি পৃথিবীতে অনেক অনগ্রসর উপজাতি আছে। আর এই অনগ্রসর উপজাতির কোন কোনটিতে পরিবারে ও সামাজে নারীদের প্রাধাণ্যই বেশী।

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত এরকম একটি সুপার পাওয়ারের দেশে আজ পর্যন্ত একজন নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্টের মুখ দেখা যায়নি। অথচ শিক্ষায়, সম্পদে, আধুনিকতায় তারা বহুদুর এগিয়ে আছে পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায়।

২০১৬ সালের ১লা জুলাই কানাডা ডে-র প্যারেডে অংশ নেয়া হাস্যোজ্জল কয়েকজন বাংলাদেশী নারী। ছবি : কাজী মাওলা

কানাডায় ৭০/৭৫ বছর আগে নারীদের ভোটাধিকারও ছিল না। সম্পত্তিতে পুরুষের ন্যায় নারীদের সমান অধিকার ছিল না শত বছর আগে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় ১৮৮৪ সালে অন্টারিওতে এবং ১৯০০ সালে ম্যানিটোবায় ‘ম্যারিড ওমেন’স প্রপার্টি এ্যাক্ট’ প্রণীত হয় যাতে প্রথমবারের মত বিবাহিত নারীদেরকে পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয় সম্পত্তিতে। পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য প্রভিন্স ও টেরিটরিতে এই আইন বলবৎ করা হয়। কুইবেকে এই আইন প্রণীত হয় ১৯৬৪ সালে।

বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে কানাডায় নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। ফেডারেল বা প্রভিন্সিয়াল কোন পর্যায়েই তাদের ভোট দেয়ার অধিকার ছিল না। ১৯১৬ সালে প্রথম ম্যানিটোবা, সাস্কাচুয়ান এবং আলবার্টা প্রভিন্সে নারীরা ভোট দেয়ার অধিকার পান। ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং অন্টারিওতে নারীগণ ভোটাধিকার পান ১৯১৭ সালে। কুইবেকে এই অধিকার পেতে নারীদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত।

শিক্ষায়, সম্পদে এবং আধুনিকতায় এই দেশটিও এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতই। কিন্তু এখানে এখনো একজন নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী দেখা যায়নি আজ পর্যন্ত। একবার একজন নারী প্রধানমন্ত্রীর মুখ দেখা গিয়েছিল কানাডায়। কিন্তু সেটি ছিল মাত্র ৪ মাসের জন্য এবং সরাসরি জনগনের ভোটে নির্বাচিত ছিলেন না তিনি। তার নাম কিম ক্যাম্পবেল।

১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্রায়ান মালরুনী অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি ঐ ঘোষণা দেওয়ার পর প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভ পার্টির লীডারশীপ দৌড়ে তখন অংশ নিয়েছিলেন কিম ক্যাম্পবেল এবং তিনি জয়ী হন। এর পর তৎকালীন গভর্নর জেনারেল তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ১৯৯৩ সালের ২৫ জুন থেকে ঐ একই বছরের ৪ নভেম্বর পর্যন্ত।

আর বাংলাদেশে? তাত্ত্বিক অর্থে বা প্রশাসনিক দৃষ্টিকোন থেকে বলা যায় বর্তমান বাংলাদেশে নারীগণ পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা বেশী স্বাধীনতা ভোগ করছেন। কারণ, দেশটির প্রধানমন্ত্রী একজন নারী যার নাম শেখ হাসিনা। তিনি ক্ষমতাসীন দলেরও প্রধান। প্রধান বিরোধী দলের দলীয় প্রধানও একজন নারী যার নাম বেগম খালেদা জিয়া। তিনিও একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সংসদের যে স্পীকার তিনিও একজন নারী যার নাম শিরীন শারমিন চৌধুরী। সংসদে যিনি বর্তমান বিরোধীদলীয় প্রধান তিনিও একজন নারী যার নাম রওশন এরশাদ। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সরকারের স্বররাষ্ট্র মন্ত্রীও ছিলেন একজন নারী যার নাম শাহারা খাতুন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন একজন নারী যার নাম দীপু মনি।

বাংলাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই পদগুলোতে নারীদের এরকম জোরালো উপস্থিতি পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। কিন্তু তারপরও দেখা যায় বাংলাদেশে নারী স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই বিঘিœত হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত ও ধনী পরিবারেও নারীদের বাক্ স্বাধীনতা নেই। দরিদ্র ও অশিক্ষিত পরিবারে নারী স্বাধীনতার পরিস্থিতি আরো শোচনীয়। অনেক পরিবারে পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই নারীদের।

শহরের গুটি কতক চাকরীজীবী নারী ছাড়া গোটা বাংলাদেশের নারীদের কোন আর্থিক স্বাধীনতা নেই। আর্থিক স্বাধীনতা না থাকলে অন্য কোন স্বাধীনতাই সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা নয়।

বাংলাদেশের নারীরা একা চলাফেরা করতে পারেন না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। নিরাপত্তার বিষয়টি ছাড়াও এখানে রয়েছে পরিবারেরও কিছু বিধিনিষেধ। নারীদের জোর করে বিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি এখনো বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে। অথবা জোর করে নারীদের বিয়ে করার সংস্কৃতিও চালু আছে যদি পাত্র পক্ষ রাজনৈতিকভাবে অথবা আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান হন। ধর্ষিতা নারীগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুবিচার পান না যদি তারা আর্থিকভাবে দুর্বল হন।

তবে এক কথা সত্যি যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা পরিস্থিতির উন্নতি ঘঠেছে অনেকটাই বিগত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে। সেটা পশ্চাদপদ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি অগ্রসর সমাজব্যবস্থার দেশ কানাডার ক্ষেত্রেও। আর কানাডায় নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিতভাবেই বেশী বাংলাদেশের তুলনায়। কানাডা প্রবাসী জনপ্রিয় বাংলাদেশী লেখিকা ভিকারুন নিসা তার একটি লেখায় একবার কৌতুক করে লিখেছিলেন, “কানাডায় যখন প্রথম এলাম, খোকন ভাবি আমাকে বলেছিলেন, শোন এই দেশে সবচেয়ে মূল্যবান কারা জান? শিশুরা হলো সবচেয়ে মূল্যবান, তারপর দ্বিতীয় হলো নারীরা। তারপর দামি হলো কুকুর। আর সবশেষে হলো পুরুষ মানুষ।”

আমরা জানি কানাডায় নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা সাংবিধানিকভাবে গ্যারান্টিড। বাংলাদেশে যেমন নারীদেরকে অবমাননা করা, নির্যাতন করা অপেক্ষাকৃত সহজ এখানে সেরকমভাবে সহজ নয়। তাছাড়া কানাডায় বাংলাদেশ থেকে যে সকল পরিবার আসেন তাদের বেশীরভাগই উচ্চ শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার লোক। সে কারণেও বাংলাদেশী কমিউনিটিতে নারী নির্যাতনের হার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম।

টরন্টোর একজন স্বনামধণ্য বাংলাদেশী-কানাডিয়ান ব্যারিস্টার একবার এই প্রতিবেদককে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ড্যানফোর্থের বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকা থেকে প্রতি দুইদিনে একজন বাংলাদেশী কানাডিয়ান পুরুষকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। কারণটা কি? জানতে চাইলে ব্যারিস্টার ভদ্রলোক বলেন,পারিবারিক সহিংসতা। অর্থাৎ স্বামী তার স্ত্রীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন বা হত্যার হুমকী দেন। কিংবা মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। অনেকসময় শিশুদের উপর নির্যাতন করার অভিযোগেও কেউ কেউ গ্রেফতার হন।

ভিকারুন নিসার লেখা থেকে এখানে আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। এটি কৌতুক নয়। উদ্ধৃতিটি এরকম “এরপর যা শুনলাম তা অতি ভয়াবহ। কানাডার মাটিতেও কী সম্ভব? প্রায় প্রতিদিনই ওনার স্বামী ওনাকে মারেন। রান্না খারাপ হলে, কোনো কিছু দিতে দেরি হলে, কারণে অকারণে তার গায়ে হাত তোলেন বুয়েট থেকে পাস করা তার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী। আজ সকালে বেবি সিটিংয়ের কিছু টাকা বাংলাদেশে মাকে পাঠাতে চাইলে তার স্বামী রেগে যান। ভাবিও একটু রাগ দেখালে তার স্বামী গায়ে হাত তুলেছেন। গালিগালাজ কিছুই বাদ দেননি। শেষমেশ ছুরি নিয়ে তার দিকে তেড়ে আসেন। তুলি ভাবি কোনোরকমে দরজা খুলে পালিয়েছেন।”

সেই মহিলা ঐ দিন সন্ধ্যায়ই আবার তার অত্যাচারী স্বামী কাছে ফিরে যান। কারণ? লেখিকার বর্ণনায়, “তিনি উঠে এলেন আমার কাছে। বললেন, ভাবি আমার তিনটা ছোট বাচ্চা আছে। ওদের জন্য এ সংসার টিকিয়ে রাখতে চাই। তার চোখেমুখে আকুতি।”

নারী স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের দেশ কানাডায় বাঙ্গালী নারীদের এ এক অন্ধকার দিক। আমরা দেখেছি গত প্রায় ১৬/১৭ বছরে এই টরন্টোতে চারজন বাঙ্গালী নারী স্বামী কর্তৃক নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন। এর বাইরেও কোন ঘটনা থাকতে পারে যা আমাদের জানা নেই। ভেঙ্গুভার, মন্ট্রিয়ল বা অটোয়ার বাঙ্গালী কমিউনিটির সব খবর আমাদের কাছে সঠিকভাবে আসে না।

অন্যদিকে কানাডায় সার্বিকভাবে নারী নির্যাতনের বিষয়টি এরকম : “এখানে প্রতিদিন গড়ে ২৩০ জন ব্যক্তি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। এটি পুলিশের খাতায় নথিবদ্ধ করা হিসাব। এর বাইরেও আরো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কানাডার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডক্টর গ্রেগরী টেইলর সম্প্রতি এ তথ্য জানান। কানাডার পাবলিক হেলথ এর উপর পরিচালিত জরীপ থেকে এই তথ্য জানা যায়। প্রধানত শারীরিক নির্যাতন,

যৌন নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ে জানার জন্য এই জরীপ চালানো হয়।  খবর সিবিসি নিউজের।”

এই রিপোর্টটি গত বছর ডিসেম্বও মাসে প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে আরো জানানো হয় যে, “কানাডায় প্রতি চার দিনে একজন করে মহিলা খুন হচ্ছেন পরিবারেরই কোন সদস্যের হাতে।”

এবারে আসা যাক প্রবাসে ইমিগ্রেন্ট নারী বিশেষ করে বাঙ্গালী নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা উপভোগের বিষয়ে। কতিপয় ঘটনা ও দুর্ঘটনার কথা বাদ দিলে এ দেশে বাংলাদেশের নারীরা বাংলাদেশের তুলনায় সামাজিক ও পারিবারিকভাবে অনেক বেশী অধিকার ও স্বাধীনতা উপভোগ করছেন। আর এ কথা স্বীকারও করেছেন প্রবাসী কণ্ঠের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এখানকার কয়েকজন বাংলাদেশী নারী।

কানাডার সংবিধানেও নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আছে পরিস্কারভাবে। এটি শুধু কাগজে কলমেই নয়, বাস্তব অর্থেই তা নিশ্চিত করা আছে। কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস এ্যাক্ট এবং কানাডিয়ান চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম এর শর্ত অনুযায়ী নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত করা হয়েছে। তাদের বয়স, বৈবাহিক অবস্থা, সম্পত্তির অধিকার, ভোট দেবার অধিকার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকারসহ আরো অনেক অধিকারই নিশ্চিত করা আছে কানাডীয় আইনে। নারীদের প্রতি কোন রকম বৈষম্য করা যাবে না। পুরুষের যেমন অধিকার নারীরও তেমন অধিকার রয়েছে এই দেশে। অর্থাৎ উভয়েরই সমান অধিকার। এবং তা বাস্তব অর্থেই।

আর এ কারণে অনুন্নত ও পশ্চাদপদ দেশ যেখানে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতার যথাযথ স্বীকৃতি নেই, বঞ্চনা আর বৈষম্য যেখানে নারীর নিত্যদিনের সঙ্গী, সে সব দেশ থেকে কানাডায় এসে ইমিগ্রেন্ট মহিলাগণ প্রথমেই একটা বড় রকমের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে আসা সারভিন আসতারী নামের একজন মহিলা এ ব্যাপারে তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে কানাডাইমিগ্রেন্ট.সিএ পত্রিকায় এক লেখায় বলেন, “কানাডায় আসার পর মনে হলো যেন বুকের উপর থেকে বিশাল একটা পাহাড় সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আমি এখন নির্বিঘেœ নিঃশ্বাস নিতে পারছি। আমাকে এখন থেকে আর পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে না, আমি মুক্ত, আমি কি পছন্দ করবো আর অপছন্দ করবো সেটি অন্য কেউ আমার উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। আমাকে আর সার্বক্ষণিক নরজদারীর মধ্যেও থাকতে হবে না।”

অনুন্নত ও পশ্চাদপদ দেশে নারীদের অধিকার ও স্বাধীনতা যে শুধু পুরুষরাই নিয়ন্ত্রণ বা হরণ করেন তা কিন্তু নয়। দেখা গেছে বাড়ির বয়স্ক মহিলারা যারা হয়তো একসময় নিজেরাও নির্যাতিত হয়েছেন তাদেরও কেউ কেউ এ কাজে পুরুষদের পক্ষ নেন! সারভিন আসতারী এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে এই বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কখনো কখনো আমরা মহিলারাই মহিলাদের বড় শত্রু হয়ে দাড়াই।

বাংলাদেশ থেকে যে সকল মহিলা কানাডায় এসেছেন তাদেরও কারো করো এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে সন্দেহ নেই। এমনকি এই কানাডায় আসার পর এখানেও কোন কোন নারীকে শ্বাশুরী ননদের অত্যাচার সইতে হয়েছে এমন নজীর রয়েছে।

তবে সন্দেহ নেই, এই রকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন খুব কম মহিলাকেই হতে হয়েছে কানাডায়। কারণ, এখানকার আইন এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতি এমন নয় যে কেউ ক্রমাগত অত্যাচারিত হয়ে যাবেন আর কোন প্রতিবাদ করতে পারবেন না।

নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকার, নারী নির্যাতন ও নারী নিরাপত্তার বিষয়গুলো যুগ যুগ ধরেই একটি ইস্যু হয়ে আছে আমাদের বর্তমান ও অতীত সামাজে। সুদূর অতীতেও এটি যেমন একটি ইস্যু ছিল, আজকের এই আধুনিক এমনকি অতি আধুনিক সমাজব্যবস্থায়ও এটি এখনো ইস্যু হয়েই রয়েছে। তবে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অতীতের তুলনায় বর্তমান কালে নারীর অধিকার ও অবস্থা বহুগুনে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও স্বীকার করতেই হবে যে, কিছু কিছু রক্ষণশীল দেশ ও সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা আজো অধিকারবঞ্চিত। সৌদী আরবের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এরকম আরো বেশ কয়েকটি দেশ আছে যেখানে নারী অধিকার ও নারী স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। এই তালিকায় আছে আফ্রিকার অনেক দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ারও অনেক দেশ।

বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়। তবে এই দেশটির অবস্থা সৌদী আরব বা ঐ পর্যায়ের কোন দেশের মত নয়। বাংলাদেশের নারীদের অধিকার অনেকটাই সুরক্ষিত এখন আগের তুলনায়। নির্যাতিত হলে যে কোন নারীই এখন ‘নারী নির্যাতন আইন’ এর আশ্রয় নিতে পারেন। কঠিন সে আইন। তবে এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে এমন অভিযোগও রয়েছে দেশটিতে।

তবে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি বাংলাদেশে এখনো পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠতে পারেনি। শহরের কথা বাদ দিলে দেশটির গোটা গ্রামাঞ্চলেই পরিবারের কোন বিষয়ে মহিলারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন না। বা মত প্রকাশ করলেও সেটাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও নেই। স্বাধীনতা নেই পোষাক নির্বাচনে। স্বাধীনতা নেই একা চলাফেরার। এখানে অবশ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত। আর এই নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরী করেছে কারা? পুরুষশাসিত সমাজের পুরুষরাই! এই অবস্থা যে শুধুু গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যমান তা কিন্তু নয়। শহরেও অনেক মহিলা আছেন যাদের অবস্থা কমবেশী ঐ গ্রামের মহিলাদের মতই।

এরকম একটি দেশ থেকে যে কজন মহিলা কানাডায় এসেছেন তারা এখানে কতটা নারী অধিকার ও নারী স্বাধীনতা ভোগ করছেন? পাশাপাশি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পোষাকের স্বাধীনতা, পরিবারের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়ে কতটা সুবিধা ভোগ করছেন তারা? কানাডার সামাজ ব্যবস্থায় বাস করার সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশের তুলনায় তারা কতটা সুখী? বিষয়টি জানার জন্য প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশী নারীকে। তারা সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন কানাডায় তারা শতভাগ স্বাধীনতা ভোগ করছেন। তাদের অধিকার এখানে শতভাগ সুরক্ষিত। তারা এখানে অনেক সুখে আছেন। সুখের মাত্রা কারো কারো ক্ষেত্রে শতভাগের চেয়েও বেশী।

যেমন কানাডা অপসরা ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাবরিন সুলতানা (মলি) বলেন, বাংলাদেশের তুলনায় কানাডায় বাংলাদেশী মহিলারা আমার মতে প্রায় সবাই সুখী। আর আমার ক্ষেত্রে আমি বলবো, কানাডায় আমি শতভাগের চেয়েও বেশী সুখী। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমার কাছে মনে হয় আমি কানাডায় একজন নারী হিসাবে শতভাগ স্বাধীন। পারিবারিক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায়ও কানাডায় আমি শতভাগ স্বাধীনতাই ভোগ করি।

এ বিষয়ে টরন্টোর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে একজন সুপরিচিত ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী উর্মী বলেন, কানাডায় পারিবারিক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের বেলায় আমিও পুরাপুরি স্বাধীনতাই ভোগ করছি। আমার স্বামী পরিবারের সব ব্যাপারেই আমার সঙ্গে পরামর্শ করেন। আমার মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকেন আমার স্বামী। তিনি আরো বলেন, প্রবাসে আমরা যারা চাকরী করি তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকে পুরাপুরিভাবেই। অর্থাৎ আমাদের আয় আমরা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করতে পারি। আমাদের নিজস্ব ব্যাংক একাউন্ট থাকে। বাংলাদেশের নারীদের অনেকেরই সেটা থাকে না। আমি সত্যিকার অর্থে এখানে অনেক ভাল আছি। এখানে নিজের মত করে চলতে পারি। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।

টরন্টো প্রবাসী আরেক বাংলাদেশী মহিলা মাহমুদা নাসরিন বলেন, আমি আসলে স্বাধীনতা বাংলাদেশে এবং কানাডা উভয় দেশেই পেয়েছি। এটি আমার সৌভাগ্য। এর জন্য আমি আমার মা-বাবা এবং আমার স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞ। মাহমুদা নাসরিন দেশে অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি আরো বলেন, পারিবারিক যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় বাংলাদেশ ও কানাডায় সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছি। কানাডায় মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশী স্বাধীনতা আছে যা আমরা উপভোগ করছি। আর নিজেকে আমি সুখী বা ভাগ্যবতী সবসময়ই মনে করি – কানাডা, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সৌদী আরব যেখানেই থেকেছি সবখানেই, সবসময়ই।

বিউটিশিয়ান শাহানা খান দুলন বলেন, সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে কানাডায় সুযোগ সুবিধা কম নেই। তাই এখানে নিজেকে সুখী বা ভাগ্যবান মনে না করার কোন কারণ আমি খুঁজে পাই না। আমি কানাডায় নিজেকে অনেক নিরাপদ বলে মনে করি। দোলন আরো বলেন, মেয়েদের ধর্মীয় স্বাধীনতা কানাডাতে বেশী বলে আমি মনে করি। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মসজিদ বা কবরস্থানে এখানে অবাধে যাতায়ত করা যায়।

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাচিঁতে চায় হে

স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের জীবন অর্থহীন। সুখও আসে না যদি স্বাধীনতা না থাকে। আবার নিরাপত্তা না থাকলে স্বাধীনতা সুখ এগুলোও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। প্রবাসে সেই স্বাধীনতা, সুখ আর নিরাপত্তা সবই পাচ্ছেন বাংলাদেশী নারীরা।

তবে প্রশ্ন আছে। সবাই কি তা পাচ্ছেন? এ প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবেই ‘না’। উপরে ভিকারুন নিসার লেখা থেকে যে উদ্ধিৃতিটি দেয়া হয়েছে সেখানে স্পষ্টই দেখা গেছে একজন মহিলার করুন হাল। এরকম চিত্র প্রবাসী বাঙ্গালী পরিবারগুলোতে বিরল নয়। স্বামী কর্তৃক অত্যাচারিত বা নিগৃহীত হয়ে ৯১১ এ কল করার ঘটনা প্রবাসে ঘটছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ড্যানফোর্থের বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকা থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় পনেরজন পুরুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। গত প্রায় ১৬/১৭ বছরে টরন্টোতে আমাদের জানামতে চারজন বাঙ্গালী মহিলা খুন হয়েছেন স্বামী কর্তৃক।

শারীরিক নির্যাতন ছাড়াও আছে মানসিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের বিষয়গুলো সাধারণত প্রকাশ পায় না। তবে এই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন যে কেবল পুরুষরাই করে থাকে তা-ও কিন্তু নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষরাও নির্যাতনের শিকার হন। টরন্টো প্রবাসী বাঙ্গালী ডাক্তার আবু আরিফ ইতিপূর্বে প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন নির্যাতনের শিকার পুরুষও তার কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন। তবে এদের সংখ্যা খুব কম। আর এরা সাধারণত নির্যাতনের কথা স্বীকার করতে চান না।

কিন্তু তারপরও বলা যায় কানাডায় প্রবাসী বাঙ্গালী মহিলাগণ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশী মাত্রায় স্বাধীনতা, সুখ ও নিরাপত্তা উপভোগ করছেন। যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাদের সংখ্যাও বাংলাদেশের তুলনায় বহুগুনে কম। আর কেউ যদি নির্যাতনের শিকার হনও তবে তিনি আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন খুব সহজেই। সরকারের শেল্টারও পাচ্ছেন প্রয়োজনে।

বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার কথা বাদ দিলে নিজের সম্মান,আত্মমর্যাদা ও সম্ভ্রম নিয়ে নারীদের বেচে থাকার পরিপূর্ণ সুযোগই রয়েছে কানাডায়। সেই সাথে আছে স্বাধীনতা, সুখ ও নিরাপত্তা।

মাহমুদা নাসরিন

কানাডায় নিজেকে অনেক নিরাপদ মনে হয় : মাহমুদা নাসরিন

বাংলাদেশের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও সৌদী আরবের কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপিকা মাহমুদা নাসরিন প্রবাসী কণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশে আমি আল্লাহর রহমতে কোন ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধের সম্মুখীন হইনি। তবে কানাডায় রাত-বিরাতে সম্পূর্ণ নিরাপদে, নির্ভয়ে চলাচলের যে সুযোগ পাচ্ছি তা অতুলনীয়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী নির্যাতন এ দেশে নেই বললেই চলে।

আমি আসলে স্বাধীনতা বাংলাদেশে এবং কানাডা উভয় দেশেই পেয়েছি। এটি আমার সৌভাগ্য। এর জন্য আমি আমার মা-বাবা এবং আমার স্বামীর কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশে আমাদের পরিবারের কাউকে

হিজাব বা বোরখা পরতে বাধ্য করা হয়নি কখনো। কানাডায় ইমিগ্রেশন নিয়ে আসার আগে আমরা সৌদী আরবে ছিলাম চাকরীর সুবাদে। সেখানে হিজাব বাধ্যতামূলক ছিল তাই পরতে হয়েছে। কিন্তু কানাডায় আসার পর সেই বাধ্যবাধকতা আর নেই। আমার মেয়েও এখানে হিজাব পরে না। কিন্তু ধর্মকর্ম সবই করি আমরা। হিজাব না পরলেও পোশাকে সবসময় শালীনতা বজায় রাখি। অর্থাৎ কানাডায় পোষাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা উপভোগ করছি যেটা বাংলাদেশেও ছিল। কিন্তু সৌদী আরবে ছিল না।

মাহমুদা নাসরীনের স্বামী টরন্টোর সুপরিচিত রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী সৈয়দ আমিনুল ইসলাম (মুকুল)। মাহমুদা বলেন, কানাডায় দৈনন্দিন কাজে আমার স্বামী আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে থাকেন।

তিনি আরো বলেন, পারিবারিক যে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় বাংলাদেশ ও কানাডায় সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পেরেছি। কানাডায় মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশী স্বাধীনতা আছে যা আমরা উপভোগ করছি।

নিজেকে সুখী বা ভাগ্যবতী আমি সবসময়ই মনে করি – কানাডা, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সৌদী আরব যেখানেই থেকেছি সবখানেই, সবসময়ই। কিন্তু কানাডায় নিজেকে অনেক নিরাপদ মনে হয়, সন্তানদের অত্যন্ত উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পাই।

নাফিয়া নজরুল

কানাডায় আমি শতভাগ স্বাধীনতা ভোগ করছি : নাফিয়া নজরুল (উর্মী)

টরন্টো প্রবাসী জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী ও নাফিয়া’স কালেকশনের সত্বাধিকারী নাফিয়া নজরুল (উর্মী) প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশে বাব-মা’র শাসনে বড় হয়েছি। ওখানে ধর্মীয় বিধিনিষেধ একটু বেশী ছিল যেটা এখানে হয়তো নেই।  এখানে যথেষ্ট ফ্রিডম আছে। এই যে রাতে কাজ করে বাসায় ফিরছি, বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করে বাড়ি ফিরছি তাতে কোন সমস্যা হচ্ছেনা। সবকিছু এখানে সুরক্ষিত।

নাফিয়ার স্বামী আবুল বাসার একজন কৃষি বিজ্ঞানী। তিনি প্রবাসী কৃষি বিজ্ঞানীদের সংগঠন আবাকন এর সাধারণ সম্পাদক।

নাফিয়া নজরুল বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আইনশৃংলা পরিস্থিতির

তুলনায় কানাডায় নিজেকে অনেক বেশী নিরাপদ মনে হয়। বাংলাদেশে যেমন পহেলা বৈশাখ বা অন্যান্য যে সকল অনুষ্ঠান হয় সেখানে নারীরা নিজেদেরকে তেমন নিরাপদ মনে করতে পারেননা। কিন্তু এখানে এই কানাডায় আমরা সেরকম নিরাপত্তাহীনতার কথা চিন্তাও করতে পারি না। এখানে একা চলাফেরা করলেও কোন ভীতি কাজ করে না।

কানাডায় পারিবারিক বিধিনিষেধের বেলায়ও আমি শতভাগ স্বাধীন যেটা বাংলাদেশে অনেক নারীরা হয়তো কল্পনাও করতে পারেন না। তাছাড়া বাংলাদেশে যে পুরুষ শাসিত সমাজ সেটা এখানে একেবারেই চোখে পড়ে না।

নাফিয়া নজরুলের কাছে আরো জানতে চাওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশে কোন কোন পরিবারে নারীদেরকে বোরখা বা হিজাব পরার ব্যাপারে বাধ্য করা হয় বা একটা চাপের মধ্যে রাখা হয়। একই প্রবণতা কানাডায়ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছু কিছু পরিবারে। এ বিষয়ে তার অভিমত কি?

উত্তরে তিনি বলেন, আমি মনে করি এটি পুরাপুরি ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপার। কাউকে জোর করে হিজাব বা বোরখা পরাতে গেলে ব্যাড ইম্পেক্ট পড়তে পারে। আবার এমনো দেখা গেছে যে কেউ কেউ হিজাব পরার পর এমনসব মেকআপ এবং টাইট ফিটিং পোষাক পরছেন যা আসলে শোভনতার মাত্রাকে ছাড়িয়ে যায়। আমি মনে করি শালীনতা বজায় রেখে পোষাক পরলেই হয়। আমি নিজে পোষাক নির্বাচনের ব্যাপারে পুরাপুরিই স্বাধীন। তবে আমি সবসময়ই মার্জিত পোষাক পরে থাকি। শাড়িটাই আমার বেশী পছন্দ।

নাফিয়া নজরুল বলেন, কানাডায় পারিবারিক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায়ও আমি পুরাপুরি স্বাধীনতাই ভোগ করছি। আমার স্বামী পরিবারের সব ব্যাপারেই আমার সঙ্গে পরামর্শ করেন। আমার মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকেন আমার স্বামী।

ঘরের কাজেও আমার স্বামী আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। ঠিক দায়ে পড়ে করেন তা নয়। নিজের উৎসাহেই বা দায়িত্ববোধ থেকেই করেন। আর কোন কাজ আমার জন্য ফেলে রাখেন না। আমি যদি ব্যস্ততার কারণে করতে না পারি তবে উনিই করেন।

নারীর ক্ষমতায়ণ বলতে অর্থনৈতিক ক্ষমতার কথা বলেন কেউ কেউ। আর আর্থিক ক্ষমতা না থাকলে আসলে কোন স্বাধীনতাই স্বাধীনতা নয়। এ বিষয়ে নাফিয়া নজরুলের অভিমত কি তা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে দেখা গেছে একজন নারীকে চাকরী করার পরও সংসারে তাকে অনেক কাজ করতে হয়। আর চাকরী করার পরও আর্থিক স্বাধীনতা যেটা থাকা উচিৎ সেটা সেরকম ভাবে আসলে থাকে না অনেকের বেলায়। কিন্তু এই প্রবাসে আমরা যারা চাকরী করি তাদের স্বাধীনতা থাকে পুরাপুরিভাবেই। অর্থাৎ আমাদের আয় আমরা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করতে পারি। আমাদের নিজস্ব ব্যাংক একাউন্ট থাকে। বাংলাদেশের নারীদের অনেকেরই সেটা থাকে না।

নাফিয়া নজরুলের কাছে সবশেষ প্রশ্ন ছিল, কানাডায় আপনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ অন্যান্য আরো অনেক বিষয়ে স্বাধীনতা পাচ্ছেন, দৈনন্দিন জীবনে নিরাপত্তাও অনুভব করছেন অনেক এবং বলতে গেলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজের মত করে চলার সুযোগ পাচ্ছেন। এই জন্য কানাডায় নিজেকে কতটা সুখী বলে মনে হয় আপনার কাছে?

উত্তরে তিনি বলেন, আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এক সেন্সে যে আমি একটি ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে আছি। আমি সত্যিকার অর্থে এখানে অনেক ভাল আছি। এখানে নিজের মত করে চলতে পারি। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তবে এই প্রবাসে একটা বিষয় আমাকে মাঝে মধ্যে একটু মন খারাপ করে দেয়। সেটা হলো, আমি নিজে একজন সঙ্গীত শিল্পী। কিন্তু আমার সেই শিল্পী সত্তা বিকাশের সুযোগ এখানে নেই। দেশে থাকলে হয়তো সেই সুযোগটা পেতাম। কারণ শিল্পী সত্তা বিকাশের জন্য চাই মূলধারার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা।

সাবরিন সুলতানা (মলি)

কানাডায় আমি শতভাগের চেয়েও বেশী সুখী : সাবরিন সুলতানা (মলি)

অপ্সরা উইমেন্স ক্লাব অব টরন্টো’র সাধারণ সম্পাদক সাবরিন সুলতানা (মলি) প্রবাসী কণ্ঠ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমার কাছে মনে হয় আমি কানাডায় একজন নারী হিসাবে শতভাগ স্বাধীন।

টরন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটিতে সুপরিচিত রিয়েল এস্টট ব্যবাসী রবীন ইসলামের স্ত্রী সাবরিন সুলতানা আরো বলেন, আমার স্বামী আমার কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন না। তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন অত্যন্ত ভাল মানুষ। বাংলাদেশে থাকা অবস্থায়ও আমার কোন সমস্যা হয়নি স্বাধীনতা ভোগ করার ক্ষেত্রে। এমনকি যৌথ পরিবারে বাস করেও। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন খুব উদারমনা।

ফলে দেশে আমার চলাফেরা, পোষাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি সব বিষয়েই স্বাধীনতা ছিল। সাবরিন সুলতানা বলেন, তবে

নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সমস্যা ছিল। ঘর থেকে বের হলে কোন মহিলা নিরাপদে ফিরে আসবে কি না তার কোন গ্যারান্টি নেই। কানাডায় আমরা মেয়েরা দলবেধে মাঝ রাতেও বের হয়ে গেলেও নিরাপত্তাহীনতা ভুগি না। বাংলাদেশের তুলনায় এখানে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা অনুভব করি। কারণ, এখানে বিরক্ত করার কেউ নেই। বাংলাদেশে তো সন্ধ্যা নামলেই ঘর থেকে বের হওয়ার ব্যাপারে নিরাপদ বোধ করে না কোন মহিলা।

বাংলাদেশে কোন কোন পরিবারে মেয়েদেরকে হিজাব বা বোরখা পরতে বাধ্য করা হয়। এই কানাডায়ও এরকম প্রবণতা দেখা যায় কোন কোন পরিবারে। অথচ ইসলামী বিশেজ্ঞদের অনেকেরই অভিমত নিকাবসহ বোরখা আসলে ইসলামী পোষাক নয়। আপনি কি মনে করেন এই বোরাখা পরতে বাধ্য করাটা নারী

স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ? এই প্রশ্নের জবাবে সাবরিন সুলতানা বলেন, যারা হিজাব বা নিকাবসহ বোরখা পরেন

তাদেরকে আমি রেসপেক্ট করি। এটা যার যার স্বাধীনতার ব্যাপার। কিন্তু চাপিয়ে দেয়ার পক্ষে নই আমি। ইসলাম ধর্মের কোথাও নেই যে কোন মহিলাকে নিকাব পরতেই হবে। আর পোষক তো আসলে বাইরের ব্যাপার। এখানে আসলে দেখতে হবে একটা মানুষের ভিতরের শুদ্ধতা কতটুকু। আমি নামাজ পড়লাম কিন্তু জায়নামাজে বসে বসে অন্যের ক্ষতির কথা চিন্তা করলাম- এটাতো হতে পারে না। আমার দৃষ্টিতে ঐ নামাজের কোন মূল্য নেই।

সাবরিন সুলতানা বলেন, পারিবারিক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় কানাডায় আমি শতভাগ স্বাধীনতাই ভোগ করি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতের গড়মিল তো হতেই পারে। এটা একেবারেই স্বাভাবিক। কিন্তু সার্বিকভাবে আমাদের দুজনের মতামতটা খুব কাছাকাছি হয়ে যায়। তবে আমি যদি কোন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তবে সে ক্ষেত্রে আমার স্বামীর অবশ্যই অধিকার আছে হস্তক্ষেপ করার। এবং এ অধিকার আমারও আছে যদি আমার স্বামী কোন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা আমার উপর চাপিয়ে দিতে চান।

কানাডায় সংসার জীবনে যে সকল পারিবারিক দায়িত্ব পালনের কথা তার পুরোটাই করেন আমার স্বামী। আমার এবং আমাদের ছেলে-মেয়েদের টেক-কেয়ারে কোন ঘাটতি রাখেন না তিনি। বরং আমিই কিছুটা পিছিয়ে আছি তার তুলনায়।

সাবরিন সুলতানা বলেন, কানাডায় মত প্রকাশের বেলায় আমি শতভাগ স্বাধীনতাই ভোগ করি। তবে আমি দেখেছি এখানে কিছু কিছু পরিবার আছে যেখানে মহিলাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। অবশ্য এইরকম পরিবারের সংখ্যা খুবই কম। বলা যায় ৫%।

বাংলাদেশের তুলনায় কানাডায় বাংলাদেশী মহিলারা আমার মতে প্রায় সবাই সুখী। তবে সুখী হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে আপনার নিজের কাছে। জোর করে তো কাউকে সুখী করা যায় না। আর আমার ক্ষেত্রে আমি বলবো, কানাডায় আমি শতভাগের চেয়েও বেশী সুখী।

শাহানা খান দুলন

নিজেকে সুখী মনে না করার কোন কারণ খুঁজে পাই না : শাহানা খান দুলন

টরন্টোর মেহরোজ বিউটি পার্লারের সত্বাধিকারী বিউটিশিয়ান শাহানা খান দুলন বলেন, কানাডাতে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষা, বর্ণ ও ধর্মের লোকদের বসবাস। সামাজিক অবস্থানও ভিন্ন।

তবে মেয়েদের ধর্মীয় স্বাধীনতা কানাডাতে বেশী বলে আমি মনে করি। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মসজিদ বা কবরস্থানে এখানে অবাধে যাতায়ত করা যায়।

টরন্টোর অক্সফোর্ড কলেজ অব আর্টস, বিজনেস এন্ড টেকনলজীর শিক্ষক ফিরোজ আনজুম এর স্ত্রী শাহানা খান আরো বলেন, কানাডা উন্নত বিশ্বের একটি দেশ। আইন শৃংখলা অবশ্যই উন্নত। অপরাধ যে এখানে হয় না তা আমি বলছি না। তবে অপরাধী বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে এবং তাকে বিচারের সম্মুখীন

হতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে অপরাধী অপরাধ করে পার পেয়ে যাবার সুযোগ পায়। অবশ্যই আমি কানাডাতে নিজেকে অনেক নিরাপদ বলে মনে করি। বাংলাদেশে হয়তো খুব অল্প সংখ্যক পরিবারে হিজাব বা নিকাব পরতে বাধ্য করা হয়। তবে আমাদের পরিবারে এই ধরণের চাপ কোন সময় ছিল না। ব্যক্তি স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা আমার একেবারেই পছন্দ নয় সেটা কানাডায় বা বাংলাদেশে যেখানেই হোক না কেন। পোষাকের স্বাধীনতা বাংলাদেশে যে একেবারেই নেই বলাটা মনে হয় সঠিক নয়। এটা নির্ভর করে কোন পরিবেশে আমরা গড়ে উঠেছি। ধর্ম, সমাজ, পরিবার এবং পরিবেশ সবকিছু উপেক্ষা করে অমরা যদি কোন পোষাক বেছে নেই এটাতো স্বাধীনতা নয়। কানাডায় পোষাকের স্বাধীনতা থাকলেও আমাদের কমিউনিটির বেশীর ভাগ মহিলাই মার্জিত পোষাক পরে থাকেন।

পৃথিবীতে খুব কম দেশ আছে যেখানে রাষ্ট্র জনগনের মৌলিক চাহিদা (যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা) পূরণ করতে সক্ষম হয়। কানাডা এই মৌলিক চাহিদা পূরণে করে থাকে। ফলে সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে কানাডায় সুযোগ সুবিধা কম নেই। তাই এখানে নিজেকে সুখী বা ভাগ্যবান মনে না করার কোন কারণ আমি খুঁজে পাই না।

প্রচ্ছদে এবং সাক্ষাৎকারের সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলো মাহমুদা নাসরিন, নাফিয়া নজরুল, শাহানা খান ও সাবরিন সুলতানার ফেসবুক থেকে নেয়া।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে সহযোগিতা করেছেন রুহুল চৌধুরী লিবু